অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৫২||

0
1098

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫২||

৮৬.
চার বছর পর-
টুইংকেল হাউজ আজ বিয়ের সাজে সেজেছে। বাড়ির গেইটটি ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। বাগানের প্রতিটি গাছের সাথে মরিচ বাতি ঝুলছে। ভেতরে ঘর সাজানোর কাজ চলছে। বাইরে থেকে কয়েকজন লোককে কাজে রাখা হয়েছে। রান্নাঘরে বিভিন্ন পদের মিষ্টান্ন তৈরী করছে তাহমিদ, আর তাকে সাহায্য করছে উপমা। পাশেই ডায়নিংয়ে খাবারের প্লেট সাজিয়ে রাখছে তূর্য। বসার ঘরে বসে মেহমানদের তালিকা তৈরী করছে আরাফ আর আহনাফ। এদিকে ইভান ইমনকে ঘুম থেকে উঠানোর জন্য দু’তলায় উঠেছে। ঘড়িতে দুপুর বারোটা। এখনও তার ঘুম থেকে উঠার কোনো লক্ষণ নেই। ইভান ইমনকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,
“উঠ না, ইমন। আজ তোর এনগেজমেন্ট, ভুলে গেছিস নাকি? মাওশিয়াতের বাবা-মা আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। বাসায় অনেক কাজ। কখন উঠবি?”

ইমন চোখ কচলাতে কচলাতে বলল,
“ভাই, তুই যা না। আমি আরেকটু ঘুমাবো।”

হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে পুরো ঘর গুঞ্জন করে উঠলো। ইমন সাথে সাথেই বালিশ থেকে মাথা তুলে এক দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। আহনাফ এসে দরজা খুলে দেখলো আদিল এসেছে, আর তার পাশে ইমান দাঁড়িয়ে আছে। ইমানকে দেখেই আহনাফের মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেলো। ইমান আহনাফকে দেখেই তার দিকে হাত এগিয়ে দিলো। এদিকে উপমা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে ভাইকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরলো। আর আদিল বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। উপমা এবার ইমানকে দেখে বলল,
“আরেহ, ইমান। কেমন আছো?”

ইমান মাথা নেড়ে বলল,
“জ্বি, আপু। ভালো আছি। আপনারা কেমন আছেন?”

“হ্যাঁ, ভালো। বসো বসো।”

ইমান আরাফের পাশে বসলো। আরাফ একবার ইমানের দিকে তাকালো, আরেকবার আহনাফের দিকে। আহনাফের মুখের অন্ধকার ভাবটা বুঝিয়ে দিচ্ছে ইমানের আগমনে সে খুশি হয় নি। এদিকে উপমা দু’তলায় উঠেই ইভানের মুখোমুখি হলো। ইভান তাকে জিজ্ঞেস করলো,
“কে এসেছে?”

“ভাইয়া আর ইমান এসেছে।”

“ওহ আচ্ছা। তাই বলো! আর ইমন ভেবেছে মাওশিয়াতের ফ্যামিলি এসেছে। তাই প্রথম বেল শুনেই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়েছে।”

উপমা হেসে বলল,
“এক প্রকার ভালোই হয়েছে। মাওশিয়াত আপুরা রাস্তায় আছে৷ যেকোনো সময় চলে আসবে। ইমন ভাইয়া আগে থেকেই তৈরী হয়ে নিলে আর দেরী হবে না। আচ্ছা, ভাইয়া, আমি অরুণিকাকে ডাকতে যাচ্ছি। ওরও হয়তো এখনো ঘুম ভাঙেনি।”

উপমা পাশের সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠলো। তিনতলার একদম শেষের ঘরটা অরুণিকার। উপমা তার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“মুনলিট, কোথায় তুমি? দরজা খুলো। বাসায় গেস্ট আসা শুরু করে দিয়েছে। ভাইয়া আর ইমানও এসে গেছে।”

‘ইমান’ নামটি শুনে অরুণিকা লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসলো। তার এলোমেলো চুলগুলো মুখের উপর এসে ছড়িয়ে পড়েছে। সে চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে বলল,
“ভাবী, আমি উঠে পড়েছি।”

উপমা চলে যেতেই অরুণিকা তাড়াতাড়ি আলমারী খুলে কাপড় খুঁজতে লাগলো। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সে তার পছন্দের লাল রঙের জামাটা বের করে মুচকি হাসলো৷ প্রায় বিশ মিনিট ধরে আয়নার সামনে বসে নিজেকে পরিপাটি করে সাজিয়ে সে ঘর থেকে বের হলো।

ছয় বন্ধুর পরিশ্রমে এই ‘টুইংকেল হাউজে’ তারা গত বছরই উঠেছিল। চারতলা বাড়ি। উপরে ছাদের পাশেই ছোট একটা সুইমিংপুল। সুইমিংপুলের নিচ বরাবার প্রতিটি ঘরের বারান্দা। বারান্দাগুলো এক একটা রুমের সমান বড়। অরুণিকার ঘরটি তিনতলার দক্ষিণ মুখী। পাশেই আরাফের ঘর। আর আরাফের ঘরের মুখোমুখি ইভানের ঘর৷ এরপর সিঁড়ি ঘর। সিঁড়িঘরের সাথে লাগানো বিশাল বড় লাইব্রেরি। এই ঘরটি বই পত্র আর গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্রে ভরে আছে। ছ’জন এখানে বসেই তাদের গুরুত্বপূর্ণ আলাপ জমায়। দ্বিতীয় তলার দক্ষিণ মুখে তূর্যের স্টুডিও। এখানে বসে সে গান করে, আর ভিডিও বানায়। আর উত্তর দিকে আহনাফ, ইমন আর তূর্যের রুম। নিচ তলায় দক্ষিণ মুখে বসার ঘর, উত্তরে রান্নাঘর আর ডায়নিং। তূর্যের বিশেষ অনুরোধে এই বাড়ির নাম রাখা হয়েছে টুইংকেল হাউজ।

এদিকে অরুণিকা দু’তলার সিঁড়ি থেকে নিচের দিকে উঁকি দিয়ে বসার ঘরের দিকে তাকালো। বড় পর্দার জন্য ভেতরের কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। তাকে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখে তাহমিদ নিচ থেকে বলে উঠলো,
“অরুণিকা, কি করছো? রান্নাঘরে গিয়ে উপমাকে একটু সাহায্য করো। মাওশিয়াতরা কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।”

অরুণিকার নাম শুনে ইমান বসার ঘরের পর্দার ফাঁকা অংশের দিকে তাকালো। অরুণিকাও সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো। পাশ ফিরতেই আহনাফ তার সামনে এসে দাঁড়ালো। অরুণিকা আহনাফকে দেখেই মুচকি হেসে বলল,
“কেমন লাগছে আমাকে?”

আহনাফ মুগ্ধ দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইলো। সবে আঠারোতে পা দিয়েছে অরুণিকা। তার চোখে-মুখে, চলন-বলনে যৌবনের সৌন্দর্য ঠিকরে উঠেছে। তার পিঠ বরাবর ঘন চুলগুলো হালকা এলোমেলো হয়ে আছে। তাই আহনাফ হাত বাড়িয়ে তার চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
“কতোবার বললাম চুল বেঁধে আসো। এতো লম্বা চুল খোলা রাখলে এলোমেলো হয়ে যাবে তো।”

অরুণিকা বুকে হাত গুঁজে বলল,
“এতো কথা না বলে আগে বলো আমাকে কেমন লাগছে?”

আহনাফ মুচকি হেসে বলল,
“সুন্দর লাগছে। খুব সুন্দর লাগছে।”

অরুণিকা লাজুক হেসে রান্নাঘরে চলে গেলো। আহনাফও অরুণিকার পিছু পিছু এলো। উপমা আহনাফকে দেখে বলল,
“ভাইয়া, আপনি এখানে? কিছু লাগবে?”

“না, কিছু লাগবে না। এমনিতেই এসেছি।”

উপমা মুখ চেপে হেসে অরুণিকার দিকে তাকালো। তারপর আস্তে করে সরে গেলো। আহনাফ এমনিতে রান্নাঘরে পা দেবে না, কিন্তু যখনই অরুণিকা রান্নাঘরে ঢুকবে, তখনই আহনাফ তার আশেপাশে ঘুরঘুর করবে। তাকে টুকটাক জিনিসপত্র এগিয়ে দেবে। অরুণিকাও এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ইদানীং আহনাফ তার পাশে না থাকলে তার কাজে ভুল হয়ে যায়। কখনো পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে হাত কেঁটে ফেলে, কখনো বা হাতে গরম তেল ছিঁটকে পড়ে, কখনো কাচের জিনিস ভেঙে যায়, কখনো বা ভুল ভাল মশলা দিয়ে রান্নার বারোটা বাজিয়ে আসে।

অরুণিকা শরবত বানিয়ে ট্রে-তে উঠাতেই আহনাফ বলল,
“শরবত কার জন্য বানিয়েছো?”

অরুণিকা বলল,
“আদিল ভাইয়াদের জন্য।”

“উপমা বানিয়ে দিয়েছিল। ওদের নাস্তা দেওয়া হয়ে গেছে।”

“আচ্ছা, আমি না হয় আরেকবার দিয়ে আসি। আজ একটু গরম পড়ছে। দুই বার শরবত খেলে ভালো লাগবে।”

আহনাফ ট্রে হাতে নিয়ে বলল,
“আচ্ছা, আমাকে দাও। আমি নিয়ে যাচ্ছি।”

আহনাফ ট্রে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো, আর অরুণিকা মুখ ছোট করে দাঁড়িয়ে রইলো। অরুণিকা মনে মনে ভাবছে, এখন কিভাবে ইমানের সামনে যাবে? কোনো অজুহাত ছাড়া সে এমনিতেই ইমানের সামনে যাবে, এটা অসম্ভব ব্যাপার। কারণ আরাফের নিষেধ আছে, ঘরে কোনো ছেলে, অতিথি হিসেবে আসলে অরুণিকা যাতে তাদের সামনে না যায়। বাসায় মাঝে মাঝে অফিসের লোক আসে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের ব্যবসায়িক কাজে কিছু লোকের যাওয়া আসা হয়। ইমানও তেমনই। তবে ইমানের সাথে তাদের পরিচয়টা এক বছর ধরেই। আদিলই প্রথম ইমানের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ইমান একজন সাংবাদিক। সে পত্রিকায় লেখালেখি করার পাশাপাশি, ছোট একটা গোয়েন্দা সংস্থাতে কাজ করে। মূলত ইমান ছ’জনকে তাদের শত্রুপক্ষের সব তথ্য এনে দেয়। আদিল আর ইমানের কারণেই তারা ছ’জন এখন মির্জা গ্রুপ আর বাস্কার গ্রুপ সহ আরো অনেক ব্যবসায়ীক গ্রুপের তথ্য নিয়ে ফেলেছে।

এদিকে অরুণিকা মন খারাপ করে সিঁড়িতে বসে আছে। এই মুহূর্তে কোনো ভাবেই ইমানের দেখা পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ইমানকে তার খুব ভালো লাগে। যদিও কখনো তার ইমানের সাথে একা কথা বলার সুযোগ হয় নি। কিন্তু দূর থেকে ইমানের কথা শুনেই তার ইমানকে ভালো লেগে গেছে। অরুণিকার হাবভাব আরাফ আর আহনাফ ধরতে পেরেছে। তাই আরাফ ইমানকে বাসায় আনতে চায় না। তবে মাঝে মাঝে আদিলের সাথে ইমান বাসায় চলে আসে। এদিকে ইমানের প্রতি অরুণিকার দুর্বল হয়ে যাওয়াটা আহনাফের একদমই সহ্য হচ্ছে না। দিনদিন সে মানসিকভাবে ভেঙে যাচ্ছে। এতো বছর ধরে সে নিরবে অরুণিকাকে ভালোবেসে গেছে আর আরাফ ছাড়া কারো কাছেই সে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করে নি। কিন্তু আজ তার ভালোবাসার মানুষটি অন্য কারো চোখে ভালোবাসা খুঁজতে ব্যস্ত।

আবার কলিংবেল বেজে উঠতেই আহনাফ দরজা খুলে দিলো। দেখলো মাওশিয়াত ও তার পরিবারের সবাই চলে এসেছে। তারা গতকাল কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছিল। আর আজই ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এসেছে৷ এনগেজমেন্ট আর আক্দের পরই তারা মাওশিয়াতকে নিয়ে চলে যাবে। আর কয়েক সপ্তাহ পর ইমন সময় নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মাওশিয়াতকে কলকাতা থেকে উঠিয়ে আনবে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা কলকাতায় হবে। তবে বাংলাদেশে ইভান খুব আয়োজন করে ইমনের আক্দ অনুষ্ঠানটা করতে চাচ্ছে। সে আগে থেকেই আক্দের স্থানটি ঠিক করে রেখেছে। যেদিন ইমন আর মাওশিয়াতের আক্দ হবে সেদিনই তাদের জীবনে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ঘটতে যাবে, যেই দিনটির জন্য তারা চৌদ্দ বছর ধরে অপেক্ষা করেছিল।

মাওশিয়াতকে দেখেই অরুণিকা ছুটে গেলো। মাওশিয়াত খুব শক্ত করে অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরলো। এই চার বছরে অরুণিকার সাথে শুধু ভিডিও কলেই কথা হয়েছিল। তাই এতো বছর পর অরুণিকাকে দেখে সে আবেগ আটকে রাখতে পারলো না। অরুণিকাও ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো। সে মাওশিয়াতের হাত ধরে বলল,
“জানো, আপু। তোমাকে কতো মিস করেছিলাম! ওখানের কথা আমার অনেক মনে পড়ে। আমার খুব ইচ্ছে করতো কলকাতায় যেতে৷ কিন্তু তোমার হবু বর আর তার ভাই-বন্ধুরা এই ঘর থেকে কাজ ছাড়া বেরুতেই চায় না। নিজেরা তো যাবেই না, আর আমাকেও যেতে দেবে না।”

মাওশিয়াত অরুণিকার থুতনি ধরে বলল,
“অরু, তুই কতো বড় হয়ে গেছিস! চাইলে নিজে নিজেই তো যেতে পারতি। থাক, এখন বিয়ে উপলক্ষে তো যাওয়া হবেই।”

সবার সাথেই মাওশিয়াত ও তার পরিবারের কুশল বিনিময় হলো। ইমনও ততোক্ষণে নিচে নামলো। সে এসেই মাওশিয়াতের বাবা-মাকে সালাম করলো। তারপর মাওশিয়াতের সামনে এসে দাঁড়ালো। মাওশিয়াত ইমনকে দেখে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“শেষমেশ আমায় ডেকেছো!”

ইমন মাথা নিচু করে মলিন মুখে বললো,
“সরি, অনেক দেরী করে ফেলেছি, তাই না?”

“অনেক বেশি। চার বছর ধরে তোমার অপেক্ষা করেছি। অনেকে অনেক কথা বলেছে। সবাই ভেবেছে, তুমি আমাকে কথা দিয়ে পালিয়ে গেছো। কিন্তু আমি জানতাম, আমার ইমন তার মাওকে কতোটা ভালোবাসে। তোমাকে চার বছর সময় দিয়েছিলাম, আমাকে সারাজীবন সময় দেওয়ার জন্য। আজ কিন্তু আমাকে সময় দেওয়ার সময় এসেছে।”

ইমন মাওশিয়াতের হাত শক্ত করে ধরে বলল,
“তুমি আমাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছ। আমি ভাবতাম, হয়তো স্বপ্ন পূরণ কর‍তে গিয়ে ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেলবো। কিন্তু না। তুমি আমার জন্য অনেক করেছো মাও। তোমাকে এর চেয়ে বেশি অপেক্ষায় রাখা আমার পক্ষে সম্ভব না।”

ইমন আর মাওশিয়াতের কথোপকথন শুনে তূর্য উপমার দিকে তাকালো। উপমা অপরাধীর মতো তূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। চার বছরের সংসারে উপমা এখনো তূর্যের ভালোবাসা পায় নি। বাংলাদেশ আসার পর তারা শুরুর দিকে ভাড়া বাসায় ছিল। যেখানে উপমা আর তূর্য অরুণিকাকে নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাটে উঠেছিল। আর পাশের ফ্ল্যাটে বাকিরা ব্যাচেলরদের মতো থাকতো। তিন বছর তারা সেখানেই ছিল। এই তিন বছরে তূর্য বেশিরভাগ সময় বাইরে বা পাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে বন্ধুদের সময় দিতো। তবে এর জন্য উপমাও অনেকখানি দায়ী৷ সে তূর্যের কাছে স্ত্রীর অধিকার কখনোই চায় নি৷ তূর্য যা করতো তা-ই সে মেনে নিতো। কখনো তূর্যের অবহেলা গায়ে মাখে নি। নিজেই সব কষ্ট মুখ ভুজে সহ্য করতো। কারণ উপমার মনে একটাই ভীতি ছিল, সে অধিকার চাইতে গেলে যদি তূর্য তাকে ছেড়ে দেয়? আর এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। আর তূর্য তাকে ছেড়ে দিলেই সবাই এটা নিয়ে হাসাহাসি করবে। সবাই বলবে, আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখার পরিণতি এমনই হয়।
চার বছর ধরে উপমা নিজেকে গুটিয়ে রাখতে রাখতে একদম নেতিয়ে পড়েছে। কারো সামনে সে কিছুই বলার সাহস পায় না। দুই বছর আগেই উপমা সন্তানসম্ভবা হয়েছিল। তূর্যের চোখেমুখে তখন অনেক আনন্দ ছিল। সেই মুহূর্তে তূর্য উপমার যথেষ্ট খেয়াল রেখেছিল। কিন্তু নিজের বেখেয়ালির কারণে তিনমাসেই উপমার মিসক্যারেজ হয়ে যায়। এরপর থেকে তূর্য তার কাছ থেকে আরো দূরে সরে যেতে থাকে।
এদিকে তূর্যের পুরোনো অভ্যাস এখনো যায় নি। সে এখনো বিভিন্ন মেয়ের সাথে কথাবার্তা বলে। মাঝে মাঝে দেখাও করে। তবে তার প্রেম ঘটিত কোনো সম্পর্ক নেই। শুধুমাত্র বন্ধুত্ব পর্যন্তই গড়িয়েছে। অন্যদিকে উপমাও তূর্যের মেয়েদের সাথে ঘোরাফেরার খবর জানে-বুঝে, তবুও কোনো অভিযোগ করে না। আর উপমার এই চুপ করে থাকাটাই তূর্যকে আরো বেশি সুযোগ দিচ্ছে।

৮৭.

অরুণিকা আর উপমা খাবারের টেবিল গুছিয়ে সবাইকে খেতে ডাকলো৷ ইমানও আদিলের পিছু পিছু ডায়নিংয়ে এসে বসেছে। অরুণিকার সাথে চোখাচোখি হতেই ইমান চোখ নামিয়ে নিলো। অন্যদিকে আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে৷ আরাফ তা দেখে অরুণিকাকে বলল,
“অরু, তুমি এদিকে বসো। খেয়ে নাও।”

অরুণিকা আরাফ আর আহনাফের মাঝখানে এসে বসলো। অরুণিকা চেয়ারে বসে কোণা চোখে ইমানের দিকে তাকালো। আহনাফ অরুণিকার প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল,
“এদিকে দেখো অরু। কি কি দেবো?”

অরুণিকা আহনাফের হাত থেকে চামচ নিয়ে বলল,
“আমি নিচ্ছি।”

আহনাফ চুপচাপ খাচ্ছে। তার মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। হঠাৎ আরাফ খাওয়ার মাঝখানে বলে উঠল,
“ইমন আর মাওশিয়াতের বিয়ের পর পরই আরেকটা বিয়ের আয়োজন করবো ভাবছি।”

সবাই অবাক হয়ে আরাফের দিকে তাকালো৷ মাওশিয়াতের বাবা, মিরাজ হাসান জিজ্ঞেস করলেন,
“হ্যাঁ, বিয়ে তো একটা না, আরো চার-পাঁচটা হওয়া এখনো বাকি। তোমাদের সবারই তো বিয়ের বয়স হয়ে গেছে৷ মেয়ে পছন্দ থাকলে করে নাও। তূর্য তো আগেই বিয়ের কাজ সেরে ফেলেছে।”

“হ্যাঁ, বিয়ে তো হবে। তবে এবার আহনাফের বিয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা ভাবছি।”

তূর্য একবার আহনাফের দিকে তাকালো, আরেকবার অরুণিকার দিকে। আহনাফ মনে মনে খুশি হলেও সেটা প্রকাশ করলো না। আর অরুণিকা খাওয়া বাদ দিয়ে বলে উঠল,
“আহনাফ, তুমি সত্যি বিয়ে করবে? আমার তো অনেক ভালো লাগছে। এখন বাসায় আরো দুইজন নতুন সদস্য আসবে।”

অরুণিকার কথা শুনে ইভান আর তাহমিদ গম্ভীরমুখে আরাফের দিকে তাকালো। আর ইমন শব্দ করে হেসে উঠলো। ইমনের হাসির শব্দ শুনে অরুণিকা বলল,
“তুমি হাসছো কেন?”

আরাফ অরুণিকাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“অরু, চুপচাপ খেয়ে নাও।”

অরুণিকা মাথা নিচু করে আহনাফের দিকে কোণা চোখে তাকালো। দেখলো আহনাফ খাবারের দিকে তাকিয়ে আছে। অরুণিকা বাঁকা হাসি দিয়ে কনুই দিয়ে আহনাফের বাহুতে গুঁতো দিয়ে বলল,
“লজ্জা পাচ্ছো, তাই না!”

ইমন অরুণিকার কথা শুনে আরো জোরে হেসে উঠলো। এবার মাওশিয়াত ইমনকে বলল,
“তুমি হাসছো কেন?”

ইমন ফিসফিসিয়ে বলল,
“সাসপেন্স আছে। শীঘ্রই জানতে পারবে।”

খাওয়া দাওয়ার পর তূর্য আরাফের কাছে এসে বলল,
“এভাবে খাবারের টেবিলে কথাটা কেন তুলেছিস?”

আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কেন কি সমস্যা?”

“আমাদের আগে টুইংকেলের মতামত জানা দরকার।”

“আমি অরুর ভালো-মন্দ বুঝি৷ আমার সিদ্ধান্ত ওর মতামতের চেয়েও ঊর্ধ্বে। কারণ ওর এই মুহূর্তে সঠিক মত দেওয়ার মতো বয়স হয় নি।”

“দেখ, চুক্তিটা কলকাতায় হয়েছিল। তার অর্থ এই না যে, চুক্তিটা বাস্তবায়ন করতেই হবে।”

“তুই কোন চুক্তির কথা বলছিস?”

“কলকাতায় টুইংকেলের কেইসে যেই চুক্তি হয়েছিল, সেটার কথা বলছি।”

“অবশ্যই না। আমি সেই চুক্তিতে বিয়ের কথা বলি নি। এটা আমার ইচ্ছে। ইনফ্যাক্ট, এটা দাদা-দাদীর শেষ ইচ্ছে। বাবা, চাচ্চুদের শেষ ইচ্ছে।”

তূর্য অবাক হয়ে বলল, “মানে?”

“দাদা আর দাদী অরুর জন্মের কিছুমাস পরই আহনাফের সাথে ওর বিয়ে দেওয়ার অসিয়ত করেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে বাবা দলিলে মৈত্রী গ্রুপে আমাদের ভাগের ৫০ ভাগ সম্পত্তি অরুণিকার নামে লিখে দিয়েছিলেন। কারণ আমার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। মাও মৃত্যুর আগে এটাই চেয়েছিলেন, যাতে আমি ডাক্তারি পড়ি। তাই আমি মৈত্রী গ্রুপের দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ কখনোই পাবো না। আর দিশান তো অরুর ছোট ছিল। তাই তারা আহনাফ আর অরুর বিয়ের কথা বলেছিল। তারা ভেবেছিলেন, অরুর আঠারো হলেই তাদের বিয়ে দিয়ে দেবেন। আর অরু আমাদের বংশের একমাত্র মেয়ে ছিল। আমাদের কোনো ফুফিও ছিল না। দাদা-দাদি চায় নি, ও অন্য ঘরে যাক। এটাই দাদা-দাদির ওসিয়তনামা ছিল। আমার এটা পালন করতেই হবে।”

“কিন্তু আহনাফ!”

আরাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“একটা সময় আহনাফ এটা মানতে চায় নি। কারণ ও তখন ছোট ছিল। সবাই যখন ওর সামনে বিয়ের কথা বলতো ও অনেক রেগে যেতো। আর এটা অস্বাভাবিক কিছু না। কাজিন-কাজিনে কতো মারামারি হয়। আর অরুর জন্য ওকে বকা শুনতে হতো, তাই ও ভাবতো বিয়ের পর অরু ওর ঘাড়ে চেপে বসবে। এটা তো ছোট বয়সে মনে আসা স্বাভাবিক। ওর বয়সও তো তখন বেশি ছিল না। তোরো-চৌদ্দ ছিল মাত্র। আর তোরা জানতে চেয়েছিলি না, আহনাফ কেন অরুর ব্যাপারে খিটখিটে ছিল? এই কারণেই। কিন্তু ধীরে ধীরে তো ওর খিটখিটে ভাবটা কেটে গেছে, তাই না?”

তূর্য ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তার মানে আমরা যেটা এতোদিন ভাবতাম, ওটাই ঠিক। আহনাফ টুইংকেলকে ভালোবাসে?”

“হ্যাঁ।”

“এটা কি শুধুই আমিই জানতাম না?”

“সবাই তো জানতো। তুইও জানতি। শুধু অজানা হয়েই থাকতি। আহনাফের হাবভাব দেখলে এটা বুঝে যাওয়া স্বাভাবিক।”

“হ্যাঁ, স্বাভাবিক। আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু টুইংকেলের দিক থেকে এমন কিছুই নেই। ও আমাদের সাথে যেভাবে কথাবার্তা বলে, আহনাফের সাথেও ওভাবেই কথা বলে। ও এটা মেনে নেবে তুই কিভাবে ভাবলি?”

“আমার কিছু ভাবতে হবে না। সময় সব ঠিক করে দেবে। আমি শুধু এতোটুকুই জানি, আজ অরুর জীবনের এই সিদ্ধান্তটা নেওয়া খুবই দরকার। আর আমি জানি অরু আমার কথার অমান্য হবে না। ইমন আর মাওশিয়াতের বিয়ের পরই আহনাফ আর অরুর বিয়ের আয়োজন শুরু হবে।”

চলবে–

(আগামীকাল দুপুরে আরেকটা পর্ব দেবো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here