অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৬৯||

0
1014

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৬৯||

১১৩.
অফিস থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠতে যাবে, তখনই কেউ একজন ইভানের হাত আঁকড়ে ধরলো। ইভান পিছু ফিরে দেখলো সানায়া দাঁড়িয়ে আছে। সানায়াকে দেখে সে প্রচন্ড অবাক হলো। আজ অনেকদিন পর সে সানায়াকে দেখছে। এই কয়েকদিনের মধ্যেই সানায়ার মুখে মলিনতার ছাপ ভেসে উঠেছে। পরিপাটি করে রাখা চুলগুলো আজ বড্ড অগোছালো। পরণের জামাটিতেও ভাঁজ পড়ে গেছে। হয়তো আলমারির কোণা থেকে তুলে এনেই গায়ে পরে নিয়েছে। আজ তার ঠোঁট জোড়ায় ব্র‍্যান্ডেড লিপস্টিকের ছোঁয়া নেই, বরং প্রচন্ড তাপদাহে যেমন মাট-ঘাট শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়, ঠিক তেমনি সানায়ার ঠোঁট জোড়ায় শুষ্কতা বিরাজ করছে। চোখ দু’টি দেখে মনে হবে বেশ কয়েকদিন ঘুম হয় নি।

সানায়ার এমন বিধ্বস্ত চেহারা দেখে ইভানের মনটা হাঁসফাঁস করতে লাগলো। সানায়া আলতো হাতে ইভানের হাতটি নিজের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে ধীরে ধীরেই বলতে লাগলো,
“অনেক ভেবেছি, ইভান। আমি আমার দিক থেকে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারি নি। আমি তোমাকে ভুলতে পারি নি, ইভান।”

ইভান কিছু বলতে যাবে তখনই সানায়া তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“প্লিজ, আমাকে বলতে দাও।”

ইভান সানায়ার কাছ থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। তারপর হাত দু’টো বুকে গুঁজে গাড়িতে হেলান দিয়ে সানায়ার দিকে তাকালো। সানায়া ইভানের হাবভাব দেখে বুঝলো, ইভান তার কথাগুলো বাধ্য হয়েই শোনার জন্য দাঁড়িয়েছে, নয়তো ব্যক্তিগত ভাবে ইভানের তার কথা শোনার মতো কোনো আগ্রহ নেই। সানায়া ইভানের ভাব দেখেই ভেতর থেকে আরো ভেঙে পড়লো। তার চোখ জোড়া অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। সে মাথা নিচু করে চোখ মুছে নিলো। তারপর আবার বলল,
“আমি জানতাম না যে আমার রক্তের দোষ, এতোই বেশি হবে, যার জন্য আমি কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারবো না বা কারো ভালোবাসা পাওয়ার জন্য নিজেকে যোগ্য ভাবতে পারবো না। আমার বাবা অনেক অন্যায় করেছে, আমার ভাইও অন্যায় করেছে। আমি শুধু এতোটুকু জানি, আমি কোনো অন্যায় করি নি। আমি শুধু বন্ধু চেয়েছি, ভালোবাসা চেয়েছি। কেউ আমার বন্ধু হতে চাইতো না। তাই আমি জোর করেই বন্ধু হতে চাইতাম। একাকিত্ব কি কারো ভালো লাগে, বলো? তার চেয়ে তো মরে যাওয়ায় ভালো। ভাইয়ার সাথে রাহির সম্পর্ক শুরু হওয়ার পর থেকে রাহিও আমাকে তেমন একটা সময় দিতে পারতো না। তোমার সাথে থাকলে আমি আলাদা কিছু অনুভব করতে পারতাম। আমি জানি না, আমি হয়তো আমার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছি না। কিন্তু তুমি পাশে থাকলে সত্যিই আমার অনেক শান্তি লাগে। তুমি কি সব ভুলে আমাকে ভালোবাসতে পারবে না? মিথ্যেমিথ্যি ভালোবাসতে পারবে?”

সানায়ার ধরা গলার আবদারগুলো ইভানকে অস্থির করে তুলছে। সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। সানায়া অধির আগ্রহে ইভানের উত্তরের অপেক্ষায় তার দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে। ইভান অনেকক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি খুব ঝামেলার মধ্যে আছি। পুরোনো ঝামেলার মধ্যে আমি নতুন ঝামেলা চাচ্ছি না, প্লিজ।”

সানায়া ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমি ঝামেলা?”

ইভান দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“হ্যাঁ, এই মুহূর্তে আমার তোমাকে ঝামেলায় মনে হচ্ছে।”

সানায়া হঠাৎ ইভানের শার্ট খামচে ধরে বলল,
“তাহলে কেন আমাকে মিথ্যে আশা দিয়েছো? কেন আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছো?”

“লিসেন, সানায়া। আমি তোমাকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে গিয়েছি। তার মানে এই নয় যে আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

“আচ্ছা? তাহলে আমার এতোটা কাছে কেন এসেছিলে? তোমার স্পর্শ আমাকে অনুভব করতে বাধ্য করেছিল যে তুমি আমাকে নিয়ে ভিন্ন কিছু ভাবো। বন্ধুত্বই যেহেতু ছিলো, তাহলে কেন প্রেমিক পুরুষের মতো আমাকে নিজের কাছে টেনে নিতে?”

ইভান চুপ করে রইলো। হুট করেই তার অতীতের কথা মনে পড়ে গেলো, যখন মাওশিয়াতকে কষ্ট দেওয়ার জন্য ইমন সায়ন্তনীর সাথে ভালোবাসার অভিনয় করেছিল। সায়ন্তনীও সেদিন ইমনকে এমন প্রশ্নই করেছিল। আর শেষমেশ সায়ন্তনীর মৃত্যু হলো। এখনো সে সায়ন্তনীকে ভুলতে পারে নি। একবুক অভিমান নিয়েই মেয়েটা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিল। আর আজ সানায়াও সেই একই স্থানে দাঁড়িয়ে আছে। ইভান চায় না, সানায়ার সাথে খারাপ কিছু হোক। সায়ন্তনী যদিও খুব শক্ত মনের মেয়ে ছিল, কিন্তু সানায়া মারাত্মক দুর্বল। সে যদি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে? ইভান অনুশোচনা নিয়ে সানায়াকে বলল,
“সরি, সানায়া। আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি। কিন্তু যা করেছি প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই করেছি। সাহিল মির্জা তোমার বান্ধবী রাহির জন্য আরাফকে ভয়ংকর ভাবে মেরেছিল। সেদিন আরাফের সাথে খারাপ কিছুও হতে পারতো। ডাক্তার ওকে ভালোভাবে চেকাপ করে বলেছিল, অল্পের জন্য ওর বড় কোনো ক্ষতি হয় নি। ওর শরীরের অভ্যন্তরে অনেক সমস্যা দেখা গিয়েছিল। আরাফের সাথে যা হয়েছিল তা আমি সাহিল মির্জাকে কিভাবে ফিরিয়ে দেবো, বলো? তুমি ছাড়া আমার কাছে কোনো উপায় ছিল না। তুমিও আমার সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলে, আর আমি সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ছিলাম।”

সানায়া মলিন হেসে বলল,
“আর তুমি ভেবেছো, আমার মন ভাঙলে সাহিল মির্জা দুর্বল হয়ে পড়বে?”

ইভান চুপ করে রইলো। সানায়া আবার বলল,
“ভাইয়ার সাথে আমি অনেকদিন কথা বলি নি। হ্যাঁ, ভাইয়া কষ্ট পেয়েছিল ঠিকই। কিন্তু ভেঙে যায় নি। এখনো প্রতিদিন অফিসে যায়, খাওয়া-দাওয়া করে, বউকে নিয়ে ঘুরতে যায়। ভাইয়া তো দিব্যি ভালো আছে। শুধু আমিই ভালো নেই।”

সানায়া কিছু একটা ভেবে বলল,
“হ্যাঁ, তোমার পরিকল্পনা সাকসেস করার একটা উপায় আছে। যদি আমি একটা সুইসাইড নোট লিখে ভাইয়াকে দায়ী করে এই পৃথিবী থেকে মুক্তি নেই, তাহলে ভাইয়ার অনেক কষ্ট হবে। ও তখন জ্বলেপুড়ে মরবে। আমি আজ বাসায় গিয়ে এই কাজটাই করবো। এমনভাবে নোট লিখবো, যাতে সাহিল মির্জা যতোদিন বেঁচে থাকবে ততোদিন অনুতাপের আগুনে জ্বলতে থাকবে। এরপর দেখা যাবে, সেও আমার চিন্তায় হার্ট এট্যাক করে ফেললো। তখন তোমার প্রতিশোধও পূর্ণ হয়ে যাবে।”

ইভান সানায়ার হাত ধরে বলল,
“তুমি এমন কিছুই করবে না, সানায়া। তুমি যদি এমন কিছু করো তাহলে তোমার ভাই অনুতাপে মরুক, না মরুক, আমি নিজেকে ক্ষমা কর‍তে পারবো না। আমি যেহেতু অন্যায় করেছি, তাই ক্ষমা চাচ্ছি। আর তুমি এখন বাসায় যাও। রেস্ট করো। আমার একটু তাড়া আছে। আমি সত্যিই অনেক বড় সমস্যার মধ্যে আছি। সমস্যার সমাধান হলে আমি তোমার সাথে দেখা করবো।”

ইভানের শেষ কথাটি শুনেই সানায়ার মনের মধ্যে আশার সঞ্চার ঘটলো। ইভান এরপর গাড়িতে উঠে বসলো। সিটে হেলান দিয়ে ইভান চোখ বন্ধ করলো, আর মনে মনে ভাবলো, সানায়াকে এমন কথা না বললে সে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবতো। অন্তত এখন আশা নিয়েই থাকুক। আশায় তো মানুষকে বেঁচে থাকার প্রেরণা দেয়।

রাতে নিজের ঘরে ঢুকেই রাহি অনেক অবাক হলো। পুরো রুম মোমবাতি দিয়ে সাজানো। সে কিছুটা অবাক হয়ে বলল,
“কি করছো, সাহিল?”

রাহির কন্ঠ শুনে সাহিল মুচকি হেসে রাহির দিকে এগিয়ে এলো। তারপর রাহির হাত ধরে তাকে কাছে টেনে এনে বলল,
“সেলেব্রেশন করছি। এখন থেকে তো আমার উপর নতুন দায়িত্ব পড়েছে।”

রাহি হালকা হাসলো। রাহির হাসি দেখে সাহিল বলল,
“মনে হচ্ছে গুড নিউজটা তোমার জন্য ব্যাড নিউজ ছিল।”

রাহি অবাক হয়ে বলল,
“এসব কি বলছো, সাহিল?”

“ঠিকই তো বলছি। তুমি তো আমার বাচ্চার মা হতে চাও নি। আমিই তোমাকে বাধ্য করেছি। তাই নিউজটা তোমার জন্য খারাপ।”

“সাহিল, বাচ্চাটা আমারও।”

“হুম, কিন্তু তার বাবা তো আমিই হবো। মিস্টার আরাফ চৌধুরী তো আর হবে না।”

রাহি সাহিলকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আরাফকে এর মধ্যে কেন আনছো? আমি কতোবার তোমাকে বুঝিয়েছি, আরাফকে আমার মানুষ হিসেবে ভালো লাগতো।”

সাহিল রাহিকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিয়ে বলল,
“রাহি, আরাফকে তুমি যেমন মানুষ ভাবার ভাবো। আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু একটা সময় তো আমি মানুষটাই তোমার প্রিয় ছিলাম। আর এখন আরাফ তোমার প্রিয় হয়ে গেছে। আর আমাকে দেখো, কতো দেশে ঘুরেছি, কতো মেয়ে দেখেছি, কিন্তু তোমার নেশা ছাড়তে পারি নি। সাহিল মির্জা যতোই খারাপ হোক, বেইমানি করে না। যার হাত একবার ধরে তার হাত কখনোই ছাড়ে না।”

রাহি সাহিলের হাত ধরে বলল,
“যেই মানুষ একটার পর একটা অন্যায় করে, তাকে কি বিশ্বাস করা যায়?”

সাহিল মির্জা হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি চলে এলো। সে হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল,
“যখন আমি থাকবো না, তখন আমার গুরুত্বটা বুঝবে। আসলে কি জানো বউ, মানুষ পেয়ে গেলে অবহেলা করে। না পেলে আক্ষেপ করে। আর পেয়ে হারিয়ে ফেললে আফসোস করে। বউ, আমি তোমাকে আফসোস করতে দেবো না।”

এদিকে ইশমাম মুন্সী বিধ্বস্ত মুখ নিয়ে বসে আছে। ইমন এসে ইশমাম মুন্সীর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“ইশমাম ভাই, কি হয়েছে আপনার? অফিসে আসার পর থেকেই মুখ ভার করে রেখেছেন!”

ইশমাম কাঁপা কন্ঠে বললো,
“শাহেদ মির্জা বাবার নামে মামলা দিয়ে এসেছে।”

“কেন?”

“আমার বাবা নাকি ওদের মেয়েকে অপহরণ করার চেষ্টা করেছে।”

“কোন মেয়ে? সানায়া?”

“না, সাবা। আমি যাকে ভালোবাসি। আর সাবাও তো আমাকে ভালোবাসে। শুধু শুধু ওর বাবাই আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিচ্ছে না। আমি না আর এতো মানসিক চাপ নিতে পারছি না।”

ইমন ইশমাম মুন্সীকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এক একটা কথা বলছে। কিন্তু ইশমাম একটা বাক্যেও সান্ত্বনা পাচ্ছে না। তখনই তাদের কেবিনে আহনাফ ঢুকলো। আহনাফকে দেখেই ইশমাম বলল,
“কি খবর, কোনো খবর পেয়েছো?”

আহনাফ বলল,
“না, তার কোনো খবর পাচ্ছি না।”

“লোকটা হুট করে কোথায় হারিয়ে গেলো?”

“সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”

“আরবান তালুকদারের বিরুদ্ধে থাকা প্রমাণগুলো পেয়েছো তো?”

“হ্যাঁ, সংগ্রহ করেছি।”

ইশমাম আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। আহনাফ ইশমামের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,
“আর ইউ ওকে, ভাইয়া?”

ইশমাম মলিন মুখে বললো,
“আমি ভালো নেই, আহনাফ।”

“কি হয়েছে?”

ইমন আহনাফকে সবটা বললো। আহনাফ সব শুনে বলল,
“মির্জা সাহেবের সমস্যাটা কি?”

ইশমাম হতাশ কন্ঠে বললো,
“জানি না, ভাই। যখন থেকে আমরা তোমাদের কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়েছি, তখন থেকেই আরো ঝামেলা করছে। থাক এসব বাদ দাও। তোমাদের জীবনেই সমস্যার শেষ নেই, আমার কথা আর কি শুনবে?”

আহনাফ বলল,
“আপনি আর মুন্সী সাহেব আমাদের কোম্পানিটাকে ইটা থেকে মৈত্রীতে রূপান্তর করতে অনেক সাহায্য করেছেন। আর এখন কি আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারবো না? আমরা মুন্সী সাহেবের বিরুদ্ধে যতো মামলা হয়েছে, সব উঠিয়ে নেবো। আমাদের পরিচিত একজন উকিল আছেন, উনাকে বলবো।”

“ধন্যবাদ।”

ইশমামের মুখটা আবার অন্ধকার হয়ে গেলো। ইমন আহনাফকে ইশারায় বোঝালো, তাকে শান্ত করা কঠিন কাজ। তবুও আহনাফ ইশমামের পাশে এসে বলল,
“ভাইয়া, সাবা আপু তো চাইলে আপনার কাছে সহজেই চলে আসতে পারে।”

“পারতো। কিন্তু ও আমার জন্যই আসছে না। ওর বাবা কোন সিকান্দার বসের সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছে। এই সিকান্দার সম্পর্কে আমি সব তথ্য বের করেছি। মারাত্মক ভয়ংকর লোক। তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে সন্ত্রাসী। শুনেছি, অনেক বড় বড় খুন করে সে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করে।”

আহনাফ আর ইমন একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো। তখনই ইশমাম আবার বলল,
“এই সিকান্দারকে আজ পর্যন্ত কেউ দেখে নি। শুধু শাহেদ মির্জাই দেখেছিল। সে নাকি বাংলাদেশে কয়েক সপ্তাহ আগেই এসেছে, এতোদিন কলকাতায় ছিল। প্রায় পনেরো বছর আগে সে কলকাতায় চলে যায়। বাংলাদেশে নাকি কার সাথে বড় একটা ঝামেলা হয়েছিল, তাই দেশ ছেড়েছিল। আর যা-ই বলো, আমার না মন মানছে না। এমন মানুষের সাথে সাবার বিয়ে হবে? এইটা একদম সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। না জানি পনেরো বছর আগে ঝামেলার নামে কাউকে খুন করে কলকাতায় পাড়ি দিয়েছিল কিনা। লোকটা সাবার যদি কোনো ক্ষতি করে ফেলে? আমরা তো এতো ক্ষমতাধর নই। মির্জাদের সাথে আমরা পেরে উঠবো না।”

আহনাফ ইশমামের কথা শুনতে শুনতেই অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। সে কেবিন থেকে বের হতেই ইমনও বের হয়ে এলো। ইমন বলল,
“তুই আবার কি ভাবছিস?”

“পনেরো বছর আগে, আমাদের পরিবারের হত্যাকাণ্ড, আমাদের কলকাতায় নিয়ে যাওয়া, এসবের সাথে ওই সিকান্দারের কোনো সংযোগ নেই তো? একটা কাজ কর, আজই সিকান্দারের সব তথ্য বের করে ফেল। লোকটা যেহেতু বাংলাদেশেই আছে, তাহলে আমাদের সাথেও দেখা হয়ে যাবে।”

এদিকে মুরশিদ জুবাইয়েরের সাহায্যে ইভান আর তূর্য গিয়ে সুলতান মুন্সীর মামলাটা উঠিয়ে নিয়ে আসে। থানা থেকে সোজা সুলতান মুন্সীকে তার বাড়িতে নামিয়ে দিতে গিয়েই ইভান আর তূর্য অবাক হলো। মুন্সীদের পুরো বাড়ি কালো পোশাকধারী লোক দ্বারা ঘেরাও করা। সুলতান মুন্সী চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
“এরা কারা? বাসায় তো আমার স্ত্রী-সন্তানরা আছে।”

সন্ধ্যা কিছুটা ঘনিয়ে এসেছে। তূর্য আর ইভান সুলতান মুন্সীকে আশ্বস্ত করে গাড়ি থেকে নেমে পেছনের গেইট দিয়ে ঘরে ঢুকলো। ভেতরে সুলতান মুন্সীর পুরো পরিবার কান্নাকাটি করছে। তূর্য আর ইভান তাদের পেছনের গেইট দিয়ে বের করার আগ মুহূর্তেই হঠাৎ গোলাগুলির শব্দ হতে লাগলো। তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে এসে সবাইকে কোনোভাবে গাড়িতে বসিয়ে এলাকা থেকে বের হয়ে গেলো।

টুইংকেল হাউজে আতংক ভীড় করছে। শাহবাজ খান, মুরশিদ জুবাইয়ের আর রিয়াজুর রহমানও এসেছেন। সুলতান মুন্সীর পুরো পরিবার টুইংকেল হাউজে আশ্রিত। পনেরো বছর আগের রাতটা যেন এবার মুন্সী গ্রুপের উপরই নেমে এলো। ভাগ্য ভালো, ঠিক সেই মুহূর্তেই ইভান আর তূর্য তাদের উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিল। নয়তো আরো একটা কাল রাত সৃষ্টি হতে পারতো। এই মুহূর্তে কারো মাথায় কিছুই ঢুকছে না। তবে ঘুরেফিরে সবার একটা বিষয়ই মাথায় এলো, আর তা হলো, হয়তো মৈত্রীদের সাথে কাজ করছে, তাই মুন্সী গ্রুপকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনাটা করা হয়েছে। রিয়াজুর রহমান বললেন,
“এই বাড়িটাও কারো জন্য নিরাপদ মনে হচ্ছে না। সুলতান সাহেবের পুরো পরিবার আজ না হয় আমার নতুন বাড়িতেই উঠুক।”

এবার শাহবাজ খান বললেন,
“আমি বাইরে পুলিশ প্রটেকশনের ব্যবস্থা করছি।”

সুলতান মুন্সী বললেন,
“আমরাও তাহলে এই বাড়িতেই থাকি।”

সুলতান মুন্সী যে কোনোভাবেই রিয়াজুর রহমানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না তা আহনাফ ভালোভাবেই বুঝেছে। সে মুন্সী সাহেবকে আশ্বস্ত করে পাঠিয়ে দিল। পুরো রাত কেউ আর ঘুমাতে পারে নি। এদিকে আহনাফ পুরো রাত সিকান্দারের তথ্যগুলো নিয়েই বসেছিল। এই নামটা তার অনেক বড় রহস্যের জট খুলে দিয়েছে।

আহনাফ লাইব্রেরিতে সবাইকে ডেকে আনলো, আর সিকান্দার ও আরবান তালুকদারের তথ্যগুলো পাশাপাশি রাখলো। বাকি পাঁচজন তথ্যগুলো দেখতে লাগলো। সব তথ্য পড়ার পর সবাই আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ হালকা হেসে বলল,
“অপরাধী ধরা খাওয়ার ভয়ে ভুল করে ফেলে। আর সেই ভুল করে ফেলেছে আসল খুনী।”

“তাহলে, আমরা যেটা ভাবছি, তুইও সেটাই ভাবছিস?”

“হ্যাঁ, শুধু একটা ছোট্ট হিন্টস পেলেই আমি নিশ্চিত হবো আসল খুনী কে। রহমতুল্লাহ শুধু আরবান তালুকদারের নাম স্বীকার করেছে। কারণ সে জানে আমরা আরবান তালুকদারের সব সত্য জেনে ফেলেছি। কিন্তু সে কিভাবে জানল এটা? আমরা ছাড়া তার সাথে আর কেইবা দেখা করতে গিয়েছিল?”

সবার হাত মুঠো হয়ে এলো। এতো বছর পর তারা আসল খুনীর সন্ধান পেয়েছে। কিন্তু, শুধু বাকি আছে একটা সূত্রের। আর এই সূত্র হয়তো তারা কালই বের করতে পারবে।

এদিকে আরবান তালুকদার কাউকে ফোন করে বললেন,
“আজ যা হয়েছে, তারপর আমাদের হাতে কালকের দিনটাই বাকি। রুকন ধরা না পড়লে আমরা আরো সুন্দর ভাবে আমাদের কাজটা করতে পারতাম। আমি চেয়েছি আমাদের ছেলের সাথে অরুণিকার বিয়ে দিয়ে পুরো মৈত্রী সম্পত্তির ভাগ নিতে। কিন্তু তা আর সম্ভব হয় নি। এবার শেষ কাজটাই বাকি। বিনিময়ে কিছু না পেলেও শান্তিতে মরতে পারবো। আগামীকাল মুরাদপুরে ঠিক বিকেল তিনটাই বোমটা বার্স্ট হবে। আর এই ছ’জন তাদের মৃত্যুর পেছনে দৌঁড়াবে। কালই কয়েক’শ মানুষের সাথে অরুণিকার দি এন্ড। সাথে আমাদের বিশেষ অতিথিরও কাল শেষ দিন।”

ওপাশ থেকে কেউ একজন বলল,
“এক ঢিলে দুই পাখি, ফেঁসে যাবে ছ’পাখি।”

কথাটি বলেই ওপাশের লোকটি হাসতে লাগলো, সাথে হাসছে আরবান তালুকদারও।

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here