অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৩৯||

0
1111

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৯||

৬৭.
উপমা ফোন হাতে নিয়ে ইন্সটাগ্রামে ঢুকতেই লাফাতে লাগলো। আদিল বোনের পাগলামো দেখে একপাশে বসে বলল,
“আবার কি হলো!”

উপমা আনন্দে কথা বলতে পারছিলো না। আদিল বলল,
“মানে তোকে দেখলে মনে হবে বাচ্চা শিশু। আমি বুঝি না, তোর মধ্যে ম্যাচুরিটি কখন আসবে!”

উপমা বলল,
“আপতত এসব ভাবগম্ভীর কথাবার্তা একপাশে রাখো। আর তোমার বোনের বিয়ের ব্যবস্থা করো।”

“বিয়ে! কার সাথে?”

“রিকির সাথে।”

আদিল বিরক্ত হয়ে ব্যাগ গোছাতে লাগলো। উপমা মোবাইলে একটার পর একটা চুমু খেতে লাগলো। আদিল বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোকে পাবনা পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। মোবাইল নিয়ে কখনো চুমাচুমি করিস, আবার কখনো কামড়াকামড়ি।”

উপমা বিছানায় উঠে লাফাতে লাফাতে বলল,
“ভাইয়া, এখন আমার লাফাতে ইচ্ছে করছে, আবার উড়তেও ইচ্ছে করছে। আসলে আমি নিজেই জানি না আমি এখন কি করবো।”

আদিল হাঁ করে উপমার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার উপমা যে সত্যিই তার ভারসাম্য হারিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আদিল চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“মেয়েটা কি সত্যিই পাগল হয়ে গেল নাকি?”

উপমা আনন্দিত কন্ঠে বলল,
“ভাইয়া, রিকি আমার মেসেজের রিপ্লাই দিয়েছে। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। দেখো, কি লিখেছে!”

আদিল চোখ ঘুরিয়ে বাঁকা চোখে উপমার দিকে তাকালো আর বলল,
“কি লিখেছে?”

“লিখেছে, চমৎকার ছবি। তুমি খুব সুন্দর।”

আদিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
“এই রুমে বড়জোর দুই মিনিট বেশি থাকলে আমিও পাগল হয়ে যাবো।”

উপমা ভাইয়ের কথায় তোয়াক্কা না করে, মেসেজের উত্তর দিলো,
“ধন্যবাদ, মাই স্টার।”

এদিকে তূর্য উপমার উত্তর দেখে মনে মনে হাসলো। তবে সে আর কিছু লিখলো না। তাকে এখন থেকে চিন্তাভাবনা করেই উত্তর দিতে হবে। কারণ সে এখন আর তূর্য নেই, রিকি হয়েই উপমার সাথে কথা বলছে। অন্যদিকে তূর্য এও জানে সে কিছু লিখুক বা না লিখুক উপমা এখন থেকে প্রতিদিন একটা করে মেসেজ তাকে দেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যেখানে উপমা একটুখানি সাড়া পেয়েছে, সেখানে আর থেমে থাকার কোনো অর্থই হয় না।

আরো তিনদিন পর তারা দার্জিলিং থেকে কলকাতায় এসে পৌঁছালো। বাসায় পৌঁছেই ইমন মাওশিয়াতকে কল করলো। মাওশিয়াতও দেরী না করে শতাব্দীর ব্যাপারে ইমনকে সবটা জানিয়ে দিলো। সব শুনে ইমন জিজ্ঞেস করলো,
“ওরা কি এখনো শতাব্দীকে দেখেছে?”

“না, কিন্তু আজ তাদের বাসায় নেমন্তন্ন করেছে শুনলাম। ছেলের বাড়ির লোকেরা নাকি যাবে।”

ইমন বিষয়টা তাহমিদকে জানাতেই সে থমকে গেলো। তাহমিদ এমন কিছু শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইভান তার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,
“তুই কি শতাব্দীকে ভালোবাসিস?”

তাহমিদ কিছু বলার আগেই তূর্য বলে উঠলো,
“কেন ভালোবাসতে যাবে শুধু শুধু। দার্জিলিংয়ে তো ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ও তো বললো ভালোবাসে না।”

ইমন তূর্যের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। তূর্য এবার অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
“সময় থাকতে ভালোবাসা বোঝা উচিত৷ নয়তো ইমনের মতোই ঝামেলায় পড়তে হবে।”

তাহমিদের চোখ দু’টি মেঝেতেই স্থির হয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে, বুকে আর পিঠে একটা বড় পাথর চেপে বসেছে। আর মনের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এদিকে সবাই তাহমিদের উত্তরের আশায় তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে ক্ষীণ কন্ঠে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ, আমি ভালোবাসি না ওকে। এটা তো সম্ভব না। আমি তো ওকে নিয়ে কখনো ওভাবে ভাবি নি।”

কথাটি বলতে বলতেই সে ধীর পায়ে নিজের রুমে চলে গেলো। আরাফ তাহমিদের যাওয়ার পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এখন কি আরেকটা মনের মৃত্যু ঘটবে? সায়ন্তনীকে হারিয়ে আরাফ তো নির্জীব হয়েই গেছে। তাহমিদও কি এবার ওর মতোই নিষ্প্রাণ হয়ে যাবে? তূর্য আর ইভান নিজেদের রুমে চলে গেলো। ইমন আরাফের কাছে এসে বলল,
“তাহমিদ যতোই না বলুক, আমি জানি ও শতাব্দীকে ভালোবাসে।”

আহনাফ চুপ করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে, সব মেয়ে মানুষই রহস্যের বাণ। যেই বাণ কখনো হয় রক্ষক, কখনো হয় ভক্ষক। একদিকে অরুণিকা তাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা, তাদের মানসিক শক্তি, অন্যদিকে তাদের জীবনে আসা অন্য মেয়েগুলো তাদের একের পর এক ক্ষত দিয়ে যাচ্ছে আর মানসিক ভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে। কিন্তু এসব অনুভূতির উপর তো কারো হাত নেই। মানুষের আত্মার সাথে যেহেতু মন সংশ্লিষ্ট, তাহলে এই মন মেয়েলোকের মরীচিকা সৃষ্টি করবেই। কেউ হয়ত সেই মরীচিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে তার মনকে জয় করবে, আর কেউ হয়তো হেরে নির্জীব হয়ে পড়বে।

আহনাফ রুমে এসে তাহমিদের পাশে বসলো। তাহমিদ চুপচাপ বসে আছে। আহনাফ বলল,
“কেউ আর এই ব্যাপারে ঘাঁটাঘাঁটি করবে না। কারণ এর আগেও এমন ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে ভুল মানুষকে বেছে নেওয়ার উদাহরণ হিসেবে আমিই আছি। কিন্তু সবাই ভুল মানুষ হয় না। তাই নিজের মনকে জিজ্ঞেস করতে হয়, ভুল মানুষ কে।”

তাহমিদ বলল,
“ও ভুল মানুষ না। ও শুধু আমার জন্যই ভুল। যেমন গোলাপ ফুল অনেক সুন্দর। কিন্তু তার গায়ে অনেক কাঁটা। তেমনি শতাব্দীও সেই গোলাপের মতোই। সে তার জায়গায় চমৎকার, অতুলনীয়। কিন্তু তাকে ধরতে গেলেই বাঁধা। ফুল গাছে থাকলেই সতেজ, আর ছিঁড়ে ফেললে মূর্ছে যাবে। শতাব্দীকেও আমাদের পরিবেশে আনলে ওর বিশেষত্ব হারিয়ে যাবে।”

“কিন্তু ইমন কি বলেছে শুনিস নি?”

“কি বলেছে?”

“ও তোকে ভালোবাসে।”

তাহমিদের বুকটা কেঁপে উঠল। ধরা গলায় বলল,
“ভালোবাসে, ভালো কথা। সব ভালোবাসা যে ভালো ঘর বাঁধবে, এমন তো হয় না। ও না হয়, অন্য ঘর বাঁধুক। ভালোবাসাগুলো মনেই জমিয়ে রাখুক।”

আহনাফ আর কিছু বলতে পারলো না। সে তাহমিদকে একা ছেড়ে দিলো। পরের দিন বিকেলে শতাব্দী বাসায় এলো। তখন বাসায় সবাই উপস্থিত ছিল। ইমন তাহমিদ আর শতাব্দীকে মুখোমুখি বসিয়ে দিয়ে বলল,
“যা বলার সামনাসামনি বলে ফেলা উচিত। আমরা ভেতরে যাচ্ছি।”

এই বলে ইমনসহ সবাই অন্য রুমে চলে গেলো। অরুণিকা দরজার ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে তাহমিদ আর শতাব্দীকে দেখছে। আহনাফ তার মাথায় ঠোকা দিয়ে বলল,
“এভাবে চোরের মতো কি দেখছো?”

অরুণিকা চোর শব্দটা শুনে ক্ষেপে গেলো। কোমড়ে দুই হাত রেখে বলল,
“কি বললে তুমি? আমি চোর?”

“হ্যাঁ, চোরের মতো উঁকিঝুঁকি মারছো! মনে তো হচ্ছে চোর।”

অরুণিকা আহনাফের দিকে তেড়ে এলো। আহনাফ সরে আসার আগেই অরুণিকা তার বড় বড় নখগুলো দিয়ে আহনাফের হাত খামচে ধরলো। আহনাফ ব্যথায় চেঁচিয়ে বলল,
“অরু, আমার হাত ছাড়ো। বদমাশ, ফাজিল, পেত্নী!”

আরাফ অরুণিকার সামনে এসে দাঁড়াতেই সে আহনাফকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ও আমাকে পেত্নী ডেকেছে।”

আরাফ বলল,
“পেত্নীর মতো নখ বড় করেছো কেন?”

আহনাফ হাতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
“আরাফ, ওর নখগুলো সব এখনই কাটা। নয়তো আমি সব একেবারে উপড়ে ফেলবো।”

অরুণিকা হাত পেছনে নিয়ে বলল,
“না, আমি নখ কাটবো না। সবাই নখ বড় করে। নখ বড় করলেই তো সুন্দর লাগে।”

আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“পেত্নী লাগে পেত্নী!”

“তুমি চুপ করো।”

“তুমি আমাকে চুপ করতে বলছো? আমার হাত খামচে দিয়ে আমার সাথে গলা বাজি করছো?”

আরাফ এবার গলার স্বর উঁচু করে বলল,
“আল্লাহর ওয়াস্তে তোরা চুপ হবি?”

অরুণিকা আহনাফের দিকে আঙ্গুল তুলে বলল,
“ও শুরু করেছে।”

আরাফ অরুণিকার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাতেই সে চুপ হয়ে গেলো। এবার আরাফ বলল,
“যাও এখনই নখ কেটে আসবে। নয়তো আমার সাথে আর কথা বলবে না।”

অরুণিকা গাল ফুলিয়ে আহনাফের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। আহনাফও চোখ ছোট করে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইলো। এবার অরুণিকা হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।

এদিকে তাহমিদ চুপচাপ বসে আছে। কিছুই বলছে না। শতাব্দী চুপ থাকতে না পেরে বলল,
“গতকাল ছেলে পক্ষ আমাকে দেখে গেছে।”

তাহমিদ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “হুম শুনেছি।”

“তুমি হয়তো এখন সব বুঝতে পারছো, তাই না?”

তাহমিদ মাথা নেড়ে বলল,
“না, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

শতাব্দী এতোক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে এবার তাহমিদের দিকে তাকালো। বলল,
“মাওশিয়াত কিছু বলে নি?”

“হুম, শুনেছি।”

“তাহলে কিছু বলবে না?”

“না, আমার কিছুই বলার নেই।”

শতাব্দী নিজের হাত নিজেই খামচে ধরলো। তাহমিদের এমন উত্তরের জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সে এমন শান্তভাবে উত্তর দিচ্ছে, মনে হচ্ছে তার কিছুই আসে যায় না। শতাব্দী বড় একটা শ্বাস নিয়ে আস্তে করে ছাড়লো। তারপর বলল,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি, তাহমিদ। ওরা আমাকে শুধু দেখে গেছে। এখনো কিছুই জানায় নি। তুমি রাজি থাকলে আমি বাবাকে বলবো।”

তাহমিদ এবার শতাব্দীর দিকে তাকালো। তাহমিদের চোখাচোখি হতেই শতাব্দী চোখ নামিয়ে নিলো। শতাব্দী আবার বলল,
“বাবা হয়তো বুঝতে পারবে।”

“কি বুঝবে?”

“আমাদের ভালোবাসা!”

তাহমিদ অবাক হয়ে বলল, “ভালোবাসা!”

শতাব্দী তাহমিদকে অবাক হতে দেখে নিজেও অবাক হলো। তার মনে ভয় ভীড় করতে লাগলো। যদি তাহমিদ না করে দেয়? তখন সে কি করবে? এবার তাহমিদ বলল,
“তুমি তোমার বাবাকে কি বলবে? তুমি আমাকে ভালোবাসো এটাই বলবে?”

“হ্যাঁ।”

“তারপর উনি রাজি হবে, এটা তুমি কিভাবে নিশ্চিত হয়েছো?”

“কেন রাজি হবে না? বাবা তো তোমাকে খুব পছন্দ করে।”

“শতাব্দী, পছন্দ করা আর আত্মীয়তা করা এক কথা না। তুমি ভালোভাবেই জানো, আমাদের ধর্ম আলাদা।”

“আমার তো এটা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।”

“তাহলে তুমি আমার ধর্মে আসতে চাচ্ছো?”

শতাব্দী চুপ করে রইলো। তাহমিদ হালকা হেসে বলল,
“তুমি আসতে চাইলেও তোমার বাবা-মা এতো সহজে এটা মেনে নেবে না।”

“কিন্তু ধর্ম পরিবর্তন না করেও…”

তাহমিদ শতাব্দীকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার জীবনটা অনেক এলোমেলো হয়ে আছে। তুমি আমার অতীত জানো না। আর আমার ভবিষ্যৎ কি সেটা আমি নিজেই জানি না। আমার এই অনিশ্চিত জীবনে কোনো প্রেম-ভালোবাসার জায়গা নেই। তবে আমি তোমাকে অনেক ভালো বন্ধু মনে করি। কিন্তু ভালোবাসি না। এখন তোমার উচিত, তোমার বাবা-মার পছন্দে বিয়ে করে ফেলা।”

শতাব্দী তাহমিদের দিকে নির্বাক তাকিয়ে রইলো। তার চোখ দু’টি ছলছল করছে। তাহমিদ শতাব্দীর চোখের দিকে তাকাতে পারলো না। সে উঠে চলে গেলো। শতাব্দীও চেয়ারের হাতল ধরে উঠে দাঁড়ালো। তাহমিদ ঘর থেকে বেরুতেই বাকিরা রুম থেকে বের হয়ে এলো। ইমন কিছু বলার আগেই শতাব্দী বলল,
“আমার ঝামেলার কারণে তোমাদের একটা কথা বলা হয় নি।”

ইমন বলল, “কি কথা?”

শতাব্দী ডুমুরের কাছ থেকে যা যা শুনেছিল সবটাই তাদের জানালো। সব শুনে ইভান বলল,
“আমার উনাকে সন্দেহ হচ্ছিল!”

তূর্য বলল,
“তাহলে উনি আমাদের কেন বাঁচিয়েছেন?”

৬৮.

জানালার বাইরে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শতাব্দী। তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে পড়তে শুকিয়ে গেছে। শ্রীজা বোনের পাশে এসে দাঁড়ালো। শতাব্দীর শূণ্য দৃষ্টি দেখে সে বলল,
“দিদি, কাল তোমায় আশীর্বাদ দিতে আসবে। তুমি বরং পালিয়ে যাও!”

শতাব্দী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বলল,
“কার সাথে পুচকি? যার হাত ধরতে চাই, সে তো আমার হাত ধরতে আগ্রহী নয়। তার তো আমার জীবনে কি হলো না হলো তাতে কিছুই আসে যায় না।”

“তাহমিদ দাদা কি তোমায় ভালোবাসে না?”

শতাব্দী মাথা নেড়ে বলল, “না।”

না শব্দটা বলতেই শতাব্দীর বুক ভারী হয়ে আসছিল। সে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে শ্রীজার হাত ধরে বলল,
“পুচকি, তোর দাদাকে আমি খুব ভালোবাসি রে। খুব ভালোবাসি। সেই ছোটবেলা থেকেই। আট বছর ধরে একটা মানুষকে চুপচাপ শুধু ভালোবেসেই গেলাম। আর আজ আমার এতোবছরের ভালোবাসার প্রতিদান আমি এভাবেই পেয়েছি? আমি কি বোকা রে পুচকি। মানুষটা আমাকে ভালোইবাসতো না রে। আর আমি বোকার মতো, তাকেই চেয়েছি। তার জন্য চুল বাঁধতাম, কারণ সে পরিপাটি থাকা পছন্দ করতো। স্কুল শেষে দূর থেকে দাঁড়িয়ে তার মিষ্টি বিক্রি দেখতাম। রোদে রাঙা হয়ে যাওয়া মুখটার মায়ায় পড়ে গিয়েছিলাম রে পুচকি। কিভাবে থাকবো মানুষটাকে ছাড়া? আমি একা একা এই জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো, কিন্তু এই মনটাতে আর কাউকে বসাতে পারবো না রে পুচকি। কতো যত্ন নিয়ে এই মনে মানুষটাকে বসিয়েছি। এতো সহজে সেই জায়গা কেউ নিয়ে নেবে? কিভাবে নিয়ে নেবে? এমন না হোক। তারচেয়ে ভালো মরণ হোক আমার!”

শ্রীজা ব্যস্ত হয়ে বোনের মুখে হাত দিয়ে ভেজা কণ্ঠে বলল,
“ওমন করে বলো না দিদি। এমন অলক্ষুণে কথা বলো না।”

“পুচকি, এই মনকে কিভাবে বোঝাবো, বল না!”

এদিকে ছাদের এক কোণে রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাহমিদ। কাল থেকেই তার মন খারাপ। কারো সাথে কোনো কথা বলে নি। রহমত চাচা সম্পর্কে জানার পরও সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় নি। যেন তার ভেতরের সব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া লোপ পেয়েছে। আরাফ ছাদে উঠে দেখলো তাহমিদ একপাশে কাঠের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে তাহমিদের পাশে এসে দাঁড়াতেই তাহমিদ একটা শুকনো হাসি দিলো। আরাফও হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“তোকে আগে কখনো এতোটা দুঃখী দেখি নি।”

তাহমিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি শুধু শুধু কেন দুঃখী হবো?”

“ভালোবাসিস শতাব্দীকে?”

“আরেহ না। তেমন কিছু না।”

“পছন্দ তো করিস। নয়তো তোর কেন খারাপ লাগবে? তোর চুপচাপ হয়ে যাওয়ার কারণ কি! কোনো কারণ ছাড়া তো কেউ দুঃখ পায় না।”

তাহমিদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“আমাদের ভাগ্যে হয়তো সিল মেরে দেওয়া হয়েছে, যাকেই আপন ভাববো, তারাই হারিয়ে যাবে।”

আরাফ মলিন হাসি দিয়ে বলল,
“ভাগ্য! এই ভাগ্যটাই খারাপ। সুখ দেখায় না৷ শূণ্যতা ছাড়া কিছুই দেয় না।”

“হ্যাঁ, আর মাত্র কয়েক মাস। পরীক্ষাটা শেষ করে এই শহর ছেড়ে দেবো। একদিন শতাব্দীও সব ভুলে যাবে।”

“যদি না ভুলে?”

তাহমিদ শুকনো হেসে বলল,
“এটা ওর আবেগ। একটা সময় এই আবেগ কেটে যাবে।”

“আর তুই!”

তাহমিদ আরাফের দিকে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকালো। আরাফ আর কিছুই বললো না। সে উত্তর পেয়ে গেছে। তাহমিদের চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছে, সে শতাব্দীকে কতোটা ভালোবাসে। তবে এই ভালোবাসার স্বীকারোক্তি এতো সহজে হবে না। আরাফ মনে মনে বলল,
“আমি ভাবতাম, আমিই সবাইকে সব কথা খুলে বলতে পারি না। কিন্তু তুই তো আমার চেয়েও বেশি অপারগ।”

আরাফ চলে যাওয়ার পর তাহমিদ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর শুভ্র মেঘের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলল,
“সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না চন্দ্রিমা। তোমার নাম চন্দ্রিমা রেখেছি, কেন জানো? কারণ তুমি আমার কাছে চাঁদের মতোই। যাকে শুধু দেখা যায়, স্পর্শ করা যায় না, কাছেও পাওয়া যায় না। চন্দ্রিমা, তুমি সবসময় আমার সাথেই থাকবে। রাতের অন্ধকারে আমি তোমাকে চাঁদের মাঝেই খুঁজে নেবো। তোমাকে না পাওয়ার মাঝেই তো তোমার বিশেষত্ব। চন্দ্রিমা, আমি তোমাকে ভালোবাসতে চাই না। শুধু অনুভব করতে চাই।”

পরের দিন ছেলে পক্ষ শতাব্দীকে আশীর্বাদ করে চলে গেলো। আর যাওয়ার আগে এনগেজমেন্টের তারিখ পাকাপোক্ত করে গেলো। এই সপ্তাহেই এনগেজমেন্ট হবে। তারপর যেকোনো একটা শুভ দিন দেখেই বিয়ের তারিখ ঠিক করা হবে৷ যেহেতু ছেলে ছুটিতে এসেছে, তাই বিয়ের জন্য এতো তাড়াহুড়ো চলছে। কারণ ছুটি শেষ হলেই ছেলে আবার চলে যাবে। কিন্তু সবকিছুর মধ্যে শতাব্দীর মুখে কোনো হাসি নেই। কারণ কোনো কিছুই তার ইচ্ছেমতো হচ্ছে না।

এদিকে ইভান ফোন নিয়ে চিন্তিত মুখে বসে আছে। ইমন তার পাশে বসতেই সে বলল,
“আমাদের হাতে সময় কম। রহমত চাচাকে বিশ্বাস করে আমরা সব উনার ভরসায় ছেড়ে দিতে পারবো না। কিছু একটা করতে হবে।”

ইমন বলল,
“ভাই, আমি একটা ব্যবস্থা করেছি।”

“কি করেছিস?”

“আমরা বাংলাদেশ যাচ্ছি।”

“কখন!”

“এক সপ্তাহের মধ্যেই। তাহমিদ আমার সাথে যাবে। তবে এটা রহমত চাচাকে জানানো যাবে না। এই কথা শুধু আমাদের মধ্যেই থাকবে। এখন আমাদের আগে মৈত্রী গ্রুপটা দাঁড় করাতে হবে। তবে এই কাজের জন্য ভালো একজন ইনভেস্টর দরকার। আর আমাদের সেই বিজনেস দাঁড় করানোর জন্য একজন ইনভেস্টরও আছেন।”

“কে সে!”

“মাওশিয়াতের চাচা। উনি আমাদের সাহায্য করবেন।”

“সব বুঝলাম। কিন্তু তোদের তো কয়েক মাস পর পরীক্ষা!”

“আমরা পরীক্ষার আগেই চলে আসবো। আপতত রহমতুল্লাহ কি চায়, এটাই জানতে হবে। পরীক্ষার পর আমরা সবাই দেশে ফিরবো। কিন্তু এই বাসাটাও পরিবর্তন করতে হবে। অরুণিকাকে এখান থেকে সরাতে হবে। তুই আর আরাফ অরুণিকাকে নিয়ে অন্য কোথাও উঠলে ভালো হবে।”

“হুম ভাবছি, অরুণিকাকে অন্য শহরে পাঠিয়ে দেবো। ওখানে একটা বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবো। আমি আর আরাফ গিয়ে মাঝে মাঝে ওকে দেখে আসবো।”

“হ্যাঁ, এটাই করতে হবে। ও তোদের সাথেই একেবারে দেশে ফিরলে ভালো হবে। আর এমনিতেই আরাফ ওকে আমাদের ভরসায় ছাড়বে না। আর একাও এই শহরে রাখবে না।”

তাদের কথার মাঝখানে তূর্য আর আরাফ এলো। তূর্য দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আরাম করে বসলো আর বলল,
“বিজনেস দাঁড় করাতে অনেক সময় লাগবে। আর আমাদের পরিচয়ও গোপন রাখতে হবে।”

আরাফ বলল,
“জানিস, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের টপ বিজনেসম্যান সাহিল মির্জা।”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“মির্জা! তারমানে মির্জা গ্রুপের এমডি?”

“হ্যাঁ, শাহেদ মির্জার ছেলে।”

ইমন বলল,
“সাহিল মির্জা নতুন এমডি হয়েছে। কিন্তু ওর বাবা মৈত্রী গ্রুপের প্রথম শত্রু ছিল।”

ইভান বলল,
“হুম, আর ওদের ওই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকাটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। যেহেতু ওরা আমাদের শত্রু পক্ষ ছিল।”

এরই মধ্যে আহনাফ আর তাহমিদ এলো। ইভানের কথায় তাল মিলিয়ে আহনাফ বলল,
“ইভান ঠিকই বলেছে। আমার কাছে এই মুহূর্তের আর সেই সময়ের বিজনেস গ্রুপগুলোর একটা লিস্ট আছে।”

আহনাফ তার ফোনটা এগিয়ে দিলো। ইভান ফোন দেখে বলল,
“এটা কি কোনো ক্লু?”

“হ্যাঁ, ওই সময় মৈত্রী গ্রুপের পরই বাস্কার গ্রুপ ছিল। তারপর চতুর্থতে মির্জা গ্রুপ। এখন শুরুতেই মির্জা গ্রুপ। আর বাস্কার গ্রুপ দ্বিতীয়। বাকিগুলো মোটামুটি। এদের কাছাকাছি আসতে বাকিদের অনেক সময় লাগবে। আর মৈত্রী গ্রুপ ডাউন হওয়ার পর পরই মির্জা গ্রুপের এতো উন্নতি হয়েছে।”

ইমন বলল,
“তবে এদের মধ্যে মুন্সী গ্রুপটা হয়তো নতুন। আগে এই গ্রুপের নাম শুনি নি।”

আরাফ বলল,
“হ্যাঁ, সুলতান মুন্সী। লোকটা আগে হোটেলে কাজ করতো। ওখান থেকেই এতো বড় বিজনেস দাঁড় করিয়েছে। তবে এই গ্রুপটার সাথে মির্জা গ্রুপের একটা দ্বন্ধ আছে।”

“কিসের দ্বন্ধ? তাদের পজিশনে তো আকাশ-পাতাল পার্থক্য।”

“কি বিষয়ে দ্বন্ধ এটা মিডিয়াতে এখনো আসি নি। তবে নিউজে এতোটুকুই দেখেছিলাম।”

চলবে-

(পরের পর্ব ২৫ তারিখ দেওয়া হবে। আমার এক্সাম চলছে তাই। আজকের পর্ব বড় করে দিয়েছি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here