#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৬||
১২.
নতুন শহরে দু’মাস কেটে গেছে। এখন কলকাতার রাস্তাঘাট আর অপরিচিত নয়। খুব অনায়াসে এখান থেকে ওখান ছুটোছুটি করছে ছয় কিশোর। বয়সে তারা এখনো কিশোর, কিন্তু এই দুই মাসে তাদের অভিজ্ঞতা ঠিকই প্রাপ্ত বয়ষ্কদের মতো হয়ে গেছে।
ঘুম ভাঙতেই যার বেলা বারোটা বাজতো, সেই আহনাফ এখন ঘুম থেকে উঠেই মহল্লার সামনে খালি বালতি হাতে দাঁড়িয়ে থাকে।
আহনাফ প্রচুর ভ্রমণ প্রিয় স্বভাবের ছিল। আর তার দুর্বলতা তার প্রিয় সেই বাইকটি, যেটি এখন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সে খুব তাড়াতাড়িই বাইক চালানো শিখে ফেলেছিল, কারণ তার স্বপ্ন ছিল অল্প বয়সেই বাইকে চড়ে নিজ দেশ ভ্রমণ করবে। তারপর একদিন বাইরের দেশে ঘুরবে। কিন্তু এখন তার সেই স্বপ্নে ধুলো জমে গেছে। এখন তার বাইক কেনার সামর্থ্য নেই, বাইক নিয়ে দেশ ঘুরতে গেলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে। যদিও তার আগে কোনো ভবিষ্যৎ চিন্তা ছিলো না। বাবার অর্থ-সম্পদে সে বাকী জীবন পার করতে পারবে সেই আশায় ছিল। কিন্তু এখন পড়াশুনা করে নিজেকে শক্ত করে তার পরিবার হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ায় তার মূল উদ্দেশ্য। আহনাফ স্বভাবে প্রচুর বেপরোয়া। তার মনমতো কিছু না হলেই সে উগ্র হয়ে যায়। তবে এই উগ্রতা তার এখনো আছে। সম্পর্কে চাচাতো ভাই হলেও আহনাফের সাথে আরাফের অনেক পার্থক্য। সে খুবই শান্ত আর প্রচন্ড ধৈর্যশীল। সে বয়সের তুলনায় অনেক বুদ্ধিদীপ্ত। আর সে তার বন্ধুদের প্রাণ। একমাত্র আরাফই এমন পরিস্থিতিতে সব হারিয়েও এখনো শক্ত। সে বাকীদের মতো ভেঙে পড়ে নি। খারাপ লাগা, নিঃস্ব হওয়ার অনুভূতি, হতাশা, ক্লান্তি সবটাই সে নিজের মধ্যে হজম করে ফেলেছে। চার বছরের ছোট্ট অরুণিকা এখন আর ঘনঘন বাবার কথা বলে না। মাকেও খোঁজে না। সেই জায়গাটা আরাফের হয়ে গেছে। আরাফকে না দেখলেই ছোট্ট অরুণিকার অস্থিরতা বেড়ে যায়। সে সব আবদার আরাফের জন্যই জমিয়ে রাখে। তাদের বয়সের ব্যবধান মাত্র এগারো বছরের, অথচ আরাফ এখন অরুণিকার প্রধান অভিভাবক।
নারী ঘরের লক্ষী হয়। সংসার সামলানোর মতো জটিল দায়িত্ব তারাই নিয়ে থাকে। তবে তাদের ব্যাচেলর সংসারের সেই দায়িত্বটা তাহমিদের হাতে। ঘর পরিষ্কার আর রান্নাবান্না এই দুইটা কাজ সে একাই করে থাকে। তার হাতের জিলাপি আর নারকেল নাড়ু এখন পুরো মহল্লার মুখে মুখে। বাচ্চার দল বিকেল হলেই তাদের বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, আর তাহমিদ আজ বিকেলে কি বানাচ্ছে তা দেখার অপেক্ষায় থাকে। সালেহ আলী তার এই কাজের প্রশংসা করে খাবার বিক্রির পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু দোকান খোলার মতো সামর্থ্য তার নেই। আর ব্যবসা শুরু করলে তার পড়াশুনা হবে না। অন্যদিকে মহল্লার কেউ প্রতিদিন টাকা দিয়ে তার কাছ থেকে নারকেল নাড়ু আর জিলাপি কিনবে না৷ এখন হয়তো খেতে আসে, টাকা খুঁজলে বাসায় আসাও বন্ধ করে দেবে। তার বিক্রি করতে হবে ভিন্ন ভিন্ন শহরে গিয়ে, যার বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতাও তার মধ্যে নেই। অভিজ্ঞতার চেয়ে তার এই পেশাটাই পছন্দের নয়। কারণ সে যেই পরিবেশে বেড়ে উঠেছে, সেই পরিবেশ থেকে এসে ভ্যানে খাবার বিক্রি করাটা তার কাছে বেমানান।
এই ছয় কিশোরের মধ্যে একমাত্র ইমনই এখনো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে মহল্লার ছেলেদের সাথে দিন-রাত ফুটবল খেলে সময় পার করে। তাছাড়া সবাই তাদের রক্তের সম্পর্ক হারিয়ে ফেললেও ইভান এবং ইমন এই দুই ভাই এখনো একে অপরের জন্য বেঁচে আছে। ইভান পড়াশুনার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। সে এই দুই মাসে মাস্টার মশাইয়ের প্রিয় ছাত্র হয়ে গেছে। শতাব্দীর বাবার কাছে তার স্কুলের কিছু ছাত্র পড়তে আসে। একদিন ইভান তাদের মধ্যে একজনকে একটা অংক বুঝিয়ে দিচ্ছিলো, যা দেখে ফেলে শতাব্দী। ব্যস, ওমনি সে বাবাকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
“বাবা, দেখো দেখো, তোমার ছাত্রকে নিজের ছাত্র বানিয়ে ফেলেছে।”
মাস্টার মশাই পরবর্তীতে ইভানকে ডেকে এনে কয়েকটা অংক বুঝিয়ে দিতে বললেন, আর ইভানের বোঝানোর ধরণ অনেক সুন্দর আর সহজ ছিলো, তাই মাস্টার মশাই তাকেই নিজের ছাত্র বানিয়ে ফেললেন। তিনি এখন সময় নিয়ে ইভানকে মাধ্যমিক শ্রেণির বইগুলো পড়ান৷ কিন্তু কোনো টাকা নেন না। আর রাতে ইভান সেই পড়া তার বন্ধুদের বুঝিয়ে দেয়। এভাবেই তাদের ঘরোয়াভাবেই পড়াশুনা হয়ে যাচ্ছে। তবে এসবের মধ্যে পিছিয়ে আছে তূর্য। তার পড়াশুনার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সাপ্তাহিক বাজারগুলো সে-ই করে আনে। মাঝে মাঝে তাহমিদকে সাহায্য করে। আর মহল্লার সামনে দাঁড়িয়ে সময় পার করে। যতোদিন একটা গিটার কিনতে পারবে না, ততোদিন সে এমনই ছন্নছাড়া সময় পার করে যাবে৷ তাই বাকী পাঁচজন সিদ্ধান্ত নিলো, প্রথমেই তূর্যকে একটা গিটার কিনে তাকে মানসিকভাবে সন্তুষ্ট করবে, তারপর বাকিটা দেখা যাবে।
বিকেলে শতাব্দী বারান্দার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“অরুণিকা, বাবু আছো?”
শতাব্দীর কন্ঠ শুনে অরুণিকা ভেতরে থেকে দৌঁড়ে বেরিয়ে এলো। এই দুইমাসে অরুণিকার সবচেয়ে কাছের মেয়ে বান্ধবী শতাব্দীই। শতাব্দী অরুণিকাকে দেখে বলল,
“বাবু, বাসায় ভাইয়ারা আছে?”
“হ্যাঁ।”
“কি করছে?”
“ডিসুম ডিসুম করছে।”
শতাব্দী কপাল কুঁচকে বলল,
“কার সাথে ডিসুম ডিসুম করছে?”
“জানি না। ফোনে ডিসুম ডিসুম করছে। আমাকে দেখতেও দিচ্ছে না। আমি কতোবার বলেছি আমি কার্টুন দেখবো। আমাকে দেখতেই দেই না। ওরা অনেক পঁচা। আরাফও পঁচা হয়ে গেছে।”
অরুণিকা ঠোঁট ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শতাব্দী বলল,
“পঁচা ভাইয়াদের বলো, ডিসুম ডিসুম বাদ দিয়ে বই খাতা নিয়ে বসতে?”
অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল,
“আচ্ছা, বলে আসছি।”
অরুণিকা দৌঁড়ে ভেতরে গেলো। আবার কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে বলল,
“ইভান আমাকে বকা দিয়েছে। বলেছে, আরেকবার বিরক্ত করলে আমাকে ফোনে ঢুকিয়ে দেবে। তুমি জানো, ফোনে সব ভূত। ওরা ভূতের সাথেই ডিসুম ডিসুম করছে। আমাকে ওখানে পাঠিয়ে দিলে তো ভূত খেয়ে ফেলবে।”
“আচ্ছা, তুমিই আমাকে দরজাটা খুলে দাও। চাবিটা দাও। আমি নিজেই খুলে ঢুকছি।”
অরুণিকা ভেতরে এসেই আরাফকে বলল,
“চাবি দাও। দরজা খুলে দেবো।”
আরাফ এবার ফোন থেকে চোখ সরিয়ে অরুণিকার দিকে তাকালো। আর ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কেন দরজা খুলবে?”
“শতু আপু এসেছে।”
ইভান বিরক্তির সুরে বলল,
“এই মেয়ে ঘনঘন এদিকে কেন আসে? ওর কি কাজ নেই?”
তাহমিদ ফোন রেখে উঠে দাঁড়ালো। চাবিটা পকেট থেকে বের করতে করতে বারান্দায় এলো। শতাব্দী তাহমিদকে দেখে মুচকি হাসলো আর বলল,
“তা জিলাপি আজ ক’টা প্যাঁচ লাগিয়েছে?”
তাহমিদ চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,
“ঠিক যতোটা প্যাঁচ তোমার চুলে লেগেছে।”
কথাটি শুনেই শতাব্দী মাথায় হাত দিলো। ইশ! আজও সে চুল আঁচড়ে আসে নি। এই তাহমিদ ছেলেটার এতো সূক্ষ্ম দৃষ্টি! শতাব্দী শুনেছে এলেমেলো চুলেও বালিকাদের সুন্দর লাগে, কিন্তু তাহমিদের দৃষ্টিতে সে অসুন্দর আর অগোছালো মেয়ে। শতাব্দী অন্তত তাহমিদের সামনে নিজেকে পরিপাটি রাখার চেষ্টা করে, কারণ বাকীরা কোনো মন্তব্য না করলেও তাহমিদ তাকে মুখের উপর খোঁচা দিয়ে বসে। যা শতাব্দীর খুবই অপমানজনক মনে হয়।
তাহমিদ গেইট খুলেই বলল,
“ভেতরে আসতে পারো।”
“আমি ভেতরে আসতে চেয়েছিলাম তোমাদের ডাকার জন্য। বাবা তোমাদের বাসায় আসতে বলেছিলো। অরুণিকাকে তো বললাম, কিন্তু তোমরা নাকি ওকে তাড়িয়ে দিলে!”
তাহমিদ শতাব্দীর কথার কোনো উত্তর না দিয়েই ভেতরে চলে গেলো। শতাব্দী সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো আর মনে মনে বলল,
“এই ছেলেটার এতো অহংকার! শুধু একটু ভালো রাঁধে, তাছাড়া তার আর কি গুণ আছে? চোখগুলোও ইঁদুরের মতো দেখতে।”
তাহমিদ এবার বেরিয়ে এলো। পেছন পেছন বাকীরাও বেরিয়ে এলো। অরুণিকা গেইট খোলা পেয়ে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলো। আর শতাব্দীকে বলল,
“শতু আপু, তোমার ছানাটা কোথায়?”
“ও তো বাসায় ঘুমাচ্ছে। তুমি চলো বাসায়। তোমাকে দেখলেই উঠে যাবে।”
তাহমিদ বলল,
“অরুণিকা, তুমি কিন্তু গোসল করেছো। আলেয়া আপা তোমাকে গোসল করিয়ে দিয়েছেন। বিড়াল ধরলে আমি কিন্তু বাসায় ঢুকতে দেবো না।”
শতাব্দী বলল,
“এ আবার কেমন কথা! আমি গতকাল আমার ছানাকে স্নান করিয়েছি। তোমার চেয়ে বেশি পরিষ্কার আমার ছানা।”
তাহমিদ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“যে নিজের চুলটাই পরিষ্কার করে না, সে আবার বিড়ালকে পরিচ্ছন্ন রাখবে!”
তূর্য হুট করে বলল,
“প্রতিদিন গোসল করালে বিড়াল তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। আর এরা খুব পরিচ্ছন্ন প্রানী হয়।”
তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমার এসব ভালো লাগে না। আমাকে এতো যুক্তি দেখাতে হবে না।”
শতাব্দী এই কথা শুনে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেলো। এদিকে তারা বাসায় ঢুকতেই মাস্টার মশাই তাদের বসতে বললেন। শতাব্দী মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“বাবা ওই চেয়ারে ধুলো পড়ে আছে। একটু মুছেই না হয় তাদের বসতে দেই। নয়তো আবার সন্ধ্যায় স্নান করতে হবে।”
তাহমিদের চেয়ারটা সরিয়ে শতাব্দী নিয়ে গেলো, আর মনে মনে বলল,
“তুমি আজ দাঁড়িয়েই থাকো। এই চেয়ার তোমার জন্য নয়।”
শতাব্দী ভেতরে চলে যাওয়ার পর মাস্টারমশাই বললেন,
“আমার স্কুলে তোমাদের ভর্তি করিয়ে দিতে চাইছি, কি বলো?”
তারা মাস্টারমশাইয়ের কথা শুনেই অবাক হয়ে গেলো। ইভান বলল,
“কিন্তু স্যার, আমাদের কাছে তো এতো টাকা নেই যে সবাই একসাথেই পড়াশুনা করতে পারব। আমরা মাসে যা পাচ্ছি, তা দিয়ে বড়জোর চারজনের পড়াশুনার খরচ চালানো সম্ভব।”
“কিন্তু তোমরা এখন পড়লে ভবিষ্যতে আরো অনেক টাকা রোজগারের সুযোগ এসে যাবে৷ মাধ্যমিক পাশ না করলে তো এখন পিয়নের চাকরিও জুটে না। তোমাদের তো পড়াশোনা করতেই হবে। আর তোমরা পড়াশুনা না করলে অরুণিকাকে কে দেখবে? ওর ভবিষ্যৎ তোমাদের ভবিষ্যতের সাথেই সংযুক্ত। আর টাকার চিন্তা করো না। আমার স্কুলে বৃত্তির ব্যবস্থা আছে। একটু বাসায় কয়েকদিন পড়ো। অন্তত তিনজন বৃত্তি পেলে, বিনা মূল্যে মাধ্যমিক পরীক্ষাটা দিতে পারবে। এখন সামনের পরীক্ষাটাই দাও। তোমাদের হাতে এখনো দুই মাস সময় আছে।”
বৃত্তির কাগজে বাবা-মার নামের জায়গায় মৃত শব্দটা ব্যবহার করতেই খুব কষ্ট হচ্ছিলো তাদের। নিচে অভিভাবক হিসেবে সালেহ আলী আর সুরাইয়ার নাম লিখলো। এরপর কাগজগুলো মাস্টার মশাইয়ের হাতে দিয়ে তারা বেরিয়ে পড়লো।
এরপর দুই মাস তারা মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করলো। পরীক্ষাও দিলো। শেষমেশ তিনজনের পরিবর্তে ইভান, আহনাফ, আরাফ আর তাহমিদ এই চারজনই বৃত্তি পেলো। এখন তাদের পড়াশুনা বাবদ কোনো খরচ নেই। শুধু তূর্য আর ইমনের পড়াশুনার খরচটাই দিতে হবে৷ তাদের এই কয়েক মাসে অনেক টাকা সঞ্চয় হয়েছে। সেই টাকা দিয়েই তারা এবার তূর্যকে তার শখের গিটার কিনে দেওয়ার পরিকল্পনা করলো। কিন্তু যেদিন গিটার কিনতে যাবে সেদিনই ঘটলো এক দুর্ঘটনা।
চলবে-