অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৩৫||

0
1191

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৫||

৫৭.
সাদা লেহেঙ্গা পরে, ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো অরুণিকা। অরুণিকাকে দেখেই আরাফ তার কাছে এগিয়ে এলো৷ অরুণিকা বলল,
“ইদ মোবারক, আরাফ।”

আরাফ মুচকি হেসে অরুণিকার হাতে পাঁচশ টাকার একটা নোট গুঁজে দিলো। অরুণিকা টাকা পেয়ে খুশি হয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো। তারপর সে ইভানের সামনে এসে দাঁড়ালো৷ ইভান ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কি সমস্যা?”

অরুণিকা কোনো উত্তর না দিয়ে শুকনো মুখে সরে গেলো। এবার ইমন তার দুই পা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আগে সালাম, তারপর সালামি।”

অরুণিকা সালামি পাবে শুনে ইমনকে সালাম করলো। ইমন একশো টাকার নোট দিয়ে কলার ঝাঁকিয়ে বলল,
“আজ আমি শ’পতি৷ তাই আজ আমি দুই হাত খুলে খরচ করবো।”

অরুণিকা টাকাটা ভালোভাবে দেখে বলল,
“মাত্র একশো টাকা দিয়েছ?”

ইমন ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“একশো টাকা কি তোমার কম মনে হচ্ছে? এই টাকা দিয়ে তুমি কতোগুলো ক্যান্ডি পাবে, জানো?”

এরপর তাহমিদ এসে অরুণিকার হাতে দুইশো টাকা দিয়ে বলল,
“ইদ মোবারক। তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে, অরুণিকা।”

অরুণিকা খুশি হয়ে বলল,
“জানো, আমি কার কাছ থেকে মেকাপ করা শিখেছি?”

“কার কাছ থেকে শিখেছ?”

“শতু আপুর কাছ থেকে। শতু আপু তোমার ফোনে মেকাপ ভিডিও পাঠিয়েছিল।”

তাহমিদ মুচকি হাসলো। ইমন বলল,
“বাহ! আজকাল তাহলে তাহমিদের ফোনে ভিডিও পাঠানো হয়!”

তাহমিদ কোণা চোখে ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অরুণিকাকেই পাঠিয়েছিল। আমাকে নয়।”

তাদের কথার মাঝখানে তূর্য এসে অরুণিকার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো৷ অরুণিকা মুখে মিষ্টি হাসি টেনে বলল,
“ইদ মোবারক, রকস্টার।”

তূর্য বলল,
“ইদ মোবারক, মাই টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার।”

এবার তূর্য অরুণিকার ব্যাগটা দেখে বলল,
“বাহ, এই ব্যাগটা তো খুব সুন্দর।”

“হ্যাঁ, মাওশিয়াত আপু আমাকে জন্মদিনে দিয়েছিল।”

তূর্য মুচকি হেসে বলল,
“আচ্ছা, চোখ বন্ধ করো। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”

অরুণিকা তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করে নিলো। কিছুক্ষণ পর তূর্য বলল,
“এবার চোখ খুলো।”

অরুণিকা চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে অবাক হলো। তূর্য বলল,
“কেমন লেগেছে?”

অরুণিকা তূর্যের হাত থেকে ট্যাবটা নিয়ে বলল,
“অনেক সুন্দর। এটা কি আমার জন্য?”

“হ্যাঁ। এটাতে তুমি ইচ্ছেমতো গেইমস খেলতে পারবে৷”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তূর্য, তুই ওকে এতো দামি ট্যাব কেন দিয়েছিস?”

“কেন দিলে কি সমস্যা?”

“ওর কি এখন আর পড়াশুনা হবে? সারাদিন তো এটা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে।”

তূর্য বলল,
“না, আমার টুইংকেল পড়ার সময় পড়বে, খেলার সময় খেলবে। তুমি কিন্তু আরাফকে প্রমিজ করেছো বেশিক্ষণ ফোন দেখবে না।”

অরুণিকা বলল, “হ্যাঁ, বিশ মিনিট দেখবো শুধু।”

এবার আহনাফ অরুণিকার ব্যাগে পাঁচশ টাকার একটা বান্ডেল ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,
“আমাকে কি দেবে?”

অরুণিকা অবাক হয়ে বলল, “আমাকেও দিতে হবে?”

“হ্যাঁ।”

“আমি তো ছোট, আমি কি দেব?”

“এখন সেটা তুমিই ভেবে দেখো।”

অরুণিকা কিছুক্ষণ ভেবে নিজের রুমে চলে গেলো। তারপর দশমিনিট পর রুম থেকে বের হলো। আহনাফ বুকে হাত গুঁজে দেয়ালে হেলান দিয়ে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইলো। এবার অরুণিকা একটা চকলেট আহনাফের দিয়ে এগিয়ে দিলো।

আহনাফ চকলেটটা নিয়ে বুক পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো, আর বলল,
“থ্যাংক ইউ।”

ইমন বলল, “আমরা কি পাচ্ছি না?”

অরুণিকা বলল, “না, আমার কাছে তো আর নেই।”

এদিকে আরাফ আর তূর্য টেবিলের উপর পায়েস আর পাস্তার বাটি রেখে সবাইকে ডাকলো। ইমন চেয়ার টেনে বসতে যাবে তখনই আহনাফ বলল,
“তুই তোর শ্বশুড় বাড়ি গিয়েই খাইস। এখন আমাদের খেতে দে।”

ইভান বলল,
“আরেহ, হ্যাঁ। কাল রাতেই মাওশিয়াত ফোন দিয়ে বাসায় যেতে বলেছিল। ইমন, তোকে ফোন দেয় নি?”

ইমন বলল, “মেসেজ দিয়েছিল।”

এবার তূর্য বলে উঠল,
“সায়ন্তনীর কথা তো সবাই ভুলেই গেছিস মনে হয়?”

তূর্যের কথা শুনে ইমন চুপ হয়ে গেলো। টেবিলে কেউ আর কোনো কথা বললো না।

খাওয়া-দাওয়া করে তারা যার যার ঘরে গিয়ে শুয়ে রইলো। অরুণিকা তার সাদা লেহেঙ্গাটি পরে ঘরে ঘরেই হাঁটছে৷ প্রতি বছর এভাবেই তাদের ইদ কাটে। এখানে পরিচিত কেউ নেই। আগের মহল্লায় হিন্দু পরিবাররাও ইদে অংশ নিতো। শতাব্দীসহ মহল্লার ছোট ছোট বাচ্চারা তাদের বাসায় আসতো। অরুণিকা তাদের সাথেই সবার বাড়িতে যেতো। মাস্টারমশাইও সবাইকে সালামি দিতেন। ওই মহল্লায় অনেক মুসলিম পরিবার ছিল। আর এই মহল্লায় দু’একটা মুসলিম পরিবারই আছে। কিন্তু তাদের সাথে আরাফদের কথাবার্তা হয় না। এমনকি পাশের বাড়ির প্রতিবেশি দম্পতিও কখনো তাদের দরজায় এসে ঠোকা দেয় নি। তবে ছ’বন্ধুর তা নিয়ে আফসোসের চেয়ে স্বস্তি বেশি। কারণ এখন অরুণিকাকে নিয়ে মাসির দরদ দেখাতে কেউ আসবে না। এর আগের মহল্লায় বেশি সামাজিকতা পালন করতে গিয়ে প্রতিবেশিরা তাদের প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছিল।

অনেকক্ষণ ধরে মাওশিয়াত ইমনকে ফোন করছে। আর ইমন বারান্দায় অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। তূর্য খাবারের টেবিলে সায়ন্তনীর কথা তোলার পর থেকেই তার মন খারাপ। সায়ন্তনীর সাথে সে যা করেছে, তার জন্য তার এখনো আফসোস হচ্ছে। কিন্তু তার ভুল তো হয়েই গেছে। আর তাই সে সায়ন্তনীর কাছে ক্ষমাও চেয়েছে। তবুও এই ভুল যেন জোয়ারের মতো তার জীবনের সব ভালো থাকাগুলোকে আড়াল করে দিচ্ছে। আর ভাটার মতো চলে যাওয়ার সময় আত্মগ্লানিই রেখে যাচ্ছে। এখন এই ভুল তো কারো মস্তিষ্ক থেকে আর মুছে দেওয়াও সম্ভব না।

এদিকে তূর্য ফোনের শব্দ শুনে বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখলো ইমন অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য তার কাঁধে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
“আমার কথায় মন খারাপ করেছিস?”

ইমন তূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল, “না।”

তূর্য বলল,
“ইমন, আমি জানি তুই যা করেছিস আবেগ আর জেদের বশে করেছিস। কিন্তু সেদিন সায়ন্তনীর কথাগুলো শুনে আমার অনেক খারাপ লেগেছিল। এমনিতে ও যদি কিছু না বলতো, চুপ থেকেই সরে যেতো, তখন হয়তো এতোটা খারাপ লাগতো না। কিন্তু ও তো অনেক কিছুই বলে ফেলেছে। ওর জন্য সম্পর্কটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।”

ইমন বলল,
“আমি জানি তুই কেন ভয় পাচ্ছিস।”

তূর্য দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ইমন বলল,
“চিন্তা করিস না। অরুণিকার সাথে এমন হবে না। ওকে আমরা চোখে চোখে রাখবো। ওকে প্রেমেই পড়তে দেবো না, তখন ধোঁকা খাওয়ার তো প্রশ্নই আসবে না। আর আহনাফ যেই চুক্তিতে অরুণিকাকে ফিরিয়ে এনেছে, সেই চুক্তিটা যদি বাস্তবে রূপান্তরিত হয়, তাহলে হয়তো আমরা আমাদের অরুণিকাকে কখনোই হারাবো না।”

তূর্য বলল,
“আহনাফ চুক্তিটা আরাফের কথায় মেনে নিয়েছিল। ওরা যেহেতু কাজিন, তাই ওই চুক্তির বিষয়টা ভিন্ন ছিল। আর এমনিতেই আরাফ-আহনাফেরই টুইংকেলের উপর আমাদের তুলনায় বেশি অধিকার আছে। বাবা, ভাই, দাদা, চাচা এদের অবর্তমানে কাজিন ভাইরাই তো প্রধান অভিভাবক হয়। কিন্তু সেদিন আহনাফ তো নিজ থেকে কিছুই বলে নি। ওর হয়তো কোনো ইচ্ছেও ছিল না। আর শুরু থেকেও ও টুইংকেলকে পছন্দ করতো না। দেশেও যখন টুইংকেল ওর আশেপাশে আসতো, ও অনেক রুড হয়ে যেতো। আমার মনে হয় না, আহনাফ ওকে নিয়ে কোনো ভবিষ্যৎ চিন্তা করেছে।”

“তাহলে কি অরুণিকাকে বাইরেই বিয়ে দিতে হবে? তাহমিদ তো ওকে বোনের চোখেই দেখে। আরাফকে তো ওর ভাই কম, বাবাই বেশি মনে হয়। তাহলে আমি…”

তূর্য ইমনকে থামিয়ে বলল,
“তুই মানে? আরাফ ঝাড়ু দিয়ে তোকে বিদায় করবে।”

ইমন মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আমার মাও আছে, বুঝেছিস! আর তুই তো সিঙ্গেলই আছিস। তুই বিয়ে করে ফেলিস ওকে।”

“আমার তো বিয়ে করার কোনো ইচ্ছেই নেই। তোদের প্রেম দেখে আমার আবেগ-অনুভূতি সব হাওয়া হয়ে গেছে। তবে ইভানকে নিয়ে ভেবে দেখতে পারিস।”

ইমন চোখ বড় বড় করে বলল, “ভাই? অসম্ভব।”

“অসম্ভব কেন?”

“আমার জালিম ভাই, অরুণিকার জীবনটাই নষ্ট করে ফেলবে। আর ওই পিচ্চি, আমি যার বমি পরিষ্কার করেছি, সে আমার ভাবী হলে আমার তো মান-সম্মানই থাকবে না। না, না, আমি মানি না এই সম্পর্ক।”

ইমনের ফোন বেজে উঠাই, সে কল রিসিভ করতে করতে ইশারায় তূর্যকে চলে যেতে বলল। তূর্যও উঠে চলে গেলো। মাওশিয়াত ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে বলল,
“ওই, তোমার কি সমস্যা? ফোন ধরছো না কেন?”

ইমন আমতা-আমতা করে বলল, “খেয়াল করি নি।”

“তোমার খেয়াল কোথায় থাকে? বাসায় আসতে বলেছিলাম, মনে নেই?”

“মনে আছে তো!”

“তো আসছো না কেন?”

“একটু পর বের হবো।”

“শুনো, আমি তোমাদের অপেক্ষায় বসে আছি৷ আমি কোথাও যাচ্ছি না আজকে। তোমরা সবাই আসবে, থাকবে, খেয়ে-দেয়ে তারপর রাতেই বাসায় ফিরবে। আমার কাজিনরাও আসবে। তাড়াতাড়ি আসো। আর শতাব্দীকেও আসতে বলেছি। তোমরা ওকে আসার সময় নিয়ে আসবে কিন্তু। ওকে ফেলে আসবে না। আর তাহমিদের জন্য বাবা গাড়ি পাঠাবে বলেছে। গাড়িটা ওতো বেশি বড় না। সামনে পেছনে তিনজনই বসতে পারবে। তোমরা যেকোনো দুইজন তাহমিদের সাথে চলে এসো৷”

“গাড়ি পাঠাতে হবে না…”

মাওশিয়াত ইমনকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“দেখো, আমার বাবার উপর কথা বলো না তো।”

ইমন চুপ করে রইল। মাওশিয়াত ‘বাই’ বলে কল কেটে দিলো।

৫৮.

তূর্য তাদের পুরোনো মহল্লার গলিতে রিক্সা দাঁড় করিয়ে শতাব্দীকে মেসেজ করলো। শতাব্দী মেসেজ দেখে বেরিয়ে এলো। তূর্য শতাব্দীকে দেখে রিক্সা থেকে নেমে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। শতাব্দী হেসে বলল,
“এভাবে তাকিয়ে থেকো না। চলো।”

তূর্য বলল,
“আমার এই অবস্থা, তাহমিদ তো হুইলচেয়ার থেকেই পড়ে যাবে।”

শতাব্দী লাজুক হেসে রিক্সায় উঠে বসল। আর বললো,
“তুমি কি এখন উঠবে?”

তূর্যও এবার উঠে বসলো। আর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“তুমি তো আমার টুইংকেলকেও অনেক কিছু শেখাচ্ছো!”

“হ্যাঁ, ও শিখতে চাইলো। আর আমারও এমন ভিডিও বানানোর ইচ্ছে ছিল। তাই ভিডিও করেই ওকে পাঠিয়ে দিলাম।”

এদিকে আহনাফ তূর্যের মেসেজ দেখে বলল,
“ওরা বের হয়েছে। আমরাও তাহলে বেরিয়ে পড়ি।”

আরাফ বলল,
“আমার একটা জায়গায় যেতে হবে। তোরা যা, আমি পরে আসবো।”

“কোথায় যাবি?”

“একটা বন্ধুর বাসায় যাবো।”

আরাফ চলে যাওয়ার পর তাহমিদ, ইভান আর ইমন গাড়িতে উঠলো। আহনাফ অরুণিকাকে নিয়ে রিকশায় উঠে পড়লো৷ রিকশায় উঠার পর থেকেই অরুণিকার বকবকানি শুরু হয়ে গেলো। আর আহনাফ মনোযোগ দিয়ে সেই কথাগুলো শুনছে। মাওশিয়াতের বাসার কাছে আসতেই অরুণিকা রিকশা থেকে নামার জন্য আহনাফের দিকে হাত এগিয়ে দিলো। আহনাফ সেকেন্ড খানিক সেই হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর তার হাতটিও এগিয়ে দিলো। অরুণিকার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিতেই তার মনে পড়ে গেলো, সেই গ্রীষ্মের দিনটির কথা।

সেদিন আহনাফের খুব জ্বর ছিল। সে স্কুলে যেতে পারে নি। তাই দুপুর পর্যন্ত ঘুমাচ্ছিলো। তার মা-চাচীরা রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কারণ দুপুরে মৈত্রী গ্রুপের একজন ইনভেস্টর তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বাইরের দেশ থেকে আসবেন। তারা দুপুরে বাসায় এসে খাওয়া-দাওয়া করবেন। তাদের জন্যই বাসায় তোড়জোড় চলছিল। সেই মুহূর্তে অরুণিকাকে দেখার জন্য কেউই ছিল না। তাই আহনাফের মা অরুণিকাকে ছেলের পাশে শুইয়ে দিয়ে বললেন,
“আহু, বাবা। অরুকে তোর পাশে রেখে গেলাম। দেখিস ওকে। আমার কাজ আছে। তোর চাচীরাও ব্যস্ত। বুঝেছিস, বাবা?”

আহনাফ অরুণিকার দিকে এক নজর তাকিয়ে দেখলো, সে চোখ পিটপিটিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ তাকে দেখেই বালিশটা মাথার উপর দিয়ে পা ধাপিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“পারবো না আমি।”

মিসেস আনিস চৌধুরী, ছেলের কথায় পাত্তা না দিয়েই চলে গেলেন।
অরুণিকার বয়স তখন মাত্র কয়েক মাস চলছিল৷ সে নিজের হাত-পা নিয়েই খেলছিলো। আর আহনাফ নড়াচড়া করে উঠলেই আহনাফের দিকে বার-বার তাকাচ্ছিল। আহনাফ হঠাৎ তার উঁ উঁ শব্দ শুনে মাথা তুলে তার দিকে তাকালো। অরুণিকা তাকে দেখেই হেসে দিলো। আহনাফ জোর করেই তার মুখটা বন্ধ করে দিল। ব্যস একটু পর অরুণিকা ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠলো। পাশে শুয়ে আহনাফ বলল,
“আরো, জোরে জোরে কাঁদো। তারপরই তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে। নয়তো আমি তোমাকে আরো কাঁদাবো।”

অরুণিকা কি বুঝলো কে জানে, কিন্তু আহনাফের কন্ঠ শুনে সে কান্না থামিয়ে দিলো। পাশ ফিরে আহনাফের দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে রইল। আহনাফ তার দিকে ফিরে হাতটা পাশেই রাখলো। অরুণিকা হাতটার মধ্যে কি দেখলো, সে-ই জানে, উলটো হয়ে সে হাতটির দিকেই তাকিয়ে রইলো। আহনাফ অরুণিকার চোখ অনুসরণ করে তার হাতের দিকে তাকালো। আহনাফ হাত উঠিয়ে বলল,
“কি দেখছ, আমার হাতে?”

অরুণিকা হাতটি তার নাগালে পেয়েই ধরে ফেললো। আহনাফও বাঁধা দিলো না। অরুণিকা হাতটি মুখের কাছে এনে তার মুখে ঢুকিয়ে দেওয়ার আগেই, এক ঝটকায় আহনাফ হাত সরিয়ে নিলো। আর অরুণিকা ভয়ে কেঁপে উঠল। তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো। আহনাফ এবার বিরক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। মিসেস জুবাইয়ের আর দাদী অরুণিকার কান্নার শব্দ শুনে রুমে চলে এলেন। দাদী আহনাফকে ধমক দিতেই সে চেঁচিয়ে বলল,
“ও আমাকে বিরক্ত করছে। আমি ওকে কাঁদায় নি। ও আমার হাতে কামড় দিতে চাইছিল।”

দাদী বললেন,
“আহু, ওর দাঁত উঠেছে এখনো?”

মিসেস জুবাইয়ের শাশুড়ীকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“মা, আহনাফেরও তো জ্বর উঠেছে। ওর তো বিশ্রাম দরকার৷ সেজো অরুকে এখানে না রেখে গেলেই পারতো। মা, আপনিই ওকে দেখেন। আমি রান্নাঘরে গেলাম।”

দাদী অরুণিকাকে কোলে নিয়ে আহনাফকে বললেন,
“আহু, দাদুভাই, তুমি অরুকে কাঁদাও কেন?”

আহনাফ মুখ ফুলিয়ে বলল,
“আমার ওকে ভালো লাগে না।”

দাদী দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন। আহনাফ চুপচাপ বিছানায় বসে রইলো। আর ভাবতে লাগল, অরুণিকা হওয়ার পর থেকেই সে সবার বকা খেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আরাফকে তো কেউই বকছে না। সে না হয় একটা ভুল করে ফেলেছিল, তাই বাবা তাকে অরুণিকার জন্য সবার সামনে বকবে?

আহনাফের ছোটবেলার অভ্যাস, সে কোনো জিনিস হাতে পেলেই তার স্ক্রু খুলে ফেলে। অরুণিকার জন্য একটা দোলনা তৈরী করেছিলেন অরুণিকার বাবা, জুবাইয়ের চৌধুরী। আহনাফ সেই দোলনার স্ক্রু খুলে ফেলেছিল। আর কাউকে জানায়ও নি। তারপর যখন অরুণিকাকে সেখানে শুইয়ে দেওয়া হলো, এর কিছুক্ষণ পরই দোলনটা খুলে নিচে পড়ে গেলো। ভাগ্যিস দোলনার নিচেও একটা স্ট্যান্ড ছিল, যেখানে একটা বেড বসানো ছিল। আর অরুণিকা সেই বেডের উপর পড়ায় ব্যথা পায় নি। কিন্তু ভয় পেয়ে অনেক কান্নাকাটি করেছিল। বাসার সবাই তার কান্না দেখে বুঝতেই পারছিলো না, সে ব্যথা পেয়েছে, নাকি ভয় পেয়েছে। এরপর ডাক্তার দেখে যাওয়ার পর সবাই নিশ্চিন্ত হলো। আর তারপরই দোলনায় স্ক্রু নেই দেখে আনিস চৌধুরী আহনাফকে সবার সামনে বকা দিলেন। এরপর থেকেই সে অরুণিকাকে পছন্দ করে না। আর অরুণিকাকে অপছন্দ করার আরেকটা বিশেষ কারণ আছে।

অরুণিকা আহনাফের হাত ছেড়ে দিতেই আহনাফ অতীতের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এলো। এরপর মাওশিয়াতের বাসায় ঢুকতেই মাওশিয়াত তাদের ড্রয়িংরুমে বসালো।

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here