#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৭||
৭৮.
তূর্য চুপচাপ খোলা বারান্দায় বসে আছে। তারা অনেকদিন ধরেই চট্টগ্রামে আছে, তাই একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে ফেলেছে। বাড়িটা ডুপ্লেক্স, আর প্রতিটা রুমই অনেক বড়। সামনে বাগানও আছে। একমাসের জন্য পঁচিশ হাজার টাকা দিতে হবে। যদিও অনেক পুরোনো বাড়ি, কিন্তু হোটেলে তাদের অনেক অসুবিধা হচ্ছিলো, তার চেয়ে তাদের এই বাড়িটাই অনেক ভালো মনে হয়েছে। এদিকে ইভান তূর্যের কাঁধে হাত রাখতেই সে পাশ ফিরে তাকালো। ইভান বলল,
“মনে হচ্ছে, মন খারাপ!”
তূর্য মাথা নেড়ে বলল,
“না, কিন্তু চিন্তায় আছি।”
“কি বিষয় নিয়ে?”
“উপমাকে নিয়ে।”
“ওহ, হ্যাঁ। ওইদিন কি কিছু হয়েছিল? মেয়েটার সাথে তো তোকে আর কথায় বলতে দেখছি না।”
তূর্য মলিন মুখে বললো,
“মেয়েটা আমাকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসে।”
ইভান বুকে হাত গুঁজে চেয়ারে আরাম করে বসে বলল,
“তোর কি মনে হয় পৃথিবীর সব বান্দায় তোর মতো ভন্ড?”
“ইভান, তুই আমাকে ভন্ড বলছিস?”
“হ্যাঁ, একমাত্র তুই-ই মিথ্যে ভালোবাসার অভিনয় করিস৷ বাকিরা না। আজ পর্যন্ত কয়টা প্রেম করেছিস, হিসাব আছে?”
“আমি একটাও প্রেম করি নি৷ বলতে পারিস, অনেক মেয়ের সাথেই আমি কথাবার্তা বলেছি। আর কথাবার্তা বলার পর ওরা দুর্বল হয়ে পড়লে, আমার তো কিছু করার নেই।”
“আর ওরা তোর জন্য যা যা করতো, ওগুলো শুধু দুর্বল হওয়া ছিল না। ওটা মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে যাওয়া ছিল। ওটা একটা অসুস্থতা, কোনো দুর্বলতা না। আর তুই-ই তাদের অসুস্থ করে দিয়েছিস।”
এবার তূর্য বলল,
“হ্যাঁ, আর এই অসুস্থতার জন্য তারা বড়জোর আমার পেছনে কয়েকদিন ঘুরঘুর করতো। পরে আবার ঠিক হয়ে যেতো। তুই যা-ই বল, আমি কিন্তু ওদের অনেক সাহায্য করেছিলাম।”
“কোন দিক দিয়ে?”
“আরেহ, আমার প্রেমে পড়েই তো ওরা মানসিক ভাবে শক্ত হয়েছিল। একটা ধাক্কা না খেলে মেয়েরা শক্ত হয় না। দুর্বল মনের মেয়েরা সংসারও করতে পারে না। আর তুই যেভাবে বলছিস মনে হচ্ছে কেউ আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। আমি তো কাউকে ভালোবাসি বলি নি।”
“তুই নিজেই তোর দেওয়া মেসেজগুলো একবার পড়ে দেখ। সবসময় ভালোবাসি বলতে হয় না। তোর কথাগুলোই একটা মেয়েকে মানসিকভাবে আকর্ষণ করে ফেলে।”
তূর্য কাতর কন্ঠে বলল,
“ভাই, আর কখনো এমন করবো না। এবারের মতো আমাকে বাঁচা।”
“কি হয়েছে আবার!”
“উপমার ভাই আমার সাথে কথা বলেছে।”
ইভান একটু নড়েচড়ে বসলো। তূর্য মলিন মুখে বললো,
“দেখা করতে বলেছে। আমাকে যদি গণপিটুনি দেয়?”
ইভান বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আর বলল,
“আমাকে কেন বলছিস এসব? আমি কি করবো এখানে?”
“আমার সাথে যাবি। আর বলবি যে আমি রিকি না। বলবি, আমার মাথায় সমস্যা আছে। বলে দিস, আমার ভুলে যাওয়ার রোগ আছে।”
“তুই কি আমাকে তোর মতো গাঁধা মনে করেছিস? আমি বলবো, আর সে বিশ্বাস করবে? বাহ!”
ইভান চলে যেতেই তূর্য উঠে বাইরে চলে গেলো। আর আহনাফকে ফোন করে পরামর্শ চাইলো। আহনাফ পরামর্শ দেওয়ার পরিবর্তে বলল,
“তোকে গণপিটুনি দেওয়ার সময় ইভানকে বলিস ভিডিও করতে। আমরা লাইভ দেখতে চাই।”
পরের দিন ইভানের জোরাজুরিতে তূর্য আদিলের সাথে সেই জায়গায় দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলো, যেখানে উপমার সাথে দেখা হয়েছিল। আর দেখা করতে না চাইলে রিকির জন্য এটা অসম্মানজনক হবে। তূর্য যদি কোনো সাধারণ মানুষ হতো, তাহলে এই বিষয়টা এড়িয়ে যেতে পারতো। কিন্তু সমস্যা হলো, সে-ই রিকি, আর এটা এখন উপমা জানে। তাই নিজের সম্মান রক্ষার্থে তূর্য ইভানকে নিয়ে রিকশায় উঠে পড়লো। অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর হঠাৎ পেছন থেকে একটা বাইকের সাথে ধাক্কা লাগায়, ইভান আর তূর্য দু’জনই ধপ করে রিকশা থেকে নিচে পড়ে গেলো। তূর্য ওরকম ব্যথা না পেলেও, ইভানের অনেকখানি ছিঁড়ে গিয়েছিল। ইভান হাত ধরে বসে রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল, তখনই একটা হেলমেট পরা মেয়ে তার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“সরি, সরি, সরি। কিছু বদমাশ লোক আমার পিছু করছিল, ওদের থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য হুড়োহুড়ি করতে গিয়েই আপনার রিক্সা উলটে দিয়েছি।”
ইভান মাথা তুলে মেয়েটার দিকে তাকাতেই মেয়েটা বলল,
“আরেহ, আপনি সেদিনের সেই লোকটা না?”
তূর্য উঠে ইভানকে ধরে বসালো। মেয়েটা তার হেলমেট খুলে বলল,
“আমি আপনাকে রিকশাওয়ালা মামা ভেবেছিলাম।”
এই বলে মেয়েটা রিকশাওয়ালা মামার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলল,
“আমাকে মাফ করবেন, মামা। আমি বুঝতে পারি নি।”
মেয়েটাকে এতো বিনয়ের সাথে অপরাধস্বীকার করতে দেখে রিকশাওয়ালা মামা বললেন,
“সমস্যা নাই আপা, আপনে ঠিক আছেন?”
ইভান দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
“জ্বি না, আমি ঠিক নেই।”
ইভান তূর্যের হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো, আর মেয়েটার দিকে আঙ্গুল তাক করে তূর্যকে বলল,
“এই মহিলাটা যেখানেই যায়, ঝামেলা করে। ওদিনও একটা ঝামেলা বাঁধিয়েছিল।”
মেয়েটা তেড়ে এসে বলল,
“কি বললেন? আমি মহিলা? আপনার কি আমাকে মহিলা মনে হয়?”
ইভান তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“তাহলে কি আপনি পুরুষ? ওহ, আচ্ছা। মেয়ে সেজে ঘুরছেন!”
সানায়া রাগী কন্ঠে বললো,
“আই এম সানায়া। আর আমি একজন মেয়ে। মহিলা না।”
তূর্যও সানায়ার কথায় সম্মতি দিয়ে ইভানকে বলল,
“হ্যাঁ, মেয়েই তো। তোর মহিলা বলা উচিত হয় নি। এতো বয়সও তো হয় নি।”
ইভান রাগী দৃষ্টিতে তূর্যের দিকে তাকাতেই তূর্য সানায়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আর আপনি যে আমার বন্ধুকে লোক বললেন!”
রিকশাওয়ালা মামা বললেন,
“ভাইজান, আপনেরা উঠেন। যাবেন না?”
তূর্য ইভানকে রিকশায় উঠিয়ে দিলো। রিকশার পেছনের অংশটা বেঁকে গেলেও রিক্সাটা এখনো চলার মতো উপযুক্ত। তূর্য আর ইভান বসতেই সানায়া বলল,
“আমার বাইকটা কে উঠাবে?”
তূর্য আবার রিকশা থেকে নামতে যাবে, তখন ইভান বলল,
“মামা রিকশা টানেন। এতো ঝামেলা ভালো লাগে না।”
রিক্সা চলা শুরু করতেই সানায়া হাঁ করে রিকশার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর নিজেই বাইক উঠাতে যাবে ততোক্ষণে তার বডিগার্ডদের গাড়ি চলে এলো। তারা এসেই বাইকটা উঠিয়ে বলল,
“ম্যাম আপনি ঠিক আছেন?”
সানায়া দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“না, কিভাবে ঠিক থাকবো? তোমরাই যেখানে আমার পিছু ছাড়ছো না।”
“মন্ত্রী সাহেব আপনার সাথে থাকতে বলেছেন।”
সানায়া বিড়বিড় করতে করতে গাড়িতে উঠে বসে তার বাইকের চাবিটা গার্ডকে দিয়ে বলল,
“স্কুটিটা গ্যারেজে নিয়ে যাও। সমস্যা থাকলে ঠিক করিয়ে বাসায় দিয়ে আসবে।”
“ওকে ম্যাম।”
এদিকে আজ দুপুরে মাওশিয়াত ইমনকে তার বাসায় নিয়ে এলো। মাওশিয়াত ইমনকে রুমে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“আজকে আমি নিজের হাতে তোমার জন্য রান্না করেছি।”
ইমন মুচকি হেসে মাওশিয়াতের হাতে হাত রাখলো। মাওশিয়াত বলল,
“তুমি বসো, আমি এক্ষুনি আসছি।”
ইমন মাওশিয়াতের রুমে এদিক-ওদিক হাঁটছে। তখনই সে পেছন ফিরে একজন মহিলাকে দেখে থমকে গেলো। ইমন তার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। মহিলাটি একটা কাপড় দিয়ে মাওশিয়াতের চেয়ার টেবিল মুছছিল। সে মহিলাটির দিকে আগাতেই মাওশিয়াত এসে বলল,
“চলো। ফ্রেশ হয়ে খেতে আসো।”
ইমনও বেশিক্ষণ না ভেবে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলো। খাওয়া-দাওয়ার পর ইমন আর মাওশিয়াত এক রুমে বসে গল্প করছিল। মাওশিয়াত দরজাটা ভেতর থেকেই বন্ধ করে দিয়েছে। ইমন তখন উঠে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। মাওশিয়াত অবাক হয়ে বলল,
“দরজায় কি দেখছো?”
ইমন মাওশিয়াতের পাশে বসে ধীর কন্ঠে বললো,
“এই মহিলাটা কে?”
মাওশিয়াত ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কার কথা বলছো?”
“এই যে একটু আগে রুমে এলো।”
“ওহ উনি তো রাহেলা খালা। উনি আমাদের বাসায় কাজ করেন।”
“কখন থেকে?”
“সাড়ে তিন বছর হচ্ছে।”
“ওহ।”
“উনার কথা কেন জিজ্ঞেস করছো?”
“এমনিতেই।”
ইমন অজানা ভাবনাতেই ডুবে গেলো। এদিকে তূর্য আর ইভান আদিলের সামনে বসে আছে। আদিল তূর্যকে ভালোভাবে দেখে বলল,
“উপমা আমার একমাত্র বোন। ছোটবেলা থেকে ওর সব আবদার আমি আর বাবা পূরণ করেছি। ওকে কষ্টে দেখলে, আমার খুব খারাপ লাগে। যা বুঝলাম, তুমি ওকে ইগনোর করছো।”
ইভান তূর্যকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই বলল,
“এমন কিছুই না। ও একটু অসুস্থ ছিল, তাই হয়তো…”
আদিল ইভানকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি নিজেও একজন পুরুষ। আমি বুঝি পুরুষ মানুষের অবহেলা, আর তাদের অজুহাত। ও যদি সত্যিই অসুস্থ থাকতো, তাহলে অন্তত উপমাকে জানাতে পারতো।”
তূর্য প্রসঙ্গ পালটে বললো,
“আপনি আমার সাথে কেন দেখা করতে চেয়েছিলেন?”
“আমি তোমাকে জোর করতে আসি নি। শুধু বলতে এসেছি, অনেক বছর ধরেই উপমা রিকির পেছনেই সময় নষ্ট করে গেছে। বাসার সবাই এটা জানে। আর সবার কাছে এটা অস্বাভাবিক ছিল না, কারণ তুমি একজন স্টার। স্বাভাবিকভাবেই একজন গায়কের ভক্ত থাকেই। কিন্তু তোমার সাথে কথাবার্তা না হলে জিনিসটা স্বাভাবিকই থাকতো। এখন তুমি উপমার সাথে কথা বলেছো, ও এটাকে ভালোবাসা ভেবে অনেক আশা করেছিল। কিন্তু দিনশেষে ওর আশা, ওর অনুভূতি, সব মিথ্যে হয়ে গেলো। যদিও আমি ওর ফোন নিয়ে ফেলেছি। দেখলাম, তোমাকে অনেক উল্টাপাল্টা মেসেজ দিয়েছে, তোমার কাছে ভিক্ষা চেয়ে বলেছে, ওর কাছে ফিরে আসতে। ও তোমাকে অনেক ভালোবাসবে। ব্লা, ব্লা, ব্লা। শুনো, ও এসব আবেগের বশে লিখে ফেলেছে। হয়তো নিজের আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে নি। রাখবেই বা কিভাবে, যাকে সে অনেক বছর ধরে দেখার আশায় ছিল, যাকে সে না দেখেই ভালোবাসতো, তাকে দেখে ফেলার পর, পাওয়ার লোভটা তো একদম স্বাভাবিক। আমি তোমাকে শুধু এতোটুকুই বলবো, উপমাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলো, তুমি কেন অবহেলা করছো? ওকে এটা বুঝতে দিও না যে তুমি একজন স্টার, তাই তুমি ওকে চাও না। তুমিই একমাত্র ওকে স্বাভাবিক করতে পারবে। এভাবে অবহেলা করে, তুমি উপমাকে মানসিকভাবে ভেঙে দিচ্ছো। ওকে শক্ত করার জন্য তোমার ওকে বোঝাতে হবে, তোমার সমস্যাগুলো দেখিয়ে, ওকে তোমার সমস্যা বানিয়ে না।”
আদিলের কথাগুলো শুনে তূর্যের ভেতর অনুশোচনা কাজ করতে লাগলো। সে হুট করেই বলে ফেলল,
“আমি উপমাকে বিয়ে করতে চাই।”
তূর্যের কথা শুনে আদিলের চেয়ে বেশি ইভানই অবাক হলো। তূর্য আবার বলল,
“আমি উপমাকে বিয়ে করবো, যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে।”
চলবে-