#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৬||
৯৩.
“সবাইকে স্বাগতম আমাদের নতুন কোম্পানি মৈত্রী গ্রুপ এন্ড ইন্ডাস্ট্রির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। যা পাঁচ বছর ধরে ইটা গ্রুপ নামে অনলাইনে সর্বাধিক পরিচিত ছিল। আমরা কলকাতায় প্রথম আমাদের ব্যবসা চালু করি। আর এই ব্যবসাটিই আমাদের পুরোনো কোম্পানিটিকে নতুন ভাবে চালু করার সুযোগ করে দিয়েছে। আর আমি হচ্ছি ইভান মাহবুব মৈত্রী গ্রুপের পুরোনো এম.ডি ইমতিয়াজ মাহবুবের বড় ছেলে।”
ইভানের কথা শুনে সুলতান মুন্সী অবাক হয়ে ইভানের দিকে তাকালেন। উপস্থিত সবাই ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য স্টেজে উঠে পেছনের ব্যানারটি খুলে ফেললো। ব্যানারটি খোলার সাথে সাথেই মৈত্রী গ্রুপের পুরোনো ব্যানাটি দেখা গেলো। তূর্য এবার মিডিয়ার লোকেদের উদ্দেশ্যে বলল,
“আজকের দিনটা আমাদের জন্য খুব শুভ। আজ মৈত্রী গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জুবাইয়ের করিম চৌধুরীর জন্মবার্ষিকী। আজ হয়তো সে আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তিনি গিয়েও রেখে গেছেন তার উত্তরসূরী। আমি তূর্য আহমেদ, মৈত্রী গ্রুপের সিনিয়র ম্যানেজার হাকিম আহমেদের একমাত্র ছেলে।”
তূর্য নিচের পরিচয় দিয়ে গ্যালারিতে বসা শাহেদ মির্জা আর সাহিল মির্জার দিকে তাকালো। শাহেদ মির্জার চোখেমুখে রাগ ফুটে উঠেছে। সাহিল বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাবা, মৈত্রী গ্রুপের সবাই তো সপরিবারে খুন হয়েছিল! তাহলে এরা কারা?”
শাহেদ মির্জা কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি আশেপাশে কাউকে খুঁজতে ব্যস্ত। হঠাৎ তার সামনে রহমতুল্লাহ এসে দাঁড়ালেন। রহমতুল্লাহ স্থির দৃষ্টিতে শাহেদ মির্জার দিকে তাকিয়ে সামনের চেয়ারে বসে পড়লেন।
আজ বাংলাদেশের স্বনামধন্য সব ব্যবসায়ীক গ্রুপগুলো একত্র হয়েছে। আর আজই ইটা গ্রুপের উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন ইটার পরিবর্তে মৈত্রী গ্রুপের নতুনভাবে উদ্বোধন হচ্ছে। এবার তাহমিদ ইমনকে নিয়ে স্টেজে উঠলো। তাহমিদ মিডিয়ার সামনে এসে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম। আমি তাহমিদ হোসেন। আলিম হোসেনের ছোট ছেলে। আমার বড় দুই ভাই তাহসান হোসেন আর তাশিন হোসেন মৈত্রী গ্রুপের সিনিয়র পদে ছিল। তারা ক্লথ সেক্টরের বিজনেস করতো। কিন্তু আমি ফুড সেক্টরের বিজনেস করছি। আমার আলাদা রেস্টুরেন্ট আছে। যার নাম মিষ্টান্নভোজন। মিষ্টির পরিবর্তে আমি বিভিন্ন ধরণের খাবার তৈরীর কাজ করছি। মিষ্টান্নভোজনের দু’টি শাখা খোলা হয়েছে। এখন মৈত্রী গ্রুপ যেহেতু শুধু একটা সেক্টর নিয়ে কাজ করতো না। সেখানে কাপড়, ওষুধ, ইলেক্ট্রনিক ডিভাসসহ বিভিন্ন সেক্ট্রর ছিল। কিন্তু এই নতুন মৈত্রী গ্রুপে আমরা ভিন্ন ভিন্ন সেক্টর রাখছি।”
ইমন বলল,
“আমাদের নতুন গ্রুপের প্রধান আকর্ষণ স্কিন। আমরা স্কিন প্রোডাক্ট তৈরী করছি। পাশাপাশি এখানে স্কিন থেরাপিও দেওয়া হবে। আর এই সেক্টরটি একদম নতুন সেক্টর। আর এখানে কাজ করছে ইভান মাহবুব। তবে আমাদের কাছে একজন স্কিন স্পেশালিষ্টও আছেন, আপনাদের পুরোনো মৈত্রী গ্রুপের এ ইউনিটের পরিচালক জুবাইয়ের করিম চৌধুরীর ভাতিজা, ডক্টর. আরাফ চৌধুরী। পাশাপাশি ফুড সেক্টরে থাকবে তাহমিদ হোসেন। ক্লথ সেক্টরে থাকবে তূর্য আহমেদ এবং আমি, ইমন মাহবুব। আর আমিই মৈত্রী গ্রুপের বি ইউনিটের নতুন এম.ডি।”
মিডিয়ার সবাই ইমনকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগলো। ইমন হাতের ইশারায় আহনাফ আর আরাফকেও ডেকে আনলো। আহনাফ স্টেজে এসে মিডিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
“আর আমি আহনাফ চৌধুরী, মৈত্রী গ্রুপের এ ইউনিটের নতুন এম.ডি। আমাদের সেক্টরটি ডেভেলাপিংয়ের কাজ করছে। আমরা আপনাদের প্লটে আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে নতুন নকশায় বাড়ি নির্মাণ করে দেবো।”
সাহিল মির্জা রাগে গজগজ করতে করতে উঠে দাঁড়াল। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,
“একটা ছোট কোম্পানি এতোগুলো সেক্টর কিভাবে খুলেছে?”
পাশের একটা লোক বলে উঠলো,
“স্যার, কোম্পানি একটা। কিন্তু চালাচ্ছে তো ছ’জন। একেই বলে একতাই বল। শুনেছি, মুন্সী গ্রুপও তাদের সাথে কাজ করছে।”
সাহিল মির্জা এবার হল থেকে বেরিয়ে এলো। এই মুহূর্তে তার মেজাজ ঠিক নেই। এতো বছর ধরে সে শুধু পোশাক খাতে কাজ করে যাচ্ছে। তার নিজস্ব ডিজাইনারও আছে। আর লাখ-লাখ টাকায় তার কোম্পানির কাপড় বিক্রি হচ্ছে। অথচ ছ’জন যুবক নতুন কোম্পানি খুলে তার পুরো ব্যবসাকেই হেলিয়ে দিয়েছে? শুরুটাই যাদের এতো জাঁকজমকপূর্ণভাবে হয়েছে, তাহলে তাদের যাত্রাটা কেমন হবে?
ছ’জন বাসায় ফেরার পর অরুণিকা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমাদের টিভিতে দেখাচ্ছে কেন?”
আহনাফ বলল,
“সেলিব্রিটি মানুষ তাই।”
“সত্যিই, বলো না৷ কি বলেছো এসব? আমার না সব কথাবার্তা মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে।”
“এখন তোমার এসব বুঝতে হবে না। কাল মাওশিয়াত আর ইমনের আক্দ। তুমি উপমার সাথে মাওশিয়াতের বাসায় চলে যাও। মাওশিয়াত ফোন দিয়েছে, তোমাদের দু’জনকে যেতে বলেছে।”
পরেরদিন জুমার নামাজের পর মসজিদে ইমন আর মাওশিয়াতের আক্দ সম্পন্ন হলো। আক্দের অনুষ্ঠানটি কোনো ক্লাবে হবে না। ইভান একটা স্থান ঠিক করে রেখেছিল, সেখানেই অনুষ্ঠান হবে। মসজিদ থেকে এসে তাহমিদ আর আহনাফ ইমনকে তৈরী করিয়ে নিচে নামলো। সন্ধ্যার দিকে তারা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। অনুষ্ঠানে মাওশিয়াতের বাবা-মা আর আত্মীয়রা, উপমার বাবা-মা ও ভাই এবং আরাফের মামা উপস্থিত হবে। পরিবারের বাইরে শুধু সুলতান মুন্সী ও তার ছেলে ইশমাম মুন্সীকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। সব ক’টা গাড়ি চাঁদগাও পৌঁছে গেলো। গাড়ি থামার পর আরবান তালুকদার গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে তাকিয়ে আরাফকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“তোমরা ইমনের আক্দ অনুষ্ঠান এখানে রেখেছো?”
আরাফ প্রশান্তির হাসি দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, এটাই তো আমাদের জন্মস্থান। এখানেই আমাদের সব স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এখানে থাকা মানুষগুলো তো আর বেঁচে নেই। কিন্তু আমরা চাই, এখানের ইট-পাথর আমাদের মিলনমেলার সাক্ষী হোক। অন্তত এখানে এসে একটু হলেও পুরোনো মানুষগুলোকে অনুভব করতে পারবো।”
আরবান তালুকদার আরাফের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন,
“একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে৷ আজকে তো খুশির দিন। মনে কোনো দুঃখ রেখো না৷ যাদের যাওয়ার তারা চলে গেছে৷ এখন যারা আছে, তাদের নিয়েই ভালো থাকতে হবে। কয়েকদিন ধরে দেখছি তূর্য আর ইভান একজন আরেকজনের সাথে কথাবার্তা বলছে না। কি হয়েছে ওদের?”
আরবান তালুকদার সেদিনের ঝগড়ার মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তাই তিনি কিছুই জানতেন না। আরাফও তার মামাকে এসব জানাতে চায় না। তাই সে প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“এসব বাদ দিন, মামা। তেমন কিছুই হয় নি৷ চলুন ভেতরে যাই।”
মৈত্রী ম্যানশনের পোড়া বাড়িগুলো আবার রং করা হয়েছে। বাড়িগুলোর ভেতরে যদিও সব আগের মতোই আছে। কিন্তু এখন আর বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যাবে না, কিছু কাল আগেও বাড়িগুলো পোড়া বাড়ি ছিল। বাড়ির বাইরে খোলা জায়গায় স্টেজ তৈরি করা হয়েছে। পাশের গ্যারেজটি পরিষ্কার করিয়ে সেখানেই খাওয়ার আয়োজন করা হচ্ছে। চারপাশে নতুন করে বাতি জ্বালানো হয়েছে। সন্ধ্যায় পুরো এলাকা বিয়ের সাজে সজ্জিত হয়েছে। গেইট থেকেই মরিচ বাতি ঝুলছে। যেহেতু অনেক বছর ধরেই বাড়িগুলো পরিত্যক্ত ছিল, তাই ইভান কাজ শুরুর আগেই হুজুর ডেকে দোয়া পড়িয়েছে। সবাই এখন অনুষ্ঠানে ব্যস্ত। মাওশিয়াতের কাজিনরা নাচ-গানের আয়োজন করেছে। সবার মনোযোগ সেখানেই। কিন্তু অরুণিকার মনোযোগ তাদের পুরোনো বাড়ির দিকে। তার চৌদ্দ বছর আগের কিছুই মনে নেই। তবুও এই বাড়িটি তাকে খুব টানছে। চৌধুরী বাড়িতে ঢুকতেই অরুণিকা চারদিকে চোখ বোলালো৷ সব বাড়িগুলোর ভেতরে পরিষ্কার করানো হলেও রং করানো হয় নি। তাই সাদা দেয়ালে কালো দাগগুলো এখনো স্পষ্ট হয়ে আছে। হলরুমে চোখ বোলাতে বোলাতে হঠাৎ পেছনে কারো উপস্থিতি পেয়ে অরুণিকা চেঁচিয়ে উঠলো। আহনাফ ব্যস্ত কন্ঠে অরুণিকার মুখে হাত চেপে ধরে বলল,
“পাগল হয়েছো? চেঁচাচ্ছ কেন?”
অরুণিকা হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি?”
“তো কাকে আশা করেছিলে?”
“ভূত আশা করেছিলাম!”
আহনাফ ভীত চোখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল,
“কি উল্টাপাল্টা বলছো? চলো বাইরে আসো। তোমাকে বাড়িতে কে ঢুকতে বলেছে?”
অরুণিকা আগে আগে দৌঁড়ে বের হতে যাবে, তা দেখে আহনাফও দৌঁড়ে বেরিয়ে এলো। বাইরে এসে আহনাফ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। অরুণিকা কোণা চোখে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি ভয় পেয়েছো?”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আমি? মোটেও না। আমি কেন ভয় পাবো?”
“তাহলে আমার পিছু পিছু দৌঁড়ে এসেছো কেন?”
“তোমার সাথে সাথেই তো হাঁটছিলাম৷ তোমারই তো ভয় লাগছিল তাই।”
অরুণিকা বাঁকা হাসি দিয়ে পেছন ফিরে ভীত চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ অরুণিকার তাকানো দেখে আর অন্যদিকে না তাকিয়ে সোজা অরুণিকার হাত ধরে জোড়ে পা চালিয়ে স্টেজের কাছে চলে এলো। অরুণিকা হাসতে হাসতে বলল,
“ভীতু ছেলে।”
আহনাফ চোখ গরম করে বলল,
“চুপ করো। বেশি কথা বললে ওই ঘরে রেখে আসবো। আর দরজা বাইরে থেকে আটকে দেবো।”
অরুণিকা মুখ ভার করে বলল,
“আমি না তোমার হবু বউ? তুমি আমার সাথে এমন অবিচার করবে?”
আহনাফ অরুণিকার কথা শুনে চুপ হয়ে গেলো। অরুণিকা নিজের মুখে এই সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিয়েছে দেখে তার খুব ভালো লাগছে। সে মুচকি হেসে অরুণিকার হাত ধরতে যাবে তখনই মাওশিয়াতের কাজিনরা এসে অরুণিকাকে টেনে নিয়ে গেলো।
এদিকে খাওয়া-দাওয়ার পর ইশমাম মুন্সী একা একটা চেয়ারে বসে আছে। তাকে একা বসে থাকতে দেখে ইভান তার পাশে গিয়ে বসলো। ইশমাম ইভানকে দেখে মুচকি হাসলো আর বলল,
“ছোট ভাইকে তো বিয়ে দিয়ে ফেলেছো। এখন নিজে কখন বিয়ে করবে?”
ইভান হেসে বলল,
“আমার সিনিয়ররাই যেখানে অবিবাহিত সেখানে আমি তো সিলেবাসের বাইরে।”
ইশমাম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ইভান ইশমাম সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছে। কিন্তু কখনো ইশমামের কাছ থেকে কিছুই শুনেনি। তাই ইভান তাকে জিজ্ঞেস করলো,
“কাউকে পছন্দ করেন?”
ইশমাম মুন্সী ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমার ভালোবাসা তো আমার মধ্যে নেই। পুরো মিডিয়া জেনে গেছে। এখন তুমি নতুন করে জিজ্ঞেস করে আমার কষ্টে আরেকটু কষ্ট মেশালে নাকি, অন্যকিছু?”
ইভান মুচকি হেসে বলল,
“মিডিয়া তো মিথ্যে কথাও ছড়ায়৷ তবে এটা ঠিক, যা রটে তা কিছু হলেও ঘটে। এবার বলেন, সত্যিই কি শাহেদ মির্জার মেয়ের সাথে আপনার সম্পর্ক আছে, নাকি শুধুই বন্ধুত্ব।”
ইশমাম মলিন হেসে বলল,
“ছেলে-মেয়ে কখনোই একে অপরের বন্ধু হতে পারে না। তারা প্রেমে পড়বেই। আর আমরাও পড়েছি। সমস্যাটা হলো শাহেদ মির্জা আমার হাতে সাবাকে দেবেন না।”
“কেন?”
“আমাদের বংশ ভালো হলেও, আমরা ছোট থেকে উঠে এসেছি। আমাদের মধ্যে আভিজাত্য ছিল না। বাবা খাবারের দোকানে চাকরি করতো। একসময় মুদির দোকানদার ছিল। চাচারাও ছোটখাটো কাজগুলোই করতো। আসলে আমাদের পরিবারের কেউই শিক্ষিত না৷ শুধু আমরা ভাই-বোনরা পড়াশুনা করেছি। তাই মির্জা সাহেব মনে করেন আমাদের স্ট্যাটাস মিলবে না। এমনিতেই আমরা প্রতিদ্বন্ধি গ্রুপ। তাই তারা মনে করে তাদের সাথে আত্মীয়তা করে আমরা উপরে উঠতে চাই।”
ইভান চুপচাপ সব শুনছে। ইশমাম বলল,
“আগে জানলে, এসব দেখেশুনেই ভালোবাসতাম। শুধু শুধু কষ্ট পেতে হতো না।”
ইভান মনে মনে বলল,
“মির্জা সাহেবের অনেক অহংকার। ভালোই তো। তার এই অহংকার দিয়েই তাকে জব্ধ করা যাবে।”
চলবে—