#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৬||
৭৭.
কবরস্থান থেকে বের হয়ে সায়ন্তনীর মায়ের সাথে দেখা করার জন্য পুরোনো মহল্লার দিকে হাঁটা শুরু করল আরাফ। হাঁটার পথে রাস্তায় এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকার দিকে তার চোখ পড়ল। ছেলেটা মেয়েটার হাত ধরে তাকে রাস্তা পার করিয়ে দিচ্ছে। আরাফ একনজর তার খালি হাতের দিকে তাকালো। তারও ইচ্ছে করে কারো হাত শক্ত করে ধরতে, কিন্তু তার ভাগ্যটা এতোই খারাপ যে সে কারো হাতই শক্ত করে ধরতে পারে না। যাকেই সে ভালোবাসতে চায়, সেই অনেকদূরে হারিয়ে যায়৷
আরাফ মহল্লায় ঢুকতেই ডুমুরের সাথে দেখা হয়ে গেলো। ডুমুর তাকে দেখেই দৌঁড়ে ঘরে ঢুকে তার মাকে আরাফের আসার খবর জানালো। সুরাইয়া ঘর থেকে বেরিয়ে আরাফকে বললেন,
“কেমন আছো, আরাফ?”
আরাফ বলল,
“আসসালামু আলাইকুম চাচি। ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি আর কেমন থাকবো? আগের মতোই। বাবুন সোনা আসে নি?”
“না, ও স্কুলে গেছে। আমি সায়ান আর আন্টির সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।”
“ওহ। আচ্ছা, যাও যাও। ওরা ঘরেই আছে।”
সুরাইয়া আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু সালেহ আলীকে দেখে আর বলতে পারলেন না। এদিকে আরাফ সায়ন্তনীর মায়ের সাথে দেখা করে বেরিয়ে আসার সময় সায়ান বলল,
“ভাইজান, একটা কথা বলার ছিল!”
“হ্যাঁ বলো।”
“অরুণিকাকে নিয়ে।”
আরাফ কিছুটা অবাক হলো। সে সায়ানকে একপাশে বসিয়ে বলল,
“অরুকে নিয়ে কি কথা! কিছু কি হয়েছে?”
“হ্যাঁ, পাশের বাসার আন্টির ছেলে বাঁধন, ও স্কুলে গিয়ে অরুণিকাকে বিরক্ত করে। আগের স্কুলে তো করতোই। এখন নতুন স্কুলে যাওয়ার পর থেকে আরো বেশি করে করছে।”
“বাঁধন তো ওই স্কুলে পড়ে না। আর অরু তো আমাদের এই ব্যাপারে কিছুই বলে নি।”
“হ্যাঁ পড়ে না। কিন্তু স্কুলের বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে। ভাইজান, আগের স্কুলে তো আমিও ছিলাম। তাই ওখানে আমি অনেকবার দেখেছিলাম। আর নতুন স্কুলে বাঁধনের অনেক বন্ধু আছে। ওরা ওদের বাড়িতে একবার বেড়াতে এসেছিল, তখনই আমি ওদের দেখেছিলাম। আর ওদিন ওর নতুন স্কুলের সামনে দিয়েই যাচ্ছিলাম, তখন দেখলাম ওকে বাঁধন আর ওর বন্ধুরা বিরক্ত করছে।”
আরাফ গম্ভীরমুখে বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে।”
“ভাইজান, কিছু মনে করবেন না। ও আসলে অনেক সুন্দর একটা মেয়ে। আমাদের ক্লাসের অনেক ছেলেই ওকে পছন্দ করে। আমার পাশে বসে ছেলেটাও ওর ক্লাসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো।”
আরাফ চুপ করে রইল। সায়ান আবার বলল,
“আমার মনে হয়, অরুণিকাও ওদের মধ্যে কাউকে পছন্দ করে।”
আরাফ একটু রাগী কন্ঠে বললো,
“কি বলছো এসব? ও এখনো ছোট!”
“জানি ভাইজান। ও তো আমার বোনের মতো। ও যখন ছেলেগুলোর সাথে কথা বলে, তখন আমার ভালো লাগে না। আমি ওকে বারণ করলে, সবার সামনে আমাকে বকাবকি করে।”
আরাফ আর কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালো। এরপর সে মহল্লা থেকে বের হওয়ার সময় বাঁধনকে দেখলো। বাঁধন রাস্তার বখাটে ছেলেদের সাথে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। আরাফকে দেখেই সে সালাম দিয়ে বলল,
“কেমন আছেন, ভাইয়া?”
আরাফ সালামের উত্তর দিয়ে চলে গেলো। বাঁধন তার বন্ধুদের উদ্দেশ্য করে বলল,
“যেমন বোন, তেমনই তার ভাই। বড় ঘরের ছেলে-মেয়ে, তাই কথাও বলে মেপে মেপে। বাবার কাছে শুনেছি, এদের দেশে, এরা নাকি কোটি টাকার মালিক। অনেক বড় ব্যবসায়ীর ছেলে।”
“ভাই, তুই এই মেয়েকে পটাতে পারলে তো সেই টাকার মালিক হয়ে যাবি!”
“ধুর, কি যে বলিস। এই মেয়েকে বিয়ে করলে মরতে হবে। এদের সাথে আত্মীয়তা মানেই মরণের খাতায় নাম লেখা। এদের শত্রুর অভাব নেই।”
“তো তুই ওর পেছনে পড়ে আছিস কেন?”
“সময় পার করা আর কি!”
এদিকে আরাফ বাসায় এসে চুপচাপ বসে রইলো। আহনাফ আর তাহমিদ তাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলো। আরাফ কোনো উত্তর দিলো না। দুপুরে ইমন অরুণিকাকে স্কুল থেকে নিয়ে বাসায় ফিরলো। অরুণিকাকে দেখেই আরাফ জোর গলায় বলল,
“ব্যাগ রেখে আমার সামনে এসে বসো।”
আরাফকে থমথমে গলায় কথা বলতে দেখে অরুণিকাও ভয় পেয়ে গেলো। অরুণিকা কোনো কথা না বলে চুপচাপ আরাফের সামনে বসে পড়লো। আরাফ সায়ানের বলা সব কথা অরুণিকাকে বলল। অরুণিকা মাথা নিচু করে বলল,
“আরাফ, সায়ান সব সত্য কথা বলে নি। ও তোমাকে অনেক মিথ্যে কথা বলেছে। হ্যাঁ বাঁধন আমাকে বিরক্ত করে। ওর বন্ধুরাও করে। আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার একটা ফ্রেন্ড আছে, উষ্মা, ও বলেছে সব কথা তোমাদের না জানাতে। ওর তো মা আছে, আমার তো মা নেই, বোনও নেই। ছেলেদের নাকি সব কথা বলা ভালো না। অনেক ঝামেলা হয়। আর তোমাকে বললে, তুমি বাঁধনকে মারতে না, বলো? মারলে তো ও আমাকে আরো বিরক্ত করবে। তখন আমার ওর সামনে যেতে আরো ভয় লাগবে। ও যদি কিছু করে ফেলে? আর উষ্মাই আমাকে বলেছে চুপ করে থাকতে। একদিন পাত্তা না পেয়ে ওরাই শান্ত হয়ে যাবে। আর আমার কাউকেই ভালো লাগে না। প্রমিজ করে বলছি। হ্যাঁ, অনেকে আমার সাথে কথা বলতে আসে। আর আমি তখন মুখের উপর কিভাবে সরে আসবো বলো? আর জানো, ক্লাসে যেই মেয়েদের সাথে বেশি বেশি ছেলে কথা বলতে আসে, সেই মেয়েকেই সবাই পাত্তা দেয়।”
ইমন অরুণিকার শেষ কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল,
“আমিও এটাই ভাবতাম।”
আরাফ চোখ গরম করে তাকাতেই ইমন হাসি আটকে ফেললো। এদিকে আহনাফ চোখ ছোট করে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বিড়বিড় করে বলল,
“আমি ওই বাঁধনের হাড্ডি গুঁড়ো করে দেবো।”
অরুণিকা আরাফের কাছে এসে বলল,
“প্লিজ, তুমি রাগ করো না, আরাফ।”
আরাফ শান্ত কন্ঠে বললো,
“তোমার আর উষ্মার বয়স আমাদের চেয়ে কম। ওর চেয়ে আমরা বেশি বুঝবো। আমরা কি করবো, না করবো এটা আমাদের ব্যাপার। কিন্তু তুমি এই কথাগুলো আমাদের সাথে শেয়ার না করে ভুল করেছিলে। এখন থেকে আমাকে সব কথা বলবে। আমাকে না বললে তূর্যকেও বলতে পারো।”
আহনাফ বলল,
“তূর্যকে বলতে হবে কেন? আমাকেও তো বলতে পারো।”
অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আমি তোমাকে কিছুই বলবো না।”
আহনাফ অবাক হয়ে বলল, “কেন?”
অরুণিকা কিছু না বলায় আহনাফ রাগী কন্ঠে বললো,
“এই তুমি আমার সাথে বেয়াদবি করো কেন? সবসময় আমার সাথে বাঁকা বাঁকা কথা বলো।”
“কারণ তুমিই আমার সাথে বাঁকা বাঁকা কথা বলো। আমাকে সবসময় বকা দাও।”
“বাসায় কি শুধু আমিই তোমাকে বকা দেই?”
“হ্যাঁ, তুমিই দাও।”
“ইভান আর আরাফের গুলো কি বকা লাগে না?”
“আরাফ বকা দিতে পারবে। তুমি পারবে না। আর ইভানের সাথে আমি কথায় বলি না। ও নিজেও আমার সাথে কথা বলে না। আমাকে বিরক্তও করে না। কিন্তু তুমি সবসময় আমাকে বিরক্ত করো।”
“অদ্ভুত মেয়ে তো! আমি তোমাকে কখন বিরক্ত করেছি? তুমিই আমার কথা শুনো না। ইভান তো একবার কিছু বললেই তুমি সোজা হয়ে যাও।”
“কারণ আমি তোমাকে ভয় পাই না। ইভানকে ভয় পাই।”
আহনাফ বসা থেকে উঠে অরুণিকার কাছে আসতে যাবে তখনই ইমন তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভাই, আর ঝগড়া করিস না।”
আহনাফ ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললো,
“ও আমার সাথে এমন কেন করবে?”
অরুণিকা দৌঁড়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। তাহমিদ বলল,
“তুই ওকে একদমই বকা দিস না। দেখ, একজনকে এতো মানুষ শাসন করা ভালো না। আরাফ আর ইভান যেহেতু শাসন করছে, সেহেতু আমাদের চুপ থাকা উচিত। তুইও এর মধ্যে কথা বললে, ও আরো রেগে যাবে।”
“তূর্যের সাথে কি রাগারাগি হয় না?”
“খুব কম। আর তূর্য তোর মতো চেঁচামেচি করে না।”
আহনাফ আর কিছু না বলে নিজের রুমে চলে গেলো। সে পুরো দিন রুমে বসে ভাবলো, কিভাবে সে অরুণিকাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে। শেষমেশ তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। পরের দিন আহনাফ তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অরুণিকার রুমে এসে তার পাশে বসে বলল,
“কি করছো?”
অরুণিকা মাথা ঘুরিয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“দেখছো না? হোমওয়ার্ক করছি।”
আহনাফ মুচকি হেসে বললো,
“ঘুরতে যাবে?”
অরুণিকা অবাক হয়ে আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ বলল,
“চলো, আজ তোমাকে বাইকে করে ঘুরাবো।”
অরুণিকা বসা থেকে উঠে আহনাফের কাছে এসে বলল,
“তুমি সত্যি আমাকে বাইরে নিয়ে যাবে?”
“হ্যাঁ। এখন যাবে?”
অরুণিকা এক গাল হেসে বলল, “হ্যাঁ, যাবো।”
আহনাফ রুম থেকে একটা প্যাকেট এনে সেটা অরুণিকার হাতে দিয়ে বলল,
“এটা পরে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। আমি নিচে দাঁড়াচ্ছি।”
আহনাফ চলে যেতেই অরুণিকা প্যাকেট খুলে দেখলো নীল রঙের শর্ট টপস আর হোয়াইট জিন্স। অরুণিকা তাড়াতাড়ি সেটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একনজর দেখে রুম থেকে বের হলো। আরাফ অরুণিকার সাথে নিচে নামলো। আহনাফ অরুণিকাকে দেখে বলল,
“অনেক সুন্দর লাগছে তোমাকে।”
আরাফ বলল,
“হ্যাঁ, তাই বলছি একটু এদিক-ওদিক লক্ষ্য করে বাইক চালাইস।”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে আরাফের দিকে তাকালো। এবার আহনাফ বাইকে উঠে বসলো। অরুণিকাও তাকে শক্ত করে ধরে বসলো।
আহনাফ বাইকে চাবি ঘুরিয়ে আরাফকে বলল,
“যাচ্ছি। বাই।”
অরুণিকাও হাতের ইশারায় আরাফকে বিদায় দিলো। এবার অরুণিকা বলল,
“আহনাফ, তুমিও ব্লু শার্ট পরেছো?”
আহনাফ হেসে বলল,
“হ্যাঁ, কেন, ভালো লাগছে না?”
“হুম, ম্যাচিং ম্যাচিং। বাহ!”
আহনাফ হাসলো। অরুণিকা আবার বলল,
“তোমার আজকে মন ভালো নাকি!”
“হ্যাঁ, আমার মন সবসময় ভালো থাকে। শুধু তুমিই বুঝো না।”
“আচ্ছা! তবে আজকে তোমার মন ভালো আছে, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। তাই তো বিনা মূল্যে ভ্রমণ করাচ্ছো।”
আহনাফ সাথে সাথেই ব্রেক করে বলল,
“আমি কখনো টাকা নিয়ে তোমাকে বাইকে উঠিয়েছি?”
“না, কিন্তু উঠানোর সময় তো বাইকটা একশোবার ধরে বলেছো, যাতে বেশি নড়াচড়া করে তোমার বাইকের কোনো ক্ষতি না করি। নখ দিয়ে সীটে কোনো আঁচড় না দেই। আজ তো এমন জ্ঞান দিচ্ছো না, তাই বললাম।”
আহনাফ পেছন ফিরে অরুণিকার নখ দেখে বলল,
“থাক, নখ কাঁটা আছে, সমস্যা নেই। এখন চুপচাপ বসে থাকো।”
আহনাফ আবার বাইক চালু করলো। এবার অরুণিকা বলল,
“আচ্ছা, আমরা যাচ্ছি কোথায়?”
“চুপচাপ বসে থাকো। গেলেই দেখতে পারবে।”
আহনাফ অরুণিকাকে বিড়লা প্ল্যানেটেরিয়ামে নিয়ে গেলো। তারপর দু’জনই গ্যালারিতে বসে তারা মন্ডল দেখতে লাগলো। অরুণিকার মহাকাশ নিয়ে জানার অনেক ইচ্ছে ছিল। মাঝে মাঝেই সে বিজ্ঞান পড়তে বসলে এসব নিয়ে অনেক প্রশ্ন করে। তাই আহনাফ তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। অরুণিকা পুরো সময়টা আহনাফের হাত ধরে বসে ছিল। সেখান থেকে বের হওয়ার পর অরুণিকার চোখেমুখে আনন্দ খেলা করছে। সে আহনাফের হাত ধরে বলল,
“তুমি জানো, আমার কত্তো ভালো লেগেছে? মহাকাশ এতো সুন্দর হয়?”
আহনাফ হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“হুম, চলো, তোমাকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাবো।”
সে এবার অরুণিকাকে নিয়ে নিকো পার্কে গেলো। সেখানে তারা অনেকগুলো রাইডে চড়লো। এরপর আহনাফ একটা হাওয়াই মিঠাই অরুণিকার দিকে এগিয়ে দিলো। অরুণিকা মনোযোগ দিয়ে সেই হাওয়াই মিঠাই খাচ্ছে। এদিকে আহনাফ অরুণিকার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
“ক্লাসে কোনো ছেলে তোমাকে কিছু বললে, আমাকে বলবে কিন্তু।”
অরুণিকা খাওয়া বাদ দিয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওহ আচ্ছা। তাহলে এতো ঘুরাঘুরি এই জন্য করিয়েছ, যাতে তোমাকে সব বলি?”
“কেন, আমাকে বললে কি সমস্যা?”
“তুমি অনেক মারপিট করো৷ যদি কাউকে মেরে চলে আসো?”
“আসলে আসবো।”
“জ্বি না। আমার রেপুটেশন নষ্ট হয়ে যাবে।”
আহনাফ হাসতে হাসতে বলল,
“বাহ, এতোটুকু মেয়ের রেপুটেশন নষ্ট হয়ে যাবে!”
“হুম, এখন বাসায় চলো।”
“আরেকটু বসি।”
“না, আমাকে মশা কামড়াচ্ছে।”
অরুণিকার জোরাজোরিতে আহনাফ বাধ্য হয়ে উঠল। এদিকে শতাব্দী আজ বাবার বাড়ি এসেছে। শতাব্দীকে দেখতে মহল্লার সব মেয়ে মানুষ ভীড় করেছে। মিতু বালা মেয়েকে সাজিয়ে ঘরে বসিয়ে রেখেছেন৷ কিন্তু শতাব্দীর কিছুই ভালো লাগছে না। শ্রীজা বোনের পাশে বসে বলল,
“তোমাকে এতো অস্থির লাগছে কেন, দিদি? আসার পর থেকেই দেখছি, কেমন ছটফট করছো!”
“কিছু না।”
“বলো না, দিদি। কি হয়েছে?”
“আচ্ছা, তুই আমাকে বাসা থেকে বের করতে পারবি?”
“মানে? কেন?”
“তাহমিদের সাথে দেখা করতে যাবো। ওকে ফোন দিচ্ছি, কিন্তু ফোন বন্ধ।”
“দিদি, বাসায় কেউ জানলে?”
“জানবে না। বেশিক্ষণের জন্য যাবো না।”
শ্রীজা কিছু একটা ভেবে বলল,
“আচ্ছা, দাঁড়াও, আমি দেখছি।”
শ্রীজা রান্নাঘরে এসে দেখলো মা রান্নায় ব্যস্ত। সে নিচে নেমে ডুমুরকে বলতেই ডুমুর একটা বুদ্ধি দিলো। শ্রীজা শতাব্দীর কাছে এসে বলল,
“দিদি, ডুমুর তোমাকে নিয়ে যাবে। খালা বাসায় নেই৷ আমি মাকে বলবো, তুমি ডুমুর আপুর বাসায় গেছো।”
কিছুক্ষণ পর ডুমুর তাদের বাসায় এসে তাকে নিয়ে গেলো। শতাব্দী মাথায় বড় একটা উড়না ঝাঁপিয়ে মহল্লার সামনে থেকে একটা রিকশা নিয়ে তাহমিদদের বাসায় গেলো। গিয়ে দেখলো, ঘরে তালা দেওয়া। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, তারা দু’দিন আগেই বাসা পরিবর্তন করে ফেলেছে। কোথায় গিয়েছে সেটা জানে না। শতাব্দী উপায় না দেখে তাহমিদের পুরোনো রেস্টুরেন্টে গেলো। তবে এবার ভাগ্য তাকে ফিরিয়ে দেয় নি৷ রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়েই সে তাহমিদকে দেখতে পেলো। কিন্তু কোনোভাবেই আর কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ সে দূর থেকেই তাহমিদকে দেখে চলে এলো। বাসায় এসে সোজা রুমে ঢুকে অনেকক্ষণ কাঁদলো। সে এই মুহূর্তে দো’টানার মধ্য দিয়ে আছে!
বিরাজ বিয়ের এক সপ্তাহ পর ক্যাম্পে চলে গেছে। শ্বশুড় বাড়ির কেউই তার সাথে ভালোভাবে কথা বলে না। সারাদিন একটা রুমে বসেই তার সময় কাটে৷ আর এই একাকীত্বটা তাকে কোনোভাবেই তাহমিদকে ভুলতে দিচ্ছে না। জীবনটা তার কাছে কাচের চুড়ির মতো হয়ে গেছে। জোড়া থাকলে সুর সৃষ্টি করে, একা থাকলে নিস্তব্ধতা দিয়ে যায়৷ এই সময়ে তাহমিদকে ভুলে থাকার তার একমাত্র উপায় ছিল বিরাজের সঙ্গ। কিন্তু মানুষটাও কেমন নির্জীব। মনে হয়, তার গলায় জোর করে শতাব্দীকে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এই জোরাজোরির সংসারে, কার গলায় কি বিঁধেছে, তার হিসেব রাখার সময় এই সমাজের নেই।
মা বলেছে, মেয়েদের মানিয়ে নিতে হয়। স্বামীর মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে হয়। কি হাস্যকর জীবন! যেখানে সে অতীতটাকেই ভুলতে পারছে না, সেখানে মরিয়া হয়ে সে কিভাবে বিরাজের মনে জায়গা পাবে?
চলবে-