#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৬৩: (২য় ভাগ)||
১০৫.
গাড়ি থেকে নেমে বডিগার্ডদের ইশারায় সরিয়ে দিলো সানায়া। তারাও এতোদিনে জেনে গেছে সানায়া তার কাছের মানুষের কাছে কতোটা নিরাপদ। তারা চলে যাওয়ার পর সানায়া পেছন ফিরে ইভানের দিকে তাকালো। ইভান মুচকি হেসে তার দিকে হাত এগিয়ে দিলো। তাদের মধ্যে দূরত্ব মাত্র দশ ফুট। তবুও এই পথটি সানায়া দৌঁড়ে পার করে ইভানের হাতটি ধরলো। ইভান বলল,
“পাহাড়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত তো?”
সানায়া এক গাল হেসে মাথা নাড়লো। ইভান সানায়াকে নিয়ে রওনা দিলো পাহাড়ের দেশে।
প্রভাবশালী শাহেদ মির্জার মেয়ে কখনো পাহাড় দেখে নি। সে ইভানকে খুব আবদার করেই বলেছিল তাকে পাহাড়ে নিয়ে যেতে। ইভান তার এই আবদারটি ফেলতে পারলো না। আর আজকাল সে সানায়ার কোনো আবদারই ফেলতে পারছে না। বরং সব ব্যস্ততা বাদ দিয়েই সে সানায়াকে সময় দেয়।
সানায়া আজ অনেক বছর পর বাসে উঠেছে। বাসে উঠেই সে জানালার পাশে গিয়ে বসে পড়লো। এরপর পুরো জানালাটা খুলে দিয়ে সে তার চুলগুলো খুলে দিলো। বাস চলতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে বাসের গতি বাড়ছে। আর বাতাসে তার চুলগুলো উড়ছে।
সানায়া চোখ বন্ধ করে তার স্বাধীনতা উপভোগ করছে। এই প্রথম সে নিজেকে স্বাধীন মানুষ ভাবছে। এদিকে ইভান অবাক দৃষ্টিতে সানায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সানায়া ইভানের দিকে ফিরে বলল,
“তুমি আমাকে আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত দিয়েছো, ইভান। থ্যাংক ইউ সো মাচ।”
সানায়ার এই কথাটা বলতে গিয়েই চোখ দু’টি ছলছল করে উঠলো। ইভান আজ সানায়াকে দেখে শুধু অবাকই হচ্ছে। সানায়া চোখের পানি টিস্যু দিয়ে মুছে বলল,
“কিছু মনে করো না। তুমি হয়তো বুঝতে পারবে না, এটা আমার জীবনের কতো বড় প্রাপ্তি। তোমার হয়তো হাসি আসতে পারে আমার কথা শুনে। কিন্তু এটাই সত্য। আমার কখনো কোনো বন্ধু হয় না, রাহি ছাড়া আমার কোনো মেয়ে বন্ধু নেই। কেউ আমাকে ভালোবাসে না। বাবা সারাজীবন নিজের কাজেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিল। তিনি নিজেকেই বেশি ভালোবাসতেন। আমার মাকেও ধরে রাখতে পারেন নি।বাবা-মা থাকার পরও আমি তাদের কারো সাথেই ফ্রি হতে পারি না। বড় আপু নিজের পার্লার আর নিজের লাইফ নিয়েই ব্যস্ত থাকে, ভাইয়া বিজনেস নিয়ে। আমি খুব একা ছিলাম। তারা কেউই আমাকে কোথাও যেতে দিতো না। তবে যেখানে যেতাম, বডিগার্ডরাই আমাকে সঙ্গ দিতো। কিন্তু ওদের সাথেও কথা বলে কোনো মজা পাই নি। ওরা তো প্রয়োজনের বেশি কোনো কথায় বলতো না। বাবা নাকি তাদের আমার সাথে বেশি কথা বলতে নিষেধ করেছে।”
সানায়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আবার বলল,
“আমি একা একা শপিং করেছি, একা একা রেস্টুরেন্টে বসে খেয়েছি। আর আমার আশেপাশে সবার কতো বন্ধু ছিল। তারা আমার সামনেই আড্ডা দিতো। আর আমি তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম।”
ইভান এবার সানায়ার হাতটি ধরলো। সানায়াও শক্ত করে ইভানের হাতটি ধরে বলল,
“আজ প্রথম আমার কোনো বন্ধু হয়েছে। যাকে আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারি।”
ইভান সানায়ার কথায় সানায়ার হাতটি আলগা করে দিয়ে বলল,
“পুরুষ মানুষকে অন্ধ বিশ্বাস করা উচিত নয়।”
সানায়া হেসে বলল,
“কিছু কিছু পুরুষ মানুষকে করা যায়।”
ইভান সানায়ার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সানায়ার চোখের গভীরতা তাকে ঘোরের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর আগেই ইভান নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। আর সানায়া লাজুক হেসে আবার প্রকৃতি দেখায় মনোযোগ দিলো।
এদিকে রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে অরুণিকা। আরাফ এখনো বিছানায় শুয়ে আছে। আজ এক সপ্তাহ ধরে সে বিশ্রাম নিচ্ছে। এখন সে অনেকটাই সুস্থ। ঝাপসা চোখে কাউকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরাফ চশমাটা চোখে লাগালো। অরুণিকাকে দেখে সে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। অরুণিকা রুমে ঢুকে আরাফের পায়ের কাছে বসে আরাফের পায়ের বৃদ্ধ আঙ্গুলটি টেনে ধরলো। আরাফ অরুণিকার হাতের স্পর্শ পেয়ে আনমনে হাসলো। মূলত এভাবেই অরুণিকা তার ভুলের জন্য ক্ষমা চায়। ছ’জনের কেউ যদি তার সাথে অভিমান করে, সে তাদের পায়ের বৃদ্ধ আঙ্গুল ধরে বসে থাকে।
আরাফ অরুণিকার দিকে তাকাতেই অরুণিকা কেঁদে উঠলো। আরাফ অরুণিকার হাত ধরে তাকে টেনে তার পাশে বসালো আর বলল,
“কাঁদছো কেন?”
“তুমি আমার সাথে কথা বলছো না কেন? রকস্টার আর মৌ ভাবী ছাড়া কেউ আমার সাথে কথা বলছে না। তুমি তো অন্তত আমার সাথে কথা বলো। কেউ কথা না বললে, আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আরাফ, তোমরা ছাড়া আমার কেউই নেই। তোমরাই যদি আমাকে দূরে সরিয়ে দাও, তাহলে আমার কি হবে?”
“তুমিই তো আমাদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছো। ইমানের জন্য আমার কথার অমান্য হচ্ছো, আহনাফের সাথে বেয়াদবি করেছো।”
“সরি। আমি আর তোমার কথার অমান্য হবো না। আমি আহনাফকে বিয়ে করবো, আরাফ। তবুও আমার সাথে কথা বলো, প্লিজ।”
অরুণিকা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আরাফ অরুণিকার এক হাত ধরে অন্য হাত দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো লাগলো। আর বলল,
“আহনাফের কাছে ক্ষমা চেয়েছো?”
“ও তো আমার সাথে কথায় বলছে না।”
“ওর কাছে যাও। ওর কথা শুনো। এখন তোমার সব দায়িত্ব ওর উপর।”
“কেন? তুমিই তো আমার অভিভাবক। আমি ওর কথা শুনবো না। শুধু তোমার কথাই শুনবো।”
“বিয়ের পর একটা মেয়ের দায়িত্ব ওর স্বামীর কাছে চলে যায়, বাবা-মার কাছে থাকে না। আর আমি তো তোমার কাজিন।”
“আমি তোমাকে কখনো কাজিন ভাবি নি, আরাফ। তুমি তো আমার বাবা-মার জায়গা নিয়েছো। তুমি, তাহমিদ আর রকস্টার, তোমরা তিনজন আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়।”
“এখন এই জায়গাটা আহনাফকে দেওয়া শুরু করো। আগেও বলেছি, আবারও বলছি, তোমার জন্মের পরই দাদা-দাদি ওসিয়ত করেছিলেন, তোমার বিয়ে আহনাফের সাথেই হবে। তোমার নামে ৫০ ভাগ সম্পত্তি, এই কারণেই লিখে দেওয়া হয়েছিল। যাতে তাদের ইচ্ছেটা পরবর্তীতে তোমার বাবা-মা আর আহনাফের বাবা-মা মেনে নেয়। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মেয়েদেরকে এতো ভাগ সম্পত্তি লিখে দেওয়া হয় না। তোমার ক্ষেত্রে হয়েছে, শুধু ওদের ইচ্ছেটার বাস্তবায়নের জন্য। আমাদের কোনো ফুফি ছিল না। দাদা-দাদি তোমার জন্মতে অনেক খুশি ছিলেন। তাই ওরা তোমাকে চৌধুরী বংশের বাইরে বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না। আজকাল কি কারো বিশ্বাস আছে? তারা ভাবতো, যদি বিয়ের পর তাদের আদরের অরুর কিছু হয়ে যায়? এখন আহনাফের সাথে বিয়ে হলে, ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকবে।”
অরুণিকা মুচকি হেসে বলল,
“দাদা-দাদি বেঁচে থাকলে, আমি ওদের পটিয়ে নিতাম।”
আরাফ হেসে বলল,
“আহনাফ দাদার ফটোকপি। এবার বুঝো, দাদার মেজাজ কেমন ছিল।”
অরুণিকা কিছু একটা ভেবে বলল,
“ওতোটাও খারাপ না। রেগে গেলেই তো ডাইনোসরের মতো হয়ে যায়। আর শান্ত থাকলে একদম কিউট বিড়ালের মতো।”
দরজার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আহনাফ এতোক্ষণ অরুণিকার কথা শুনছিল। আরাফ আহনাফকে দেখে মুচকি হাসলো৷ আহনাফ অরুণিকা পেছন ফেরার আগেই সরে গেলো। অরুণিকা আরাফের চোখ অনুসরণ করে পেছন ফিরে দেখলো, কেউ নেই। অরুণিকা চোখ ছোট করে আরাফের দিকে তাকিয়ে, দরজার কাছে এসে ইমনকে দেখে চমকে উঠলো। ইমন অরুণিকার পাশ কেটে আরাফের রুমে ঢুকলো। আরাফ ইমনকে দেখে বলল,
“শুনলাম, তোরা নাকি আমার অরুর সাথে কথা বলছিস না।”
ইমন বাঁকা চোখে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর অরুকে বল, আগে আমাদের বন্ধুর কাছে ক্ষমা চাইতে।”
অরুণিকা পা ধাপিয়ে বলে উঠল,
“ক্ষমা চেয়েছি, কিন্তু ওই ভূতটা আমার সাথে কথায় বলছে না।”
“এভাবে ভূত ডাকলে ক্ষমা করবে?”
অরুণিকা কিছু একটা ভেবে বলল,
“আচ্ছা, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। সেটাই করি।”
অরুণিকা আরাফের রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো, আর আহনাফের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। আহনাফ অরুণিকাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“আমার রুমে কেন এসেছো?”
অরুণিকা আহনাফের ঘরে ঢুকে আহনাফের বিছানায় ধপ করে উঠে বসলো। আহনাফ বলল,
“যাও এখান থেকে।”
অরুণিকা গালে হাত দিয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম, আমি রান্না করছি, হঠাৎ তেলের কড়াই আমার পায়ে এসে পড়লো। ব্যস ওমনিতেই আমি….”
আহনাফ অরুণিকার হাত চেপে ধরে বলল,
“মিথ্য স্বপ্ন বলা বন্ধ করো। স্বপ্ন নিয়ে মিথ্যে বলা উচিত না।”
“তোমার সমস্যা কি! বললে বললাম।”
“এখন তুমি এটা ভাবছো, আমি তোমার মিথ্যে স্বপ্নের কথা শুনে, আবার আগের মতো তোমার পেছনে সময় নষ্ট করবো। এটা তোমার ভুল ধারণা। তোমার রান্নাঘরে গিয়ে হাত পুড়িয়ে আসতে ইচ্ছে করলে যাও, আমি তোমার সাথে কোথাও যাবো না। একা কাজ করতে না পারলে, বাসায় আরো অনেকে আছে, তাদের সাহায্য নাও। আমাকে বিরক্ত করা বন্ধ করো।”
“তুমি ছাড়া কে আছে আমার বলো!”
আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তুমি বিরক্ত হও না, এই একটা লাইন সবাইকে কপি পেস্ট করে শুনাতে?”
“সবাইকে কোথায় শোনায়? শুধু তোমাদের ছ’জনকেই তো শোনায়। তুমি ছাড়া আমার কে আছে? তুমি ইজ ইকুয়েল টু আরাফ, ইমন, তাহমিদ, ইভান, রকস্টার। তো একই কথায় তো হলো!”
আহনাফ মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো। অরুণিকা বলল,
“আমার বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু দেখো, আমি সব স্বপ্ন বাদ দিয়ে তোমাকে বিয়ে করার জন্য রাজি হয়েছি। আমি এতো বড় ত্যাগ দিচ্ছি। তুমি কি আমাকে ক্ষমা করে তোমার জিরাফের মতো উঁচু মাপের ইগোকে ভুলতে পারবে না?”
আহনাফ অরুণিকার কথা শুনে বলল,
“ইগো আর আত্মসম্মান দু’টি আলাদা বিষয়, অরু। তুমি আমার আত্মসম্মানে আঘাত করেছো। তোমার সাথে আমার কোনো ইগোর সম্পর্ক নেই। তুমিই তো আমার অহংকার। তুমি ছাড়া আমার কিসের অহংকার? কিন্তু এর উপরেও আছি, আমি নিজেই। আর আমি মানেই আমার আত্মসম্মান। তুমি আমার ক্যারেক্টর নিয়ে কথা বলেছো, অরু। তাই আমি এতো সহজে এসব ভুলে তোমার সাথে স্বাভাবিক হতে পারবো না। আমার একটু সময় লাগবে। আমাকে আপতত স্পেইস দাও।”
আহনাফ কথাগুলো বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“সব কথায় মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ইগো আর আত্মসম্মান সহজ দুইটা শব্দটাকে এভাবে পেঁচিয়ে দিয়ে চলে গেল?”
চলবে—-