অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||বোনাস পর্ব-০২||

0
1214

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব-০২||

৬২.
উপমা ফোন হাতে নিয়ে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। পাশেই তার ভাই আদিল দাঁড়িয়ে আছে। বোনকে লাফাতে দেখে সে বলল,
“এভাবে ক্যাঙ্গারুর মতো লাফাচ্ছিস কেন?”

“ভাইয়া, রিকি নতুন গান ছেড়েছে। ওয়াও।”

উপমা হেডফোন লাগিয়ে ফোনের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। আদিল বোনের দিকে রাগী দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেলো। ভিডিওটা একটা কটেজের সামনে করা হয়েছে। সামনে একটা উঁচু ঢিপিতে পা রেখে গিটার হাতে নিয়ে রিকি দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনের ঢালু বেয়ে নেমে গেছে ছোট ছোট ঘাসের সারি। নিচে আরো কটেজ দেখা যাচ্ছে, আর মুখোমুখিতে অনেকগুলো পাহাড়। সব পাহাড়ের গায়ে লেগে আছে সাদা সাদা মেঘ। ভিডিওটা পেছন দিক থেকে করা হয়েছে। আর রিকি গিটার বাজিয়ে তিনটা গানের মিশ্রণে ভিডিওটি বানিয়েছে। উপমা চোখ বন্ধ করেই সেই গান শুনছে।

“ইয়ে দোস্তি…হাম নাহি তোরেঙ্গে,
তোরেঙ্গে দাম আগার, তেরা সাথ না ছোড়েঙ্গে
.
ধারকান ইয়ে কেহতি হে,
দিল তেরে বিন ধারকে না,
এক তুহি ইয়ার মেরা
মুঝকো কিয়া দুনিয়া সে লেনা….
.
উড়ি একসাথে নীলে নীলে,
উড়ি একসাথে মিলে ঝিলে।
চল বন্ধু চল, চল বন্ধু চল, চল বন্ধু… চল।
.
তেরি জিত মেরি জিত,
তেরি হার মেরি হার
শুন ইয়ে মেরা ইয়ার
তেরা গাম মেরা গাম
তেরি জান মেরি জান
এইসে আপনা পিয়ার
জান পে ভি খেলেঙ্গে
তেরা লিয়ে লে লেঙ্গে
সাবসে দুশমানি
ও…
.
উড়ি একসাথে নীলে নীলে,
উড়ি একসাথে মিলে ঝিলে।
চল বন্ধু চল, চল বন্ধু চল, চল বন্ধু… চল।
.
লাগলে বলিস,
জায়গায় বসে আওয়াজ দিস।
কলিজাটা ছিঁড়ে তোকে দেবো
লবণ মাখিয়ে নিস।
একা লাগলে বলিস,
মনে মনে আমার নামটা নিস,
তোর মুড অন করে দেবো,
একটা ট্রিট দিয়ে দিস।
উড়ি একসাথে নীলে নীলে,
উড়ি একসাথে মিলে ঝিলে।
চল বন্ধু চল, চল বন্ধু চল, চল বন্ধু… চল।”

ভিডিওটা শেষ হওয়ার পর উপমা একটা প্রশান্তির হাসি হাসলো। মনে মনে বলল,
“যার কন্ঠ এতো মিষ্টি, সে দেখতে কেমন হবে? তার মনটা কেমন হবে? রিকি, দা স্টার… না, না, মাই স্টার। আমি তোমাকে না দেখেই ভালোবেসে ফেলেছি। এটা কি সম্ভব? কাউকে কি না দেখে ভালোবাসা যায়?”

এদিকে তূর্য পেছন ফিরে তার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো। আহনাফ এতোক্ষণ বসে বসে তার ভিডিও শুট করছিল। তূর্য আরাফ আর ইমনের মাঝখানে বসে বলল,
“শুনেছি বন্ধুরা পরিবারের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কখনোই হয় না। কিন্তু আমরা পরিবার হারিয়ে যেই পরিবার পেয়েছি, সেটা আমাদের বন্ধুত্ব থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। আমরা ছোটবেলা থেকেই বন্ধু। কিন্তু পরিবারের মতো আছি আজ আট বছর ধরে। অতীতে যা হয়েছিল, সব ভুলে আমাদের একটা নতুন জীবন শুরু করা উচিত। প্লিজ, আগের সবকিছু ভুলে যা।”

তূর্যের কথা শুনেও আরাফের কোনো হেলদোল দেখলো না ইমন। এখনো আরাফ চুপ করে বসে আছে। এবার ইমন শুকনো হাসি দিয়ে পকেট থেকে একটা সিগারেটের পকেট বের করলো। তারপর ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট রেখে বলল,
“পাপীদের সাথে কোনো বন্ধুত্ব হয় না। আমি তো পাপী। আমি তো খুনী।”

আরাফ রাগী দৃষ্টিতে ইমনের দিকে তাকালো। ইমন সিগারেট জ্বালানোর আগেই সে সিগারেটটা টেনে নিয়ে বলল,
“এমন শান্তির পরিবেশটা কি দূষিত করবি?”

ইমন বলল,
“আমার একটা সিগারেটে এই পরিবেশ দূষিত হবে না।”

“এখানে অরু আছে। তোর জন্য অরুর সমস্যা হবে।”

অরুণিকা নিজের নাম শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাদের দিকে তাকালো। এতোক্ষণ সে অন্যদিকে তাকিয়ে মানুষের যাওয়া-আসা দেখছিল। এবার ইমন বলল,
“অরুণিকার এতো আহামরি ক্ষতি হবে না৷ ক্ষতি হলে আমি অন্য কোথাও চলে যাচ্ছি।”

ইমন উঠতে যাবে তখনই আরাফ বলে উঠলো,
“সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।”

“আমাকে তোর ডাক্তারি জ্ঞান দিতে আসিস না।”

তূর্য হাত উঁচু করে তাদের মাঝখান থেকে উঠে একপাশে এসে দাঁড়ালো। তাহমিদ তার পাশে এসে বলল,
“আগুনে ঘিঁ ঢেলে দিয়েছিস।”

“থাক, এই ঘিঁ যদি এখন পানিতে রূপান্তর হয়, তখনই আবার সব ঠিক হবে।”

অনেকক্ষণ ধরেই ইমন আর আরাফের বাকবিতণ্ডা চললো। এক পর্যায়ে দু’জনই শান্ত হয়ে দু’দিকে চলে গেলো। ইভান বলল,
“শতাব্দীকে আনলাম না, মাওশিয়াতকে আনতে পারবো না তাই। আরাফ আবার মাওশিয়াত আর ইমনকে দেখলে আরো মন খারাপ করে ফেলবে। কিন্তু শতাব্দী আসলে ভালোই লাগতো। মেয়েটা ভালোই রসিক।”

তূর্য বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,
“বাহ, ইভান দেখছি শতাব্দীকে খুবই মিস করছিস!”

তাহমিদ ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই ওকে মিস করছিস?”

আহনাফ, তূর্য আর ইভান তাহমিদের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে দিল। তাহমিদ বলল,
“তোরা হাসছিস কেন? অদ্ভুত তো!”

তাহমিদ উঠে একপাশে চলে গেলো। সে এখন হাঁটতে পারে। তবে বেশিক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলে তার হাঁটুতে ব্যথা করে, এমনকি সে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়েও থাকতে পারে না।

এদিকে উপমা রিকির সেই ভিডিওটির কমেন্ট বক্সে ঘুরে এলো। সবার কমেন্ট দেখে সে বুঝলো, রিকি দার্জিলিং থেকেই এই ভিডিওটি ছেড়েছে। সে শুধু রিকিকে একনজর দেখার জন্য দৌঁড়ে বাবার কাছে গিয়ে বলল,
“আমি দার্জিলিং যেতে চাই।”

উপমার কথা শুনে আদিল আর করিম সিদ্দিক অবাক হয়ে উপমাকে দেখছে। আদিল কি ভেবে তার ফোনটা হাতে নিলো। তারপর কিছুক্ষণ পর বলল,
“আচ্ছা, তা-ই?”

করিম সিদ্দিক বললেন, “কি তাই?”

আদিল বলল,
“তোমার মেয়ের সেই রিকি দা স্টার এখন দার্জিলিংয়ে।”

“তুই কিভাবে জানলি?”

“আরেহ, তোমার মেয়েই তো জোর করে আমাকে সেই রিকির পেইজ আর ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করিয়েছে। এখন সেই ছেলের সব আপডেট আমার ফোনেও আসে।”

মিসেস জুলেখা নাক সিঁটকে বললেন,
“রিকি! কেমন জঙ্গলি নাম! নাম শুনেই মনে হচ্ছে কোনো বখাটে ছেলে।”

উপমা রাগ দেখিয়ে বলল,
“মা, রকস্টারদের নাম এমনই হয়।”

এবার উপমার জোরাজুরিতে মিসেস জুলেখাও রাজি হতে বাধ্য হলেন। করিম সিদ্দিক আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। কারণ তিনি স্ত্রী-কন্যাকে আজকেই রাজি করিয়ে দার্জিলিং যাওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতেন। কিন্তু এখন উপমা নিজ থেকেই রাজি হয়ে গেছে, তাই তাকে আর কষ্ট করতে হয় নি। পরেরদিন উপমা তার বাবা-মা আর ভাইয়ের সাথে দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্য রওনা দিলো।

৬৩.

রাস্তার দু’পাশে নয়নাভিরাম সৌন্দর্য। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আছে এক একটা কাঠের তৈরী কটেজ। পাশাপাশি দুইটা রুমের একটা কটেজে তারা উঠলো। সামনের কটেজে তাহমিদ, তূর্য আর ইভান। এর পাশের কটেজে আরাফ আর অরুণিকা। দূরের আরেকটা কটেজে ইমন আর আহনাফ উঠেছে। তারা সকালে নাস্তা করেই পাহাড়ের রাস্তা বেয়ে চা বাগানের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগল। একপাশে ঢালু রাস্তা নিচে নেমে চমৎকার দৃশ্য তৈরি করেছে, অন্যপাশে সবুজ ঘাসে ছেয়ে থাকা ছোট ছোট টিলার মতো উঁচু রাস্তাগুলো সরু হাঁটার পথটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। অরুণিকা আহনাফের টি-শার্টের কোণা ধরে পাহাড়ের নিচের দিকে পা উঁচিয়ে দেখছে। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তুমি আমার টি-শার্টটা নষ্ট করে ফেলছো। এভাবে ভাঁজ করে ফেলছো কেন? ছাড়ো তো।”

অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে আরো শক্ত করে টি-শার্টটা আঁকড়ে ধরলো। টি-শার্টের অনেকখানি অংশ অরুণিকার হাতের মুঠোয় চলে আসায়, আহনাফের টি-শার্টের গলাটা নিচের দিকে নেমে গেছে। যার ফলে তার অনেক অস্বস্তি লাগছিল। সে অরুণিকার হাতের মুঠো থেকে তার টি-শার্টের অংশটি ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে শান্তিতে হাঁটতে দাও।”

অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে সামনে গিয়ে তূর্যের শার্ট খামচে ধরে বলল,
“রকস্টার, আমার ভয় লাগছে। আমি তোমার শার্ট ধরে রাখি?”

তূর্য মুচকি হেসে বললো, “আচ্ছা।”

অরুণিকা মুচকি হেসে পেছনে ফিরলো। আহনাফ ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। অরুণিকা আহনাফের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে সামনে ফিরলো। আহনাফ তাদের পাশ কেটে আরো সামনে এগিয়ে গেলো।

এদিকে উপমা তার পরিবারের সাথে ভারতে চলে এসেছে। করিম সিদ্দিক ট্রেনের টিকেট কেটে নিলেন। এরপর তারা ট্রেনে উঠে বসলো। ট্রেনটি শুকনো বনের ভেতরে দিয়ে যাচ্ছে। ট্রেনের গতি সাধারণ গতির তুলনায় কম। আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে ট্রেনটি যাচ্ছে। উপমা জানালার বাইরে তাকিয়ে রিকির ভাবনায় ব্যস্ত। প্রতিটা রাস্তা পার করতেই তার মন তাকে বলছে,
“এই রাস্তা দিয়েই হয়তো রিকি এসেছে। এই রাস্তাটা রিকির পরিচয়ের সাক্ষী হয়ে আছে। এই পথ, তুমি কি আমার সাথে একটু কথা বলবে? তুমি কি বলবে রিকি দেখতে কেমন? ও যখন গানের ফাঁকে হাসে, তখন ওর হাসিটা কল্পনায় আমার কাছে স্বপ্নে দেখা ঝর্ণার মতো, একদম চঞ্চল, আর দুর্লভ। ও বাস্তবেও কি ঠিক আমার স্বপ্নের মতোই হাসে?”

উপমা এসব ভাবছে, আর আনমনে হাসছে। আদিল বোনকে ধাক্কা দিতেই উপমা নড়েচড়ে বসলো। আদিল বলল,
“একা একা হাসছিস কেন? মাথা কি আউট হয়ে গেছে?”

উপমা হেসে বলল,
“হ্যাঁ। জানো, আমার ভাবতেই অনেক ভালো লাগছে যে আমি রিকিকে দেখবো।”

“এতোগুলো মানুষের মধ্যে তুই রিকিকে কিভাবে চিনবি? তুই তো ওর চেহারায় দেখিস নি।”

“ভাইয়া, মাঝে মাঝে তো একটু বুদ্ধিমানের মতো কথা বলো। রিকি একজন স্টার৷ ওর মধ্যে আলাদা একটা ভাব থাকবে। হাতে গিটার থাকবে। আশেপাশে ভীড় থাকবে।”

“ওকে তো কেউই দেখে নি। ভীড় কেন থাকবে?”

“আমার মনে হচ্ছে ভীড় থাকবে। স্টাররা এমনই হয়। কেউ না চিনলেও সবার কাছে পরিচিতি পায়।”

আদিল বোনের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যদিকে তাকালো। দার্জিলিং পৌঁছে তারা একটা রিসোর্টে উঠল। তূর্যরা যেই রিসোর্টে উঠেছিল, সেটা ওতো বেশি উন্নতমানের না। আর উপমারা এখানকার সবচেয়ে উন্নত রিসোর্টেই উঠেছে।

রাতে কটেজের বাইরে বসে দাঁড়িয়ে গান গাইছে তূর্য। ঘুমানোর আগে সেই গানটিও পেইজে আপলোড করেছে সে। উপমা রুমে শুয়ে শুয়ে সেই গানটি শুনছে। গান শুনার পর সে কমেন্টে লিখল,
“তোমাকে দেখার ইচ্ছেটা কি স্বপ্নই থেকে যাবে?”

এদিকে আহনাফ বসে বসে তূর্যের পেইজের কমেন্ট পড়ে সবাইকে শুনাচ্ছে। তাহমিদ এসব কমেন্টগুলো শুনে বলল,
“শুনেছি, ছেলেরাই মেয়েদের পিছনে ঘুরতে থাকে। কিন্তু মেয়েরাও যে কম না, আজ এই কমেন্টগুলো দেখেই বুঝেছি।”

ইভান বলল,
“সবকটাই ছ্যাঁচোর। ভদ্র মেয়েরা এমন উদ্ভট কমেন্ট করবে না।”

তূর্য বাঁকা চোখে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর তো মন বলতে কিছুই নেই। তাই তোর এসব উদ্ভট লাগছে। এগুলোকে বলে ভালোবাসা। দেখ, রিকি দা স্টারকে ভালোবাসে না এমন মেয়ে খুঁজে পাবি না। তোকে ক’জন বাসে?”

“আমার এতো ভালোবাসার প্রয়োজন নেই।”

পরের দিন সকালে তারা আবার ঘুরতে বেরিয়ে পড়লো। তারা ক্যাবল কারে উঠলো, যা মাটি থেকে প্রায় সাত হাজার ফুট উঁচুতে। ক্যাবল কারটি মেঘের ভীড়ে চলছে। অরুণিকা উৎসুক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। আর আহনাফ অবাক হয়ে অরুণিকাকে দেখছে। তার চাহনী দেখে আরাফ তাকে হালকা ধাক্কা দিতেই সে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। আরাফ ইশারায় তাকে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে বলল। ক্যাবল কার থেকে নেমে আরাফ আহনাফকে একপাশে নিয়ে গিয়ে বলল,
“আহু, কি করছিলি তুই?”

আহনাফ আমতা-আমতা করে বলল,
“কি করছিলাম আমি?”

“তোর চোখ-মুখ দেখে সব বোঝা যাচ্ছে। অরু থেকে একটু দূরত্ব রাখার চেষ্টা কর।”

“কেন দূরত্ব রাখবো? তুই তো জানিস….”

আরাফ আহনাফকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“ওর প্রেম করার বয়স হয় নি। ও এখন সব বুঝে। দেখিস না ইমন আর মাওশিয়াতকে একসাথে দেখলে কিভাবে হাসে। আর শতাব্দীও বাসায় আসলে ও তাহমিদকে শতাব্দীর সাথে ব্যস্ত রাখার ফন্দি আঁটে। এখন তোরটা বুঝলে তুই ঘরে থাকতে পারবি?”

“ঘরে থাকতে পারবো না কেন?”

“অস্বাভাবিক লাগবে দেখতে৷ বুঝিস না কেন এসব?”

“তো, তুই কি বলতে চাচ্ছিস? আমি ওকে ভুলে যাবো?”

“না আহনাফ। আগে ওর আঠারো হোক। এরপর আমি তোদের বিয়ে দিয়ে দেবো৷ এখন বাকিরাও এসব জানে না। ইভান হয়তো একটু আধটু বুঝে। কিন্তু ও নিজেও এটা নিয়ে কথা উঠাচ্ছে না। কেন বুঝতে পারছিস নি?”

“কেন?”

“দেখ, এখন ইমন আর মাওশিয়াত একটা সম্পর্কে আছে। কিন্তু তারা আলাদা বাসায় থাকছে। তাই বিষয়টা দেখতে ওতোটা খারাপ লাগছে না। আর তুই এখন আগাতে চাইলে এক ঘরে থাকলে সুন্দর দেখাবে না৷ সারাদিন তখন একসাথে সময় কাটাবি। তখন কোনো কিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ হারালে, এসব আমরা নিতে পারবো না। ও আগে বড় হোক। এরপর একেবারে বিয়েই হবে। এর আগে কিছুই না।”

আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“ওতো আমাকে পছন্দ করে না।”

আরাফ এবার জোর গলায় বলল,
“ওর এখন এসবের বয়স হয় নি। বারো বছরের মেয়ের সাথে কি প্রেম করবি তুই? মাথা ঠিক আছে তোর?”

আরাফের ধমক খেয়ে আহনাফ চুপ হয়ে গেলো। বাকি সময়টা সে অরুণিকার আশেপাশেও যায় নি। দূর থেকেই তাকে দেখেছে।

এবার তারা চুন্নু সামার ফল পার্কে টিকেট কেটে ঢুকলো। তারা ঢোকার একটু পরই আদিল চারটা টিকেট কাটলো। করিম সিদ্দিক তার স্ত্রী জুলেখার হাত ধরে একপাশে হাঁটছেন। আদিল ক্যামেরা হাতে আশেপাশের ভিডিও ধারণ করছে। আর উপমা এখনো কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনায় ব্যস্ত। সে গান শুনে শুনে হাঁটছে।
এদিকে তূর্য ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ঝর্ণার পানি উপর থেকে বেয়ে পাথরের ফাঁক দিয়ে ধেয়ে চলছে। আর পাথরের সাথে ধাক্কা খেয়ে সেই পানি ধারার চমৎকার ধ্বনি সৃষ্টি হচ্ছে। তূর্য মনে মনে ভাবছে, গিটার সাথে থাকলে এখানে বসে একটা ভিডিও শুট করা যেতো। তখনই একটা শব্দ কানে আসতেই সে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলো, ভেজা রাস্তায় পা ফেলতে গিয়ে একটা মেয়ে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেছে। মেয়েটার ব্যথায় কাতর মুখ দেখে কেন যেন তূর্যের অনেক হাসি পেলো। যদিও সে এতোক্ষণ হাসি নিয়ন্ত্রণ কর‍তে চাইছিল, কিন্তু মেয়েটি তার দিকে তাকানোর পরই সে শব্দ করে হেসে দিলো। মেয়েটি তূর্যকে হাসতে দেখে লজ্জায় একেবারে নুইয়ে পড়েছে। সে আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে খুঁজতে লাগলো। তখনই একটা ছেলে দৌঁড়ে এগিয়ে এলো।

উপমা আদিলের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো। আদিল ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“ব্যথা পেয়েছিস?”

উপমা কিছু বললো না। সে আঁড়চোখে তার সামনে থাকা ছেলেটির দিকে তাকালো। মনে মনে বলল,
“কি অসভ্য ছেলে! একটা মেয়ে দুর্ঘটনাবশত নিচে পড়ে গেছে, আর সে দাঁত দেখিয়ে হাসছে?”

উপমা নিজের ভাব ধরে রাখার জন্য ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে জোর গলায় বলল,
“আপনার তো দেখছি বিন্দুমাত্র বিবেক নেই। রাস্তায় চলার পথে কতো এক্সিডেন্ট হয়। তখন কি আপনি এভাবে খিকখিক করে হাসেন?”

উপমার কথা শুনে তূর্যের এবার আরো বেশি হাসি পেলো। সে নিজের হাসি আটকাতে অন্যদিকে ঘুরে হাঁটতে লাগল। উপমা পিছু যাবে তখনই আদিল বলল,
“বাদ দে না। পাগল নাকি তুই? ছেলেটা হাসলে তোর সমস্যা কি?”

“ভাইয়া ওই বদমাশটা আমাকে দেখে হাসছিল।”

আদিল উপমাকে শান্ত করে তার সাথে নিয়েই হাঁটতে লাগলো। এদিকে তূর্য হাসি থামিয়ে পেছন ফিরে উপমাকে খুঁজতে লাগলো। ইভান তার সামনে এসে বলল,
“কাকে খুঁজছিস?”

“একটা আপন মানুষকে খুঁজছি।”

“মানে?”

“একটা মেয়েকে খুঁজছি। কথাবার্তার ধরণ দেখে মনে হলো আমাদের দেশের। কতো বছর পর বাংলাদেশী কন্ঠ শুনেছি!”

“কেন আমাদের কন্ঠ কি বিদেশী নাকি!”

“তা না। কিন্তু মেয়েলী কন্ঠ আট বছর পর শুনেছি৷ আর টুইংকেল তো রিমিক্স ভাষায় কথা বলে। সেই ভাষায় না আছে পুরোপুরি কলকাতার এক্সেন্ট, না আছে চট্টগ্রামের স্পর্শ। ওর কথাবার্তা শুনলে একেবারে জগাখিচুরি মনে হয়।”

ইভান হেসে বলল,
“ওর এই জগাখিচুরি ভাষাটার জন্যই ওর কথাগুলোর মধ্যে আলাদা মাধুর্য আছে। নয়তো ও যা ক্লু লেস কথা বলে, কেউ এক সেকেন্ডও শুনতে চাইবে না!”

তূর্য আরেকবার পেছন ফিরে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠলো,
“মেয়েটা আমাদের চট্টগ্রামের মেয়ে!”

তূর্য পুরো পার্কে শুধু উপমাকেই খুঁজেছে। সে ভাবছে, দেখা হলে হাসার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেবে৷ কিন্তু সে আর উপমাকে পেলো না।

চলবে—

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here