অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৬১||

0
1043

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৬১||

১০২.
বিয়ের পর থেকেই বিরাজ কুমারের সাথে শতাব্দীর সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছিলো না। শতাব্দী বিচার-বিবেচনা না করেই স্বামীকে তার পুরোনো ভালোবাসার কথা জানিয়ে দেয়। কিন্তু বিরাজ কুমারের মন-মানসিকতা ওতো ভালো ছিল না। সে এরপর থেকেই শতাব্দীর কাছ থেকে দূরত্ব রাখা শুরু করে দেয়। বিয়ের কয়েক মাস পর সে দেশদ্রোহীদের হাতে শহীদ হয়৷ কিন্তু বিরাজ কুমারের মা কুসংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনে করতেন শতাব্দী অলক্ষুণে, তাই তার ছেলে অল্প বয়সে মারা গিয়েছে। এরপর থেকে তিনি শতাব্দীকে ঘরে বন্দি করে রাখেন। শতাব্দীর বাবা-মার সাথেও তাকে দেখা করতে দিতেন না। তবে এই নিয়ে শতাব্দীর খুব একটা অভিযোগ ছিল না। বরং একাকীত্বকেই সে মেনে নিয়েছিল। প্রায় দুই বছর পর শতাব্দীর মানসিক বিকার ঘটে। প্রথম প্রথম তার কথাবার্তা অস্বাভাবিক হয়ে উঠে, তারপর মাঝে মাঝে রাতে বা দিনে অস্বাভাবিক আচরণ করে বসে। শতাব্দীর এই আচরণের পর তাকে বাবার বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে শতাব্দী শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। তার স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে, আর প্যারালাইজড হয়ে যায়। এরমধ্যে একবার সে ব্রেইন স্ট্রোকও করেছিল। সৃষ্টিকর্তার দয়ায় সে লাইফ সাপোর্ট থেকে বেঁচে এসেছিল। এখন সে পুরোপুরি পঙ্গু। হুইলচেয়ারই তার ভরসা। কথাও ঠিকভাবে বলতে পারে না। কি বলে তা সহজে বোঝা যায় না। তবে সে সবার কথায় বুঝতে পারে।

মাস্টারমশাই শতাব্দীর সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা তাহমিদকে জানালেন। সব শুনে তাহমিদের মনের সব শক্তি যেন ধপ করে নিভে গেলো। এই চার বছর সে এই আশা নিয়ে ছিল, যে তার চন্দ্রিমা সুখে আছে, অথচ সে এতোদিন সম্পূর্ণ মিথ্যে আশায় বেঁচে ছিল। শতাব্দী তাকে ছাড়া কখনোই ভালো ছিল না। তাহমিদ শতাব্দীর হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
“আমি কি এই হাতটা ছেড়ে দিয়ে খুব ভুল করে ফেলেছিলাম? আমার অনুভূতি তো এই সমাজের কাছে পঙ্গু ছিল। কিন্তু এই সমাজ বিনিময়ে কি দিয়েছে?”

শতাব্দীর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মিতুবালা তাহমিদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“আমার মেয়ের পছন্দ কখনোই খারাপ ছিল না। শুধু ভুল সমাজে তোমাদের পরিচয় হয়েছিল।”

তাহমিদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। মাস্টারমশাই বললেন,
“চলে যাবে, বাবা?”

“হ্যাঁ, কাল দেশে ফিরবো। ইমন আর মাওশিয়াতের বিয়ের জন্য এসেছিলাম। দেশে অনেক সমস্যার মধ্যে আছি। তাদের বিয়েটাও তাড়াহুড়োর মধ্যে হয়েছে।”

“বাকীরা কেমন আছে?”

শ্রীজা হুট করে পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
“অরুণিকা কেমন আছে, দাদা?”

তাহমিদ মুচকি হেসে বলল,
“আমি বিকেলে ওকে নিয়ে আবার আসবো। তারপর না হয় ওর সাথেই গল্প করে সব জেনে নেবে। অরুণিকা তোমাদের কথা এখনো বলে। স্পেশালি ওর শতু আপুর কথা!”

শতাব্দীর বুক ফেঁটে কান্না এলো। কিন্তু সে শব্দ করে বলতে পারছে না, যে এতো বছর সে শুধু একনজর তার ছোট সখী, আর তার মিষ্টি মশাইকে দেখার অপেক্ষায় ছিল। তাহমিদ যাওয়ার আগে শতাব্দীর হাত ধরে বলল,
“আমি আবার আসবো।”

তাহমিদ মহল্লা থেকে বেরিয়ে সোজা রিক্সা নিয়ে নিলো। পকেটে একটা সানগ্লাস ছিল, ওইটা চোখে পরে নিলো। পকেট থেকে মাস্ক বের করে ওইটাও মুখে লাগালো। নিজের হাঁটু খামচে ধরে শক্ত হয়ে বসে আছে সে। কোনোভাবে নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। চোখ দিয়ে দরদর করে অশ্রু গড়াচ্ছে। অর্ধেক রাস্তায় নেমে রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে সেই গাছের নিচে চলে গেলো, যেখানে সে আগে মিষ্টি বিক্রির পর এসে বসতো, আর তাকে সঙ্গ দিতো শতাব্দী। তাহমিদ গাছের নিচে এসে ধপ করে বসে পড়লো। মুখ থেকে মাস্কটা টেনে ফেলে দিলো। তারপর গলায় আটকে থাকা সব শব্দ যেনো বেরিয়ে এলো। আজ অনেক বছর পর সে শব্দ করে কাঁদছে। মনের সব আক্ষেপ, হতাশা তার ফুঁপিয়ে উঠা শব্দের সাথে আকাশ-বাতাস আন্দোলিত করছে। আজ খোলা হাওয়া তার ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে গেছে। অনেক তো নিজের ভালোবাসাকে সে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলেই মনের ভেতর চাপিয়ে রেখেছে, অনেক তো সব অনুভূতিগুলোকে চার দেয়ালের ভেতর আটকে রেখেছিল। আর সব অশ্রুকণা বৃষ্টির পানির সাথে ধুয়ে দিয়েছে, কখনোবা ওয়াশরুমের কল ছেড়ে দিয়ে আড়াল করেছে। কিন্তু আজ সে আড়াল করতে পারছে না।

পুরুষ মানুষের অশ্রু জমানোর গল্পগুলো অনেক ভারী আর গভীর। এই গভীরতা একবার প্রকাশ পেলে পুরো মুহূর্ত থমকে যায়। ঠিক এই মুহূর্তটাও তাহমিদের জন্য থমকে গেছে। পরিবেশটা আজ এতো বিষণ্ণ, যেন আজ প্রকৃতিও কাঁদতে চাইছে। কিন্তু সব কান্না দৃশ্যমান হয় না। তাহমিদের মনে জমানো আক্ষেপগুলো প্রকৃতি শুষে নিয়েছে। তাই সেও মিনিট সেকেন্ডের মধ্যেই নিজেকে হালকা করে উঠে দাঁড়িয়েছে। তাহমিদ পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখটা মুছে নিলো। এবার সে সামনের রাস্তায় পা বাড়ালো। আর ধীরে ধীরে পায়ের গতি বাড়াতে লাগলো। রোদের তাপে সে যতো দ্রুত সম্ভব হাঁটছে। আজ সবাই এটাই জানবে তার চোখের ক্লান্তি শুধু বহুপথ হেঁটে আসার জন্যই এসেছে, কেউই এটা জানবে না, তার মনটা আজ কি পরিমাণ আঘাত পেয়েছে।

তাহমিদকে দেখে আহনাফ তার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“কি রে চোখ-মুখের এই অবস্থা কেন?”

“রাস্তায় জ্যাম ছিল, তাই হেঁটে এসেছি।”

“ডাক্তার তোকে বেশি হাঁটাহাঁটি করতে নিষেধ করেছে, ভুলে গেছিস? হেঁটে এসেছিস কেন? বাইক রাইডার নিয়ে চলে আসতি।”

“বাদ দে, এসেই তো গেছি। আচ্ছা, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

এই বলে তাহমিদ ভেতরে চলে গেলো। আর আরাফ তাহমিদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। বিকেলে তাহমিদ অরুণিকাকে বলল,
“চলো, পুরোনো মহল্লা থেকে ঘুরে আসি।”

তাহমিদের কথায় বাকিরাও যাওয়ার আগ্রহ দেখালো। এমনিতে আরাফ কলকাতায় এসে একবার সায়ন্তনীর মা আর ভাইয়ের সাথে দেখা করে এসেছে। সায়ান এখন কলেজে উঠেছে। সে নিজেই টিউশন করিয়ে টাকা আয় করতে পারছে। ভালো একটা বাসাও নিয়েছে। বলা যায়, তারা এখন একপ্রকার ভালোই আছে।

এদিকে বিকেলে সবার সাথে মাওশিয়াতও শতাব্দীদের বাড়িতে গেলো। সে আগে অনেকবার শতাব্দীকে ফোন দিয়েছিল, কিন্তু তাকে ফোনে পাওয়া যায় নি। শতাব্দীর বাড়িতে এসেও তার খোঁজ নিয়েছিল, কিন্তু তারাও কিছু জানায় নি। আর মাওশিয়াতের সাথে শতাব্দীর বাবা-মার তেমন কোনো ভালো যোগাযোগ ছিল না। ইমনদের মাধ্যমেই মাওশিয়াতের সাথে শতাব্দীর পরিচয় হয়েছিল। পারিবারিকভাবে কোনো ঘনিষ্ঠতা ছিল না, তাই তারা মাওশিয়াতকে শতাব্দীর ব্যাপারে কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করে নি।

তারা সবাই শতাব্দীকে দেখে থমকে গেলো। এদিকে আরাফ তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাহমিদের মুখের ভাব স্বাভাবিক দেখে সে সবটা বুঝে নিলো, যে সকালে হেঁটে আসার জন্য তাহমিদকে বিধ্বস্ত দেখায় নি, বরং সে নিজের দুর্বলতা আড়াল করার জন্যই রোদে পুড়ে হেঁটে এসেছে।

এদিকে অরুণিকা শতাব্দীর হাত ধরে বসে আছে। সে কোনোভাবেই শতাব্দীকে ফেলে যাবে না। রাত হয়ে আসছে। কালই তাদের ফ্লাইট। সুরাইয়া, ডুমুর আর বাকী মহিলা প্রতিবেশী যারা অরুণিকাকে ছোট থেকে চিনতো, তারা সবাই অরুণিকাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। বাইরে আহনাফ আর তাহমিদ দাঁড়িয়ে আছে। বাকিরা মহল্লার গলির সামনে চলে এসেছে। আহনাফ বাইরে থেকে বলল,
“অরু, চলো। দেরী হয়ে যাচ্ছে।”

অরুণিকা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। শতাব্দীর হাত ছেড়ে দিয়ে সে তাহমিদের কাছে এসে হুট করে বলে ফেলল,
“তাহমিদ, তুমি কি আমার শতু আপুকে বিয়ে করবে?”

অরুণিকার কথা যাদের কানে পৌঁছেছে তারা সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে। আর তাহমিদ তাকিয়ে আছে মাস্টারমশাইয়ের দিকে।

মাস্টারমশাইয়ের এখন অনেক বয়স হয়েছে। চুল পড়ে গেছে। মুখের মধ্যে ক্লান্তি রেখা ফুটে উঠেছে। মাস্টারমশাইয়ের মুখের ভাব দেখেই তাহমিদ বুঝে ফেলেছে, তার সম্মানের কাছে শতাব্দীর অনুভূতির কোনো মূল্য নেই। সে একজন বাবাকে তার মেয়ের অনুভূতির জন্য হারতে দেবে না। তাহমিদ অরুণিকার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“এটা অসম্ভব। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমাদের অনুশাসন আলাদা। একজনের অনুভূতির জন্য এতো বড় নিয়মের বিশৃঙ্খলা ঘটানো উচিত হবে না।”

তাহমিদ এই কথা বলে বেরিয়ে গেল। অরুণিকা হাত মুঠো করে বলল,
“তোমরা সবাই কঠিন হৃদয়ের মানুষ। তোমাদের মানুষ বলাই উচিত না।”

আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে তাকে নিয়ে নিচে নামলো। অরুণিকা পুরো গাড়িতে কারো সাথে কোনো কথা বলে নি। পুরো রাত সে কেঁদেছে। আর আরাফকে জিজ্ঞেস করেছে, কেন শতাব্দী তার ভাবী হতে পারবে না? আরাফ শুধু চুপ করে বসে ছিল। তাহমিদ যেখানে কোনো উত্তর দিচ্ছে না, সেখানে সে আর কি বলবে? রাত দুইটাই আহনাফ আর আরাফ তাহমিদের খোঁজে ছাদে উঠলো। দেখলো সে আগে থেকেই সেখানে তূর্যের সাথে বসে আছে। তূর্য তাদের দেখে বলল,
“আয়, আয়, সব দেবদাস মিলে একসাথে মিটিং করি।”

তারপর সে আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুই আপতত দেবদাসের কাতারে পড়ছিস না।”

আহনাফ বলল,
“বিয়ে হলে দেবদাস থেকে প্রমোশন নিয়ে নিবো। আপতত দেবদাসই থাকি। পারুর মনে তো আমার জন্য কোনো জায়গায় নেই। পৃথিবীর সবাইকে নিয়ে সে ভাববে, শুধু আমার শরীরে মরিচা ধরাবে।”

এদিকে আরাফ তাহমিদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো পরিবেশই তাহমিদকে নাড়া দিচ্ছে না। কেমন যেন জড় পদার্থ হয়ে গেছে। আরাফ এবার তাহমিদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুই চাইলে শতাব্দীকে মেনে নিতে পারিস। কারণ ওর বাবা-মা হয়তো এখন এই সম্পর্কে কোনো বাঁধা দেবে না।”

তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কেন বাঁধা দেবে না?”

তূর্য বলল,
“বাঁধা দেওয়ার মতো কিইবা বাকি আছে? আর তুই যদি এখনো ওকে ভালোবাসিস, এই অবস্থায়ও ওর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারিস, তাহলে বসে থাকিস না।”

তাহমিদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“তোদের সবার কাছে এটাই মনে হচ্ছে, শতাব্দী শারীরিকভাবে অসুস্থ তাই ওর বাবা-মা আমার সাথে বিয়ে হলে কোনো অমত করবেন না, তাই তো? শুন, কোনো সন্তান তার বাবা-মার কাছে অসুস্থ হয় না৷ আমি মাস্টারমশাইয়ের চোখে কষ্ট দেখেছি। শতাব্দীকে হারানোর কষ্ট। তার চোখে আমি নিজের ভুল সিদ্ধান্তের অনুশোচনা দেখেছি। আমি একজন বাবাকে আরেকবার হেরে যেতে দেবো না। আমি শতাব্দীকে নিয়ে কি অনুভব করি, এটা আমি কাউকে প্রকাশ করতে ইচ্ছুক নই। কিন্তু ও আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। আর যাকে আমি সুস্থ অবস্থায় কাছে টেনে নিতে পারি নি, তাকে অসুস্থ অবস্থায় বিয়ে করে তাকে সবার সামনে দয়া দেখাতে পারবো না। শতাব্দী আমাকে বিয়ে করলে আমার ধর্ম মেনে নেবে, আর এটা মাস্টারমশাই চান না। কিন্তু এখন হয়তো সমাজের অনেকেই তাকে বলবে, বিয়ে হচ্ছে এটাই অনেক। যেই ধর্মে যাক, কোনো বাঁধা নেই। আমার শতাব্দী এতো অসহায় হয় নি যে তাকে আমি দয়া করে বিয়ে করবো। ওর জন্ম-পরিচয় পরিবর্তন করে দেবো। ও আমার কাছে আগের মতোই থাকবে।”

তূর্য বলল,
“তুই কি করতে চাইছিস তাহলে? শতাব্দীকে একা ফেলে চলে যাবি?”

“আমার ওকে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনো অধিকার নেই। আর আমি সেই অধিকার অর্জনের চেষ্টাও করবো না। আমি শুধু এতোটুকু জানি, শতাব্দীর বাবা-মার তাকে নিয়ে একটা স্বপ্ন আছে, তারা যতোদিন বেঁচে আছে, আমি তাদের স্বপ্ন ধ্বংস করতে পারব না।”

“কেমন স্বপ্ন!”

“ধর, তোর আর উপমার একটা মেয়ে হলো। তোরা আদর দিয়ে মেয়েটাকে বড় করলি, তার বিয়ে নিয়ে স্বপ্ন দেখলি। মেয়েটা একদিন অন্য ধর্মের এক ছেলেকে ভালোবেসে ফেললো। এটা তুই কখনো মেনে নিতে পারবি না, তূর্য। তোর মেয়ের কোনো ত্রুটি থাকলেও তুই পারবি না। সমাজ তোকে বলবে, বিয়ে দিতে পারলেই মুক্তি। তোর তখন বুকটা ফেঁটে যাবে। এতোটা অসহায় লাগবে, তুই অশ্রু লুকানোর জায়গা পাবি না। এরপর তুই মেয়ের খুশির জন্য যাকে সুস্থ অবস্থায় সেই ছেলের সাথে বিয়ে দিস নি, তাকে অসুস্থ অবস্থায় সেই ছেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সমাজের কাছে হেরে যাবি। একজন বাবা এই হার নিয়ে কখনোই শান্তিতে বাঁচতে পারবে না। কারণ সবকিছুর ঊর্ধ্বে ধর্ম। আর মাস্টারমশাইও এটাই চান, তার মেয়ে তার ধর্ম নিয়েই মরুক। এটা উনার অধিকার। যতোদিন উনারা বেঁচে আছেন, এই কষ্টটা নিয়ে আমি ওদের মরতে দেবো না। আমি পারবো না এটা।”

আহনাফ বলল,
“তাহলে তুই শতাব্দীকে এই অবস্থায় রেখে দেশে যেতে পারবি?”

তাহমিদ উত্তরে মলিন হাসলো। তার কাছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।

পরেরদিন তারা ছ’জন এয়ারপোর্টে চলে এলো। মাওশিয়াত ওর বাবা-মার সাথে আলাদাভাবে আসছে। পুরো রাস্তা মেয়েটা কেঁদেকেটে অস্থির। বিয়ে করে স্বামীর বাড়ি যাচ্ছে, তাও আবার ভিনদেশে। কান্না করাটাই তো স্বাভাবিক। যখন তখন ছুটে আসার সুযোগ তো আর পাবে না।

তারা সব ফর্মালিটি পূরণ করতেই দেখলো মাস্টারমশাই আর মিতু বালা শতাব্দীকে নিয়ে এয়ারপোর্টে এসেছেন। অরুণিকা শতাব্দীকে দেখে দৌঁড়ে গেলো। তাহমিদ মাস্টারমশাইকে দেখে অবাক হলো। বাকিরাও যথেষ্ট অবাক হয়েছে। তার হাতে একটা লাগেজও আছে। মূলত লাগেজ দেখেই সবার এতো অবাক হওয়া। অরুণিকা শতাব্দীর হাত ধরে বলল,
“শতু আপু, তোমাকেও আমি আমার সাথে নিয়ে যেতে চাই। কিন্তু দেখো, সবাই চুপ করে আছে। সবাই এক একটা গাছ। সব বুঝে কিন্তু কোনো নড়ন নেই৷ এরা সবাই পাথর।”

মাস্টারমশাই অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“এই বাবাটা এতোটাও পাথর নয় যে তার মেয়েদের কষ্ট বুঝবে না। আমি আমার মেয়েকে তার ছোট সখীর কাছ থেকে আলাদা করতে পারবো না।”

তাহমিদ ধীর পায়ে মাস্টারমশাইয়ের দিকে এগিয়ে এলো। মাস্টার মশাই তাহমিদের সামনে হাত জোড় করে বললেন,
“আমি হেরে গেছি, বাবা। আমার শতাব্দীকে কি নিয়ে যাবে তোমার সাথে?”

তাহমিদ মাস্টারমশাইয়ের হাত ধরে বলল,
“এভাবে বলবেন না, মাস্টারমশাই। এভাবে কেন বলছেন আপনি?”

মিতু বালা বললেন,
“মেয়েটা তোমাদের দেখে কতো বছর পর হেসেছে! আমার মেয়েটা তো কথা বলতে পারে না। ও তো ওর মনের কথাগুলো আমাদের জানাতে পারছে না। কিন্তু ওর চোখগুলো সব বুঝিয়ে দিয়েছে। আমরা তো অসহায় হয়ে গেছি। মেয়ের খুশির জন্য আমরা সব করতে পারবো। সব মেনে নেবো। ওকে কি তোমাদের সাথে নিয়ে যাবে? কোনো দাবী থাকবে না, কোনো সম্পর্ক থাকবে না, শুধু শান্তিতে বলবো, মেয়েটা ভালোই আছে তার প্রিয় মানুষগুলোর সাথে।”

তাহমিদ এবার হাঁটু গেড়ে শতাব্দীর সামনে বসলো। তারপর তার হাত ধরে মাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“শতাব্দী আপনাদের মেয়ে। ওর খুশির জন্য আপনারা সব পারছেন, আমি কি আপনাদের খুশির জন্য একটা দায়িত্ব নিতে পারবো না? আমার কাছে আপনারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। যখন আমাদের কোনো অস্তিত্বই ছিল না, তখন আপনারা আমাদের হাত ধরেছেন। আমাদের স্কুলের ভর্তি, আমাদের জন্য কাজের ব্যবস্থা, আমাদের বিপদ-আপদ, অরুণিকার কেইস, আমার এক্সিডেন্ট, সব ব্যাপারে আপনারা আমাদের পাশে ছিলেন। অনেক কাছের মানুষও এতো কিছু করে না। আর আমি তো আপনাদের কাছের মানুষ মনে করি।”

তাহমিদ মাস্টারমশাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে আমি শতাব্দীকে আমার বন্ধুর জায়গাটা দিতে চাই। অরুণিকার শতু আপুকে ওর সখী করেই নিয়ে যেতে চাই। আপনারা যখন চাইবেন শতাব্দীকে দেখতে আসবেন। শতাব্দীকে নিয়েও যেতে পারবেন। কোনো দাবি-দাওয়া থাকবে না।”

অরুণিকা শতাব্দীর হাত ধরে বলল,
“আমার শতু আপু তার ছোট সখীর সাথে থাকবে। আপু জানো, আমার রুমটা অনেক বড়। আমরা দু’জন একসাথে সেখানে থাকবো। আমি তোমার অনেক যত্ন নেবো। তুমি ছোটবেলায় যেভাবে আমার খেয়াল রেখেছো, ঠিক সেভাবেই আমি তোমার খেয়াল রাখবো। দেখবে, তুমি খুব শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবে।”

তাহমিদ এবার শতাব্দীর হাত ধরে বলল,
“সব সম্পর্কের নাম হয় না। কিছু সম্পর্ক নাম ছাড়াও অনেক সুন্দর হয়। আর তা গভীরভাবে মনে লালন করতে জানতে হয়। প্রয়োজন শুধু একটু সম্মান আর ভালোবাসার। আমি শতাব্দীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ধর্ম-অনুশাসন, আদর্শ সবকিছুকে অনেক সম্মান করি। আমাদের সমাজে অনেক সম্পর্কের নাম আছে। কিন্তু সেই সম্পর্কে কোনো সম্মান নেই। আর যেখানে সম্মান থাকে, সেখানে আর কিছুর প্রয়োজন হয় না। বাকি সব শৃঙ্খল এমনিতেই সৃষ্টি হয়ে যায়। আমি বা আমরা কেউই আমাদের সীমালঙ্ঘন করবো না। আমরা অরুণিকার দায়িত্বটা যেভাবে পালন করেছি, কোনো নাম ছাড়া, কোনো সম্পর্ক ছাড়া, ঠিক সেভাবেই শতাব্দীর দায়িত্বটা আমি নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। ওর সন্তুষ্টি যদি আমাদের সাথে থাকায় হয়, তাহলে সেটাই হবে। কিন্তু বরাবরই ওর সব বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তার বাবা-মার হাতেই থাকবে।”

মাওশিয়াত মুচকি হেসে শতাব্দীর পাশে বসে বলল,
“আসলেই অরুণিকা একটা দায়িত্বের নাম। একটা ছোট্ট অরুণিকা তার ছ’জন পুরুষকে এতো বড় করে তুলেছে যে তারা সব পরিস্থিতির জন্য এখন প্রস্তুত। তারা সব শৃঙ্খলের ঊর্ধ্বে। আর তা একমাত্র অরুণিকার দ্বারাই সম্ভব হয়েছে। আজ তার ছয় পুরুষ তার জন্যই মানসিকভাবে শক্ত হয়েছে। নিজেদের সংযমী রাখতে শিখেছে।”

অরুণিকা হেসে বলল,
“হুম, আমি আছি বলেই তো এতোকিছু সম্ভব হয়েছে। আমি মানুষটাই খুব স্পেশাল।”

আহনাফ তূর্যের কানে ফিসফিস করে বলল,
“সবকিছুই স্পেশাল, কিন্তু বুদ্ধিটাই…”

তূর্য আহনাফকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
“মরিচাধরা।”

আহনাফ আর তূর্য উভয়ে মাথা নেড়ে একে-অপরের মতকে সম্মতি দিলো৷ অরুণিকা বাঁকা চোখে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ যে তাকে নিয়েই কিছু বলছে তা সে বুঝতে পেরেছে। সে মনে মনে বলল,
“আগে বাসায় চলো, তারপর বুঝবে অবহেলা কাকে বলে! কতো প্রকার ও কি কি? হুহ।”

টিকেট না পাওয়ায় শতাব্দী বাকীদের সাথে বাংলাদেশে যেতে পারলো না। পরের টিকেটের জন্য তাহমিদ নিজেও তার টিকেট ক্যান্সল করলো। অরুণিকাও শতাব্দীর সাথে যাওয়ার জন্য বায়না ধরলো। কিন্তু মাওশিয়াতকেও তো বরণ করে নিতে হবে। বাসায় অরুণিকা ছাড়া আর কোনো মেয়ে নেই। উপমাও তো বাবার বাড়ি চলে গেছে। তাই অরুণিকা বাধ্য হয়ে চলে গেলো। এদিকে আরো সাত ঘন্টা পর আরেকটা ফ্লাইট। তাহমিদ সেই সময়টা কাটানোর জন্য শতাব্দীকে নিয়ে আবার মহল্লায় ফিরলো। শ্রীজা বোনকে দেখে অনেক খুশি হলো। চার ঘন্টা সে বোনের পাশে বসে বসে গল্প করলো। তাহমিদ পুরো সময়টা দুই বোনের গল্প দেখে কাটিয়ে দিলো। এক ঘন্টা হাতে নিয়ে তারা আবার এয়ারপোর্টে এলো। এবার মাস্টারমশাই, মিতু বালা আর শ্রীজাও সাথে এসেছে। শ্রীজা যাওয়ার আগে তাহমিদের হাত ধরে বলল,
“দাদা, আমার দিদিকে তোমার ভরসায় পাঠাচ্ছি কিন্তু।”

তাহমিদ মুচকি হেসে বলল,
“ইনশাআল্লাহ, আমি তোমার ভরসা রক্ষা করবো।”

শতাব্দীকে সিটে বসানো হলো। সে হাতটা নাড়াতে পারছে না। কিন্তু তার খুব ইচ্ছে করছে তাহমিদের হাতটা ধরতে। তার মনের ভাষাগুলোও তো ধ্বনি খুঁজে পাচ্ছে না। তাহলে তা তাহমিদের কাছে কিভাবে পৌঁছাবে? তবে কিছু মনের ভাব ভাষাকেও হার মানিয়ে ফেলে, তাই হয়তো কোনো আবদার না শুনেই তাহমিদ নিজের আর শতাব্দীর সিট বেল্ট বেঁধে দেওয়ার পর তার হাতটি ধরলো। শতাব্দীর চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়লো। তাহমিদ তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“আমরা প্রতিদিন ভিডিও কলে বাবা-মার সাথে কথা বলবো। লম্বা ছুটি পেলে কলকাতায় আসবো। মাওশিয়াতও তোমার সাথে মাঝে মাঝেই আসবে। দু’টো আলাদা দেশ, তবুও মাত্র কয়েক ঘন্টার পথ। তুমি শুধু ধৈর্য ধরবে, তখন এই কয়েক ঘন্টার পথও কম মনে হবে।”

শতাব্দী মনে মনে বলল,
“মিষ্টি মশাই, তোমাকে কবে যে আবার এই নামে ডাকবো! তুমি এতো মিষ্টি কেন বলো না, মিষ্টি মশাই? তুমি সারাজীবন আমার মিষ্টি মশাই হয়েই থাকবে।”

এদিকে আজ উপমার চাকরির প্রথম দিন। সে ভালো একটা কোম্পানিতে বসের পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট হিসেবে যোগ দিয়েছে৷ প্রথম দিন তাই আলাদা উত্তেজনা কাজ করছে। একটু ভয়ও লাগছে। সে ভেতরে ঢুকতেই একজন পিয়ন তাকে তার ডেস্কে বসিয়ে দিলো। সে ভালোভাবে ডেস্কের উপর রাখা ফাইলগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলো। তখনই পেছন থেকে একজন বয়ষ্ক লোক এসে বলল,
“তুমি বসের কেবিনে যাও। তোমাকে কি করতে হবে, সে-ই বলবে।”

উপমা উঠে পেছন ফিরে বয়ষ্ক লোকটাকে দেখে সালাম দিয়ে মাথা নেড়ে বসের কেবিনের দিকে পা বাড়ালো। কেবিনের সামনে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে শব্দ এলো,
“আসতে পারো।”

উপমা অবাক হয়ে ভাবলো,
“দরজায় কড়া নাড়লাম না, তবুও কিভাবে বুঝলো?”

সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো দরজার বাইরে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। সে সেটির দিকে তাকাতে তাকাতে দরজা খুললো। দরজা খুলেই সামনে বসা মানুষটিকে দেখে সে বলে উঠল,
“আপনি?”

রিয়াজুর রহমান মুচকি হেসে বললেন,
“আমার কোম্পানি, আমি থাকবো না?”

উপমা শক্ত মুখে ভেতরে ঢুকে বলল,
“আপনি সেদিন রাতে খাবার নিয়ে বাসায় গেছেন, আর আজ আমাকে চাকরি দিয়েছেন? কেন? তূর্য আহমেদ আপনাকে বলেছে আমাকে কাজ দিতে? এখন তাহলে আমাকে কনভিন্স করার জন্য সে এই পথ খুঁজে নিয়েছে!”

রিয়াজুর রহমান ভ্রূ কুঁচকে উপমার দিকে তাকালো। সে উপমার কথার কোনো অর্থই বুঝলো না। তবে এতোটুকু বুঝেছে হয়তো উপমা আর তূর্যের সম্পর্কে কোনো ঝামেলা চলছে। রিয়াজুর রহমান মুচকি হেসে উত্তর দিলেন,
“অন্যদেরটা তো জানি না। তবে আমার আপনাকে কনভিন্স কর‍তে অনেক ভালো লাগে।”

উপমা ভ্রূ কুঁচকে রিয়াজুর রহমানের দিকে তাকালো। এরপর সে আর কিছু বললো না। চুপচাপ কাজ বুঝে নিয়ে নিজের ডেস্কে ফিরে এলো৷ এদিকে রিয়াজুর রহমানকে আনমনে হাসতে দেখে নিয়াজ হোসেন বললেন,
“আল্লাহর কাছে তোর হেদায়েতের জন্য দোয়া করেছিলাম। কিন্তু কথায় আছে না, হেদায়েতের মালিক আল্লাহ। যাকে দিতে চান না, তার কপালে কিছু নেই।”

রিয়াজুর রহমান বিরক্ত মুখে বললেন,
“মনটা ডিস্ট্রেক্ট করছিস কেন? আমি একটা জিনিস ভাবছি, আমাকে শান্তিতে ভাবতে দে।”

“দেখ, রিয়াজ, প্রথমত মেয়েটা বিবাহিত, দ্বিতীয়ত মেয়েটা তোর মৃত বন্ধুর ছেলের বউ। তৃতীয়ত তোর অর্ধেক বয়সী। এটা অসম্ভব।”

“অসম্ভব। তো?”

“তো! এই সম্পর্ক কখনোই সম্ভব না। কি উল্টাপাল্টা চিন্তা করছিস, হ্যাঁ?”

“দেখ, ও যদি আমার হতে না চাই, আমি ওকে জোর করবো না। ওর যার সাথে ইচ্ছে সংসার করুক। কিন্তু আমার ওকে দেখতে ভালো লাগে। আমি দেখবোই।”

কথাটি বলেই রিয়াজুর রহমান বাঁকা হেসে আবার বললেন,
“অনেক পুরোনো হিসেব জমে আছে। নতুন খাতায় এই নতুন হিসেবের নামটা উঠিয়ে নিস। এতোদিন মাঠে ছিল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী, এবার নেমেছে নতুন খেলোয়াড়। মাঠ যাতে পরিষ্কার থাকে। কারণ আমি প্রথম ব্যাটেই আমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে আউট করে দিবো।”

(আগামী পর্বে আরেকটা থ্রিলড অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্য। আর কয়েক পর্ব শুধু, অরুণিকার শেষ অংশ আসবে খুব শীঘ্রই।)

চলবে—-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here