#অলকানন্দা
#পর্ব-১৪,১৫
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
১৪
৪০.
সার্থকের হাত আলগা হতেই তার বুকে নিজের পিঠ দিয়ে ধাক্কা দিলো মাহা। আকস্মিক ধাক্কাটা সামলিয়ে উঠতে পারলোনা সার্থক। পিছিয়ে গেলো কিছুটা। মাহা মর্গের দরজাটা খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তার সমস্ত চুল এলোমেলো হয়ে আছে। ওড়নাটাও শরীরে নেই। হাতে রক্তের মাখামাখি। হলদেটে ফর্সা মুখটা লালবর্ণ ধারণ করেছে। উন্মাদের মতন আচরণ করছে মাহা। কাজল কালো চোখে অদ্ভুত আকুতি। ছলছল করছে নেত্র যুগল। নিজেকে সামলিয়ে মাহাকে আবার আঁকড়ে ধরলো সার্থক।
“মাহা, আমার অলকানন্দা। আমার বুকটা ঝাঁঝড়া করে দাও। তবুও এমন পাগলামি করোনা। আমার যে কষ্ট হয়।”
নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে মাহা। সার্থকের কথাগুলো আদোও তার কানে গিয়েছে কিনা সন্দেহ! ধাক্কাধাক্কির এক পর্যায়ে মাহার গালে চড় বসিয়ে দিলো সার্থক। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে মাহা। বামহাতটা গালে দিয়ে অশ্রু মিশ্রিত চোখে সার্থকের দিকে তাকালো সে। সার্থক কিছু বলবে তার আগেই কান্নায় ভেঙে পড়লো মাহা। ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। মনের সব কষ্ট গুলোকে অশ্রু হিসেবে বের করার বৃথা চেষ্টা যেন। দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়লো মাহা। দেয়ালে মাথা হেলিয়ে কেঁদে যাচ্ছে একমনে।
“চৈতি। চৈতি রে। আল্লাহ। আমার আপন মানুষগুলোকে তুমি কেন কেড়ে নাও আল্লাহ।”
সার্থক অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইলো কতক্ষণ। অতঃপর নিজেও বসে পড়লো মাহার পাশে। পাশ থেকে কালো ওড়নাটা উঠিয়ে হাতে নিলো। ওড়নাটা আলতো করে দিয়ে দিলো মাহার উপরে। মাহা ভুলে গেলো সকল বাঁধা। ঝাঁপিয়ে পড়লো সার্থকের বুকে। এই বুকটা কি একান্তই নিজের সম্পত্তি বানিয়ে নিয়েছে মাহা? মাহার উষ্ণ অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে সার্থকের সাদা শার্ট। একেকটা অশ্রুর ফোঁটা কাঁটার মতো বিঁধছে বুকটায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় সার্থক আলতো করে জড়িয়ে ধরলো তার অলকানন্দা কে। এক ফোঁটা অশ্রু তার চোখ থেকেও গড়িয়ে পড়লো কি? কেটে গিয়েছে সহস্র বছর, সহস্র মাস, সহস্র ঘন্টা। ঘোরের মাঝেই ছিলো দুজনে। একসময় ঘোর কাটলো সার্থকের। মাহা তার বুকে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সার্থক নিজের নরম ঠোঁট দুটোর উষ্ণ ভালোবাসা দিলো মাহার কপালে। অতঃপর কোলে তুলে নিলো তাকে। একেবারে মিশিয়ে ফেললো বক্ষে। হেঁটে যাওয়ার পথে মানুষজন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে দেখছে তাদের। চার বছর হয় হসপিটালে জয়েন করেছে সার্থক। এই চারবছরে কোনো দিন কোনো নারী পেশেন্টের সাথে অতিরিক্ত কথা পর্যন্ত বলেন নি ডক্টর ফায়রাজ সার্থক। তাহলে আজ? কে এই মেয়ে? এই মেয়ের প্রতি এতটা টান কেন ডক্টর ফায়রাজের?
হসপিটালের প্রতিটা স্টাফ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সার্থক কে দেখে মুইংচিন দৌড়ে এলো তার কাছে। মাহার দিকে একবার তাকালো সে। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“সাতক, মেয়েটা কে?”
প্রথমে জবাব দিলোনা সার্থক। মুচকি হাসলো একটু। অতঃপর হাঁটতে হাঁটতে ফিসফিসিয়ে বললো,
“আমার পবিত্রা।”
মুইংচিন কি বুঝলো কে জানে। আরেকবার হাসিরা এসে ধরা দিলো তার মুখে। তার ছোট ছোট চোখ দুটো হাসির কারণে আরো ছোট হয়ে গেলো। কুঁচকে উঠলো চোখের দুপাশ। সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করলোনা সার্থক। সে নিজের মতো হেঁটে চলে গিয়েছে দূরে। বহুদূরে।
৪১.
“জানেন জিনিয়া ম্যাডাম, সার্থক স্যার একটা মেয়ের জন্য কি যে চোটপাট দেখাইলো। মেয়েটার মাথায় সমস্যা। কেমন পাগলামি করে। ঐ মেয়েরে আবার স্যার কোলেও নিছে।”
ডক্টর জিনিয়া তাবাসসুম। সার্থকের সহকর্মী। নার্স নাজমার কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো জিনিয়া। অদ্ভুত সুরে বললো,
“সার্থক আর কোলে?”
“ইয়েস, ম্যাডাম।”
“আপনি যে কি বলেন না নাজমা আপা। এটাও পসিবল!”
“সত্যি বলছি ম্যাডাম। বিশ্বাস না হলে আপনি অন্যদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।”
চেয়ারে হেলান দিয়ে কতক্ষণ নাজমার দিকে হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলো জিনিয়া। বিগত তিনটা বছর ধরে সার্থকের সাথে একটা সম্পর্ক গড়ার চেষ্টায় আছে জিনিয়া। সার্থক কোনোভাবেই তার ডাকে সাড়া দেয়নি। মনে তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকেই অজানা মেয়েটাকে দেখার ইচ্ছে পোষণ করলো জিনিয়া। যে মেয়ে পাথরের বুকে ফুল ফুটায় তাকে তো একবার দেখতেই হয়!
_________________
“অফিসার মোবারক আপনি একটা টিম নিয়ে সিলেট যাবেন। সিলেট পুলিশের সাথে কথা বলে আগুন পাহাড় সহ আশেপাশের জায়গা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করবেন। আশা করছি কোনো সূত্র আমরা পাবোই।”
“ঠিক আছে মিঃ রেজওয়ান। ভিক্টিমের পরিবার কি হসপিটালে পৌঁছেছে?”
“জ্বি। আমি বের হবো এখনই। দ্রুত হসপিটালে যাওয়া প্রয়োজন।”
প্রয়োজনীয় কথা বলা শেষে থানা থেকে বের হয়ে গেলো রেজওয়ান। প্রাণপাখিটার জন্য মন কেমন করছে তার।
“স্যার, আমার একটু সমস্যা হয়েছে বাসায়।”
কনস্টেবল মুন্সিকে ফোন দিয়ে এসব কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে গেলো রেজওয়ানের। যথাসম্ভব ঠান্ডা সুরে প্রশ্ন ছুঁড়লো সে,
“আপনি আমায় না বলে চলে গেলেন কেনো মুন্সি সাহেব?”
“স্যার, আপনি তো বড় স্যারের কার্যালয়ে আসলে অনেকক্ষণ থাকেন। এমন কি রাতও হয়ে যায়। আর আমার বাসা থেকে হঠাৎ ফোন করলো…
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি আপনার কাজ শেষ করে পরে আসুন।”
“সালাম স্যার।”
গাড়ি নিয়ে নিজেই হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো রেজওয়ান।
রাস্তায় জ্যাম নেই তেমন। গাড়ি চলছে আপন গতিতে। রেজওয়ানের মনটা বোধহয় উড়ে চলে গেছে তার প্রাণপাখির কাছে। একটা ফোন করেও কোনো খোঁজ নেয়নি সে। মাহা কি রেগে আছে তার প্রতি? হঠাৎ মনের মানসপটে ভেসে উঠলো সেই হলুদ ফর্সা মায়াবী মুখটা। কোঁকড়া চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে আছে। মোহিত করা অক্ষি যুগল। ভারী ভারী নেত্রপল্লব। আর সুর! কি মনোমুগ্ধকর! কি অভূতপূর্ব গলার সুর। সৃষ্টিকর্তা কি সমস্ত মিষ্টতা মেয়েটার গলায় দিয়েছে? রেজওয়ানের এখনো মনে পড়ে। তখন মাহার বয়স কত! তের কি চৌদ্দ। কি অভূতপূর্ব বীণা বাজাতো মাহা। প্রতিদিন ভোরে মাহাদের ছাদে লুকিয়ে থাকতো রেজওয়ান। মাহা যখন এলোমেলো চুলে মন খুলে ছাদের একপাশে বসে বীণা বাজাতো, কি মনোমুগ্ধকর লাগতো তার!
কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে জোরে ব্রেক কষতে হয় রেজওয়ানকে। সামনে মানুষের জটলা বেঁধেছে।
“স্যার, স্যার।”
একটা বৃদ্ধ লোকের ডাকে গাড়ি থেকে নামলো রেজওয়ান।
“কি হয়েছে চাচা?”
“মাইয়াটার হাতে ছুরি দিয়া ফোস দিছে পরে মোবাইল লইয়া ছিনতাইকারী ভাগছে স্যার।”
“দেখি সাইড দেন।”
উঁচু গলায় বললো রেজওয়ান। ইউনিফর্ম পরনে পুলিশ অফিসার দেখে মানুষ জন সরে জায়গা করে দিলো। সাথের বৃদ্ধ লোকটা বললেন,
“এই স্যারেরে সাইড দেন আফনারা, সাইড দেন।”
লাল থ্রি পিস পরনে একটা মেয়ে বাম হাতে ডান হাতের কব্জিতে চেপে ধরে রাস্তায় বসে আছে।
“আপনি ঠিক আছেন ম্যাডাম?”
রেজওয়ানের প্রশ্নে মুখ তুলে মেয়েটা।
৪২.
দিনার ভাগিনী এশাকে দেখে খানিকটা অবাক হয় রেজওয়ান। মাহাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে মেয়েটা। শ্যামলা গাঁয়ের বর্ণ। দীঘল কালো হাঁটু সমান চুল।
“এই তুমি এশা না?”
নিজের প্রিয় মানুষটাকে চোখের সামনে দেখে কান্নাগুলো বেরিয়ে আসে স্পষ্ট ভাবে। কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়ায় এশা। রেজওয়ানের কষ্টই লাগে দেখে।
“আচ্ছা, কান্না করোনা। উঠে দাঁড়াও।”
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায় এশা। হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে তার। ছুরির টানে অনেকটা কেটেছে বোধহয়।
“হাত থেকে রক্ত পড়ছে তো। চলো আমি তোমাকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি।”
ভিড়ের দিকে তাকিয়ে রেজওয়ান বললো,
“এভাবে তামশা না দেখে মেয়েটাকে একটু সাহায্য করলেও তো পারতেন আপনারা!”
এশা মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে। রেজওয়ান এশাকে ইশারায় আসতে বলে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এশা আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো তার পিছুপিছু। রেজওয়ান গাড়িতে ড্রাইভিং সিটে বসলো। এশা বসলো তার পাশে। বিড়বিড় করে বললো,
“হাত কেটে যদি আপনার পাশে বসা যায় তাহলে আমি এমন একশবার নিজের হাত কাটতে রাজি রেজওয়ান।”
________________
ঘুমন্ত মাহার দিকে একমনে তাকিয়ে আছে সার্থক। কি মায়বী তার অলকানন্দা! কোঁকড়া চুলগুলো ছড়িয়ে আছে সারা মুখে।
“মেয়েটা কি স্পেশাল কেউ? ডক্টর ফায়রাজ?”
জিনিয়ার প্রশ্নে তার দিকে একবার তাকায় সার্থক। অতঃপর চোখ ফিরিয়ে আবার মাহার পানে তাকিয়ে বলে,
“হয়তো।”
“তা সেও কি ডক্টর?”
“কেন?”
“না, মানে ডক্টর ফায়রাজ তো আর সাধারণ কাউকে ভালোবাসবে না। মেয়েটা কে দেখে বয়সে আপনার থেকে অনেক ছোট মনে হচ্ছে। মেয়েটা কি মেডিকেল স্টুডেন্ট? কোন মেডিকেলে পড়াশোনা করে?”
“ওর নাম মাহা। মাহা বলে ডাকলেই খুশি হবো ডক্টর জিনিয়া। তাছাড়া ডক্টর রা কি শুধু ডক্টরদেরই প্রেমে পড়ে?”
“না, না। আমি তো তা বলিনি?”
গলা উঁচিয়ে বললো জিনিয়া। খয়েরী চুলগুলো পোনিটেল করা। লেডিস শার্ট এবং জিন্স পেন্টের উপরে ডাক্তারী এফরন। সাদা ফর্সা গাঁয়ের রঙ। চেহারায় দাম্ভিকতা।
“আস্তে কথা বলুন ডক্টর জিনিয়া। একজন পেশেন্ট এখানে ঘুমাচ্ছে।”
সার্থকের কথায় থমথমে হয়ে উঠলো জিনিয়ার মুখটা। কিছু না বলেই স্থান ত্যাগ করলো সে।
“ভালোবাসার গহীনে তুমি আমাকে টেনেই নিলে অলকানন্দা!”
শীতের রেশ কাটছে ধীরে ধীরে। বসন্তের আগমন ঘটবে ধরণীতে। নির্জীবতা কে দূরে ঠেলে দিয়ে সজীব হয়ে উঠবে ধরণী। গাছে গাছে গজাবে নতুন পাতা। রঙিন ফুলে মুখরিত হবে চারপাশ। নতুন প্রেমের হাওয়া লাগবে মনে। ঊনত্রিশ বছর শেষে শুষ্ক মরুভূমি তে এবার কি ফুটবে ফুল? ছড়িয়ে দিবে তার সৌরভ?
(চলবে)….
#অলকানন্দা
#পর্ব-১৫
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৪৩.
“তুমি তাহলে ব্যান্ডেজ করা শেষ হলে বাসায় চলে যেও এশা। আমার একটু জরুরি কাজ আছে।”
ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে এশার হাতের কাটা অংশ ব্যান্ডেজ করা হচ্ছে। চোখ মুখ কুঁচকে রেখেছে মেয়েটা। পাশে রেজওয়ান। এশা আদোও রেজওয়ানের কথা শুনেছে কিনা সন্দেহ। কাটা স্থানটায় স্যাবলন লাগাতেই এক চিৎকার দিলো সে। সহ্য করতে না পেরে কেঁদেই দিলো এবার। নার্স রুনা বিরক্ত হলেন। এমন চিৎকার, চেঁচামেচি করা রোগী তার বড্ড অপছন্দ। পাশে ইউনিফর্ম পরনে পুলিশ দেখে চেয়েও ধমক দিতে পারছেন না তিনি। তাই নরম গলায় বললেন,
“এতো চিৎকার করবেন না।”
এশা তার টানা টানা ছলছল চোখে একবার তাকালো রেজওয়ানের দিকে। তার চোখগুলো যেন চিৎকার করে বলছে,
“এই পুলিশ একটু আমার হাত ধরলে কি হয়! একটু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে কি হয়!”
মুখে নিস্তব্ধতা। রেজওয়ান তখন ফোনে ব্যস্ত। চোখ তুলে তাকানোর আগেই এশা নিজের চোখ ফিরিয়ে নেয়। এক তরফা ভালোবাসায় সত্যিই অনেক কষ্ট। নিরবে চোখের পাশ ঘেঁষে বেয়ে পড়ে অশ্রু। এই অশ্রুর মূলে কে? হাতে জ্বালা নাকি রেজওয়ান? নার্স ব্যান্ডেজ করে চলে গিয়েছেন। ছোট বেডটায় বসে এশা। হাঁটু বিস্তৃত চুলগুলো এলোমেলো।
“চলো তোমাকে রিকশা করে দিই।”
এশা কোনো প্রতুত্তর করলোনা। মনে কথা কি মুখে বলা যায়? হাসপাতালের গেটের সামনে থেকে এশাকে রিকশা করে দিলো রেজওয়ান। রিকশায় উঠে মাথা নিচু করে বসে রইলো এশা। রেজওয়ান ভাড়াটা মিটিয়ে দিয়ে বললো,
“এখন জরুরি কাজ আছে আমার। নয়তো আমিই দিয়ে আসতাম তোমাকে। আর ছিনতাইকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো আমি। তুমি চিন্তা করোনা।”
“আচ্ছা।”
অভিমান ভাঙলো তবে। এই কয়েকটা লাইনই মন ভরিয়ে দিলো যেন। মুচকি হাসিটা বিস্তৃত হলো ঠোঁটে। শ্যামল মায়াবতীর রূপ দেখার জন্য রেজওয়ানের সময় কই? সে তো তার প্রাণপাখিতে মত্ত!
“কই আমার মাইয়া কই? আল্লাহ গো।”
চৈতির ফুফুর আহাজারিতে হাসপাতাল কেঁপে উঠছে। চৈতির বাবা জামান সাহেব অসুস্থ মানুষ। চেয়ারে চুপ করে মাথা নিচু করে বসে আছেন তিনি। রেজওয়ান প্রথমে একটু থতমত খায়। চৈতির ফুফুর এহেন আচরণ ও আশা করেনি। যতদূর জানতো চৈতির ফুফু তো চৈতিকে সহ্যই করতে পারেনা। আর এখন এমন দেখাচ্ছে যেন চৈতি উনার নিজেরই মেয়ে। রেজওয়ান বসলো জামান সাহেবের পাশে। আস্তে করে বললো,
“চাচা।”
মাথা তুললেন জামান সাহেব। চোখ দুটো গর্তে ডেবে আছে। রোগা, ফর্সা শরীর। বড় দাঁড়ি। এককালে এই লোক অনেক সমৃদ্ধশালী ছিলেন দেখেই বুঝা যায়। রেজওয়ানের হাতে দুটো ফাইল। ফাইল খুলে একটা সদ্য তোলা ছবি দেখালো সে। একটা নুপুরের ছবি। সাদা গোল্ডের নুপুর। শুধু একটা চিকন চেন। একপাশে একটা লাভ আকৃতির ডিজাইন। ছবিটার দিকে শব্দহীন কয়েক পলক চেয়ে রইলেন জামান সাহেব। অতঃপর দু’হাতে মুখ ঢেকে নিরবে অশ্রু ঝড়ালেন তিনি। রেজওয়ান জিজ্ঞেস করলো,
“চাচা, নুপুরটা কি চৈতির?”
জবাব না দিয়ে মাথা নাড়লেন জামান। নিজেকে সামলিয়ে সিক্ত গলায় বললেন,
“নুপুর টা আমার চৈতির। আমিই উপহার দিয়েছিলাম।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রেজওয়ান। সে বুঝতে পারছে জামান সাহেবের মন অবস্থা ভালোনা। কিন্তু কিছু কথা না জিজ্ঞেস করলেই নয়।
“আপনার শেষ কবে কথা হয় চৈতির সাথে?”
“বিশ কি বাইশ দিন আগে।”
“ঠিক আছে। আপনি বসুন। কিছুক্ষণের মাঝেই ডিএনএ টেস্ট করার জন্য ডাকা হবে আপনাকে।”
“আমার চৈতি? আমার চৈতির কি হয়েছে ইন্সপেক্টর সাহেব?”
৪৪.
অসহায় বাবার আকুতিতে কিছুই বলতে পারলোনা রেজওয়ান। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“আপনি বসুন। আমি আসছি।”
চৈতির ফুফু রেহানা। নিজের মতো বিলাপ করেই যাচ্ছেন। দোষগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিনি মাহার কাঁধেই ফেলতে চাচ্ছেন। রেজওয়ান মহিলার বিলাপে কর্ণপাত না করে বেরিয়ে এলো।
দুতালায় যাওয়া প্রয়োজন। এশাকে রিকশায় তুলে দিয়ে আসার সময়ই চৈতির ফুফু আর বাবার সাথে দেখায় হয়ে গিয়েছিলো রেজওয়ানের। এতোটা সময় হয়ে গেছে! এত চেষ্টা করেও দুতালায় যাওয়ার সুযোগ পেলোনা সে।
ঘুমিয়ে আছে মাহা। রেজওয়ান ঘুমন্ত মাহার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে। মেয়েটা এত মোহনীয় কেন? সার্থক ইনজেকশন নিয়ে ভিতরে ঢুকে বিরক্ত চোখে রেজওয়ানের দিকে তাকালো। মিঃ রেজওয়ান কেন এভাবে তার অলকানন্দার দিকে তাকিয়ে থাকবেন? কেন? বুকে জ্বালাময়ী অনুভূতি অনুভব করছে সার্থক। সেও কি তবে হিংসুটে হয়ে গেলো?
“মিঃ রেজওয়ান?”
একধ্যানে মাহার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো রেজওয়ান। সার্থকের ডাকে ধ্যান ভাঙে তার। কিছুটা বিব্রতবোধ করছে সে। বিব্রতবোধ কাটাতে হালকা হেসে বলে,
“ডক্টর ফায়রাজ, মাহার কি অবস্থা এখন?”
মাহার কাছে এগিয়ে আসে সার্থক। একটা অধিকারবোধ থেকে হাত ধরে তাতে ইনজেকশন পুশ করে। তুলা দিয়ে স্থানটায় হালকা ঘষে বলে,
“পেশেন্ট মানসিক ট্রমার ভিতর আছেন। চৈতি মেয়েটার মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না সহজে। নিজেকে অপরাধী ভাবছেন। যার ফলস্বরূপ প্রেশার হাই হয়ে উন্মাদের মতন আচরণ করছেন তিনি।”
“আমারই ভুল ডক্টর ফায়রাজ। আমার ওকে মর্গে নিয়ে যাওয়া ঠিক হয়নি।”
“আমরা যারা প্রতিনিয়ত এসব দেখে আসছি তারা যত সহজে জিনিসটাকে গ্রহণ করতে পারবো একজন সাধারণ মানুষ তা পারবেনা মিঃ রেজওয়ান। আমার মনে হচ্ছে পেশেন্টের এসবের উপর ভয়ানক রকমের ফোবিয়া আছে।”
রেজওয়ান আর কিছু বললোনা। একবার তাকালো মাহার ঘুমন্ত মুখপানে। সার্থক নিজের রাগ চেপে গেলো। মেয়েটাকে একবার নিজের করে পেলে হৃদয়ের ভিতরে রেখে দিবে। যেন অন্য কেউ তাকে ছুঁতে না পারে, দেখতে না পারে।
“ভিক্টিমের পরিবারবর্গ এসেছে কি ইন্সপেক্টর রেজওয়ান?”
আবার ধ্যানে ব্যাঘাত ঘটে রেজওয়ানের। এবার কিছুটা বিরক্ত হয় সে। সার্থক আর রেজওয়ানের মাঝে একটা সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে। দুজন দুজনের উপরে বিরক্ত। শুধু প্রকাশে নমনীয়তা।
“জ্বি। ভিক্টিম চৈতির বাবার ডিএনএ টেস্ট করা হবে।”
নিরবতা। দুজনই অপরজনের উপস্থিতি পছন্দ করছেনা। ঘুমন্ত মাহার মুখপানে একমনে তাকিয়ে থাকতে চাচ্ছে। নিজের প্রেয়সীর সাথে একান্তে সময় বিনিময় করতে চাচ্ছে। অঘোষিত লড়াইয়ে কে হবে বিজয়ী?
কেটে গেলো সহস্র সময়। ফোন বেজে উঠলো রেজওয়ানের। মোবারক ফোন করেছেন। ফোন হাতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাইরে বেরিয়ে গেলো সে।
ঈষৎ হাসলো সার্থক। এগিয়ে গেলো মাহার পাশে। ধপ করে বসে পড়লো পাশের চেয়ারটায়। হাত বুলিয়ে দিলো মাহার মাথায়।
“তুমি তো একান্তই আমার।”
৪৫.
“বলুন, মিঃ মোবারক।”
“মিঃ রেজওয়ান, আমি টিম নিয়ে সিলেটের পথে বেরিয়ে পড়েছি। শাওনের কথা ছিলো সিরিয়াল কিলার মাতব্বর শরীফ এর সাথে জেলে গিয়ে কথা বলার।”
“পারমিশন নিয়েছেন?”
“প্রলয় স্যারের পারমিশন নেওয়া হয়েছে। তবে বিপত্তি অন্য জায়গায়?”
“একটু খুলে বলুন মিঃ মোবারক।”
“শাওন এই কেসটায় আমাদের সাথে থাকতে পারবেন না মনে হচ্ছে। উনার ওয়াইফ সন্তান সম্ভবা। কিছুদিনের ছুটি নিতে চাচ্ছেন।”
“উনি কথাটা প্রলয় স্যারের সামনে বলেন নি কেন?”
“স্যারকে সবাই ভয় পায়। বুঝতেই তো পারছেন।”
“এখন করনীয়?”
“মিস তাজ আমাদের সাথে যোগ দিবেন।”
“কথাটা কি স্যারকে জানানো হয়েছে?”
“না, এজন্যই আপনাকে কল করা। আপনি কি কাইন্ডলি স্যারকে একটু রাজি করাতে পারবেন?”
বিরক্ত হলো রেজওয়ান। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে বাইরে। ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে রেজওয়ান বললো,
“আমি বললে জিনিসটা খারাপ দেখায় ইন্সপেক্টর মোবারক। এসপি স্যার খুবই ভরসা করে আমাদের তিনজনকে নিযুক্ত করেছেন। তাছাড়া বিপদটা কত গভীর সেটা হয়তো আপনিও উপলব্ধি করতে পারছেন। আমরা এখন রুখে না দাঁড়ালে পুনরায় ২০১২ দেখতে হবে আমাদের। হাহাকার, আহাজারি থাকবে চারপাশে।”
“বুঝতে পারছি মিঃরেজওয়ান। তবে কাইন্ডলি আপনি যদি স্যারকে বলে দেন। তাহলে স্যার শাওন কে ছুটি দিবেন। উনার ওয়াইফের কন্ডিশন ভালোনা। বিদেশ নেওয়া প্রয়োজন। মিস তাজ তো দক্ষ পুলিশ অফিসার। আপনি একটু বিষয়টা দেখেন মিঃ রেজওয়ান।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রেজওয়ান। অতঃপর বললো,
“ঠিক আছে। আমি দেখছি।”
জুনিয়র অফিসার প্রদীপকে কল করলো রেজওয়ান,
“হ্যালো, প্রদীপ?”
“ইয়েস স্যার।”
” ডিএনএ টেস্ট করা শেষ হয়েছে?”
“না, স্যার। সময় লাগবে। ভিক্টিমের পরিবার আপনার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে।”
“ঠিক আছে। আমি আসছি।”
রেহানার আহাজারি কমেছে কিছুটা। রেজওয়ান কে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি।
“ঐ মাইয়া কই, স্যার?”
“কোন মেয়ে?”
“যার জন্য আমার চৈতি মরলো। মাহা?”
রেহানাকে ধমক দিলেন জামান।
“কি শুরু করলি রেহানা? চুপ কর।”
“ভাইজান, আপনে আমারে চুপ করতে বলেন? আপনে তো নিজেও জানেন চৈতি ঐ মাইয়ার লগেই সিলেট গেছিলো। সব দোষ ঐ মাইয়ার ভাইজান। আমি ছাড়তাম না। কেস করমু। ক্ষতি পূরণ চাই আমার। কত বড় ক্ষতি হইয়া গেলো ভাইজান?”
বলে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। এতক্ষণে রেজওয়ানের কাছে বিষয়টা স্পষ্ট হলো। চৌকস মস্তিষ্ক বুঝে গেলো ক্ষতিপূরণ পাওয়ার লোভেই এই নাটক তবে। গম্ভীর সুরে সে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি এতটা সিউর কি করে যে মাহা এর সাথে যুক্ত?”
ভড়কালেন রেহানা। ভীতু চেহারায় বললেন,
“মানে?”
“মানে আপনি হয়তো যুক্ত আছেন কাজটার সাথে। মাহা যদি কিছু করে থাকে তাহলে মাহার সাথে আপনিও যুক্ত আছেন।”
“কিসব আবোল তাবোল বলছেন স্যার! আমি কেমনে যুক্ত থাকবো?”
“এখন আবোল তাবোল লাগছে কেন? আপনি তো পুলিশ না তাহলে আপনি বুঝলেন কি করে অপরাধী কে? ধরাই যায় আপনিও অপরাধী?এইজন্যই সবটা জানেন। অপরপক্ষের সাথে মনোমালিন্যের কারণে দায় চাপাতে চাচ্ছেন।”
স্তব্ধ হয়ে গেলো রেহানা। বুঝতে পারলো চৌকস লোকের সামনে সে নিতান্তই শিশু। সব আহাজারি বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার। রেজওয়ান আর কথা বাড়ালোনা। এগিয়ে গিয়ে জামান সাহেবের পাশে বসলো আবারো।
________________
ঘুমের মাঝে মনে হচ্ছে একটা শক্ত হাত। একটা শক্ত হাত গলা চিপে ধরেছে মাহার। সে চিৎকার……
(চলবে)