অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৪৫||

0
1066

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৫||

৭৬.
ইভান একটা বেঞ্চে বসে ফোন দেখছিল। হঠাৎ কোথা থেকে পানির ছিটকে তার গায়ে এসে পড়লো। সে তাড়াতাড়ি বেঞ্চ থেকে উঠে পেছন ফিরে দেখলো একটা মেয়ে তার হাতে থাকা বোতলটা খুলতে গিয়েই অর্ধেক পানি বের করে ফেলেছে, যার ছিঁটেফোঁটা ইভানের গায়ে এসে পড়েছে। মেয়েটা এমন পরিস্থিতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
এদিকে ইভানের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। সে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,
“এতো জায়গা থাকতে, আমার মাথার কাছে এসেই আপনার বোতলটা খুলতে হলো?”

মেয়েটা এমন কথা শুনে ভড়কে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“ও লিসেন, আমি ইচ্ছে করে করি নি। এটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট ছিল।”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“দেখুন, সুন্দর করে কথা বলবেন। আমি এখানে ঝগড়া কর‍তে বসি নি।”

“আহ! আচ্ছা। তাহলে আমি কি অসুন্দর করে কথা বলছি? আর আপনার কি মনে হয় আপনার সাথে ঝগড়া করার জন্য আমি এখানে এসেছি?”

“দেখুন আপনার সম্বোধনটা আমার পছন্দ হয় নি।”

“ওহ আচ্ছা। তাহলে আপনাকে কি মাননীয়, জনাব বা স্যার সম্বোধন করে কথা বলতে হবে?”

“আপনি এভাবে আঙ্গুল দেখিয়ে দেখিয়ে কথা বলছেন কেন?”

“আমার ইচ্ছে।”

ইভান আর কিছুই বলল না। সে আবার বেঞ্চে বসে পড়লো। এদিকে সানায়া আপনমনে বিড়বিড় করে যাচ্ছে। তার বাবার পাঠানো বডিগার্ডগুলো থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য সে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে পার্কে এসে বসেছে। সে ভেবেছে বডিগার্ডগুলো তাকে না পেয়ে চলে গেলে, সে মেলায় যাবে। অনেকক্ষণ বসে থাকায় পানির তৃষ্ণা পেয়েছিল। তাই একটা পানির বোতল কিনে সেটা খুলতে গিয়েই এই অঘটন ঘটলো। ইভানকে চুপ করে থাকতে দেখে সানায়া তার পাশে বসে পড়লো। আর গটগট করে পানি খেতে লাগল। ইভান এক নজর তার দিকে তাকালো।

সানায়া পানি খেয়ে ইভানের দিকে তাকালো। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“সরি। আসলে কিছু বদমাশ লোক আমার পিছনে পড়েছিল। ওদের থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য আমি এই পার্কে এসেছি। কারণ জায়গাটা নিরাপদ মনে হয়েছে। এখানে অনেক মানুষও আছে। আর এসব ঝামেলার কারণে মাথা ঠিক ছিল না। তাই আপনাকে হয়তো উল্টোপাল্টা বলে ফেলেছি। সরি।”

ইভান কোনো উত্তর দিলো না। সানায়া ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ ইভানের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলল,
“আপনি মনে হয় শুনতে পান নি। আমি আপনাকে সরি বললাম।”

ইভান চোখ ছোট করে সানায়ার দিকে তাকালো। সানায়াও প্রতুত্তরে চোখ ছোট করে তাকালো। এবার ইভান অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। সানায়াও অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মিনমিনিয়ে বলল,
“ইগোয়িস্টিক ম্যান।”

ইভান সানায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “সরি?”

সানায়া উঠতে যাবে তখনই দু’জন বডিগার্ড তার সামনে চলে এলো। ইভান তাদের দেখে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে অন্যদিকে যাবে তখনই সানায়া ইভানের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমরা যাও, আমি আমার বন্ধুর সাথে আছি।”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে সানায়ার দিকে তাকালো। বডিগার্ড দু’জন এখনো দাঁড়িয়ে আছে। সানায়া চেঁচিয়ে বলল,
“আমাকে কি এখন প্রাইভেসিও দেবে না?”

তারা দু’জনই চুপচাপ সরে গেলো। ইভান বুকে হাত গুঁজে বলল,
“আমি আপনার বন্ধু না।”

সানায়া মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আপনার মতো ইগোয়িস্টিক লোক এমনিতেই আমার বন্ধু হওয়ার যোগ্য না।”

ইভান কোনো উত্তর না দিয়েই চলে গেলো৷ ইভান চলে যেতেই সানায়া বিড়বিড় করে বলল,
“মির্জাদের সাথে থাকতে থাকতে আমি সত্যিই রুড হয়ে যাচ্ছি। শুধু শুধু লোকটার সাথে মেজাজ দেখালাম। দোষটা তো আমারই ছিল।”

এদিকে উপমা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। তূর্য টেবিলে হাত রাখতেই সে এক নজর তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্য বলল,
“ফোনে তো অনেক কথা বলো। আর এখন চুপ করে আছো!”

উপমা লাজুক হেসে বলল,
“আমার খুব নার্ভাস লাগছে।”

তূর্য খাবার অর্ডার দেওয়ার জন্য মেন্যু এগিয়ে দিলো। উপমা মেন্যু দেখে মনে মনে ভাবলো,
“আমি ওর সামনে কিভাবে খাবো? কিছু খেলেই মুখটা হাঁ করতে হবে, লিপস্টিক নষ্ট হয়ে যাবে। আমি ভালোভাবে খেতেই পারবো না।”

তূর্য টেবিলে ঠোকা দিয়ে বলল, “কি ভাবছো?”

উপমা হেসে বলল,।”কিছু না।”

“কি খাবে, বলো?”

“কোল্ড ড্রিংক্স।”

“শুধু কোল্ড ড্রিংক্স? অন্য কিছু অর্ডার করো।”

“না, আমার ক্ষিধে নেই।”

তূর্য বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো। বলল,
“আমাকে সেলেব্রিটি মনে করলে কিছু খেতে পারবে না। আমাকে বন্ধু মনে করো।”

উপমা তূর্যের কথা শুনে আরো লজ্জা পেলো। তূর্য আবার বলল,
“আমার টুইংকেল একদম তোমার মতো। কোথাও গেলে খেতে চায় না। ওর লিপস্টিক নষ্ট হয়ে যাবে তাই।”

উপমা ভ্রূ কুঁচকে বললো, “আপনার টুইংকেল!”

“হ্যাঁ, আমার টুইংকেল।”

“ওই বাচ্চাটা?”

“হ্যাঁ, বাচ্চা না। এখন বড় হয়ে যাচ্ছে।”

“ও কি আপনার সাথেই থাকে।”

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু আপনি তো বললেন, ও আপনার বন্ধুর কাজিন।”

“হ্যাঁ, আমরা একসাথেই থাকি।”

“আমি আসলে বুঝতে পারছি না। কেন একসাথে থাকেন? আই মিন, আপনি আপনার পরিবারের সাথে থাকেন না?”

তূর্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমার বাবা-মা নেই। কেউই নেই। আমার বন্ধুরাই আমার পরিবার। আর অরুণিকা, আমার টুইংকেল, আমার মানসিক শক্তি। ওকে একদিন না দেখলে আমার খুব অস্বস্তি লাগে। বাংলাদেশে আসার পর থেকে ওর সাথে অনেক বার ভিডিও কলে কথা বলেছি। তবুও ভালো লাগছে না।”

উপমা কিছুটা দমে গেলো। ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“ওর বয়স কতো?”

“হবে তোরো-চৌদ্দ।”

“অনেক বড় হয়ে গেছে।”

“হ্যাঁ।”

উপমা তার একটা হাত দিয়ে অন্য হাত চেপে ধরে রাখলো। তূর্যের অরুণিকার প্রতি ভালোবাসা দেখে তার নিজেকে নিয়েই সন্দেহ হচ্ছে। সে ভাবছে, তূর্য কি তাকে সত্যিই পছন্দ করে? ভয়ে তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। উপমা নিজের মনকে শক্ত করে তূর্যকে বলল,
“আমি একটা কথা বলতে চাই।”

“হ্যাঁ, বলো। তোমার সাথে কথা বলতেই তো এসেছি।”

উপমা অনেক ইতস্তত ভাব নিয়ে বলল,
“আমার আপনাকে ভালো লাগে।”

তূর্য হেসে বলল, “হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি।”

“না, ওরকম না।”

উপমা আমতা আমতা করছে দেখে তূর্য বলল,
“রিল্যাক্স। কি হয়েছে?”

“আমি আসলে আপনাকে পছন্দ করি। পছন্দ না, ভালোবাসি। ভক্ত হিসেবে না, সত্যি সত্যি।”

তূর্য আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“আচ্ছা, আমি পাস্তা অর্ডার করছি। তোমার ভালো লাগবে। শুনেছি এখানের পাস্তাটা অনেক মজার।”

তূর্যকে প্রসঙ্গ পালটাতে দেখে উপমা অনেক লজ্জা পেলো। সে আর কিছু বলল না। তূর্য তার ভার্সিটি, ক্লাস, আর পরিবার নিয়ে টুকটাক প্রশ্ন করলো। আর উপমা শুধু হু, হ্যাঁ করে উত্তর দিলো। সে একবারো চোখ তুলে তূর্যের দিকে তাকালো না। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতেই তূর্য বলল,
“মেলায় যাবে?”

উপমা ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“না না, বাসায় যাবো। আর আপনাকে থ্যাংক ইউ বলার ছিল। আমার কথায় দেখা করতে এসেছেন তাই।”

তূর্য মুচকি হাসলো। উপমা বলল,
“আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। আমি এমনিতেই বেশি কথা বলি।”

তূর্য এবারও কিছু বলল না। শুধু একটা মুচকি হাসি দিলো। উপমা সামনে পা বাড়িয়ে একটা রিক্সায় উঠে পড়ল। তারপর তূর্যের দিকে একনজর তাকিয়ে রিকশার হুডি তুলে দিল। পুরো রাস্তায় সে নিরবে কেঁদেছে। বারবার তূর্যের প্রসঙ্গ পালটে দেওয়াটাই তার মনে পড়ছে। তাহলে কি তূর্য তাকে ভালোবাসে না? বাসায় এসে সে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। টেবিলে থাকা ফ্রেমে বাঁধানো তূর্যের সেই হাতের ছবিটা সামনে এনে বলল,
“সবাই ঠিকই বলেছে। স্টার তো স্টারই৷ আর আমি তো সাধারণ একটা মেয়ে। আমিই শুধু শুধু মিথ্যে স্বপ্ন দেখেছি।”

এরপর টানা অনেকদিন তূর্য ইন্সটাগ্রামে আসে নি। উপমা সারারাত কেঁদেকেটে বালিশ ভিজিয়ে যাচ্ছে।

আসলে মেয়েরা প্রচন্ড আবেগী হয়। তারা অসম্ভব বস্তুকেই নিজের খুব প্রিয় করে তোলে, আর সেটি নিয়েই স্বপ্ন দেখা শুরু করে। আর স্বপ্ন পূরণ না হলে অকারণেই অশ্রু বিসর্জন করে।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here