#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৩||
৫৪.
তূর্য আর আহনাফ ইভানের উপর খুবই ক্ষুব্ধ৷ তূর্য রাগী কন্ঠে বললো,
“তুই ইমনের পক্ষ নিচ্ছিস? তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?”
ইভান বলল,
“আমার যা ভালো মনে হয়েছে, আমি তাই করেছি। ইমন মাওশিয়াতকে ভালোবাসে। তাহলে আমি কেন ওকে সায়ন্তনীর ব্যাপারে ভাবতে বলবো?”
আহনাফ বলল,
“অবশ্যই ভাবতে বলবি। সম্পর্কে গিয়েছিল কেন ও?”
তূর্য ইমনের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“ভাই, সায়ন্তনীর জন্য তোর একটুও খারাপ লাগছে না? আরেকবার ভেবে দেখ। মেয়েটা তোকে সত্যিই ভালোবাসে৷ মাওশিয়াত আর সায়ন্তনী দু’জনের মধ্যে সায়ন্তনীই তোর জন্য বেশি উপযুক্ত।”
ইভান তূর্যকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তুই আবার এসব শুরু করেছিস? তুই কি প্রেম গুরু নাকি কোনো মনিষী? সবসময় তুই ওর জন্য ও ভালো হবে, এ ভালো হবে, এই জ্ঞানই দিতে থাকিস। তুই নিজের মাথায় তেল দে। ইমনের ব্যাপারে নাক গলাবি না। আমি ইমনের বড় ভাই, আমি জানি ওর জন্য কি ভালো, কি খারাপ!”
এবার তাহমিদ বলল,
“ইভান, তুই তূর্যের সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন? ও তো ভুল কিছু বলে নি। আমরা জানি তুই ইমনের বড় ভাই। কিন্তু আমরা কি ওর খারাপ চাইবো?”
আহনাফ বলল,
“তোরা এসব তামাশাগুলো কখন বন্ধ করবি? মাওশিয়াত, সায়ন্তনী এই দুইটা মেয়েকে নিয়ে তোরা যেভাবে মিটিং করছিস, মনে হচ্ছে তোরা এদের উপরই পি.এইচ.ডি করবি। এই বাসায় কি আর কোনো বিষয়ে কথা হবে না?”
ইভান বলল,
“তুই চুপ কর, আহনাফ। তোর যতি এসে আমাদের জীবনে কম ঝামেলা বাঁধায় নি।”
আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“অন্তত আমি ওর বিষয়ে এভাবে সালিস বসাই নি। আমি ওই মেয়েটাকে চুপচাপ সহ্য করে যাচ্ছিলাম। কাউকে বলি নি যে আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”
এবার ইমন বলল,
“এটাই আহনাফ। আমিও এটাই বলতে চাইছি। সায়ন্তনী ভালো। কিন্তু আমার জন্য উপযুক্ত না। ওর সাথে আমি মানসিক শান্তি পাই না৷ কেন পাইনা আমি নিজেও জানি না। হয়তো মাওশিয়াতকে ভালোবাসি তাই।”
আহনাফ এবার চুপ করে রইলো। মনে মনে বলল,
“ঠিকই তো। আমিও তো যতির সাথে মানসিক শান্তি পাই নি। হয়তো ও একটু বেশি পজিজিভ ছিল। কিন্তু আমিও তো ওকে ভালোবাসতে পারি নি। কারণ আমি তো…..”
আহনাফ এবার অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা তাহমিদের পাশে বসে বসে তাদের ঝগড়া দেখছে আর ক্যান্ডি খাচ্ছে। ইভানের কথা শুনে আহনাফের মনোযোগ আবার আগের জায়গায় ফিরে গেলো। ইভান বলল,
“তোরা সবাই আহনাফকে জোর করে ওই মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করিয়েছিলি। ওকে প্রেম করতে বাধ্য করেছিস। কিন্তু আহনাফ তো ওর সাথে ভালো ছিল না। তাহলে সময় নষ্ট তো আহনাফেরই হয়েছিল। আরাফ ছাড়া আমরা কেউই এটা দেখি নি যে আহনাফ যতিকে ভালোই বাসে না। এটা দেখেছি যতি আহনাফের ব্যাপারে কতোটা ডেডিকেটেড। ভাই, এক পক্ষের ডেডিকেশন দিয়ে সম্পর্ক চালানো যায় না। আর জোর করে কারো মনোযোগও পাওয়া যায় না। তাই আমাদের উচিত মন যেটা বলে সেটাই করা। আজ নিজের মনের কথা শুনলে, ভবিষ্যতে কারো উপর দোষ দেওয়ারও সুযোগ থাকবে না, কাউকে ভালো কিছুর ক্রেডিটও দিতে হবে না। আমি ভালো আছি, এটাই আমার জন্য যথেষ্ট।”
ইভানের কথায় সবাই নিরব হয়ে গেলো। হঠাৎ তূর্য বলল,
“অন্তত এটা মিথ্যা না যে, তুই নিজেই চাস না সায়ন্তনী আর ইমনের কোনো সম্পর্ক থাকুক।”
ইভান তূর্যের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। তূর্য আবার বলল,
“যদি ইমন সায়ন্তনীকেই ভালোবাসতো, তবুও তুই এই সম্পর্কটা মেনে নিতি না।”
ইমনসহ সবাই তূর্যের দিকে তাকালো। ইভান বিনা দ্বিধায় বলল,
“হ্যাঁ নিতাম না। কারণ ও আমাদের স্ট্যাটাসের না।”
তূর্য হেসে বলল,
“এটাই আমি শুনতে চেয়েছিলাম।”
এই কথা বলে তূর্য চলে যেতে নিবে তখনই ইভান বলল,
“বাবা-মা বেঁচে থাকলে কখনোই এমন সম্পর্ক মেনে নিতো না। আর ওদের অবর্তমানে ইমনের অভিভাবক আমি।”
তূর্য পেছন ফিরে বলল,
“সমস্যাটা এই জায়গায় ইভান। বাংলাদেশ ফিরলে ইমনের স্ত্রী মৈত্রী গ্রুপ এন্ড ইন্ডাস্ট্রির ৩০% অংশ পাবে। একটা বস্তির মেয়ে এই দায়িত্ব কিভাবে নেবে? মাওশিয়াত শিক্ষিত, স্মার্ট। এই দায়িত্ব মাওশিয়াত সহজেই নিতে পারবে।”
ইভান তাহমিদের দিকে তাকালো। তূর্য বলল,
“তাহমিদ আমাকে কিছুই বলে নি, ইভান। ওইদিন তোদের কথাগুলো আমি সব শুনেছি। সুরের জগতে থাকলেও আমি আশেপাশের খেয়াল রাখি।”
ইভান বলল, “হ্যাঁ, এটাই বাস্তবতা।”
“তোর কথায় এখন আমাদের ভালোবাসতে হলে স্ট্যাটাস দেখেই ভালোবাসতে হবে। ইভান, আমি আজ বুঝেছি, আমাদের গ্রুপের এতো শত্রু কেন ছিল? আজ বুঝেছি একটা পরিবারকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার কারণ কি!”
ইভান রাগী কন্ঠে বলল,
“কি বলতে চাইছিস তুই?”
“এসব নিয়ম। আর এসব স্ট্যাটাসই আমাদের প্রধান শত্রু। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আরুপা ফুফির কারণেই সেই রাতটি মৈত্রী গ্রুপের জন্য কাল রাত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আরুপা ফুফি আত্নহত্যা করার পর থেকেই এই ঘটনাগুলো ঘটছিল। কেন ফুফি আত্মহত্যা করেছিল? কারণ কেউই তার ওই ছেলের সাথে সম্পর্কটা মেনে নেয় নি। ওই ছেলেকে যাচ্ছেতাই শুনিয়ে প্রহরীদের ডাকিয়ে সভাঘর থেকে সেদিন ধাক্কা দিয়ে বিদায় করেছিল। কারণ ফুফির নামে থাকা সম্পত্তির অংশগুলো যাতে ওই ছেলে বা ওর বংশের নামে না হয়৷”
আহনাফ বলল,
“তোকে এসব কে বলেছে?”
“গিটারে সুর তুলতে ব্যস্ত থাকলেও আমি সেই রাত এখনো ভুলি নি। শুধু তোরাই ভুলে যাচ্ছিস।”
৫৫.
রোজা শুরু হয়ে গেছে। রোজা নিয়ে অরুণিকার অনেক আগ্রহ। সে এক সপ্তাহ আগে থেকেই ট্যা ট্যা করছিলো যে, সে রোজা রাখবেই রাখবে। তাই আরাফ সেহেরীর সময় তাকে ডেকে তুললো। ঘুম ঘুম চোখে খুব উৎসাহের সাথে সে ভাত খেলো। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়লো। আজ রোজা রেখেছে, তাই স্কুলে যাবে না, তাহমিদের সাথেই বাসায় থাকবে। বাকিরা যার যার কাজে বেরিয়ে পড়লো৷ কিন্তু সারাদিন সে তাহমিদের সাথে এতো বকবক করলো যে তার গলাটাই এখন শুকিয়ে গেছে। তাহমিদ বলল,
“থাক, তুমি ছোট মানুষ। তোমার রোজা রাখতে হবে না। পানি খেয়ে ফেলো, যাও।”
অরুণিকা মলিন মুখে বললো,
“আমার এগারো হয়ে গেছে। আর এগারো হলে রোজা রাখতে হয়।”
“তো তুমি বার-বার পানি খাবে কেন বলছ!”
“আর বলবো না।”
তাহমিদ অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি ঘুমিয়ে পড়ো, যাও।”
“তুমি আমাকে কোরা’আন শেখাবে না? তুমিই তো বললে শেখাবে।”
“তোমাকে আগে অক্ষর শেখাতে হবে।”
“আমি আলিফ, বা, তা, সা সব পারি। যবর, যের, পেশ দিয়েও বলতে পারি। ওই বাড়িতে শিখেছিলাম, মনে নেই?”
“আচ্ছা, দুপুরে শেখাবো। ঠিক আছে?”
“আচ্ছা। চলো এখন আমরা খেলি।”
তাহমিদ অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“অরুণিকা, আমার ঘুম আসছে। প্লিজ বোন, তুমিও ঘুমাও। আমাকেও একটু ঘুমাতে দাও।”
এরপর দুপুরে বাকিরাও বাসায় ফিরলো। তারপর একটু বিশ্রাম করে, নামাজ-দোয়া সেরে, ইফতারি তৈরীতে লেগে পড়লো। ওদিকে অরুণিকা হাত-পা মেলে বিছানায় শুয়ে রইলো। আরাফ তার হাত ধরে তাকে টেনে তুলে বলল,
“আগে তো নামাজ শিখতে হবে। রোজা তো আরেকটু বড় হলেও রাখতে পারতে। এখন উঠো। তুমি আসরের নামাজ পড়েছ?”
অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আমি তো পারি না।”
“কাল শিখিয়েছিলাম, মনে নেই?”
“অনেক কঠিন। আমি সব ভুলে গেছি।”
তাহমিদ হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে অরুণিকার রুমে এসে বলল,
“যাও আমি শিখিয়ে দেবো এখন। ওজু করে আসো।”
অরুণিকা উৎসাহ নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে এলো৷ তারপর টেবিল থেকে কোর’আন এনে বলল,
“এখন শুরু করব?”
“অরুণিকা, আগে নামাজটা তো শিখতে হবে। কোর’আন পরে শিখিও।”
“না, আমি এটাই পড়বো।”
“নামাজ শিখবে না?”
“পরে শিখবো, বললাম তো।”
তাহমিদ বিড়বিড় করে বলল,
“নিজে যা বুঝে তাই করবে।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কি বললে তুমি?”
“কিছু না।”
তাহমিদ নামাজে দরকার হবে সেই সূরাগুলোই বার-বার অরুণিকাকে শেখাতে লাগলো। অরুণিকা একটু পর থেমে গিয়ে বলল,
“তুমি শেষে চলে গেলে কেন? এইগুলো পড়বো না?”
“আগে এই সূরাগুলো শিখে মুখস্থ করতে হবে। তারপর বাকিগুলো পড়তে পারবে।”
“যদি ভুলে যাই?”
“তাই তো বার-বার পড়াচ্ছি।”
অরুণিকা পা ধাপিয়ে বলল,
“অনেক কঠিন এগুলো।”
ইভান ড্রয়িংরুম থেকে চেঁচিয়ে বললো,
“এই মেয়ে এতো কথা বলে কেন?”
অরুণিকা ইভানের কথা শুনে এবার জোরে জোরে পড়তে লাগলো। আহনাফ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ইভানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এক ধমকে সোজা হয়ে গেছে। তুই গিয়েই ওকে পড়া! তাহমিদ রেস্ট নিক।”
ইভান বলল,
“আমি পড়াতে গেলে, পড়া কম কান্না করে চোখের পানি ফেলবে বেশি৷ তাহমিদের ধৈর্য আছে। ও-ই পড়াক।”
ইফতারির সময় সবাই গোল হয়ে বসলো। অরুণিকা খাবারের প্লেট ভর্তি করে ফেলেছে। ইমন বলল,
“তুমি সব খেতে পারবে তো?”
অরুণিকা মুচকি হেসে বললো,
“হ্যাঁ। আমার অনেক ক্ষুধা লেগেছে। আমি সব খাবো।”
“দেখবো তো! পুরো প্লেট যাতে খালি দেখি।”
আজান দেওয়ার পর সবাই ইফতারি শুরু করল। অরুণিকা অল্প একটু ছোলা আর পিঁয়াজু খেয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। তারপর আস্তে করে এক চামচ ছোলা আরাফের প্লেটে তুলে দিলো। আরাফ ভ্রূ কুঁচকে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা অন্য দিকে তাকিয়ে পিঁয়াজু খাওয়ার ভান ধরল। ইভান রান্নাঘরে যেতেই সে কিছু পিঁয়াজু আর বেগুনি তার প্লেটে দিয়ে সবাইকে ইশারায় চুপ থাকতে বলল। ইমন বলল,
“কেউ একজন বলেছিল, আমি সব খাবো।”
অরুণিকা মুখ ছোট করে বলল,
“না, আমি তো খেতামই। কিন্তু পরে ভাবলাম, আমি এখনো ছোট। আমার তো এতো শক্তি লাগবে না। তোমরা তো মোটা মোটা বই পড়ো, অনেক কাজ করো, তাই তোমাদের খাওয়াচ্ছি।”
“আচ্ছা, পন্ডিতমশাই। এবার যা খেতে পারেন, তা তো অন্তত খান!”
অরুণিকা পেটের উপর হাত রেখে বলল,
“আরেকটু খেলে আমি ঠুস করে ফেঁটে যাবে।”
ইভান রান্নাঘর থেকে আসতেই অরুণিকার মুখটা চুপসে গেলো। সে আবার চামচ হাতে নিয়ে ছোলাগুলোকে প্লেটের মধ্যেই ঘুরাতে লাগলো। আরাফ অরুণিকার জন্য আলাদা প্লেটে হালিম তুলে রেখে, তার হাত থেকে চামচ নিয়ে বলল,
“থাক, জোর করে খেতে হবে না। পরে খেও। আমি তোমার জন্য তুলে রেখেছি। যাও এখন রেস্ট করো।”
রোজা শুরু হওয়ার পর থেকেই ইফতারির পর প্রতিদিন শতাব্দী বাসায় চলে আসে। আর ছ’জনই অরুণিকাকে শতাব্দীর কাছে রেখে তারাবিহ পড়তে চলে যায়। রোজা রেখে সকালে ক্লাস, বিকেলে কাজ, রাতে তারাবিহ পড়ার পর কারো শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট থাকে না।
এদিকে সায়ন্তনী দোকান বন্ধ রাখে নি। কারণ এটাই তার জীবিকার পথ। আর আরাফও প্রতিদিন দূর থেকে এসে সায়ন্তনীকে দেখে চলে যায়। দিন দিন সায়ন্তনী শুকিয়ে যাচ্ছে। আরাফের খুব ইচ্ছে করে তার পাশে বসে দু’দন্ড কথা বলতে। কিন্তু কোনোভাবেই সাহস পায় না।
কয়েকদিন পর তারাবিহ পড়ে বাসায় আসার পর সবাই বসার ঘরে এক এক জায়গায় বসে পড়ল। শতাব্দী চুল ঠিক করতে করতে বলল,
“আমি যাচ্ছি তাহলে।”
তূর্য বলল,
“একটু বসো। আজ এতো তাড়াহুড়ো করছো কেন?”
“মা ফোন করেছে। বলেছে বাসায় পিসিমা আসবেন।”
“আসলে আসবে।”
“না, বাবা। তুমি বুঝো না এসব। এতো রাতে বাইরে থেকে ফিরলে অনেক বকাবকি করবেন।”
“এখানে এসেছো বলবে।”
শতাব্দী মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“পিসিমা মা-বাবার মতো এসব মানবে না গো। উলটো মায়ের কান ভরবে। এমনতেই স্কুল পাশ করার পর থেকে বিয়ে বিয়ে করে মাথা খেয়ে ফেলছে। আমার তো ছোট বোন আছে। আমার বিয়ে দিলেই তো তার বিয়ে দেবে। আর পিসিমার কাছে জগতের সব পুরুষের খোঁজ পাওয়া যাবে। ডাক্তারবাবু, ইঞ্জিনিয়ারমশাই, দারোগা বাবু, তুমি যেই পাত্র চাইবে একেবারে চুটকির মধ্যে খুঁজে এনে দেবে। তাও বাবা তোমাদের খুব ভালোবাসে, আর ছোট সখী তার চোখের মণি, তাই আমাকে এখানে আসতে দেয়। মাকেও তো বাবাই রাজি করিয়েছিল।”
তাহমিদ বলল,
“তোমার বিয়ে দিয়ে দেবে নাকি!”
“দিয়ে দেবে বললে তো দেওয়া যায় না। আমি মানলেই তো হবে। কিন্তু সোজাসাপ্টা চলাফেরা করলেই তো আমার কথার মান থাকবে, নাকি! দেরী করে বাসায় ফিরলে তাড়াতাড়ি ভাগিয়ে দেবে।”
তূর্য হেসে বলল,
“মিষ্টিমশাই তুমি একটু শক্ত হয়ে বসো। আমি শতাব্দীকে তাড়াতাড়ি বাসায় দিয়ে আসি। নয়তো তুমি হুইলচেয়ার ছাড়ার আগেই সে শ্বশুড়বাড়ি চলে যাবে।”
তাহমিদ রাগী দৃষ্টিতে তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্য চোখ মেরে বলল,
“আরেহ, বসে বসে কি বিয়ের আনন্দ পাবে? তাই বলছি। তুমিও না উল্টোটাই বুঝো।”
শতাব্দী লাজুক হেসে তাহমিদের দিকে তাকালো। তাহমিদ হুইলচেয়ারটি উল্টোদিকে ঘুরিয়ে নিলো।
পরেরদিন সেহেরী করে ঘুম থেকে উঠতে উঠতে সবার দুপুর হয়ে গেছে। আরাফ বিছানা থেকে মাথা তুলে অরুণিকার রুমের দিকে তাকালো। দেখলো বিছানায় অরুণিকা নেই৷
আরাফের বেড থেকে সরাসরি অরুণিকার বিছানাটা দেখা যায়৷ রাতে অরুণিকাকে ঘুম পাড়িয়ে সে ড্রয়িংরুমে চলে আসে৷ তারপর করিডরের বাতিটা জ্বালিয়ে দেয়, যাতে মাঝ রাতে ঘুম ভাঙলে অরুণিকা ভয় না পায়। তবে যদি অরুণিকার ঘুম ভাঙে, সে সুড় সুড় করে ড্রয়িংরুমে এসে বসে থাকবে। কখনো কখনো আরাফ আর ইভানের বেডের মাঝখানে যেই খালি জায়গা থাকে, সেখানেই শুয়ে পড়বে। আর আরাফ ও ইভান মেঝেতেই আলাদা বিছানা করে ঘুমায়।
এদিকে আরাফ বিছানা ছেড়ে উঠে সোজা অরুণিকার রুমে চলে এলো৷ এসে দেখলো অরুণিকা চেয়ারে দুই পা তুলে হাঁটুতে মুখ গুঁজে চুপচাপ বসে আছে। আরাফ তার কাছে এসে বলল,
“অরু, তুমি কখন উঠেছ?”
অরুণিকা ছলছল চোখে আরাফের দিকে তাকালো। আরাফ ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“তুমি কাঁদছো কেন? কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?”
আরাফের কন্ঠ শুনে ইমন রুমে ঢুকলো। সে অরুণিকার পাশে বসে বলল,
“অরুণিকা, কাঁদছো কেন তুমি?”
তারপর আরাফকে জিজ্ঞেস করলো,
“কেউ বকা দিয়েছে নাকি!”
আরাফ বলল,
“না, ইভান তো এখনো শুয়েই আছে। আর কেউ তো রুমে আসে নি।”
আরাফ আহনাফকে ডাকলো। আহনাফের পিছু পিছু তূর্য আর তাহমিদও চলে এলো। তূর্য অরুণিকার চোখে পানি দেখে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“টুইংকেল, তুমি কাঁদছো কেন? কি হয়েছে আমাকে বলবে?”
অরুণিকা মুখে হাত দিয়ে ঢুঁকরে কেঁদে উঠলো। আহনাফ বলল,
“আচ্ছা, শুনো, অরু। কি হয়েছে না বললে আমরা কিভাবে বুঝবো, বলো? তুমি কি খারাপ স্বপ্ন দেখেছ?”
অরুণিকা চোখের পানি মুছে বিছানার দিকে ইশারা করল। সবাই সেদিকেই তাকালো। ইমন বলল,
“পোকা দেখে কাঁদছো? দাঁড়াও, আমি দেখছি।”
ইমন বিছানার আশেপাশে ভালোভাবে ঘাঁটাঘাঁটি করলো। তারপর কিছু না দেখে বলল,
“কিছুই তো নেই।”
হঠাৎ তাহমিদের চোখ পড়লো, ওয়াশরুমের পাশে পড়ে থাকা জামা-প্যান্টের দিকে। সে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে কালকের পরণের জামাটা পরিবর্তন করে ফেলেছে। সে এবার হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে জামাটা উঠালো। সে যা ধারণা করেছিল, তাই হয়েছে। জামাটা হাতে নিতেই সবার নজর সেদিকেই পড়লো। ইমনেরও এবার বিছানায় ভালোভাবে চোখ পড়ল। আরাফ অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“অরু, ভয় পাচ্ছো কেন বলোতো? এটা তো সাধারণ ব্যাপার।”
আরাফ আহনাফের দিকে তাকাতেই সে শতাব্দীকে কল করল। শতাব্দী কল ধরতেই আহনাফ তাকে সব বললো। শতাব্দী বলল,
“সখীকে দাও তো। আমি কথা বলছি।”
“আচ্ছা, তুমি বাসায় আসলে ভালো হয়। ওকে একটু বুঝিয়ে বলবে আর কি। ও ভয় পেয়ে কান্না করছে।”
“আচ্ছা, আমি এখনি বের হচ্ছি।”
আহনাফ অরুণিকাকে ফোনটা দিলো। অরুণিকা ফোন কানের কাছে আনতেই শতাব্দী বলল,
“সখী, তুমি কান্না করছো কেন বলো তো? তুমি একদম কাঁদবে না৷ আমি আসছি, দাঁড়াও।”
অরুণিকা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি কি মারা যাবো?”
অরুণিকার কথা শুনে সবাই রাগী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। শতাব্দী বলল,
“ধুর বোকা। এটা তো মেয়েদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। তুমি মরে যাওয়ার কথা বলো না, সখী। তোমার কিছু হলে তোমার ছ’ পুরুষের কি হবে বলো তো দেখি?”
অরুণিকা সবার দিকে একবার একবার তাকালো। ফোন রেখে দেওয়ার পর তাহমিদ বলল,
“যাও ভালোমতো ফ্রেশ হয়ে আসো। কান্নাকাটি বন্ধ করো।”
এদিকে ইভান সব শুনে দোকানে গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়ে এলো। বিশ মিনিটের মধ্যেই শতাব্দী বাসায় চলে এলো। বাসায় এসে অরুণিকাকে সব বুঝিয়ে বলল। নিজে বসেই অরুণিকার সব কাপড়, আর বেডশিট ধুয়ে দিলো। শতাব্দীর এমন কাজে আরাফ বলল,
“তুমি এসব করতে গেলে কেন?”
শতাব্দী বলল,
“ও আমার বোনের মতো। তাই আমিই ধুয়ে দিয়েছি। আর তোমরা রোজা রেখেছ। অরুণিকা তো এখনো ছোট। ভাবছি, আমাদের বাড়িতে কাজ করে, উনাকে এখানে পাঠিয়ে দেব। রোজা রেখে তোমরা এতো কাজ কীভাবে করবে, বলো?”
“কাজের বুয়া রাখার মতো টাকা এখন আমাদের হাতে নেই। আমরাই পারবো। বাড়তি খরচ করতে চাচ্ছি না।”
“আচ্ছা, আর আমি অরুণিকাকে সব বুঝিয়ে বলেছি। তোমরা চিন্তা করো না।”
“থ্যাংক ইউ, শতাব্দী৷ তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে। কলকাতায় এসে তোমার মতো একটা মেয়ের সাথে আমাদের দেখা হয়েছে, এটা আমাদের সৌভাগ্য। তুমি না থাকলে কি হতো জানি না! তুমি আমাদের অনেক উপকার করেছো। সবসময় পাশে থেকেছো।”
“বিপদে বন্ধুই তো কাজে আসে। আর আমি কি আমার সখী আর সখাদের জন্য এতোটুকু করতে পারবো না?”
চলবে-