অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৩০||

0
1182

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩০||

৪৯.
দুই সপ্তাহ পর শতাব্দীর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হবে। কিন্তু তার মনোযোগ একটুও পড়াশুনায় নেই। সে তাহমিদের ভাবনায় ডুবে আছে। সকালে নাস্তা করেই সে তাহমিদকে দেখতে চলে গেলো। বাসায় ইমনই তাহমিদের সাথে ছিলো। শতাব্দীকে দেখে সে বলল,
“শতাব্দী, তুমি কি কয়েক ঘন্টা বাসায় থাকতে পারবে? আমি একটা কাজে বের হবো। এরপর অরুণিকাকেও স্কুল থেকে আনতে যাবো। আমি না আসা পর্যন্ত থাকবে?”

শতাব্দী ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই। কেন থাকবো না? তুমি যাও।”

তাহমিদ তখন হুইলচেয়ারে বসে শতাব্দীর উৎসাহিত মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে মনে মনে ভাবছে,
“শতাব্দী আমার সাথে থাকার জন্য এতো উৎসুক হয়ে যাচ্ছে কেন? ওইদিনও বাসায় বলেছিলো, এখানে এসে থাকবে। ও কি আমার প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে?”

ইমন চলে যাওয়ার পর শতাব্দী মেইন দরজা আটকে দিয়ে তাহমিদের হুইলচেয়ারের পাশে এসে দাঁড়ালো। তাহমিদ শতাব্দীকে বলল,
“তুমি নাস্তা করে এসেছ?”

“হ্যাঁ, তুমি খাও নি?”

তাহমিদ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। শতাব্দী হুইলচেয়ারটি ঠেলে ঠেলে বারান্দায় নিয়ে গেলো। তারপর হুইলচেয়ার ঘেষে মেঝেতে বসে পড়লো। তাহমিদ চুপ করে আছে। শতাব্দীও কিছু বলছে না। কিন্তু এই নিরবতা যেন অনেক কিছুই বলে দিচ্ছে। তাহমিদ গলা খাঁকারি দিয়ে নিরবতা ভাঙলো। শতাব্দী তাহমিদের চোখের দিকে তাকালো। তাহমিদ সেই চোখের গভীরে ভিন্ন কিছু দেখে ফেলেছে, তাই সে কিছুক্ষণ পর চোখ সরিয়ে নিলো। শতাব্দী কাঁপা কন্ঠে বলল,
“তোমার এক্সিডেন্ট হওয়ার পর থেকে আমার কিছুই ভালো লাগছে না। বাসায় একদম মন বসে না। মনটা সবসময় এখানেই পড়ে থাকে।”

তাহমিদ অবাক হয়ে বলল, “কেন?”

শতাব্দী তাহমিদের প্রশ্ন শুনে অভিমানী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। তাহমিদ বলল,
“তোমার আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করতে হবে না। আমি তো একা থাকি না। আরাফ, তূর্য ওরা সবাই আমাকে দেখছে। ওদের মতো বন্ধু থাকতে আমার কিছুই হবে না।”

“শুধু কি বন্ধুরাই চিন্তা করে? আর কারো বুঝি চিন্তা হয় না!”

তাহমিদ প্রসঙ্গে পালটে বলল,
“এখন অরুণিকাও আমার যথেষ্ট যত্ন নেয়।”

শতাব্দী অভিমানী কন্ঠে বললো,
“ছোট সখীর যত্ন আর আমার যত্ন কি এক?”

তাহমিদ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। শতাব্দীর প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না।

কিছুক্ষণ পর তাহমিদ বলল, “আমি ভেতরে যাচ্ছি।”

“কেন? এখানে কি সমস্যা? এই মিষ্টি হাওয়া কি তোমার ভালো লাগছে না?”

“না। মাথাটা ভারী ভারী লাগছে।”

তাহমিদ হুইলচেয়ার চালাতে যাবে তখনই শতাব্দী পেছন থেকে হাতল ধরে বলল,
“কোথায় যাবে বলো, আমি নিয়ে যাচ্ছি।”

“আমার ঘরে।”

শতাব্দী তাহমিদকে ঘরে নিয়ে যেতেই সে উঠার চেষ্টা করতে যাবে, তখনই শতাব্দী তাকে ধরে বলল,
“কোথায় যাচ্ছো?”

“ওয়াশরুমে যাবো।”

শতাব্দী কিছু একটা ভেবে বলল,
“কিভাবে যাবে? তুমি তো এখনো পায়ে ভর দিতে পারো না।”

তাহমিদ মনে মনে ইমনকে বকে যাচ্ছে। শতাব্দী বলল,
“আমি নিয়ে যাবো?”

তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে শতাব্দীর দিকে তাকালো। শতাব্দী ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“এতো ভাবাভাবির কিছু নেই। চলো আমিই নিয়ে যাচ্ছি। আমি তোমাকে বসিয়ে দিয়ে চলে আসবো।”

হুইলচেয়ারটা টেনে ওয়াশরুমের কাছে আনতেই তাহমিদ শতাব্দীকে বলল,
“তুমি রুমের দরজা বন্ধ করে বাইরে যাও।”

“কিন্তু তুমি!”

“তোমাকে যেতে বলছি, যাও।”

শতাব্দী বের হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। তাহমিদের অপেক্ষায় রুমের বাইরে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ তার ড্রয়িংরুমে রাখা টেবিলের উপর চোখ পড়লো। কাচের টেবিলের নিচে একটা কাগজ সেঁটে দেওয়া হয়েছে। সেখানেই তাহমিদের খাবার আর ওষুধের সময়সূচি লেখা আছে। শতাব্দী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, এখন তাহমিদকে ফল কেটে দিতে হবে। সে রান্নাঘরে গিয়ে আনার, আপেল, কমলা আর আঙ্গুর সাজিয়ে একটা প্লেটে রাখলো। তাহমিদ অনেকক্ষণ পর শতাব্দীকে ডাক দিলো। শতাব্দী প্লেট হাতে নিয়ে রুমে ঢুকলো। তাহমিদ আলমারির দিকে ইশারা করে বলল,
“উপরের তাকে আমার জামা আর প্যান্ট রাখা আছে। কিছু মনে করো না তোমাকে বিরক্ত করছি। কাপড়গুলো একটু নামিয়ে দিতে পারবে?”

শতাব্দী মুচকি হেসে এক সেট জামা নামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার তো ভালোই লাগে তুমি কোনো কাজ দিলে।”

এরপর শতাব্দী তাহমিদের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে বলল,
“মিষ্টিমশাই, এখন একটু এসব বন্ধ করো। এতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দেখতে গেলে, তোমারই কষ্ট হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছো না, সেখানেও তোমার শুচিবায়ু যায় নি!”

“পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা ঈমানের অঙ্গ। আমাকে নামাজ পড়তে হবে। তাই জামা পাল্টাবো। তারপর ওজু করবো।”

“তুমি এই অবস্থায় নামাজ পড়বে?”

“হ্যাঁ, এতোদিন সুস্থ ছিলাম, কিন্তু সিজদা দেওয়ার জন্য একটু সময় বের করতে পারি নি। আজ আমি যার রহমতে বেঁচে আছি, তাকে ভুলে থাকতে পারবো না। সেদিন আমার কিছু হয়ে গেলে, অনেক পাপ নিয়েই মরতে হতো। আল্লাহ আমাকে আরেকটা সুযোগ দিয়েছে। আমি আর তাকে অসন্তুষ্ট করবো না। এমনিতেই ছোটখাটো অনেক পাপ করি। নিজেকে পুরোপুরি শুদ্ধ করতে অনেক সময় লাগবে। অন্তত একটা ভালো কাজ করলে, কিছুটা ভারমুক্ত হবো।”

শতাব্দী মুগ্ধ হয়ে তাহমিদের কথা শুনছে। সে বলল,
“আমি তোমাকে ওজু করিয়ে দিতে পারবো?”

তাহমিদ মুচকি হেসে সম্মতি দিলো। শতাব্দী এরপর রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আর তাহমিদ একা একাই কাপড় পাল্টাতে লাগলো। তাহমিদের অনেক কষ্ট হচ্ছিলো। শতাব্দীর তা দেখে অনেক খারাপ লাগছে। সে ইমনকে ফোন দিয়ে বলল,
“ইমন, কোথায় তুমি?”

ফোনের ওপাশ থেকে ইমন বলল,
“আমি একটা কাজে আটকে গেছি।”

“দুপুরের রান্নাও তো হয় নি। আমি তো জানতামই না এগারোটায় তাহমিদকে ফল দিতে হবে। একটু আগেই দেখলাম। আর অরুণিকার তো অনেক আগেই স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। ও কোথায়?”

“ও আরাফের সাথে। সামনে ইদ আসবে। রোজা রেখে ইদের কেনাকাটা করা সম্ভব না। তাই শপিং করতে গেছে।”

“এখন তাহমিদ কি খাবে না কিছু?”

“হ্যাঁ, আহনাফকে ফোন দিয়েছি। ও বাইরে থেকে খাবার নিয়ে বাসায় যাবে। ও হয়তো এখন রাস্তায় আছে।”

“বাইরে থেকে কেন আনবে? আমিই রান্না করি।”

ইমন বলল,
“না, বাসায় কিছু নেই। এই সপ্তাহে আমরা বাজার করার সময় পাই নি। আর তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে? কোনো তাড়া আছে?”

শতাব্দী বলল,
“আমার সমস্যা নেই। আমি বাসায় বলেই এসেছি। তাহমিদেরই কষ্ট হচ্ছে।”

“ওর কেন কষ্ট হবে?”

“ওয়াশরুমে যাওয়া নিয়ে।”

“ওহ শিট। আমার মাথায়ও আসে নি এতোকিছু। আহনাফ আসলে ওকে এসব বলো না, প্লিজ। ও আমাকে আস্ত রাখবে না।”

“আচ্ছা।”

শতাব্দী কল কেটে কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ হাঁটাহাঁটি করে রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো, তাহমিদ কাপড় পালটে ফেলেছে। এবার শতাব্দী রুমে এসে ফলগুলো এগিয়ে দিলো। তাহমিদও সেগুলো খেতে লাগলো। এদিকে শতাব্দী ততক্ষণে একটা চেয়ার ওয়াশরুমে রেখে তাহমিদকে সেই চেয়ারে বসিয়ে দিলো। এরপর তাহমিদের কথা মতো তাকে ওজু করিয়ে দিতে লাগলো। এরপর সে হুইলচেয়ারটিও ভালোভাবে মুছে দিলো। তারপর শতাব্দী একটা জায়নামাজ মাটিতে বিছিয়ে তাহমিদকে আবার হুইলচেয়ারে বসিয়ে দিলো। তাহমিদ নামাজ শুরু করে দিয়েছে। শতাব্দী এবার ঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে তা দেখতে লাগলো আর মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে তাহমিদের সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করতে লাগলো। তাহমিদ নামাজ শেষ করার আগেই আহনাফ বাসায় চলে এলো। তারপর তিনজন একসাথে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সারলো। এরপর শতাব্দী চলে গেলো।

বিকেলে আরাফ অরুণিকাকে নিয়ে বাসায় ফিরলো। অরুণিকা তাহমিদের সামনে এসে বলল,
“তুমি দুপুরে পায়ে ক্রিম লাগিয়েছো?”

তাহমিদ মুচকি হেসে বললো,
“হ্যাঁ, আহনাফ লাগিয়ে দিয়েছে।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি গোসল সেরে তোমাকে আমার ড্রেসগুলো দেখাবো।”

অরুণিকা চলে যেতেই তাহমিদ ভাবনায় ডুবে গেলো। তার ভাবনায় এখন শতাব্দীর বিচরণ হচ্ছে। আজ সে শতাব্দীকে যতোটা কাছে পেয়েছে, এর আগে কখনোই পায় নি। সে বুঝতে পারছে শতাব্দী তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। আর তার জীবনেও শতাব্দীই প্রথম মায়াবী কিশোরী। কলকাতায় আসার পর থেকে শতাব্দী ছাড়া কোনো মেয়েকে নিয়েই তার বাড়াবাড়ি রকমের অনুভূতি ছিলো না। বরং কোনো মেয়েই তাকে আকর্ষণ করতে পারে নি। কিন্তু এখন তার নিজেরও মনে হচ্ছে এই অনুভূতি দিনদিন গভীর হয়ে যাচ্ছে। তাহমিদ চায় না, এই অনুভূতি ভালোবাসায় রূপান্তর হোক। তার শতাব্দীর প্রতি মায়া জমে গেছে। কিন্তু এই মায়া বাড়তে থাকলে, সে কখনোই মানসিক শান্তি পাবে না। কারণ শতাব্দী অন্য ধর্মের। শতাব্দীর বাবা-মা এই সম্পর্ক কখনোই মানবেন না। আর তাহমিদও এই কাজ করতে পারবে না। বাবা-মা হারিয়ে সে প্রতিটা বাবা-মার অনুভূতি বুঝে ফেলেছে। সে চায় না কোনো বাবা-মা তার সন্তানকে হারিয়ে ফেলুক। তাহমিদ মনে মনে বললো,
“আমাকে শতাব্দীর কাছ থেকে দূরত্ব রাখতে হবে। ওর এই বাসায় ঘনঘন আসা বন্ধ করতে হবে।”

৫০.

কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়, ঠিক তেমনি ইভান প্রেম দিয়ে প্রেম তুলবে। মাওশিয়াত ইভানের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ইভান তার মুখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,
“ইমনকে পাওয়ার জন্য এটা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।”

মাওশিয়াত কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“এখন তুমি বলতে চাইছো, আমরা এক সাথেই কম্পিউটার ক্লাসে ভর্তি হবো। আর সেখানেই ইমনকে দেখিয়ে দেখিয়ে প্রেম করবো?”

“হ্যাঁ, কারণ ইমন ওখানেই ক্লাস করছে।”

“ওকে ডান। তাহলে কাল থেকেই আমরা আমাদের নতুন মিশন শুরু করবো। মিশন ইমনকে ফিরে পাওয়া।”

মাওশিয়াত কথাটি বলেই হাসতে লাগলো। ইভানও তার সাথে হাসছে। আর তাদের একসাথে দেখে ইমন ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইভান পাশ ফিরে ইমনকে দেখে মাওশিয়াতের হাত ধরলো। মাওশিয়াত চমকে উঠলো। ইভান বলল,
“প্রেম দিয়ে প্রেম তোলার মিশন এই মুহূর্তেই শুরু করতে হবে। কারণ তোমার প্রিয় দূরে দাঁড়িয়ে আছে।”

মাওশিয়াত ওদিকে তাকাতে যাবে তখনই ইভান তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে এনে বলল,
“বোকা নাকি তুমি? তুমি ওদিকে তাকাচ্ছো কেন? ইমন ভাববে আমরা ওকে নিয়ে কথা বলছি। চলো, উলটো দিকে হাঁটি।”

মাওশিয়াত মাথা নেড়ে শক্ত করে ইভানের হাত ধরলো। ইভান বলল,
“এভাবে হাত চেপে ধরেছো কেন?”

মাওশিয়াত হাত আলগা করে বলল,
“উত্তেজনায় কি করবো, কি করবো না বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে যুদ্ধ হচ্ছে। আর আমি যুদ্ধে অংশ নিয়েছি।”

ইভান মাওশিয়াতের কথা শুনে হাসলো। আর এদিকে ইমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের যাওয়া দেখছে। কিছুক্ষণ পর সে সায়ন্তনীর দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো। সায়ন্তনী ইমনকে দেখে তড়িঘড়ি করে একটা বাটি মুছে কড়াই থেকে পেঁয়াজু নামিয়ে নিলো। ইমন আনমনে বসে আছে। সায়ন্তনী ইমনের হাত ধরে বলল,
“তোমাকে অনেক ক্লান্ত লাগছে।”

ইমন বিরক্ত হয়ে এক ঝটকায় সায়ন্তনীর হাত ছাড়িয়ে নিলো। সায়ন্তনী কিছুটা দূরত্ব রেখে বসলো। তখনই মাওশিয়াত আর ইভান সায়ন্তনীর দোকানে এলো। তাদের একসাথে দেখে সায়ন্তনী খুব অবাক হলো। মাওশিয়াত বলল,
“সায়ন্তনী, এক কাপ চা, আরেক কাপ কফি দাও।”

ইমন মাওশিয়াতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মাওশিয়াত আর ইমনের চোখাচোখি হতেই মাওশিয়াত চোখ সরিয়ে ইভানের হাত ধরল। সায়ন্তনী চা বানাতে বানাতে একবার মাওশিয়াত আর ইভানের দিকে তাকালো, আরেকবার ইমনের দিকে। সায়ন্তনী মনে মনে ভাবছে,
“ইমন কি এখনো মাওশিয়াতকে পছন্দ করে?”

এদিকে তূর্য অরুণিকাকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। তারপর মেকাপ বক্স সামনে নিয়ে তাকে সাজিয়ে দিতে বসেছে। আহনাফ তূর্যের ঘরে এসে দেখলো, অরুণিকা আর তূর্য অনেক হাসাহাসি করছে। আহনাফকে দেখে তূর্য বলল,
“তাহমিদের এক্সিডেন্ট হওয়ায় টুইংকেল স্কুলের প্রোগ্রামে অংশ নিতে পারে নি। তাই ভাবছি আজ ওর ইচ্ছেটা পূরণ করে দেব।”

আহনাফ চেয়ার টেনে বসে বলল,
“কি করবি?”

“আজ টুইংকেলকে নিয়ে শুট করবো। আমার গানটার একটা অংশে ও থাকবে।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“ওটা তো প্রেমের গান! অরু ওই গানে কি করবে?”

“প্রেম করবে!”

অরুণিকা বলল, “বউ হবো না আমি?”

তূর্য হেসে বলল,
“অবশ্যই মাই টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার৷ তুমি বউ হবে।”

আহনাফ বলল,
“আমি বুঝতে পারছি না ওর ভিডিওটাতে কাজ কি!”

“দেখ, গানটা ছোটবেলার প্রেমিক-প্রেমিকাকে নিয়ে। ওই ভিডিওর একটা অংশে টুইংকেল সেই নায়িকার ছোট বেলার অংশটাতে থাকবে।”

“ওখানে ছেলে কে হবে?”

“কোনো ছেলে থাকবে না। বাসার ছাদে একটা দোলনা লাগাবো। ওখানেই টুইংকেলের শট নেবো।”

অরুণিকা বলল,
“রকস্টার তুমি অনেক ভালো।”

আহনাফ কপাল কুঁচকে বললো,
“এখানে ভালো হওয়ার কি আছে!”

তূর্য গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“তোর এতো জ্বলছে কেন? ও আমাকে ভালো বললে তোর সমস্যা কোথায়।”

আহনাফ কোনো উত্তর দিলো না। তূর্য আবার বলল,
“এটা বলিস না যে, তুই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এখন থেকেই পজেজিভ হয়ে গেছিস। ওটা শুধু টুইংকেলকে ফেরত পাওয়ার একটামাত্র উপায় ছিলো।”

আহনাফ বলল,
“বাই এনি চান্স, যদি এই চুক্তি আমি ভবিষ্যতে মেনে নিতে চাই, তখন?”

তূর্য কথাটি শুনে হাসতে লাগল। আহনাফ বলল,
“হাসছিস কেন? আমি কি হাসার মতো কিছু বলেছি?”

তূর্য অরুণিকাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“লিটল স্টার, তুমি একটু বাইরে যাও।”

অরুণিকা মাথা নেড়ে শাড়ির কুঁচি ধরে বেরিয়ে পড়ল। তূর্য বলল,
“তুই একটা সময় ওকে একদমই পছন্দ করতি না।”

“হ্যাঁ করতাম না। তুই যেভাবে জিজ্ঞেস করছিস, মনে হচ্ছে তুই খুব পছন্দ করতি!”

“অদ্ভুত! আমি তো কখনোই ওকে অপছন্দ করি নি।”

আহনাফ বসা থেকে উঠতেই তূর্য বলল,
“টুইংকেল এখন অনেক কিছুই বুঝে। ও চুক্তির ব্যাপারটা না বুঝলেও আমরা যে ওর ভাই না, এটা ও ভালো করেই জানে। এটাও বুঝে কে ওকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আর যার কাছে ও গুরুত্ব পাবে, ও তার কাছেই থাকতে চাইবে।”

“হোয়ট ডু ইউ মিন, তূর্য!”

“আমি বোকা না, আহনাফ। তোর ব্যাপারগুলো আমি অনেক আগে থেকেই খেয়াল করেছি। একদম শুরু থেকেই। শুধু আমার সাথেই তোর যতো ঝামেলা। এই বাসায় সবাই টুইংকেলের সাথে কথা বলে, কিন্তু আমি কথা বলতে গেলেই তুই প্রহরীর মতো বসে থাকিস। আমি অনেক বার মজা করে বলেছি ওকে বিয়ে করবো। এই মশকরা সবাই বুঝেছে। শুধুমাত্র তুই বুঝিস নি। কেন আহনাফ!”

আহনাফ কোনো উত্তর না দিয়ে হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে অরুণিকার হাত ধরে তাকে টেনে তূর্যের সামনে এনে দাঁড় করালো। অরুণিকা ফ্যালফ্যাল করে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য আহনাফের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“কি করছিস তুই?”

আহনাফ বলল,
“আমি প্রহরীর মতো বসে থাকি? ওকে ফাইন, আমি আর এখানে বসে থাকবো না। আমি তো শুধু দেখতে এসেছি তোরা কি করছিস। আমার হয়তো এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে, দুঃখিত। এখন তোরা যা ইচ্ছা কর। আই ডোন্ট কেয়া’র!”

আহনাফ রুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে এসে দেখলো তাহমিদ বিছানায় শুয়ে আছে। তাহমিদ আহনাফকে দেখে বলল,
“কি হয়েছে তোর?”

আহনাফ কোনো উত্তর না দিয়ে পাশের বেডে শুইয়ে বাতি নিভিয়ে দিলো। তাহমিদ দুই-তিনবার ডাকলো। কিন্তু সে কোনো সাড়া দিলো।

এখন আহনাফের মাথায় ঘুরছে অরুণিকা কেন তাকে তেমন গুরুত্ব দেয় না? আরাফের ব্যাপারটা আলাদা। কারণ আরাফই একপ্রকার অরুণিকার বাবা-মার জায়গাটা নিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু তূর্য ও তো ওভাবে অরুণিকাকে সময় দেয় নি। তাদের মধ্যে আরাফ, তাহমিদ আর ইভানই অরুণিকাকে অনেক বেশি সময় দিয়েছে। অন্যদিকে তূর্য যতোটুকু সময় দেয়, তার চেয়ে বেশি সময় আহনাফ অরুণিকাকে দেয়। তবুও আহনাফের চেয়ে অরুণিকার কাছে তার রকস্টারই প্রিয়। আহনাফ এখন ভাবছে, কি করলে সে অরুণিকার কাছ থেকে আলাদা মনোযোগ পাবে, যেই মনোযোগটা এখন তূর্য পাচ্ছে।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here