অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৫৪||

0
1006

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৪||

৯০.
অরুণিকার কথায় আহনাফ ইমানের সাথে দেখা করতে গেলো। তারা একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে। ইমান কফির কাপে চুমুক বসাতেই আহনাফ বলল,
“ওদিন হঠাৎ তুমি চলে গেলে যে!”

ইমান আহনাফের প্রশ্নে মনে মনে ঘাবড়ে গেলেও মুখে হাসি টেনে বলল,
“হাসপাতাল থেকে মা ফোন দিয়েছিল। আমার বোনের একটা মেয়ে হয়েছিল তো তাই। মা বলল তাড়াতাড়ি আসতে। তাই চলে এলাম।”

আহনাফ গম্ভীরমুখে বলল,
“এটা তো খুশির খবর। এই খবরটা তো আমাদের জানিয়ে যেতে পারতে।”

ইমান আহনাফের দিকে সেকেন্ড খানিক শীতল চোখে তাকিয়ে থেকে বলল,
“মা ফোন করে বলেছিল, তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যেতে। মেয়ে হয়েছে সেটা আগে বলে নি। তাই চিন্তিত ছিলাম।”

“আচ্ছা, ভালো। মেয়েটার ছবি তো দেখাও। দেখতে কেমন হয়েছে দেখি!”

ইমান দাঁত কিড়মিড়িয়ে ফোন বের করলো৷ ছবি খুঁজতে খুঁজতে বলল,
“একটাই ছবি তুলেছিলাম। মা আসলে সদ্যোজাত শিশুর ছবি তোলা পছন্দ করেন না। আর কাউকে দেখানো তো একদমই না। মা মনে করেন নজর লেগে যাবে। আমি অবশ্য এসবে বিশ্বাস করি না।”

ইমান ফোন ঘেঁটে বলল,
“হায় হায়, মা তো ছবিটাই ডিলিট করে দিয়েছে। দেখেছেন ভাইয়া, মা এসব ব্যাপারে মারাত্মক সচেতন।”

আহনাফ কোণা চোখে ইমানের দিকে তাকিয়ে রইল। ইমান প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“নতুন একটা প্রজেক্টের জন্য মির্জা গ্রুপ আর বাস্কার গ্রুপ মিলিত হয়ে কাজ করছে। ওদের প্রজেক্টটা খুব কোয়ালিটি সম্পন্ন। ওরা বাই এনি চান্স, প্রজেক্টটা লঞ্চ করলে, আপনারা উঠতে পারবেন কিনা সন্দেহ। আর মুন্সী গ্রুপ খুব দুর্বল একটা কোম্পানি। আপনারা বাকি কোম্পানি বাদ দিয়ে তাদের সাথে পার্টনারশীপ করেছেন, এটা একটু ভাববার বিষয়।”

“দেখো ইমান। তুমি তো জানোই মির্জা গ্রুপ আমাদের কতো বড় শত্রু। একটা প্রবাদ আছে, শত্রুর শত্রু মিত্র হয়৷ সুলতান মুন্সী আর শাহেদ মির্জার ঘোর দ্বন্ধ, আর সেই সুযোগে আমরা তাদের মিত্র হয়ে গেলাম।”

ইমান শূন্য দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাইয়া, মাঝে মাঝে চোখের দেখাও ভুল হয়।”

আহনাফ বাঁকা হেসে বলল,
“জানি, চোখের দেখা যেমন ভুল হয়, মুখের কথাও অনেক সময় মিথ্যে হয়।”

ইমান ভ্রূ কুঁচকে আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ বসা থেকে উঠতে উঠতে বলল,
“তোমাকে নতুন কাজ দেওয়ার জন্য ডেকেছি। মুরশিদ জুবায়ের আর রহমতুল্লাহর সব তথ্য বের করে দেবে। তাদের ছবি, আর কিছু ডিটেইলস তোমাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিয়েছি।”

আহনাফ রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে একটা সিগারেট ধরালো। আর মনে মনে বলল,
“আই এম সরি অরু, তুমি ইমানকে যতোটুকু পছন্দ করো, তার চেয়ে বেশি আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর আহনাফ নিজের ভালোবাসা আদায় করে নিতে পারে।”

আহনাফ বাসায় আসতেই অরুণিকা দৌঁড়ে তার কাছে গেলো। আহনাফের কাছে আসতেই সিগারেটের গন্ধ পেয়ে অরুণিকা নাক চেপে ধরে বলল,
“তুমি আবার সিগারেট খেয়েছো?”

আহনাফ অরুণিকার কাছে এসে বলল,
“ছাড়ার কোনো সুযোগ পাচ্ছি না তাই।”

“সুযোগ পাচ্ছো না কেন? তোমাকে কেউ চেপে ধরে সিগারেট খাইয়ে দিচ্ছে নাকি!”

“তুমি বুঝবে না। এসব বোঝার জন্য তুমি এখনো অপরিপক্ব।”

অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে আহনাফের হাত ধরে তাকে উপরে নিয়ে গেলো। আহনাফ রুমে এসেই আলমারি থেকে নিজের কাপড় বের করতে লাগলো। অরুণিকা আহনাফের পেছনে দাঁড়িয়ে বলল,
“কিছু বলছো না যে?”

আহনাফ পেছন ফিরে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আবার কাপড় খোঁজায় মনোযোগ দিলো। অরুণিকা আহনাফের শার্টের কোণা আঁকড়ে ধরে বলল,
“বলো না। আমি এতোক্ষণ তোমার অপেক্ষায় বসে ছিলাম।”

আহনাফ অরুণিকার দিকে ফিরে কিছুক্ষণ গম্ভীরমুখে তাকিয়ে থেকে বলল,
“প্রতিদিন তো আর অপেক্ষা করো না। আজ তো বিশেষ খবরের অপেক্ষায় বসে ছিলে, তাই না?”

অরুণিকা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। আহনাফ তার আঙ্গুল ধরে বলল,
“ইমানের সাথে দেখা করে এসেছি।”

অরুণিকা আগ্রহী কন্ঠে বলল,
“হুম, কি বলেছে ও?”

“অরু, ইমানকে তোমার কথা তো বলি নি, শুধু এতোটুকু জিজ্ঞেস করেছি, কোনো প্রেমের সম্পর্ক আছে নাকি।”

অরুণিকা জিজ্ঞাসু চোখে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মন বার-বার বলছে, আহনাফ তাকে ভালো খবরই দিবে। কিন্তু আহনাফ বলল,
“ও একটা মেয়েকে ভালোবাসে। ওদের বিয়েও ঠিক হয়ে গেছে। আর খুব শীঘ্রই ওদের বিয়ে হবে।”

অরুণিকা আহনাফের হাত সরিয়ে দিয়ে বিছানার একপাশে গিয়ে বসে পড়লো। আহনাফ তার কাপড় আলমারি থেকে নামিয়ে অরুণিকার পাশে এসে বসলো। অরুণিকা মলিন মুখে বললো,
“ওর সাথে তো আমার আলাদাভাবে কখনো কথাও হয় নি। কিন্তু ওর চোখাচোখি হলেই মনে হতো ও আমাকে পছন্দ করে। ভাবীও বলেছিল, মেয়েরা ছেলেদের চোখ দেখলেই বুঝে ফেলে, তারা কি অনুভব করে। তাহলে আমি কিভাবে ভুল বুঝলাম?”

আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“আমার চোখ দেখে কি তুমি কিছু বোঝো নি?”

অরুণিকা আহনাফের চোখের দিকে তাকালো। তারপর ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কি বুঝবো!”

আহনাফ এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“কচু বুঝো তুমি। কচু। তুমি চোখ দেখে কিছুই বুঝো না। বুঝলে এখন বলতে পারতে আমি তোমার কতোটা কেয়ার করি।”

“আরেহ, ওটা তো জানিই। তুমি, আরাফ, তাহমিদ, রকস্টার আর ইমন, তোমরা আমাকে অনেক ভালোবাসো। শুধু ইভানই বাসে না।”

“আগে ও নিজেকে ভালোবাসুক, তারপর বাকিদের ভালোবাসবে। এখন ওর কথা বাদ দাও।”

তারপর আহনাফ মিনমিনিয়ে বলল,
“পুরো বিশ্বের সবার ভালোবাসা তার লাগবে, শুধু আমারটাই লাগবে না।”

অরুণিকা তার কানটা আহনাফের মুখের কাছে এনে বলল,
“বিড়বিড় করে কি বলছো!”

আহনাফ তাকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“উফ! অরু। যাও এখন। আমি ফ্রেশ হবো। ইমানের চ্যাপ্টার ক্লোজ হয়ে গেছে।”

অরুণিকা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তারপর যাওয়ার আগে বলল,
“এখন কি আমার তোমাকেই বিয়ে করতে হবে?”

আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“সমস্যা আছে বিয়ে করতে?”

“না, সমস্যা তো নেই। আসলে আমি তো তোমাকে নিয়ে ওভাবে চিন্তা করি নি!”

“তো এখন করো। যাও আমার জন্য শরবত বানিয়ে আনো। আফটার অল, আমি তোমার হবু বর। আমার সেবা করা তোমার দায়িত্ব।”

অরুণিকা আহনাফের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“তোমার শরবত তুমি বানিয়ে খাও। একটা কাজ দিয়েছি ওটাও ভালোভাবে করতে পারো নি। হুহ।”

অরুণিকা হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আহনাফ মলিন হেসে বলল,
“তুমি এখনো অনেক ছোট অরু। এখনো কিছুই বুঝতে শেখো নি। নয়তো হবু বরকে কি কেউ প্রেমিকের কাছে পাঠায়? তাও আবার তার ভালোবাসার কথা জানার জন্য!”

আজই নতুন গাড়ি কিনেছে আরাফ। সেই গাড়ি করেই সে চেম্বারে যাচ্ছে। হঠাৎ তার গাড়ির সামনেই হাত এগিয়ে দিয়ে একটা লোক এসে দাঁড়ালো। আরাফ গাড়ি থামিয়ে নামতেই লোকটা আরাফের হাত ধরে বলল,
“বাবা, কিছু খেতে দেবে? আমার হাতে একটা টাকাও নেই।”

লোকটা কথাটি বলতে বলতেই শব্দ করে কেঁদে দিলো। আরাফ তার মানিব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে লোকটার হাতে দিতেই সে লোকটির মুখোমুখী হলো। আরাফ কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে লোকটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“মামা! আপনি?”

আরবান তালুকদার ভালোভাবে আরাফের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কে তুমি? তোমাকে তো চিনলাম না।”

“মামা, আমি আরাফ। আরাফ চৌধুরী।”

আরবান তালুকদার আরাফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,
“তুমি বেঁচে আছো? আমার তন্নির ছেলে? তুমি তন্নি আর আরহামের ছেলে?”

“হ্যাঁ।”

আরবান তালুকদার শক্ত করে ভাগ্নেকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। আর বলতে লাগলেন,
“বাবা, কেউ নেই আমার। সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। বোনটাকে তো হারিয়েই ফেললাম, তোমার নানা-নানুও আর বেঁচে নেই। ছেলে দুইটাকে কতো টাকা খরচ করে মানুষ করিয়েছি৷ ওরা আমার ঘর থেকে আমাকেই বের করে দিলো। আমার থাকার কোনো জায়গা নেই। আমার কোনো আপন মানুষ নেই।”

“কি বলছেন মামা? আমি আছি তো।”

আরাফ আরবান তালুকদারকে একটা দোকানে বসিয়ে কলা-পাউরুটি খাওয়ালো। তারপর মামার পাশে বসে বললো,
“মামা, বাসায় চলেন।”

“কার বাসায় যাবো? ওরা তো এতো স্বার্থপর হয়ে গেছে যে আমাকে বাবা বলেই আর স্বীকার করে না। ”

“আমার বাসায় যাবেন, মামা।”

“তুমি আমাকে নিয়ে যাবে? কেন বাবা? আমি তো তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমি তোমার বাবা-চাচাদের সাথে অনেক অন্যায় করেছি। আমার বোনটার মৃত্যুর দায় তাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এটা তো স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল। তোমার বাবা তো তন্নিকে অনেক ভালোবাসতো। কিন্তু আমিই জেদ ধরে তোমার বাবার নামে মামলা করেছি। আল্লাহ এখন এই অপরাধের শাস্তিই দিচ্ছেন!”

“যা হওয়ার হয়ে গেছে। এসব তো বাবা অনেক আগেই ভুলে গিয়েছিলেন।”

“তোমার বাবা খুব ভালো মানুষ ছিল। আমি শুধু শুধু তোমার বাবার উপর রাগ করে সম্পর্কটা ভেঙে দিয়েছিলাম। তোমাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবা।”

আরাফ আরবান তালুকদারকে বাসায় আনল। তাকে নিজের রুমে বসিয়ে জামা-কাপড়ের ব্যবস্থা করলো। উপমাকে বলল খাবারের ব্যবস্থা করতে৷ ইভান আরাফের হাত ধরে তাকে এক পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল,
“উনাকে কেন এনেছিস?”

“উনি রাস্তায় পড়ে ছিল। উনার ছেলেরা উনাকে বাড়ি ছাড়া করেছে।”

“ভুলে যাবি না, উনি তোর বাবার কতো বড় ক্ষতি করেছিল। আন্টির মৃত্যুর পর এই লোকটাই একাধারে চৌধুরী বংশের সবার নামে মামলা করে সবাইকে জেলের ভাত খাইয়েছিল।”

“কিন্তু এটা অনেক আগের ঘটনা। মামা উনার ভুল বুঝতে পেরেছেন।”

“তোর দাদা উনাকে পছন্দ করতো না, আরাফ।”

“হ্যাঁ, কারণ উনি আমাদের ক্ষতি করতে চেয়েছিল। কিন্তু কেন? মায়ের মৃত্যুর জন্যই তো! আমার মা মারা গিয়েছিল। একজন ভাইয়ের জন্য এটা কতো কষ্টকর তুই বুঝতে পারছিস না? তোরও তো বোন ছিল।”

“আমার বোনের খুন হয়েছে। আর তন্নি আন্টি অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছিলেন। দুইটা আলাদা ব্যাপার।”

“আর কতোদিন ঘৃণা করবো। দোষ তো আমারই। ডাক্তার বলেছিল, মায়ের জন্য সন্তান জন্ম দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। তবুও মা আমাকে জন্ম দিয়েছে। এখানে বাবারও দোষ নেই, মামারও দোষ নেই। আমার দোষে এতোগুলো সম্পর্ক এলোমেলো হয়ে গেছে। ইভান, এখন আমি অনাথ। বাবাকেও হারিয়ে ফেলেছি। এতো বছর পর একজন কাছের মানুষ পেয়েছি। আমি কি করে তাকে রাস্তায় ফেলে আসবো?”

ইমন তাদের কথোপকথন আন্দাজ করে ইভানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ভাই, তুমি একটু উদার হও। আংকেলটা অনেক অসুস্থ। আমাদের মামা হলে আমরা ফেলে আসতে পারতাম, বলো?”

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here