অলকানন্দা #পর্ব-১২,১৩

0
397

#অলকানন্দা
#পর্ব-১২,১৩
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
১২

(আজকের পর্বটা নিজ দায়িত্বে পড়ে নিবেন। কেউ যদি মর্গ, মর্গের বর্ণনা এসবে ভয় পান, তাহলে আমার পরামর্শ থাকবে পর্বটি স্কিপ করার।)

৩৪.
মর্গ। হিমশীতল কনকনে ঠান্ডা যুক্ত গাঁ ছমছমে এক জায়গা। দু’তালার এককোনায় ঘরটা। দুপাশে রুগীদের ওয়ার্ড পেরিয়ে মাঝ বরাবর সরু এক রাস্তা। তারপর হাতের ঠিক ডানদিকে এই লাশঘর।

শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আছে মাহার। ভয় সে পাচ্ছেনা। তবে থেমে থেমে গাঁ কাঁপুনি দিয়ে উঠছে তার। ওড়না দিয়ে কপালের ঘামের বিন্দুগুলো আবার মুছে নিলো সে। সামনে ইউনিফর্ম পরনে রেজওয়ান এবং ডাক্তার ওয়াসিফ। এই তো কতক্ষণ আগে মাহা পৌঁছেছে হাসাপাতালে। আর তখনই…..

________________

রিকশা থেকে নেমে ঝটপট ভাড়া মিটিয়ে যেই হাসপাতালের গেট দিয়ে ডুকবে অমনি রেজওয়ান এগিয়ে এলো মাহার পানে। প্রচুর ভিড়। সাংবাদিক এবং তাদের ক্যামেরা ম্যানদের ঠাঁই হচ্ছেনা স্থানটায়। এএসপি রেজওয়ানের পিছুপিছু তারাও চলে এলো সেখানে।
“মাহা, চলো।”

বলেই মাহার হাত আঁকড়ে ধরলো রেজওয়ান। দুজন কনস্টেবলও রয়েছেন। তারা যথাসম্ভব চেষ্টা করছেন আমজনতা আর সাংবাদিকদের ভিড়টাকে ঠেলে দিতে। কোনো ক্রমেই পেড়ে উঠছেন না। এত পুরুষের মাঝে নিজেকে অসহায় লাগছে মাহার। এর মাঝে আবার হাত আঁকড়ে ধরেছে রেজওয়ান। কেমন যেন লাগছে মাহার। সবাই উপচে পড়ছে তাদের উপরে। রেজওয়ান এক ধমক দিলো। কাজ হয়নি। এতো এতো ফ্ল্যাশ, ক্যামেরা। সব তাক করা হচ্ছে মাহার উপরে। ভিড় ঠেলে যেই না একটু সামনে এগুলো মাহা আর রেজওয়ান অমনি একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন,
“আপনি কি পা শনাক্ত করতে এসেছেন? আপনার সাথে ভিক্টিমের কি সম্পর্ক?”
নীল শার্ট পরা একজন ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন,
“সিলেটের এই ঘটনার সাথে ২০১২ সালের ঘটনার সম্পৃক্ততা রয়েছে। আপনার কি ধারণা?”
“আপনি কি ভিক্টিমের পূর্ব পরিচিত?”
“ভিক্টিম কি ছেলে না মেয়ে?”
“আপনার কি এই খুনের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা রয়েছে?”
“এএসপি রেজওয়ান কি আপনার পূর্ব পরিচিত?”

এমন সব প্রশ্নে হতভম্ব হয়ে যাচ্ছিলো মাহা। মাথা থেকে কালো ওড়নার ঘোমটা খুলে গেলো তার। ঝরঝর করে সারা পিঠময় ছড়িয়ে পড়লো কোঁকড়া চুলগুলো। হলদে ফর্সা মায়াবী মুখের কাছে বিষণ্ণতাও যেন হার মানছে। হঠাৎ রেজওয়ানের হাত থেকে মাহার হাত ছুটে গেলো। ব্যাপারটা এতো বেড়েছে যে পুলিশও ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা। সাংবাদিকদের পাশাপাশি আছে উৎসুক জনতার ভিড়। গেটের বাইরেই এমন ভিড়। ভিতরে পুলিশ কাউকে আপাতত ঢুকতে দিচ্ছেনা।

৩৫.
হতবিহ্বল হয়ে পড়লো মাহা। ভিড়ের মাঝে মনে হলো কোনো পুরুষ নিজের নিম্ন অংশ দিয়ে ইচ্ছে করে মাহার পিছনে স্পর্শ করছে। গা ঘিনঘিন করে উঠলো মাহার। হঠাৎ একটা হাত যেই না মাহার শরীরের সামনের অংশ স্পর্শ করবে অমনি চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে উঠলো মাহা। রেজওয়ানের ডাকও সে শুনতে পাচ্ছে। মাহা মাহা করে নাম ধরে ডাকছে। শত অপবিত্র হাতের মাঝে একটা পবিত্র হাত আঁকড়ে ধরলো মাহার ডানহাত। মাহা তখনও চোখ বন্ধ করে রেখেছে। কেবল মনে হলো সে সামনে এগুচ্ছে। একটা পবিত্র শরীরের বেস্টনি তাকে সামনে নিয়ে যাচ্ছে। এই ঘ্রাণটা তো মাহার বড্ড পরিচিত। আপন আপন একটা ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণের লোকটাকে তো মাহা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারে। খুব ইচ্ছে ছিলো চোখ মেলে দেখবে। যখন তাকালো তখন সে হাসপাতাল গেটের ভিতরে। সামনে রেজওয়ান মলিন মুখে দাঁড়িয়ে।
“আমাকে ক্ষমা করো মাহা। হঠাৎ হাতের বাঁধন টা আলগা হয়ে গেলো!”

মুখ খুলে স্পষ্ট ভাবে কিছু বলতে পারছেনা মাহা। কাঁপা কাঁপা সুরে প্রশ্ন করলো,
“আমাকে….আমাকে এখানে কে দিয়ে গেলো ভাইয়া?”
“এখানের একজন ডাক্তার। ফায়রাজ সার্থক।”

সার্থক নামটা শুনে বুকের ধুকপুক ধুকপুক করা যন্ত্রটা যেন থেমে যাচ্ছিলো আপনমনে। শরীরে অদ্ভুত অনুভূতি। মাহা কেন জানেনা। পিছন ফিরে তাকালো একবার। মানুষটার পিছনের অংশ দেখতে পেলো সে। পায়ে সু, কালো প্যান্ট আর ডাক্তারদের সাদা এফরন গায়ে। গটগট করে হেঁটে চলে যাচ্ছে নিষ্ঠুর টা!

__________________

“মাহা?”

ধ্যান ভেঙে বাস্তবে ফিরলো মাহা। চলে এসেছে তারা। উপরে সাদা বোর্ডে লাল রঙের হরফে স্পষ্ট লেখা,”মর্গ”। লেখাটার দিকে তাকিয়ে গায়ে কেমন যেন একটা কাঁপুনি দিয়ে উঠলো মাহার। রেজওয়ান আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কি ভয় পাচ্ছো? মাহা?”
“না…..না, ভাইয়া।”

কাঁপা সুরে উত্তর দিলো মাহা। দরজাটা খুলে দিতেই ভিতরে প্রবেশ করলো তারা। একটা ভ্যাপসা গন্ধ এসে নাকে লাগলো মাহার। ঘরটা অন্ধকার। হিম শীতল। সারি সারি লাশ রাখা। সবগুলোর উপরে সাদা কাপড়। ঘরটা মোটামুটি বড়। একপাশের দেয়াল ঘেঁষে তৈরি লাশ রাখার ফ্রিজ। মাহা চোখ, মুখ বন্ধ করে হেঁটে যাচ্ছে ওদের পিছুপিছু। অবশেষে কাঙ্খিত স্থানে এসে পৌঁছালো তারা। কেমন যেন গা ছমছমে ভাব। মাহার অদ্ভুত কারণে ভয় লাগছেনা। কেন এমন হচ্ছে মাহা জানেনা। মন প্রাণ দিয়ে চাইছে শরীরের অংশটুকু যেন চৈতির না হয়। হলুদ টিমটিমে একটা বাতি জ্বলছে স্থানটার উপরে। বেডের মতন শক্ত পাটাতনের উপরে সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। রেজওয়ান, মাহা দাঁড়িয়েছে বামপাশে। ডাক্তার ওয়াসিফ ডানপাশে। পঞ্চাশোর্ধ বয়সের প্রবীণ, অভিজ্ঞ ডাক্তার তিনি। আসার সময় কি কি যেন বলছিলেন রেজওয়ানকে। মাহা শুনেনি। চশমাটা ঠিক করে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন ডাক্তার ওয়াসিফ। আস্তে আস্তে বললেন,
“এমন ঘটনা কি করে আবার পুনরাবৃত্তি হলো তাই নিয়েই টেনশনে আছি মিঃরেজওয়ান। এমন কত শরীরের অংশ দেখেছি তবে সম্পূর্ণ শরীর আজোও মিসিং!”
“আমারও একই চিন্তা ডাক্তার ওয়াসিফ।”

কথা বলার মাঝেই সাদা কাপড়টা উপরে উঠিয়ে দিলেন ডাক্তার ওয়াসিফ। মাহা এতক্ষণ নিরব দর্শক ছিল। ছিন্ন পায়ের দিকে তাকিয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো মাহার। পাগলের মতো খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো সে। উড়ু থেকে ছিন্ন একখানা পা। উরুর দিকটায় লাল রক্ত জমাট বেঁধে আছে।

৩৬.
বুড়ো আঙুলের পাশটায় কাটা দাগ। এটা তো চৈতির পায়ের মতো! কনিষ্ঠা আঙুলের পাশটায় একটা লাল তিল।
“চৈতিরে…

বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো মাহা। বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছে তার। এটা তো চৈতির পা! বিশ্বাস হচ্ছেনা মাহার। ডাক্তার ওয়াসিফ তাকালেন রেজওয়ানের দিকে। রেজওয়ান আঁকড়ে ধরলো মাহাকে। আস্তে আস্তে বললো,
“কাম ডাউন মাহা। এখনো ডিএনএ টেস্ট বাকি। এটা তো কেবল প্রাথমিক শনাক্তকরণ। কেঁদো না প্লিজ।”
“ভাইয়া এটা চৈতিই। আমার চৈতির পা এটা ভাইয়া।চৈতিরে। চৈতি!”

মাহার অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। স্থান, কাল ভুলে গেছে মাহা।
“মিঃরেজওয়ান, আপনি ওকে নিয়ে বাইরে যান। আকস্মিক শকটা ও হয়তো নিতে পারছেনা।”

জ্ঞান হারালো মাহা।

_________________

একটা সবুজ পাহাড়। চারপাশে সবুজে আবৃত। বিভিন্ন রকম ডাক ভেসে আসছে চারপাশ থেকে। মাহা দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের এক কোনায়। তার পরনে একটা লাল টকটকে শাড়ি। শিফন শাড়িটার আঁচল উড়ছে হিমেল বাতাসে। স্নিগ্ধ বাতাসে মনে দোলা দিচ্ছে অদ্ভুত ভালোলাগা। হঠাৎ…..

আবার একটা চিৎকার। যেমনটা ছিলো আগের মাঠে। মাহার নাম ধরে ডাকছে কেউ। মাহা হতবিহ্বল হয়ে পড়লো। এপাশ ওপাশ খুঁজতে লাগলো সে শব্দের উৎস। কি করুণ ডাকটা। বাঁচতে চাওয়ার আকুতি, মিনতি সে কন্ঠে। মাহা অবশেষে খুঁজে পেয়েছে সে কন্ঠ। নীলকন্ঠ। বিষাক্ত কন্ঠ। পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে একটা বড় খাদ। চৈতি একটা গাছের ডাল ধরে ঝুলে আছে। পাহাড়ের গায়ে লাগোয়া শুকনো ডালটা। মাহাকে দেখে করুণ কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমাকে বাঁচাবি না মাহা?”

মাহা জবাব দিতে পারলোনা। কি মায়াবী চোখ মেয়েটার। মাহা হাত বাড়ালো চৈতির দিকে। চৈতি একটা হাত এগিয়ে দিলো মাহার দিকে। একটু। আর একটু হলেই তো চৈতি ছুঁয়ে ফেলবে মাহার হাত। তখনই…..

তখনই ডালটা ভেঙে গেলো। চৈতি তলিয়ে গেলো খাদের গহীনে। কেবল ভেসে এলো একটা ডাক,
“মাহারে…

সেই নীলকন্ঠের পিছনে যেই না মাহা ঝাঁপিয়ে পড়বে ঠিক তখনই কেউ আঁকড়ে ধরলো মাহার হাত। একেবারে বুকের মাঝে নিয়ে গেলো। তার উষ্ণ ঠোঁটের পরশ দিলো মাহার কপালে। স্পর্শটা সত্যিই অনুভব করলো মাহা। খুব করে অনুভব করলো। অতঃপর ঝাঁকড়া চুলের মানবটা খুব করে বকলো তাকে। মাহা চুপ করে শুনছে। ভালোলাগছে তার। খুব ভালো লাগছে। তার বুকের স্পন্দন গুণতে ভালোলাগছে।
_______________

“এই মাহা? মাহা।”

রেজওয়ানের ডাকে অবচেতন মস্তিষ্ক সচেতন হয়ে উঠলো মাহার। ভারী চোখ দুটো খোলার চেষ্টা করলো সে। মস্তিষ্ক সচল হতেই চোখ খুলে গেলো তার। মনে পড়লো বিগত কথাগুলো। পা, পা টা তো চৈতির।

হাতের স্যালাইন ছিঁড়ে ফেললো মাহা। তরতর করে রক্ত বের হচ্ছে সেখান থেকে। রেজওয়ান তৎক্ষনাৎ হাত চেপে ধরলো তার। অসহায় কন্ঠে বললো,

“এসব কেমন পাগলামি মাহা? এমন জানলে আমি তোমাকে কখনোই এখানে আসতে বলতাম না। তুমি না বুঝদার। কেন অবুঝের মতো করছো মাহা?”

মাহার মনে হলো ও নিজের মাঝে নেই। এই মুহুর্তে সে চৈতিকে দেখতে চায়। মর্গে গেলে কি খুঁজে পাবে? নাকি সিলেটের আগুন পাহাড়?
“ভাইয়া প্লিজ আমাকে ছাড়েন। আমি চৈতির কাছে যাবো। প্লিজ ভাইয়া।”

বলেই উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো মাহা। সবার কাছে শক্ত মনের এএসপি রেজওয়ানও যেন অসহায় হয়ে পড়ে এই মেয়েটার সামনে। তার প্রাণপাখিটার সামনে। মাহার পাগলামি বাড়ছে। উঠে বসার চেষ্টা করছে সে। হঠাৎ একটা ভারী পুরুষালি কন্ঠ ধমক দিলো তাকে।
“একদম চুপচাপ বসুন। কোনো নড়াচড়া করবেন না।”

পরিচিত কন্ঠের এমন ধমকে কেঁপে উঠে দরজার পানে তাকালো মাহা। সার্থক দাঁড়িয়ে। গলায় স্টেথোস্কোপ। গায়ে সাদা এফরোন, ভিতরে সাদা শার্ট। মাহা স্থির হয়ে বসে রইলো। মাথা নিচু হয়ে গেলো তার। রেজওয়ান উঠে হাত মেলালো ডক্টর ফায়রাজ সার্থকের সাথে। মলিন হেসে বললো,
“মেয়েটা এমন কেন করছে ডক্টর?”

সার্থক, মাথা নিচু করে রাখা মাহার পানে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো।
“হঠাৎ ধাক্কাটা নিতে পারেন নি। তাছাড়া পেশেন্টের শরীর প্রচুর দুর্বল। ঠিক মতো ঘুমান না, খাওয়া দাওয়া করেন না। তাই এমন হচ্ছে।”
“ওকে সুস্থ করে তুলুন ডক্টর ফায়রাজ।”

ইউনিফর্ম পরনে এএসপি রেজওয়ানের এমন আকুতিতে রাগ লাগছে সার্থকের। কেন লাগছে সে জানেনা। এই আকুতিতে কিছু একটা আছে। সেটা কি কোনো অধিকারবোধ?

(চলবে)….

#অলকানন্দা
#পর্ব-১৩
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৩৭.
“আপনি চিন্তা করবেন না মিঃ রেজওয়ান। মিস মাহা সুস্থ হয়ে যাবেন।”

চেহারায় যথাসম্ভব ভদ্রতা বজায় রেখে কথাটা বললো সার্থক। এই মুহূর্তে নিজের রাগ সে প্রদর্শন করতে চাচ্ছেনা। রেজওয়ান আস্বস্ত হলো কিনা তার চেহারা দেখে বুঝার উপায় নেই। রেজওয়ান এগিয়ে গেলো মাহার কাছে। পাশে রাখা চেয়ারে বসে বললো,

“মাহা, আমি একটু আসছি। কিছুক্ষণের ভিতরই ফিরে আসবো। প্লিজ তুমি শান্ত হয়ে থেকো। তুমি না ব্রেইভ্ গার্ল?”

মাহা মাথা নিচু করে রেখেছে। আস্তে করে মাথাটা ডানদিকে দুলালো একবার। অতঃপর স্থান ত্যাগ করলো রেজওয়ান। সম্পূর্ণ সময় ধরে মাহা এবং রেজওয়ানকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন ডক্টর ফায়রাজ সার্থক। রেজওয়ান বেরিয়ে যেতেই মাহার পাশে এসে বসলো সে। হাতটা টেনে নিলো আলতো করে নিজের কাছে। রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে কিছুটা। কেঁপে উঠলো মাহা। হাতের রক্ত পরিষ্কার করতে করতে সার্থক বললো,
“আপনি কি সবসময় এমন পাগলামি করেন মাহা?”

মাহা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মুখ দিয়ে কোনো কথাই আসছেনা তার। হাত কাঁপছে রীতিমতো। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো সে। সার্থক আরো শক্ত করে চেপে ধরলো।

“আমার সাথে একদম জেদ দেখাবেন না মাহা। আমি অফিসার রেজওয়ান নই। এখানকার কর্তব্যরত একজন ডাক্তার আমি। আশা রাখছি একজন ডাক্তারের সাথে কিরকম ব্যবহার করতে হয় সেই শিক্ষা আপনার পরিবার আপনাকে দিয়েছে?”

বুকটায় হঠাৎ একটা পিঁপড়ের কামড় অনুভব করলো মাহা। বিষ পিঁপড়া। দলে দলে কামড়ে চলেছে তার বুকে। হাত পরিষ্কার শেষে উঠে দাঁড়ালো সার্থক। গটগট করে বেরিয়ে গেলো সে। একবার পিছু ফিরে তাকায়নি! তাকালে হয়তো দেখতে পেতো তার অলকানন্দার ছলছল দুটি নেত্র।

কিছুক্ষণ বাদে একজন নার্স এলেন। হাতে স্যুপের বাটি। মাহাকে নিজ হাতেই খাইয়ে দিলেন তিনি। মাহা অবাক হলো অনেকটা। নার্সের এতো ভালো ব্যবহারের পিছনে কার হাত রয়েছে বুঝতে অসুবিধা হলোনা তার। নার্স ওর হাতে ইনজেকশন পুশ করার কিছুক্ষণের মাঝেই ঘুমেরা এসে জড়ো হলো তার চোখে। ঘুমের দুনিয়ায় পাড়ি জমালো মাহা। মাহা কি জানে এতটা সময় তার পাশে বসে ছিলেন ডক্টর ফায়রাজ সার্থক? এই যেমন এখনো বসে আছেন। দ্বিতীয়বারের মতো মাহার কপালে চুমু এঁকে দিলো সার্থক। মেয়েটাকে কি সে ভালোবেসে ফেললো তবে? এই যে কালো সালোয়ার কামিজ পরনে হলদেটে ফর্সা মেয়েটা। কোঁকড়া চুলের হৃদয় দুলানো মেয়েটার কি প্রেমে পরে গেলো সার্থক। অবাধ্য জীবনে কি শান্তির পরশ হবে মেয়েটা? মাহার মাথায় হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে সার্থক বললো,

“তুমি আমার পবিত্রা, অলকানন্দা।”

দূর থেকে তাদের লক্ষ্য করছে নেকড়ের চেয়েও ধারালো দু’খানা চোখ। একেবারে পর্দার আড়াল থেকে। দুজনের মধ্যে একজন ব্যাক্তির প্রতি তার ভিষণ রাগ। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।
“কে বাইরে?”

সার্থকের গলার আওয়াজ পেয়ে সরে গেলো সে। নারী! এই পৃথিবীতে একমাত্র নারীই পুরুষকে ধ্বংস করতে পারে। আবার এই নারীই কোনো ধ্বংসের তান্ডবে মাতোয়ারা পুরুষ কে নিজের ছোঁয়ায় পবিত্র করতে পারে। ভালোবাসা এ এক গভীর কুহক। এই কুহকে ডুবে নিজের সত্তাও ভুলে যায় অনেকে। কিন্তু অতীত! অতীত তাকে ফেলে দেয় দোটানায়। এক গভীর দোটানায়।

৩৮.
এসপি প্রলয় চ্যাটার্জীর জরুরি তল্লবে হাসপাতাল থেকে চলে এসেছে রেজওয়ান। এখানে উপস্থিত আছেন আরো দুই চৌকস পুলিশ অফিসার। এএসপি শাওন ও মোবারক। প্রলয় চ্যাটার্জী ভেতরে প্রবেশ করতেই দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করলো তিনজন। মধ্যবয়সী ভদ্রলোকের চেহারায় কাঠখাট্টা ভাব। চুলগুলো ছোট করে কাঁটা। এই বয়সেও যথেষ্ট ফিট তিনি। ইউনিফর্মে তাকে দেখলে অনেক নব্য পুলিশ অফিসারেরই ঘাম ছুটে যায়। বিশাল কাঁচের টেবিলের বামপাশের চেয়ারে বসলেন তিনি। রেজওয়ান সহ বাকিদের বসতে বললেন তার বিপরীতে রাখা তিনটা চেয়ারে। সকলে চেয়ারে বসতেই রেজওয়ানের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন প্রলয়। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

“মেয়েটা কি শনাক্ত করতে পেরেছে?”
“জ্বি, স্যার। কিন্তু বাকি জিনিসগুলো দেখানোর আগেই ওর অবস্থা খারাপ হয়ে যায় ফলে দেখানোর আগেই অজ্ঞান হয়।”
“মাহা হোসেন তো আপনার পূর্ব পরিচিত?”
“জ্বি।”

ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে কপালের একপাশ ঘষলেন প্রলয়। এটা তার মুদ্রাদোষ।

“অফিসার্স। এই শরীরের অংশ প্রাপ্তির ঘটনাকে কোনো ভাবেই হেলায় ফেলায় নেওয়া যাবেনা। ২০১২ সালে এমনই এক ঘটনার স্বাক্ষী হয়েছিলো সারা বাংলাদেশ। পিবিআই, সিআইডি, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ একযোগে কাজ করেছিলো তখন। প্রয়াত স্যার আজিজ এই ঘটনার মূল তদন্তে ছিলেন। স্যারের নেতৃত্বে অবশেষে অপরাধী কে ধরতে সক্ষম হই আমরা। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে কেস এগুচ্ছে না। কোর্টের শুনানির আগের দিন আজিজ স্যারের বাসায় আগুন ধরে। পুড়ে ছাই হয়ে যায় সব। প্রাণ হারান স্যার আজিজ সহ তার পরিবার।”

মোবারক প্রশ্ন ছুঁড়েন,
“স্যার সব প্রমাণ কি আজিজ স্যারের কাছে ছিল? কিভাবে মারা যান তিনি?”
“সে সম্পর্কে আজও আমরা জানিনা। সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ফলে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সন্দেহভাজন কোনো কিছুই ছিলোনা। তাই এই ঘটনাকে এক্সিডেন্ট হিসেবে ধরে নিয়েছে আদালত।”

শাওন মাঝে প্রশ্ন করলো,
“স্যার এমনও তো হতে পারে। এটা পরিকল্পিত?”
“হতেও পারে অফিসার শাওন। কিন্তু এরপর থেকে খুনের ঘটনা আর ঘটেনি।”

রেজওয়ান চুপচাপ সব শুনছিলো। সে প্রশ্ন করলো,
“স্যার এখন আমাদের প্রথম পদক্ষেপ কি?”
“দেখুন মিঃ রেজওয়ান। মাহা হোসেন আপনার পূর্ব পরিচিত। তাছাড়া সর্বপ্রথম মিসিং কেসে আপনার সাথেই তিনি যোগাযোগ করেন। অর্থাৎ কেসটায় সর্বপ্রথম ইনভলভ আমরা হয়েছি। আপাতত সিআইডি কিংবা অন্য কোনো ব্রাঞ্চ কে আমি এর সাথে যুক্ত করতে চাচ্ছিনা। মিঃরেজওয়ান আপনি, শাওন এবং মোবারক আপনাদের তিনজন কে নিয়ে একটি বিশেষ দল গঠন করা হবে। আপনাদের আন্ডারে থাকবেন ১০০ জন পুলিশ সদস্য। আমি আশা রাখছি এই ঘটনার মূল অপরাধীদের আমরা শনাক্ত করবোই।”
“সিলেট পুলিশের সহযোগীতাও প্রয়োজন পড়বে স্যার।”
“অবশ্যই। আমি যোগাযোগ করেছি। তারা সাহায্য করবেন আপনাদের।”
“স্যার লাশটা আতিয়া জামান চৈতির কিনা তা আগে আমাদের নিশ্চিত হতে হবে।”
“ভিক্টিমের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করুন।”
“করেছি স্যার। চৈতির বাবা এবং ফুফু আর কিছুক্ষণের মাঝেই হাসপাতালে পৌঁছে যাবেন।”
“ভেরি গুড রেজওয়ান। তাহলে আপনারা কাজে লেগে যান। এই ঘটনা উদ্ঘাটন করতে পারলে অনেক বড় শিকলের সন্ধান মিলবে বলে আমার ধারণা।”

শাওন, মোবারক কেবিন ত্যাগ করলো। রেজওয়ান বের হওয়ার আগেই তাকে ডাকলেন প্রলয়।
“মিঃ রেজওয়ান?”
“জ্বি, স্যার।”
“আপনাকে নিয়ে আমি আশাবাদী মিঃ রেজওয়ান। এই ঘটনা বড় কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস। কিংবা ঝড়টা হচ্ছে আমাদের অজান্তে। আমরা টের পাচ্ছিনা। বহু মানুষের জীবন এর মাঝে জড়িয়ে আছে। মাত্র কিছুক্ষণের মাঝেই মিডিয়াতে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে এই ঘটনা। আমাদের যা করার শীঘ্রই করতে হবে।”
“আমি আমার সর্বাত্মক চেষ্টা করবো স্যার।”

বলেই বেরিয়ে গেলো রেজওয়ান।

৩৯.

মর্গের রাস্তা কোনদিকে মনে করতে পারলোনা মাহা। সে কোন তলায় আছে তাও তার ধারণার বাইরে। শুধু মনে আছে ঘুম থেকে উঠে মনে হলো চৈতি তাকে ডাকছে। চৈতির কাছে যাওয়া প্রয়োজন। তাই আবার স্যালাইন ছিঁড়ে মর্গের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে সে। চৈতির সাথে তার কথা বলা খুব প্রয়োজন। হাত থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে মেঝেতে। সেই খেয়াল তার নেই। মানুষ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সেদিকে খেয়াল নেই। এটা কয় তালা? দুতালা নাকি তিন। কোথায় মর্গ! উফ! মাথাটা চেপে ধরে সিঁড়ি দিয়ে পাগলের মতো নামছে মাহা।

“নার্স, এই কেবিনের পেশেন্ট কোথায়?”

রক্ত লাল চোখে প্রশ্ন করলো সার্থক। একটু আগে মাত্র বাইরে বেরিয়ে ছিলো সে। আর এসে দেখে মাহা নেই!
“কি হলো বলুন? আপনাদের কাজের প্রতি এত অনীহা কেন আমাকে বলতে পারবেন? মেয়েটা মানসিক ভাবে সুস্থ না। আপনাকে দায়িত্বে রেখে গেলাম। মেয়েটা কোথায় চলে গেলো তা আপনি জানেনও না!”

নার্স নাজমা যারপরনাই অবাক হচ্ছেন। এতটা বছরে কখনো হাসিমুখ ছাড়া সার্থক কারো সাথে কথা বলেনি। সবসময় সুন্দর ভাবে কথা বলেছে। বড় বড় ভুল হলেও বুঝিয়ে দিয়েছে। আজ একটা মেয়ের জন্য এতটা অস্থির তিনি কেন হচ্ছেন? মেয়েটা কি অনেক স্পেশাল কেউ? মুখ খুলে কিছু বলবে তার আগেই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো সার্থক। ফ্লোরে রক্তের ফোঁটা তার চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। রক্তের ফোঁটার সূত্র ধরেই সামনে এগুচ্ছে সে। কপালে ভাঁজ। তার ব্রাশ করে রাখা ঝাঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো। অদ্ভুত কালো চোখের মণি দুটো লালবর্ণ।

সরু রাস্তা ধরে এগুচ্ছে মাহা। একটা সরু কন্ঠে চৈতি ডাকছে তাকে। চৈতির সরু ডাক ভেসে আসছে। মাহাকে কি যেন বলতে চায়। খুব জরুরি কথা। মাহাও এগিয়ে যাচ্ছে। শুনতে যে তাকে হবেই! এই তো মর্গের দরজা। উপরে সাদা বোর্ডে লাল কালিতে বড় বড় করে লেখা,”মর্গ”।

“আমি আসছি চৈতি।”

বলে মর্গে প্রবেশ করার আগেই তাকে পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সার্থক। পাগলামি শুরু করলো মাহা। তাকে যে ভিতরে যেতেই হবে। চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু হলো তার।
“প্লিজ, আমাকে ছেড়ে দেন। আমাকে ভিতরে যেতে দেন।”
“চৈতি ডাকছে আমায়।”
“এই চৈতি। আমি আসছি।”

সার্থক আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
“মাহা, শান্ত হন।”

শক্ত, সামর্থ্যবান সার্থকও যেন পেরে উঠছেনা মাহার সাথে। কোনো দৈব শক্তিতে তাকে ভর করেছে যেন। সার্থকের হাত হালকা আলগা হতেই……

(চলবে)…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here