অলকানন্দা #পর্ব-১৬,১৭

0
501

#অলকানন্দা
#পর্ব-১৬,১৭
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
১৬

৪৬.
মাহা চিৎকার করে উঠে বসলো। নার্স নাজমা বিরক্ত হলেন। মাহা উঠে বসে হাঁপাচ্ছে।
“পানি, পানি।”

নার্স নাজমা পানি এগিয়ে দিলেন। সকাল আটটা বাজে। চারিদিকে রোগী আর আত্মীয় স্বজনের আহাজারির আওয়াজ। নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় নিলো মাহা। গলাটা প্রচুর ব্যথা করছে তার। ঢকঢক শব্দ তুলে পানি খেলো সে। পানি গিলতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। পানির মগটা পাশে রেখে আশেপাশে তাকালো মাহা। ততক্ষণে নার্স নাজমা বেড়িয়ে গেছেন। মাহার শরীরটা প্রচন্ড দুর্বল লাগছে। উঠে দাঁড়ালো মাহা। বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে। মাথায় উড়না পেঁচিয়ে নিজেকে ঢেকে নিলো। উদ্দেশ্য মর্গে যাবে। তিনতালা থেকে দুতালায় নেমে এলো মাহা। দুইপাশেই যাওয়ার রাস্তা। মাঝ বরাবর সিঁড়ি। ডানে যাবে না বাঁয়ে! দ্বিধায় পড়লো সে। ডানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। পা বাড়ানোর আগেই পুরুষালি আওয়াজ।
“মাহা।”

রেজওয়ান সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। উঠে মাহার কাছে এসে দাঁড়ালো। নরম কন্ঠে বললো,
“কোথায় যাচ্ছো?”

মাহা মাথা নিচু করে রইলো। আস্তে করে বললো,
“আমায় বাড়ি নিয়ে চলুন, রেজওয়ান ভাই।”
“ঠিক আছে। চলো। হাঁটতে পারবে?”
“হুম।”

ব্যস, কথা এতটুকুই। রেজওয়ানের সাথে বাইরে এসে দাঁড়ালো মাহা।
“তুমি দাঁড়াও। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।”

মাহার বেহায়া হৃদপিণ্ড ছলাৎ ছলাৎ করছে। কি এক তৃষ্ণা মিটাতে চাচ্ছে। ঝাঁকড়া চুলের মানুষটা। ঝাঁকড়া চুলের মানুষটা কি তবে মন বন্দী করার অদ্ভুত ক্ষমতা রাখে! মর্গে যাওয়ার কথা ভুলে গেলো মাহা। কেবল সেরিব্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভারী পুরুষালি কন্ঠের মানুষটার কন্ঠ। ডক্টর ফায়রাজ সার্থক। হর্নের আওয়াজে ধ্যান ভাঙলো মাহার।
“গাড়িতে উঠো।”
“হুম।”

বলেই গাড়িতে উঠে পড়লো মাহা। হসপিটাল ছেড়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে বহুদূর। আবারো হৃদয় নিঙড়ানো ব্যথা অনুভব করলো মাহা। তাদের গাড়ি বের হওয়ার সময় পাশ দিয়েই ভিতরে ঢুকলো সার্থকের গাড়ি। ভোরের দিকে মাহার পাশ থেকে উঠে জরুরি কাজে বাইরে যেতে হয়েছিল তাকে। রেজওয়ান আপনমনে গাড়ি চালাচ্ছে। ভালোবাসার মানুষ পাশে বসলে হৃদয় হয়ে উঠে প্রজাপতির মতো। উড়ে বেড়ায় দিগন্ত থেকে দিগন্তে। রেজওয়ানের মনেও লেগেছে সেই হাওয়া। হৃদকম্পন বেড়ে গিয়েছে কয়েকগুণ। বিড়বিড় করলো রেজওয়ান,
“কবে তুমি আমার হবে?”

মুখের অভিব্যক্তি সব সময়ের মতো। দেখে বুঝার উপায় নেই তার ভিতরে কি চলছে। মাহার অবশ্য এসব খুঁজার সময় নেই। সে চেয়ে আছে বাইরে। সাদা ধবধবে আকাশের পানে। মনের বিরুদ্ধে সে লড়ছে নাকি মন তার বিরুদ্ধে লড়ছে? গাড়িটা থেমে গেলো। বাকিটা পথ হেঁটে যেতে হবে। রেজওয়ানের জরুরি কাজ আছে। থানায় যাওয়া প্রয়োজন। বাকিটা পথ ইচ্ছে ছিলো একসাথে যাওয়ার। মানুষের কিছু কিছু ইচ্ছে অপূর্ণ থেকে যায়। একেবারে নিরবে নিভৃতে।
“মাহা। আমার কাজ আছে। বাকিটা পথ তুমি একা যেতে পারবে?”
“পারবো, ভাইয়া।”
“ঠিক আছে। সাবধানে যেও। আর মা অনেকদিন যাবত তোমার কথা বলছিলেন। বিকালে যদি পারো তাহলে একটু মায়ের সাথে দেখা করে এসো।”
“আচ্ছা।”
“তাহলে আমি যাই।”

কথোপকথন শেষে মাহাকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো রেজওয়ান। মাহা চলেছে বাড়ির পথে। হঠাৎ করেই রাস্তায় পা রাখার পর বাবার জন্য মন কেমন করে উঠেছে মাহার। দ্রুত বাড়ির দিকে ছুটলো মাহা।

৪৭.
“স্যার। মিঃ শাওন এই কেস থেকে বিরতি নিতে চাচ্ছেন। উনার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা।”

প্রলয় খানিকটা মনক্ষুন্ন হলেন। যদিও তার কঠিন চেহারায় সেই অভিব্যক্তি প্রকাশ পেলোনা। উনি অনেক ভেবে চিন্তে তিনজন তেজস্বী পুলিশ অফিসার নিযুক্ত করেছিলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে উনি বললেন,
“সম্পূর্ণটা বলুন রেজওয়ান।”

প্রলয় তেজস্বী মস্তিষ্কের মানুষ। রেজওয়ান ভালোই জানে। তাই বললো,
“স্যার, আমরা মিস তাজকে আমাদের সাথে নিতে চাচ্ছি।”

কথাটা শুনে ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে কপালের একপাশ ঘষলেন প্রলয়। এটা তার মুদ্রাদোষ। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন,
“ঠিক আছে।”

স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো রেজওয়ান। কেস নিয়ে কিছু কথা বলে বাইরে বেরিয়ে এলো সে। অনেক পরিকল্পনা করতে হবে। মোবারকের কল।
“সালাম, মিঃ রেজওয়ান।”
“সালাম।”
“আমি সিলেট পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেছি। কিছুক্ষণের মাঝেই টিম নিয়ে বেরিয়ে পড়বো স্পটের উদ্দেশ্যে।”
“গুড। মিঃ মোবারক। খেয়াল রাখবেন একটা ক্লু। একটা ক্লুই পারে আমাদের সঠিক দিশা দেখাতে।”
“সর্বাত্মক চেষ্টা করবো মিঃ রেজওয়ান। আপনি মিস তাজের সাথে কথা বলে নিবেন। আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী এগুতে হবে।”
“জ্বি।”

কথা শেষে কল কেটে দিলো রেজওয়ান। কোথ থেকে কি শুরু করবে! কিছুই বুঝতে পারছেনা সে। এটা অনেকটা অন্ধকারে সুঁই খোঁজার মতো। নিজের চেয়ারে বসে ঘটনাটুকু বিশ্লেষণ করলো রেজওয়ান।

‘মাহা-চৈতির সিলেট ঘুরতে যাওয়া। হঠাৎ করেই রাতের বেলা মাহার ফোন। চৈতির হারিয়ে যাওয়া। চৈতির খোঁজ করা। মাহার সবকিছু ভুলে যাওয়া। আগুন পাহাড় থেকে একটা অজানা নারীর পায়ের অংশ খুঁজে পাওয়া। প্রাথমিক শনাক্তকরণে যা বুঝা গেলো এটা চৈতির দেহের অংশ। খুনের ধরন সেই ২০১২ সালের সিরিয়াল কিলার মাতব্বর শরীফের মতো। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব! মাতব্বর শরীফ তো জেলে। তার বিচার কাজ এখনো ঝুলে আছে। তাহলে কে আছে এর পিছনে? আদোও মাতব্বর শরীফ কি আসল খুনি? নাকি তাকে কেবল ব্যবহার করা হয়েছে? ঘটনার পিছনের ঘটনা কি? কিন্তু শরীফকে ধরার পর থেকেই তো খুন বন্ধ হয়েছিলো। তাছাড়া আজিজ ছিলেন ২০১২ সালের ঘটনার তদন্তে। সমস্ত উত্তর মিলতো তার কাছে। তিনি তো মৃত। উনার মৃত্যু হয়েছে অগ্নিকান্ডে। সেটা কি আদোও এক্সিডেন্ট!’

অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রেজওয়ানের মস্তিষ্কে। একটারও সঠিক উত্তর নেই। আঙুলের ডগায় কলম নিয়ে একমনে চিন্তা করছিলো রেজওয়ান।
“আসবো, মিঃ রেজওয়ান?”

মিস তাজ এসেছেন। মাথা তুলে তাকালো রেজওয়ান। বললো,
“আসুন। মিস তাজ।”

তাজ চেয়ারে এসে বসলেন। আটাশ বছর বয়সী চৌকস পুলিশ অফিসার। মুখে টানটান ভাব। গাঁয়ে বাংলাদেশ পুলিশের ইউনিফর্ম। চুলে খোঁপা। শান্ত চেহারার এই তরুণী ভয়ংকর। যতটা শান্ত তাকে দেখা যায় ততটাই অশান্ত তিনি। আসামির কলিজা কেঁপে উঠে দ্বিতীয়বার তার সাক্ষাৎ পেলে। প্রথমবার তাকে অবলা ভেবে অনেকেই ভুল করে। যারা আসল রূপ দেখেছে তাদের গাঁয়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় এই নারীর দ্বিতীয় দর্শনে। ঘোড়া দৌড়ে স্বর্ণপদক জয়ী এই তেজস্বী।

৪৮.
“চলে গেছেন মানে?”
“উনি সকালে পুলিশ অফিসারের সাথে চলে গেছেন।”

নার্স নাজমার কথায় অনেকটা অবাক হলো সার্থক। মানে মাহা তাকে না বলে চলে গেলো! মাহার কাছে এতটা পর সার্থক! আবার পালালো তার থেকে? সেই প্রথমবারের মতো এবারেও। দীর্ঘশ্বাস ফেললো সার্থক। নিজের চেয়ারে হেলান দিলো এবার। নার্স নাজমা দাঁড়িয়ে আছেন।
“স্যার, আমি কি আসতে পারি?”
“হুম।”

গম্ভীর শোনায় সার্থকের গলার আওয়াজ। কি ভেবে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তাঁর। পুলিশ অফিসার মানে! রেজওয়ানের সাথে বেরিয়েছে মাহা! অজানা কারণে সার্থক রেজওয়ানকে পছন্দ করেনা। মাহার প্রতি রেজওয়ানের দৃষ্টিভঙ্গী অন্যরকম। মাহার কাছে রেজওয়ানকে দেখলেই সার্থকের রাগ উঠে যায়। প্রচন্ড রকমের রাগ। শান্ত, ঠান্ডা মস্তিষ্কে রক্তের বুদবুদ ফুটে যেনো।

“তোমাকে আমি নাহয় ছিনিয়ে নিলাম দুনিয়া থেকে।”

_________________

এই মিনিট কয়েকের পথটাও হাজার মাইলের লাগছে মাহার কাছে। রাস্তাটা শেষ হচ্ছেনা যেন। ধীর পায়ে দুর্বল শরীরে বাড়ির সামনে পৌঁছালো মাহা। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই কান্নার আওয়াজ পেলো সে। বাবার জন্য মন কেমন করে উঠলো মাহার। নিজের কথা না ভেবে দৌড়ে উপরে উঠছে মাহা। এই পৃথিবীতে একমাত্র আপন মানুষটা কি ঠিক আছে? তিনতালা পেরিয়ে চারতালায় উঠতেই আহাজারি স্পষ্ট হলো মাহার কাছে। দিনা কাঁদছেন। সেই সাথে মাহার সৎ ভাই মাহিন, বোন দিয়ারও কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। ভিতরে প্রবেশ করলো মাহা। ড্রয়িং রুমে কিছু মানুষের ভিড়। মাহা হতভম্ব হয়ে দৌড়ে গেলো বাবার ঘরের দিকে। খাটের উপর আজাদ হোসেন শুয়ে আছেন। আর হয়তো কোনোদিন চোখ খুলে তাকাবেন না তিনি। ঘরে আমেনা, দিয়া, মাহিন, দিনা, এশা সহ অনেকে। কিছুক্ষণ আগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন আজাদ হোসেন। মাহা অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো বাবার নিথর দেহের দিকে। চোখ ফেটে জল বেরুলো না এবার। হৃদপিণ্ড নিমিষেই পাথর হয়ে উঠলো তার। চোখ দুটো ইটের খন্ড। সবাই কান্না করছে। সে চেয়ে আছে। তার চোখে কোনো পানি নেই। গলায় কোনো আওয়াজ নেই। দিনা হঠাৎ খেয়াল করলেন মাহাকে। আহাজারি থামিয়ে এসে মাহার সামনে দাঁড়ালেন। কিছু বুঝে উঠার আগেই গালে চড় পড়লো মাহার। মাহা কোনো প্রতিক্রিয়াই করলোনা। তাকিয়ে রইলো নির্নিমেষ।
“তুই রাস্তায় মরতে পারলি না? আমার স্বামীকে খাইয়া শান্তি হয় নাই তোর? আরো খাইতে চাস? আমাকে খাবি। নে, আমাকে খা। মুখপুড়ী গিল আমারে।”

দিনা চিৎকার করে উঠলেন। আমেনা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন দিনাকে।
“মা, শান্ত হ।”
“কেমনে শান্ত হই। আজ কেবল এই কলঙ্কিনীর কারনে আমি বিধবা হইছে। আমি মাইরা ফেলবো ওরে।”

দিনা আবারো তেড়ে এলেন মাহার দিকে। মাহা ঠায় দাঁড়িয়ে। কোনো নড়চড় নাই। এদিকে কয়েকজন মিলেও ধরে রাখতে পারছেনা দিনাকে। এবারে দিনার বড় ভাই অর্থাৎ এশার বাবা এগিয়ে এসে থামাতে চাইলেন দিনাকে। দিনা থামলেন না। কারো কথা শুনলেন না। মাহার হাত ধরে টানতে টানতে নিচে নেমে এলেন। মাহা অনুভূতিহীন।

(চলবে)…..

#অলকানন্দা
#পর্ব-১৭
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৪৯.
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মাহা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একমনে। কোনো অনুভূতি নেই, কোনো অভিব্যক্তি নেই। নির্বিকার মানবী। বসন্ত এসেছে নির্মল ধরায়। হালকা হাওয়া বইছে। সাঁই সাঁই করে পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে চলন্ত গাড়ি। সবাই সবার মতো ব্যস্ত। গমগমে আওয়াজ, চেঁচামেচি, গাড়ির হর্নের শব্দ, হকারের
হাঁক দেওয়ার শব্দ, শিশুর কান্নার শব্দ,কাকের কা কা, মানুষের কথাবার্তা। সব মিলিয়ে একত্রিত হয়ে তৈরি করেছে এক ঝিমঝিম শব্দ। শব্দের রয়েছে নিজস্ব বলয়। অদৃশ্য এক বলয়। সেই বলয়ের কারণেই হয়তো মাহার কানে অদ্ভুত এক আওয়াজ ভেসে আসছে। পিছন পিছন একটা কালো হাইস অনেকক্ষণ যাবত আসছে। অর্ধজাগ্রত, জীবন উদাসী মাহা হয়তো তা খেয়ালও করেনি। নিরব হলো রাস্তা। জনমানবশূন্য রাস্তায় প্রবেশ করতেই পিছন থেকে দ্রুত বেগে ধেয়ে আসলো গাড়িটা। কিছু বুঝে উঠার আগেই টেনে নিয়ে গেলো ভিতরে। মাহার ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীর প্রতিবাদ করতে চাইলো খানিকটা। জুতসই হলোনা। জ্ঞান হারালো মাহা।

_________________

হসপিটালের বড় ঘড়িটা টং টং করে শব্দ করে উঠলো। জানান দিচ্ছে রাত বারোটা ছুঁয়েছে সময়। আজ দিনটা অনেক ব্যস্ততায় কেটেছে রেজওয়ানের। ইন্সপেক্টর তাজের সাথে ইনভেস্টিগেশন নিয়ে আলোচনা সহ নানা কাজ। ডক্টর ওয়াসিফের সাথে একটু আলোচনা প্রয়োজন। হাসপাতালের নিচতলায় ফরেনসিক ল্যাব। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে পশ্চিম পার্শ্বে কিছুদূর হাঁটতে হয়। এদিকটায় নিরব। জুতোর সাথে টাইলস লেগে হাঁটার দারুণ শব্দ হচ্ছে। ঠক ঠক ঠক। ফরেনসিক ল্যাবের দরজাটা সাদা রঙের। কাঁচের তৈরি। দরজা খোলাই। দরজার বাইরে রেজওয়ানকে দেখে হাঁক ছাড়লেন ওয়াসিফ।
“আসুন, মিঃ রেজওয়ান।”

বহু জিনিসপত্রে সাজানো গোছানো, ছিমছাম ঘর। কেমিক্যাল, পরীক্ষা করার যন্ত্র। ছুরি, হাতুড়ি সহ নানা জিনিস। একটা টেবিলে চৈতির ছিন্ন পা এবং অপরপাশে উদ্ধারকৃত আলামতসমূহ। রেজওয়ান পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
“ডিএনএ রিপোর্ট আসতে কতদিন সময় লাগতে পারে? ডক্টর?”
“আরো পাঁচদিনের মতো লাগবে ।”

ল্যাবে তাদের ছাড়াও আরো দুইজন উপস্থিত। মোহাম্মদ জুলফিকার। সে ইন্টার্নি করছে আর ডক্টর মিনহাজ। দীর্ঘক্ষণ চৈতির পা পর্যবেক্ষণ করলেন ডক্টর ওয়াসিফ। অতঃপর বললেন,
“আপনাকে জরুরি একটা কথা বলার ছিলো মিঃ রেজওয়ান।”
“জ্বি, বলুন।”
“আপনি আমার সাথে আসুন।”

ডক্টর ওয়াসিফের পিছু পিছু ফরেনসিক ল্যাবের ভিতর আরেকটা দরজা দিয়ে ছোট একটা ঘরে ঢুকলো দুজনে। ঘরের একপাশে তিন থাকের ওয়ারড্রবের মতো ফ্রিজ। ঘরের তিনভাগের দুইভাগ ফ্রিজ। অপরদিকে কাঠের তৈরি থাক। তাতে কেমিক্যাল ভরপুর শতখানেক কাঁচের কৌটা। সেখানে ডুবিয়ে রাখা লাশের চোখ, হৃদপিণ্ড, কিডনি সহ অন্যান্য অঙ্গাণু। ঘরের মাঝে একটা কাঠের পুরানো টেবিল। ওয়াসিফ ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলেন।
“আপনাকে কিছু দেখাতে চাচ্ছি মিঃ রেজওয়ান। আশা রাখছি আপনার ইনভেস্টিগেশনে তা সাহায্য করবে।”

রেজওয়ান কিছুই বললোনা। বর্তমানে হাতের কাছে যা পাবে তাই অনেক। একটা ক্লু। কেবলমাত্র একটা ক্লুর সন্ধান চাচ্ছে রেজওয়ান। বর্তমানে সে এবং তার টিম এমন পর্যায়ে আছে তাতে কি রেখে কি করবে বুঝা দায়। কি থেকে কি শুরু করবে! সন্ধ্যার দিকে ইন্সপেক্টর মোবারকের সাথে কথা হয়েছিলো তার। ঘটনা স্থান বারবার খুঁজেও কোনো তথ্য মোবারক পাননি।

৫০.

অন্ধকার ঘর। কেমন স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ। মাহার জ্ঞান ফিরলো। কিন্তু আকস্মিক অন্ধকারে মস্তিষ্ক ধাক্কা অনুভব করলো। আলোর সন্ধান চায় সে। দুর্বল, ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঢুকরে উঠলো মাহা। চিৎকার করলো পাগলের মতন। কেউ আসেনা, কেউ না। পিছনে কিসের পাটাতন মাহার জানা নেই। তাতে হেলান দিলো মাহা। কানে ভেসে এলো ব্রিটিশ এক্সেন্টে আওড়ানো কিছু বুলি। কি বলছে বুঝতে পারছেনা মাহা। অন্ধকার সয়ে এসেছে চোখে। মাহার মনে হলো এমন ঘটনা তার সাথে আগেও ঘটেছে। এবং সেটা দেজা ভ্যু নয়। এরকম বন্দী অবস্থায় ছিলো সে। আধা জাগ্রত, আধা অবচেতন মাহা মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করলো তীব্রভাবে। তাতে জোড়ালো চিনচিন ব্যথার সৃষ্টি হয়েছে। মাহার সেদিকে খেয়াল নেই। আবছা স্মৃতিগুলোকে পুনর্জীবিত করার চেষ্টা চলছে যে! স্মৃতিকে বারবার মনে করতে থাকলে স্মৃতিটি যে নিউরোনে সংরক্ষিত আছে, সেটার সিন্যাপ্স বারবার আন্দোলিত হয়। যত বেশী সিন্যাপ্স আন্দোলিত হবে, সেই স্মৃতি তত শক্তিশালী হবে। মাহার ক্ষেত্রে তা হচ্ছেনা। সিন্যাপ্স আন্দোলিত হচ্ছে তবে কিছু মনে পড়ছেনা। মাথায় দু হাত চেপে ধরে আবার চিৎকার করে উঠলো মাহা। এবার মস্তিষ্কে জোর চালালো না। পিছনে শক্ত পাটাতন হয়তো এটা দেয়াল তাতে মাথা হেলিয়ে দিলো। চোখ বুজে গেলো তার। নিউরোন আন্দোলিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। মাহার মস্তিষ্কের কিছু নিউরোন চাইলেও সম্পূর্ণরূপে আন্দোলিত হতে পারছেনা। কিছু একটা যেন ধরে রেখেছে তাদের। চোখ বুজলো মাহা। ফিরে গেলো কিছুদিন পূর্বে।

_______________

বিকেলে বাইরে বের হয়েছিলো মাহা, চৈতি। পরের ঘটনা অন্ধকারে ছেয়ে আছে । চোখের সামনে আবছা অন্ধকার। মাহার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে কেউ। আশেপাশে জঙ্গল। দূরে বিশাল বিশাল পাহাড়। বড় একটা মেহগনি গাছের পিছনে লুকিয়ে মাহা। বারেবারে তার নাম ধরে চিৎকার করছে কেউ। কান খাড়া করলো মাহা। এই আওয়াজ তো চৈতির! গাছের পিছন থেকে বেরিয়ে এলো সে। দূরে শিয়াল ডাকছে। হুক্কা হুয়া। গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো মাহার। সে এগিয়ে গেলো সামনে। অন্ধকার নেমে এসেছে চারপাশে। মাহা হাঁটছে। কাঙ্ক্ষিত ডাক থেমে গেলো। মাহার মুখ পিছন থেকে শক্ত করে কেউ ধরেছে। ছটফট করছে মাহা। ছাড়াতে পারছেনা। টানতে টানতে কেউ তাকে নিয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের ভিতরে। কাঠের ঘর। একটা হারিকেন জ্বালানো কেবল। তাকে ঘরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাইরে দিয়ে দরজা আটকে দিলো পুরুষালি রুক্ষ হাত। মাহা অনবরত চিৎকার করছে আর দরজা ধাক্কাচ্ছে। না কেউ খুলছেনা। বদ্ধ জায়গায় অসম্ভব খারাপ লাগে মাহার। ক্লস্ট্রোফোবিয়ায় আক্রান্ত মাহা কোনোদিন মানতে চায়নি তার কোনো বিষয়ে ফোবিয়া থাকতে পারে। একসময় শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। অতঃপর সব অন্ধকার।

যখন জ্ঞান ফিরালো তখন বোধহয় বাইরে গভীর রাত। নিশুতি রাতের কান্না ভেসে আসছে। হরেকরকম প্রাণীর ডাক ভেসে আসছে বাহির থেকে।
মাহা ঘরে দুজন মানুষের অস্তিত্ব অনুভব করলো। বাইরে একটা হারিকেন জ্বলছে। সেই আবছায়া আলোর ছিটেফোঁটা ভিতরে প্রবেশ করছে কেবল। ব্রিটিশ এক্সেন্টে একজন লোক কি যেন বলছে। তার পাশে বিশালদেহী আরেকজন। বিদেশি লোকটার নীল চোখ অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। মাহা চিৎকার করার আগেই তার ঘাড়ে একটা ইনজেকশন পুশ করে দিলো লোকটা। মাহা একটা সূক্ষ্ম জ্বালা অনুভব করছে ঘাড়ে। মনে হচ্ছে ঘাড়ের ভিতর, শিরা দিয়ে রক্ত চলাচলের পাশাপাশি সুঁইও চলাচল করছে।

৫১.
সুঁইগুলো চলাচলের সময় যেন একটা করে তীক্ষ্ণ আঘাত করে যাচ্ছে ঘাড়ে। নির্দিষ্ট জায়গায়। মাহা অর্ধচেতন হয়ে পড়লো। বিদেশি লোকটাকে দেখা যাচ্ছেনা। মাহা বুঝে গেলো। কারণ অন্ধকারে নীল জ্বলজ্বলে চোখ দেখা যাচ্ছেনা। মাহা কাঠের ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে। চোখ বুজা তার। হঠাৎ খেয়াল করলো বিশালদেহী লোকটা নিজের একটা হাত এগিয়ে তার শরীরে স্পর্শ করতে চাচ্ছে। ধারালো দাঁতে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে লোকটার হাতে কামড় বসিয়ে দিলো মাহা। লোকটা চিৎকার করে উঠেছে। কাঠের ঘরের দরজা খোলা। মাহা সবকিছু ভুলে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো৷ দিকবিদিকশুন্য হয়ে দৌড় দিলো প্রাণপণে। নিজের অস্তিত্বের লড়াই, নিজের সম্ভ্রম বাঁচানোর লড়াইয়ে জয়ী হলো মাহা। পিছনে লোকটা দৌড়ালেও এখন নেই। জঙ্গল পেরিয়ে পাকা রাস্তায় উঠে গেছে সে। তারপর আবার দৌড়। পরে কি হলো মাহা জানেনা। যখন চোখ খুললো মাহা তখন পাশে পেয়েছে রুমানাসহ তার বাড়ির মানুষদের।

___________________

বর্তমান, অতীত মিলে একাকার। মাহা এখন কোথায় আছে জানেনা। মনে হলো প্রিয় একটা পুরুষালি হাত তার গালে নরম করে চাপড় মারছে। নরম কন্ঠে তাকে ডাকছে। মাহার চোখ খুলতে ইচ্ছে করছেনা। উষ্ণ বুকে মাথা দিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে সহস্র দিন, সহস্র মাস, সহস্র বছর। সার্থক একহাতে মাহাকে বুকে নিয়ে অপর হাতে ড্রাইভ করছে। মাহার মুখে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো সে। একটা ফোন পেয়েই এই রাস্তায় ছুটে এসেছিলো। ঘুমের মাঝেই কি যেন বিড়বিড় করছে মাহা। সার্থক আবার চুমু খেলো। এই মেয়েটাকে পারলে বুকের ভিতরেই রেখে দিতো সে। বিশাল আকাশে চাঁদ উঠেছে। হাওয়া বইছে মৃদু। মাহার দুচোখের পাশ ঘেঁষে জল গড়িয়ে পড়ছে। সার্থক শুষে নিলো তা। মাহার কানে কানে বললো,
“তোমার সকল কষ্টগুলো আমার।
আমার সকল সুখগুলো তোমার।”

মাহা অবচেতন অবস্থায় আরো গাঢ় করে জড়িয়ে ধরলো সার্থক কে। মাথা ঠেকিয়ে দিলো সার্থকের চওড়া বুকে। সার্থকের ঠোঁটে ঈষৎ হাসির রেখা দেখা দিলো কি?

চাঁদের সাথে মেঘেদের অবাধ খেলা হচ্ছে আকাশে। কখনো কখনো দুষ্টু মেঘের দল ঢেকে দিচ্ছে চাঁদকে। কখনো বা সরে যাচ্ছে। যেমনটা মাহার চুলগুলো তার সাথে করছে। খোলা কোঁকড়া চুলগুলো কখনো তার মুখ ঢেকে দিচ্ছে কখনোবা সরে যাচ্ছে। সার্থক চাঁদের পানে তাকালো একবার। আবার তাকালো তার অলকানন্দার দিকে। মুচকি হাসি উপচে করলো গম্ভীর মুখটায়। আবার চাঁদের পানে তাকিয়ে সে বললো,
“এই যে মেঘেরা আমার চাঁদ বেশি সুন্দর।”

মেঘের দল রাগ করলোনা। আকাশের চাঁদটাকে ঢেকে দিলো তারা। যেন বুঝিয়ে দিলো,
“হুম। তোমার চাঁদ বেশি সুন্দর ছেলে।”

(চলবে)…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here