#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৯||
৯৭.
সিগারেট হাতে নিয়ে টেবিলের উপর পা তুলে আয়েশ করে চেয়ারে বসে আছেন বাস্কার গ্রুপের এম.ডি রিয়াজুর রহমান। বয়স আটচল্লিশ পেরিয়েছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার ঘনিষ্ঠ সহচর নিয়াজ হোসেন। নিয়াজ হোসেন বয়সে রিয়াজুর রহমানের দুই বছরের বড়। তবুও তাদের মধ্যে তুইতোকারি বন্ধুত্ব। বয়সের ব্যবধান দুই বছর হলেও নিয়াজ হোসেনকে দেখলে তার বার্ধক্য প্রকাশিত হয়। কিন্তু রিয়াজুর রহমানকে দেখলে আটচল্লিশ পার করেছেন বলে মনে হয় না। তার শুধু চুলগুলোই পেকেছে, যা তিনি কৃত্রিম রঙের স্পর্শে লাল করিয়ে রাখেন। বয়স হলেও দাঁড়ি রাখেন না। আর খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে খুবই সচেতন হওয়ায়, তিনি এখনো ফিট আছেন। তিনি এমন প্রকৃতির মানুষ, যা-ই কিছু হয়ে যাক, দিনলিপিতে একটুও পরিবর্তন ঘটান না৷ তার রুটিনে প্রতিদিন একটার বেশি সিগারেট থাকে না। পুরো দিন মানসিক চাপ না থাকলে তিনি রাতে তার ভালোবাসার মানুষের দিকে তাকিয়ে থেকেই সিগারেট ধরান। আর যদি দিনে কোনো চাপ তার উপর এসে পড়ে, তাহলে রাতে আর প্রিয় মানুষটিকে দেখেন না৷ কারণ তার মানসিক চাপ হালকা করার জন্য ওই একটাই সিগারেট বরাদ্ধ থাকে।
এদিকে নিয়াজ হোসেন রিয়াজুর রহমানকে সিগারেট খেতে দেখে বললেন,
“ভাই, আম্মা আর ক’দিনই বা আছেন! তার শরীর ভালো না। ডাক্তার তো জানিয়েই দিয়েছে যে তার সময় কম। তুই এবার আম্মার ইচ্ছেটা পূরণ করে ফেল।”
রিয়াজুর রহমান কোণা চোখে নিয়াজের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“দেখ, নিয়াজ। এতো শখ হলে তুই নিজেই আরেকটা বিয়ে করে নে।”
“আস্তাগফিরুল্লাহ। ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়ে ফেলেছি, এই বয়সে দ্বিতীয় বিয়ে?”
“তো আমাকে কেন বিয়ের কথা বলছিস?”
“তুই তো বিয়েই করিস নি। অরূপাকে কি এবার ভুলে যাওয়া উচিত নয়?”
রিয়াজুর রহমান মুহূর্তেই চোখ-মুখ শক্ত করে বললেন,
“সব মানুষ ভুলে যাওয়ার জন্য মনে জায়গা পায় না। কিছু মানুষ মরেও হৃদয়ে বেঁচে থাকে।”
“কিন্তু ভাই, তুই বিয়ে না করে যে পাপ করে যাচ্ছিস, সেটা কতোটা ন্যাক্কারজনক, জানিস?”
রিয়াজুর রহমান চুপ করে রইলেন। নিয়াজ হোসেন বললেন,
“আম্মা যদি জানে তুই বিয়ে ছাড়া মেয়েদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক রাখিস, একদিনও বাঁচবে না। আল্লাহকে ভয় কর। নামাজ দোয়া পড়। বয়স তো শেষ হয়েই যাচ্ছে।”
রিয়াজুর রহমান চেঁচিয়ে বললেন,
“অরূপাকে চেয়েছিলাম আমি। মেয়েটা আমার নেশা ছিল, নেশা। আমি ওর মধ্যে এতো ডুবে গিয়েছিলাম যে ওকে পাওয়ার জন্য আমি সব করতে পারতাম। কিন্তু ও আমাকে সুযোগ না দিয়ে আত্মহত্যা করে জাহান্নামে চলে গেছে। আমিও তাই জাহান্নামে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
নিয়াজ হোসেন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নেড়ে বললেন,
“আল্লাহ তোকে হেদায়েত করুক।”
নিয়াজ হোসেন এই বলে চলে গেলেন। এদিকে রিয়াজুর রহমানের টেবিলের উপর অনেকগুলো মেয়ের ছবি। মা তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য এই ছবিগুলো সংগ্রহ করে নিয়াজের দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, আর তা দেখেই রিয়াজুর রহমানের মাথা বিগড়ে গিয়েছে।
তিনি ছবিগুলো সব একত্র করে লাইটার দিয়ে সব ছবিগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“যেদিন ঠিক অরূপার মতো কেউ আমার মনে জায়গা নিতে পারবে, সেদিনই আমি মানুষ হবো।”
ফোন বেজে ওঠায় তিনি ছবিগুলো বেসিনের উপর ফেলে দিয়ে পানি ছেড়ে দিলেন আর ফোন রিসিভ করে বললেন,
“মিস্টার রহমতুল্লাহ, আপনার সমস্যাটা কি বলুন তো? আমাকে ফোন দিয়ে আপনি এই পাড়া ওই পাড়ার খবর দিতে থাকেন। এই দায়িত্বের জন্য কি আপনাকে আলাদা করে কেউ বেতন দিচ্ছে?”
রহমতুল্লাহ হেসে বললেন,
“কি যে বলেন রিয়াজ সাহেব! আমি তো আপনার খবর নেওয়ার জন্যই ফোন দিয়েছি।”
“আমার খবর নেওয়ার চেয়ে আপনি অন্যের খবর আমাকে বেশি দেন।”
“আপনাকে জানাতে ভালো লাগে।”
“তা আজ কার খবর দেবেন?”
“আপনি বোধহয় ইদানীং নিউজ দেখছেন না।”
“আমার এসব নিউজ দেখার সময় নেই। আমাকে নিয়ে কোনো খবর থাকলে আমার লোকেরা আমাকে জানিয়ে দেয়।”
“তবে এই খবরটা আপনার অজানা রয়ে গেল কিভাবে জনাব?”
“কোন খবর!”
“মৈত্রী গ্রুপ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে! শুনেন নি?”
রিয়াজুর রহমান কথাটি শুনে কপাল ভাঁজ করে চেয়ারে বসলেন। তারপর বললেন,
“বুঝলাম না। সোজাসুজি কথা বলুন।”
“আপনার প্রাক্তন বন্ধুদের ব্যবসায়িক গ্রুপ নিজের জায়গা আবার ধরে নিয়েছে।”
“অসম্ভব।”
“সম্ভব জনাব, সম্ভব।”
“ওদের কেউই বেঁচে নেই। তাহলে এটা….”
রহমতুল্লাহ রিয়াজুর রহমানকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“বেঁচে আছে বলেই তো সম্ভব হয়েছে।”
“কে বেঁচে আছে!”
“আপনার কাছের বন্ধুর ভাগ্নে তাহমিদ, আপনার পুরোনো পার্টনার আনিস চৌধুরীর ছেলে আহনাফ। আরো আছে। আপনি বরং এই এক সপ্তাহের খবরগুলো দেখুন। তারপর সব জানতে পারবেন।”
রিয়াজুর রহমান ফোন রেখে গত চারদিনের পত্রিকা ঘাঁটতেই সব তথ্য পেয়ে গেলো। তিনি সাথে সাথেই নিয়াজ হোসেনকে ফোন করে বললেন,
“মৈত্রী গ্রুপের নতুন দুই এম.ডির সব তথ্য আমাকে পাঠা, ফাস্ট। আর বাকি যারা বেঁচে আছে, তাদের সবার ডিটেইলসও দিবি।”
এদিকে সন্ধ্যায় এলাকার গলিতে হাঁটতে বের হয়েছে ইভান। হঠাৎ সে দেখলো গলির সামনে দুইটা ছেলে একটা মেয়েকে উত্যক্ত করছে। সে কাছে যেতেই দেখলো মেয়েটা আর কেউ নয়, বরং সানায়া। ইভান সানায়াকে তার এলাকায় দেখে কিছুটা অবাক হলো। সানায়া ইভানকে দেখে আনন্দিত কন্ঠে বললো,
“আপনি আসবেন আমি জানতাম।”
ইভান সানায়ার কথায় কিছুটা অবাক হলো। সানায়া ইভানের হেলদোল না দেখে চেঁচিয়ে বলল,
“আরেহ, স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? মারুন এদের।”
ইভান ছেলেগুলোর কলার ধরে এক ধাক্কা দিয়ে পেছনে সরালো। তখনই সানায়ার বডিগার্ডগুলো এসে সানায়ার পেছনে দাঁড়ালো। ইভান ছেলে দুইটাকে মারতে যাবে সানায়া তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“থাক, থাক, আর মারতে হবে না। ওরা বুঝে গেছে ওরা কাকে বিরক্ত করছিল। এখন ভুলেও আর আমাকে বিরক্ত করার সাহস দেখাবে না।”
সানায়া এবার ছেলে দু’টোকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এই ছেলেরা, দেখেছো। আমার আশেপাশে কতো লোক আছে? আমার চেহারাটা মনে রেখে দাও। পরের বার আমাকে দেখলে যাতে রাস্তা পরিষ্কার দেখি।”
ইভান সানায়ার কথায় ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকালো। ছেলে দুইটা দৌঁড়ে চলে গেলো। সানায়া তার বডিগার্ডদের দিকে ফিরে বলল,
“কোথায় থাকো তোমরা? আজ তোমাদের বেখেয়ালির জন্য আমার কতো বড় বিপদ হতে পারতো, জানো?”
তাদের মধ্যে একজন বলল, “সরি ম্যাম।”
সানায়া ইভানকে দেখিয়ে গার্ডগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আজ ইনি না আসলে আমার অনেক বড় বিপদ হয়ে যেতো। স্যালুট করো উনাকে।”
তারা সানায়ার কথায় ইভানকে স্যালুট করলো। সানায়া এবার নরম কন্ঠে বলল,
“তোমরা এবার এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমার অপেক্ষা করো। আমি উনার সাথে আছি, বুঝেছো? উনি থাকতে তোমাদের প্রয়োজন নেই।”
কথাটি বলেই সানায়া ইভানের হাত ধরে সামনে হাঁটতে লাগলো। ইভান অবাক হয়ে সানায়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুদূর যাওয়ার পর ইভান নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“সব ব্যাপারটাই কেন যেন আমার স্ক্রিপ্টেড মনে হলো!”
সানায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তাছাড়া আমার উপায় ছিল না। ছেলে দুইটাকে আমি ভাড়া করে এনেছি। আমার ক্লাসমেটের এলাকার ছেলে।”
“কিন্তু এগুলো করার কারণ কি!”
“দেখছেনই তো বডিগার্ডগুলো উঠতে বসতে আমার পেছনে লেগেই থাকে। এখন ভেবেছি, ওদের সামনে কাউকে যদি বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যায়, ওরা হয়তো তার সাথে আমাকে একা ছাড়বে। তাই এই নাটক করা।”
ইভান বুকে হাত গুঁজে বলল,
“বাহ! তা এই নাটকে আমাকে ঢুকিয়েছেন কেন?”
সানায়া হালকা হেসে বলল,
“কারণ আমার আপনাকেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে।”
“ইন্টারেস্টিং। কয়েকবার দেখেই আপনি আমাকে বিশ্বাস করে ফেলেছেন?”
“হুম, আচ্ছা, এসব বাদ দিন। এখন যেহেতু বিশ্বাসযোগ্য মনেই হয়েছে, তাহলে এটা একটু আগাক।”
“কি আগাবে?”
“আমাদের সম্পর্কটা!”
“যেমন?”
সানায়া হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, “ফ্রেন্ডস।”
ইভান কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“আগে বলুন, এই স্ক্রিপ্টেড নাটকে আমার এখানে আসাটা কি আপনার নাটকে আগে থেকেই লিখিত ছিল?”
সানায়া লাজুক হেসে বলল,
“না, আসলে, আমি আপনাকে কয়েকদিন ফলো করিয়েছিলাম। ওই দুইটা ছেলেই আপনার বের হওয়ার সময়টা আমাকে জানিয়েছে। আপনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় বিশ মিনিট হাঁটেন। তাই না?”
ইভান হেসে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, “ফ্রেন্ডস।”
সানায়া তাড়াতাড়ি হাত মিলিয়ে একটা দীপ্তিময় হাসি দিলো। তার হাসি দেখে মনে হচ্ছে, তার বহুদিনের ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। ইভান সেই হাসির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।
৯৮.
দরজা খুলতেই শাহবাজ খানকে দেখে অবাক হলো আহনাফ। সেই পনেরো বছর বয়সে সে শাহবাজ খানকে দেখেছিল। তবুও এই লোকটাকে চিনতে তার একটুও দেরী হলো না। শাহবাজ খানও আহনাফকে চিনতে পেরেছেন। তাই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন,
“আহনাফ, অনেক বড় হয়ে গেছো, দেখছি।”
কথাটি বলেই আহনাফের অনুমতি ছাড়াই ঘরে ঢুকে পড়লেন। আহনাফ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলল,
“আপনি এখানে কেন এসেছেন?”
শাহবাজ খান আহনাফের শীতল কণ্ঠ শুনে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“খুব অভদ্র হয়ে গেছো মনে হচ্ছে!”
আহনাফ কপাল ভাঁজ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। শাহবাজ খান বললেন,
“বড়দের দেখলে সালাম দিতে হয়, সেটা হয়তো জানো না। জানবেও বা কিভাবে, শেখার বয়সেই তো সব শিক্ষক হারিয়েছ!”
আহনাফ ক্ষ্যাপা কন্ঠে বলল,
“আপনি এখানে কেন এসেছেন?”
“অরুণিকাকে নিতে এসেছি।”
“ওকে নিতে আসার তো আপনার কোনো অধিকার নেই।”
“আমি ওর মামা। আমি ওকে নিয়ে যেতেই পারি।”
“এসব কোন ধরণের তামাশা? আপনি হঠাৎ কোথা থেকে এসে এসব কথা বলছেন?”
“আর তুমি আমার সাথে কেমন তামাশা করছো? আসার সাথে সাথেই অভদ্রের মতো কথা বলছো।”
“আপনিও খুব একটা ভদ্রভাবে ঘরে ঢুকেন নি। আপনার হাবভাবে কোনো ভদ্রলোকের লক্ষণ দেখা যায় নি। তাই আমিও ভদ্রতা দেখানোর প্রয়োজন মনে করছি নি।”
শাহবাজ খান হঠাৎ তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
“তাহলে এই ছেলেই হবে আমার ভাগ্নির উড বি হাসবেন্ড? এমন অভদ্র, বেয়াদব ছেলের সাথে অরুণিকার বিয়ে ঠিক হয়েছে? তোমাকে তো আমার সেই সময় থেকেই অপছন্দ ছিল।”
উপর থেকে তূর্য দুই সিঁড়ি নেমে শাহবাজ খানকে দেখে আবার উপরে উঠে গেলো। সে গিয়ে উপমাকে বলল,
“উপমা, তুমি টুইংকেলের কাছে যাও। ওর সাথে কিছুক্ষণ থাকো। ও যাতে কোনোভাবেই নিচে না নামে।”
উপমা চিন্তিত কন্ঠে বললো, “কি হয়েছে?”
তূর্য তাগাদা দিয়ে বলল,
“তোমাকে যা বলেছি আপতত তাই করো।”
উপমা উপরে উঠতেই তূর্য বাকিদের ঘরে গিয়ে শাহবাজ খানের আসার খবর দিলো। সবাই নিচে নামতেই শাহবাজ খান বললেন,
“সৈন্যবাহিনী নিয়ে চলে এসেছো দেখছি। এবার অরুণিকাকেও আসতে বলো।”
আরাফ শাহবাজ খানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“কি চান আপনি?”
“অরুণিকাকে দেখতে এসেছি। ওকে নিতে এসেছি।”
“আপনার হাতে অরুকে দেবো, এটা আপনি ভাবলেন কিভাবে?”
“কেনই বা দেবে না?”
“তা আপনি ভালো করেই জানেন, মিস্টার শাহবাজ খান।”
শাহবাজ খান দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
“জানি, সেই খবরটাই তো দেখেছো, যেটা দেখে তোমরা আমাকে খুনী ভাবছো! ভাবছো আমি সেই রাতে মির্জাদের সাথে মিলিত হয়ে সবাইকে খুন করিয়েছি? ওকে ফাইন। ভাবো, যা ভাবার। আমি কাউকে এক্সপ্লেইন করার প্রয়োজন মনে করি না।”
ইভান শাহবাজ খানের হাত ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“শুধু প্রমাণটা একবার পাই, তারপর সব দাদাগিরি বেরিয়ে যাবে।”
এরপর ইভান টেনে শাহবাজ খানকে ঘর থেকে বের করে দিলো। শাহবাজ খান বললেন,
“আমি এতোটুকুই বলবো, অরুণিকা আমার বোনের মেয়ে। জিহান, জিসান আমার ভাগ্নে ছিল। নিপা আমার বোন ছিল। জুবাইয়ের করিম চৌধুরী আমার ভগ্নিপতি ছিল। আমি বাইরের কারো সাথে আত্মীয়তা রাখি না, কিন্তু আত্মীয়দের সাথে আত্মীয়তা ভালোই রাখতে জানি। এখন কেউ যদি আমার নামে মিথ্যে অভিযোগ করে। মিডিয়া যদি আমাকে খুনী মনে করে, তাহলে আমার কিছুই করার নেই। তবে একটা কথা শুনে রাখো, অরুণিকা নিজ থেকেই আমার সাথে যেতে চাইবে। আর ওই আহনাফকে বলে দিও, আমার ভাগ্নির বিয়ে ওই বেয়াদব ছেলের সাথে কখনোই হবে না।”
ইভান ধড়াম করে শাহবাজ খানের মুখের উপর দরজা বেঁধে দিলো। ইমন বলল,
“এখন বাড়ির বাইরে আরো কয়েকজন পাহারাদার লাগাতে হবে। সিকিউরিটি আরো শক্ত করতে হবে।”
এদিকে রাতে অরুণিকার ফোনে একটা কল এলো। অরুণিকা ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,
“ছোট্ট সোনামণি, অরুণিকা, কেমন আছো মা?”
“কে আপনি?”
“আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী!”
অরুণিকা কিছুটা অবাক হলো। লোকটি আজ তাকে তার মামার বাসায় আসার ঘটনাটি বললো, আর কিভাবে ছ’জন তাকে অপমান করে বের করেছে সব জানালো। অরুণিকা বলল,
“আপনি আমাকে এসব কেন বলছেন?”
“তোমাকে সতর্ক করতে চাইছি। এই ছ’জন তোমার সাথে যেকোনো সময় যেকোনো কিছু করতে পারে৷ ভুলে যেও না, তুমি ৫০ ভাগ অংশের মালিক। এই ৫০ ভাগ অংশে মৈত্রী ম্যানশনের অর্ধেক জায়গা এসে পড়ছে। তোমার বাবা-দাদার পৈতৃক সম্পত্তিসহ অনেক কিছু। তুমি একাই কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছো। এখন এই টাকাগুলো তোমার কাছ থেকে নেওয়ার জন্যই এই ছ’জন তোমাকে ব্যবহার করছে।”
অরুণিকা বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“চুপ করুন। আমার লাগবে না ৫০ ভাগ সম্পত্তি। নিলে নিয়ে নিক। আমার তাতে কিছুই আসে যায় না। আমার মূল সম্পদ সেই ছ’জন পুরুষ, যাদের নিয়ে আপনি আমাকে এখন উল্টোপাল্টা কথা বোঝাচ্ছেন। আরেকবার ফোন করলে আপনার নামে আমি মামলা করে আসবো। আপনার সিম বন্ধ করিয়ে দেবো।”
অরুণিকা ফোন কেটে দিলো। লোকটাকে যাচ্ছেতাই শুনালেও অরুণিকা কোনোভাবে নিজের মনকে শান্ত করতে পারছে না। সে বুকে হাত দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“আর কেউ আমাকে ধোঁকা দিলেও আরাফ কখনোই আমাকে ধোঁকা দেবে না। আমি আরাফকে বিশ্বাস করি।”
আজ অনেকদিন পর নিয়াজ হোসেনের সাথে মার্কেটে এসেছেন রিয়াজুর রহমান। সাধারণত তার জিনিসপত্র কেনার দায়িত্ব নিয়াজ হোসেনের উপরই থাকে। তবে আজ তিনিসহ এসেছেন। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তার চোখ আটকে গেলো। তিনি মুগ্ধ দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছেন। নিয়াজ হোসেন রিয়াজুর রহমানকে থমকে যেতে দেখে বললেন,
“কি হয়েছে? দাঁড়িয়ে গেলি কেন?”
রিয়াজুর রহমান মুচকি হেসে বললেন,
“নিঁখুত সৌন্দর্য।”
নিয়াজ হোসেন সামনে তাকিয়ে একটা মেয়েকে দেখে বললেন,
“আমার মেয়ের বয়সী মনে হচ্ছে!”
রিয়াজুর রহমান ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“কার মেয়ের বয়সী জানতে চাই নি। আমার যেহেতু মেয়ে নেই, তাহলে মেয়ের বয়সী বলতে কোনো নারীই আমার জন্য এই পৃথিবীতে নেই। সবগুলোই আমার বয়সী। আমি এই মেয়ের সব ডিটেইলস চাই।”
নিয়াজ হোসেন বললেন,
“পৃথিবীর সব মেয়ের ডিটেইলস নিয়ে আমি বসে থাকি না। আমাকে কি তোর গুগল মনে হচ্ছে?”
“মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণ করার সময় এসে গেছে, নিয়াজ।”
নিয়াজ হোসেন অবাক হয়ে বললেন,
“তুই এই মেয়েকে দেখেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিস?”
রিয়াজুর রহমান কোনো কথা না বলে মার্কেট থেকে বেরিয়ে পড়লেন। নিয়াজ হোসেন মনে মনে বললেন,
“এই রিয়াজ আমাকে আবার কোন ঝামেলায় ফেললো। বুড়ো বয়সে আমাকে হেনস্তা করিয়ে ছাড়বে।”
এদিকে ইভান আর সানায়া একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে। ইদানীং তাদের প্রায়ই দেখা হয়। তাদের বন্ধুত্বও খুব জমে উঠেছে। যেই ইভান খুব কম হাসতো, সে এখন প্রাণখুলে হাসে। আর সেই হাসি বরাবরই সানায়াকে মুগ্ধ করে। প্রথমদিন থেকেই ইভানের ব্যক্তিত্ব সানায়াকে মুগ্ধ করেছিল। সেই থেকে সে যতোবারই ইভানকে দেখেছিল, মুখে গম্ভীর ভাব রাখলেও মনে মনে খুব খুশি হতো। মাওশিয়াত আর ইমনের এনগেজমেন্টেও যাওয়ার মূল কারণ ইভানকে দেখা। তবে সানায়া তার অনুভূতির কথা কাউকে বলে নি, এমনকি রাহিও এসব জানে না। তার ভালো লাগা সে নিজের মাঝেই জমিয়ে রেখেছে।
সানায়া আর ইভান কথা বলছিল, হঠাৎ এক মহিলা চেয়ারে বসতে গিয়ে ধপ করে নিচে পড়ে গেলো। ইভান উঠে মহিলাটিকে বসিয়ে তার কোলের বাচ্চাকে নিয়ে নিলো। মহিলাটির কোলে এক বছর বয়সী একটা বাচ্চা ছিল। রেস্টুরেন্টের অনেকেই মহিলাটিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর ইভান সেই বাচ্চাটির কান্না থামানোর জন্য বিভিন্ন মুখোভঙ্গি দিচ্ছে। সানায়া তা দেখে আনমনে হাসছে। ইভান মহিলাটির ব্যথা কমলে, তার কোলে বাচ্চাটিকে দিয়ে দিলো। এরপর সে খাবারের বিল দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো। সানায়া তাকে বলল,
“বাচ্চাদের সাথে খুব সখ্যতা আছে দেখছি!”
ইভান হেসে বলল,
“ওটা তো অনেক শান্ত বাচ্চা ছিল। যেখানে একটা রগচটা বাচ্চাকে বড় করে তুলেছি, সেখানে সখ্যতা তো থাকবেই।”
“কে সে?”
“অরুণিকা। সেই দুষ্টু ছিল মেয়েটা। তবে ও আমাকে অনেক ভয় পাই।”
“স্বাভাবিক, যা এক্সপ্রেশন দেখাও। তোমার চোখ দেখলে বড়-বুড়োরাও ভয় পেয়ে যাবে।”
ইভান হেসে বলল,
“কিন্তু, তুমি তো একটু ভয় পাও না।”
সানায়া মনে মনে বলল,
“যেই রাগী চেহারার উপর পটে আছি, সেটা দেখে ভয় পাই কিভাবে বলো?”
(পরবর্তী পর্বে থাকবে থ্রিলড।)
চলবে—-