#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪০: ২য় ভাগ||
৭০.
ল্যাপটপ সামনে নিয়ে বসে আছে তাহমিদ। রহমতুল্লাহর কিছু তথ্য আগে থেকেই তাদের জানা ছিল। এখন সে পুরোনো তথ্যগুলোর সাহায্যে রহমত চাচার সম্পূর্ণ অতীত-ইতিহাস বের করে নিলো৷ এরপর ইমনের কাছে এসে বলল,
“ইমন, উনি আমাদের নিজের সম্পর্কে কিছুই মিথ্যে বলে নি। উনি যেই কোম্পানিতে কাজ করতো, সেই কোম্পানির মালিকের সাথে ফোনে কথা হয়েছে। রহমত চাচা একটু জেদি মানুষ ছিলেন। কার সাথে নাকি ঝামেলা হয়েছিল, এরপর চাকরিটা ছেড়ে দেন।”
ইমন বলল,
“এরপরই তিনি মৈত্রী গ্রুপে কাজ নিয়েছিলেন!”
“হ্যাঁ, কিন্তু উনি এতো অভিজ্ঞ ছিলেন না। তাই বেশিদিন আমাদের কোম্পানিতে কাজ করতে পারেন নি। আর উনার জন্য সেই সময় মৈত্রী গ্রুপ ছোটখাটো একটা সমস্যায় পড়েছিল।”
“উনি কি এই জন্য প্রতিশোধ নিয়েছেন?”
“ইমন, জাস্ট তার অযোগ্যতার জন্যই তাকে কোম্পানি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। এর সাথে খুনের কোনো সম্পর্ক নেই।”
“আচ্ছা, তাহলে এখন উনি কোথায় আছেন?”
“যাকে জিজ্ঞেস করেছি, সে আর কিছুই জানে না। তবে তার ঠিকানা দিয়েছে।”
“কোথায় থাকেন?”
তাহমিদ বলল,
“কাপাসগোলা। বাকিটা আমাকে ইমেইলে পাঠাবে বলেছে। ঠিকানাটা পাঠালে আজই আমরা রাতের দিকে ওই বাড়িটা দেখে আসবো।”
সন্ধ্যায় রহমতুল্লাহর খবর দেওয়া লোকটি ঠিকানা পাঠিয়ে দিল। তাহমিদ আর ইমন সেই ঠিকানায় চলে গেল। ইমন রহমতুল্লাহর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, এই বাড়ি উনার।”
তাহমিদ চিন্তিত কন্ঠে বলল,
“উনি যদি একতলার সেমি পাকা বাড়িতে থাকেন, তাহলে আমাদের প্রতি মাসে বা দুই মাস পর পর এতো টাকা কিভাবে পাঠাতেন? এমন বাড়িতে থাকা মানুষের কাছে ছ’টা ছেলের খরচ বহন করা তো সহজ কথা না।”
“হয়তো উনার এখনই এই অবস্থা, আগে ভালো অবস্থায় ছিল। আর এমনও তো হতে পারে আমরা ভুল ঠিকানায় এসেছি। একটা কাজ করি, আগে আমরা উনার জন্য অপেক্ষা করি। কোনো না কোনো সময় তো উনি বাসা থেকে বের হবেনই। এরপর যদি নিশ্চিত হই, এটা উনার বাড়ি। তাহলে এখানের কাউকে জিজ্ঞেস করে নেবো, তিনি কতো বছর ধরে এখানে আছেন।”
তারা দু’জন সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত রহমতুল্লাহর অপেক্ষায় ছিল। ঘড়ির কাঁটা ঠিক সাড়ে এগারোটার ঘর ছাড়তেই হঠাৎ তাহমিদ ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো। ইমন তার হাত ধরে বলল,
“কি হয়েছে তোর? ঠিক আছিস তো!”
তাহমিদ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“পা’টা অবশ হয়ে আসছে।”
ইমন তাকে টেনে উঠালো আর পাশের একটা দোকানের সিঁড়িতে বসালো। তাহমিদ বলল,
“যেই কাজে এসেছি, তুই সেই কাজটা কর।”
“তোর খারাপ লাগলে হোটেলে ফিরে যাই, চল৷ আমরা অন্য একদিন আসবো।”
“না। এতো সময় নেই আমাদের হাতে।”
ইমন তাহমিদের জোরাজুরিতে আবার সেই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। আরো কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর ইমন এসে তাহমিদকে বলল,
“এমনও তো হতে পারে আমরা এখানে আসার আগেই রহমতুল্লাহ বাসায় ঢুকে পড়েছিল।”
হঠাৎ তাহমিদ চোখ বড় বড় করে সামনে তাকালো। ইমন পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলো রহমতুল্লাহ একটা বড় গাড়ি থেকে নামছে। ইমন ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“সেমি পাকা বাড়ি, আর এতো বড় গাড়ি। অদ্ভুত তো!”
রহমতুল্লাহ হাত নেড়ে গাড়ির ভেতরে বসে থাকা আগন্তুককে বিদায় দিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়লো। ইমন তাড়াতাড়ি সিগারেট ধরিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরালো, যাতে রহমতুল্লাহর কোনো সন্দেহ না হয়। তিনি ঘরে ঢোকার পরই তাহমিদ আর ইমন রাস্তায় এসে দেখলো গাড়িটা চলে যাচ্ছে। তাহমিদ বলল,
“আমাদের গাড়িটার পিছু নেওয়া উচিত। হয়তো মির্জা গ্রুপের কেউ হবে।”
ইমন আশেপাশে রিকশা ছাড়া কোনো সিএনজি দেখতে পেলো না। এখন রিকশা নিয়ে এই গাড়ির পিছু করা অসম্ভব। ইমন তাড়াতাড়ি গাড়িটার নম্বর মুখস্থ করে ফোনে লিখে রাখলো। এরপর তারা হোটেলে ফিরে এলো।
রাতে ইমন তাহমিদের পায়ে ওষুধ মালিশ করে দিতে লাগলো। তাহমিদের পা ফুলে গেছে। সে ইমনকে বলল,
“আমি তো মনে হয় পঙ্গুই হয়ে যাবো। বেশিক্ষণ দাঁড়ালেই পা’টা অবশ হয়ে আসে।”
“তোর কিছু হবে না। তুই রেস্ট কর। কাল আমি একাই বের হবো।”
“না, আমি তোকে একা ছাড়বো না।”
“আমি এখন আর বাচ্চা ইমন নই। আমি একাই যেতে পারবো।”
পরেরদিন ইমন একাই রহমতুল্লাহর বাড়ি গেলো। আশেপাশের লোকেদের সাথে কথা বলে জানতো পারলো তিনি প্রায় বিশ বছর ধরে এই বাড়িতে আছেন। ইমনের এবার সন্দেহ হলো। যেই মানুষ সেমি পাকা বাড়িতে বিশ বছর ধরে আছে, তার পক্ষে এতোগুলো টাকা তাও দুই মাস পর পর পাঠানো এতো সহজ হবে না। তাহলে উনি এতো টাকা কোথায় পেলেন? তিনি অন্তত কোনো বহুতল ভবনে ভাড়া থাকলেও এটা চিন্তা করা যেতো। এবার ইমন সবাইকে কনফারেন্স কল করে বিষয়টা জানালো। আরাফ বলল,
“এমনও তো হতে পারে, আমাদের নামে ব্যাংকে যেই একাউন্ট আছে, সেখান থেকেই তুলেছে।”
তাহমিদ বলল,
“কিন্তু এটা তো সম্ভব না। এর জন্য তো সাইন করা চেকবই লাগবে। আর ওইদিন বাড়িতে আগুন লাগার পর তো সব জরুরী কাগজপত্রও ছাই হয়ে যাওয়ার কথা।”
আহনাফ বলল,
“হয়তো উনার কাছে কোনো সাইন করা চেক বই আছে।”
ইমন বলল,
“আচ্ছা আমরা ব্যাংকে গিয়ে খবর নিয়ে দেখি।”
এর পরের দিন তাহমিদ আর ইমন দু’জনেই একসাথে ব্যাংকে গেলো। অনেকগুলো ব্যাংকেই তাদের একাউন্ট ছিল। সব’কটাই এখন বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় আট-নয় বছর বন্ধ থাকায় তাদের নামে থাকা ডিপিএসগুলো রাষ্ট্রীয় মালিকানায় চলে গেছে। তাদের পুরোনো একাউন্টগুলো চালু করতে হলে তাদের বাবা-মার মৃত্যু সনদ আর তাদের পরিচয়পত্র জমা দিতে হবে, যা এই মুহূর্তে অসম্ভব। সব খবরাখবর নিয়ে ইমন আর তাহমিদ হোটেলে ফিরে এলো। তাহমিদ ইমনকে বলল,
“এখন এই রহমত চাচা আমাদের মারাত্মকভাবে কনফিউজড করে দিচ্ছে।”
ইমন কিছু একটা ভেবে বলল,
“কেউ কি উনাকে টাকা দিচ্ছে?”
“কেন টাকা দেবে?”
“আমাদের ভরনপোষণের জন্য!”
“কে করবে এমন কাজ! সবাই তো আমাদের শত্রু।”
“এখানে কিছু একটা তো আমরা মিস করে যাচ্ছি। আচ্ছা, ওই গাড়িটা কার হতে পারে? রহমত চাচাকে এতো রাতে কে তার বাসায় পৌঁছে দেবে? আর এতো রাতে উনি আসছেনও বা কোথা থেকে। উনি যেই দোকানে চাকরী করেন ওটা একদম উনার বাসার কাছেই। বাসায় ফিরতে বিশমিনিট লাগবে। আর দোকান বন্ধ করেন আটটার পর। তাহলে এতো রাত পর্যন্ত তিনি কোথায় ছিলেন?”
“ওই গাড়িটা মির্জা গ্রুপের কারো হবে না তো?”
“আহনাফ এটাতে সাহায্য করতে পারবে। গাড়িটা ইন্ডিয়ান কোম্পানির। আর সেটা ইন্ডিয়া থেকেই এসেছে। তাই এই তথ্য পেলেও পাওয়া যাবে। কারণ মাওশিয়াতের চাচার অনেক বড় বড় বিজনেস কোম্পানির মালিকের সাথে সম্পর্ক আছে। উনি এই ব্যাপারে তথ্য নিয়ে ফেলবে।”
ইমন সেদিনই আহনাফকে গাড়ির ব্যাপারে জানালো। মাওশিয়াতের চাচাকেও সব বললো। তিনি আহনাফকে নিয়ে সেই কোম্পানির মালিকের সাথে দেখা করতে গেলেন। সেই মালিকের সাক্ষাৎ পেতে মোটামুটি এক সপ্তাহ লেগে গেলো। এই এক সপ্তাহ ইমন আর তাহমিদ মির্জা গ্রুপ আর বাস্কার গ্রুপের অনেক তথ্য বের করে ফেলেছে। আর এও জেনেছে মুন্সি গ্রুপের সাথে মির্জা গ্রুপের দ্বন্ধের কারণ শাহেদ মির্জার মেয়ে সাবা, সুলতান মুন্সীর ছেলে ইশমামকে ভালোবাসে। এমন খবরও পাওয়া গেছে, তারা কাজি অফিসে বিয়ে করতে গিয়েও করতে পারে নি। তবে এসবের কোনো নিশ্চিত সত্যতা নেই। এসব খবর মিথ্যেও হতে পারে, আবার কোনো অংশে সত্যও হতে পারে।
এদিকে গাড়ির কোম্পানির মালিক বাংলাদেশে তাদের যেই ব্রাঞ্চ আছে, সেখানে খবরটা পৌঁছালো। আর সেখান থেকে গাড়িটির মালিকের খবর আসলো প্রায় বিশদিন পর। আহনাফ নামসহ সম্পূর্ণ তথ্য ইমনকে মেসেজ করে পাঠিয়ে লিখলো,
“চাচ্চু ঠিকই বলেছে। শত্রু আমাদের নাকের ডগায় ছিল।”
ইমন নামটা দেখে চোখ বড় বড় করে তাহমিদের দিকে তাকালো। তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“গাড়ির মালিক কে?”
ইমন বলল, “মুরশিদ জুবাইয়ের।”
তাহমিদ নামটা শুনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো, “মামা!”
“হ্যাঁ, তোর মামা। তোর মামা এই খুনের সাথে জড়িত!”
তাহমিদের হাত কাঁপছে। সে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“অসম্ভব। মামা আমার বাবা-মাকে খুন করবে কেন?”
“এটা তো উনিই জানবেন।”
ইমন এবার তাহমিদের হাত ধরে বলল,
“উনি আমাদের সাথে অন্যায় করেছেন। আমি জানি তুই তোর মামাকে খুব ভালোবাসিস। উনি আগে অনেকবার বাসায় এসেছিল। তোকে অনেক আদর করতো। ভাই, এসবের জন্য কি তুই পিছিয়ে যাবি?”
তাহমিদ নিজেকে শান্ত করে বলল,
“অসম্ভব। আমি আমার বাবা-মা, দাদী, আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত মুখ সবাইকে হারিয়ে ফেলেছি। আর এর পেছনে যদি মুরশিদ জুবাইয়েরই থেকে থাকেন, তাহলে আমি উনাকে কখনো ক্ষমা করবো না।”
তারা বাংলাদেশে আরো দুই সপ্তাহ ছিল। এর মধ্যে মুরশিদ জুবাইয়েরের অনেক খবর তারা পেয়ে গেলো। এর মধ্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য ছিল, মুরশিদ জুবাইয়ের কয়েক বছর আগে বাস্কার গ্রুপে ইনভেস্ট করেছিল। এরও আগে মির্জা গ্রুপকে একটা প্রজেক্ট তৈরীতে সাহায্য করেছিল। এসব জানার পর খুনিদের মুখগুলো তারা চিনে আবার কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। এবার তারা ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েই স্থায়ীভাবে দেশে ফিরবে।
চলবে-
(আজকের পর্বটার অপর নাম রাখা উচিত তথ্যবহুল পর্ব। শুধুই তথ্য দিলাম। আগামী পর্বে কান্নাকাটি শুরু।)