#অলকানন্দা
#পর্ব-২০,২১
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
২০
৫৮.
“পরিস্থিতি যেমনই ছিলো আমাদের বিয়েটা হয়েছে এটা সত্য। আমরা একটা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি মাহা। আমার এই পৃথিবীতে কেউ নেই। বিয়ে, ভালোবাসা এসবে আমার আগ্রহ ছিলোনা কোনোকালেই। বিশ্বাস করো মাহা এটা পবিত্র বন্ধনের শক্তি কিনা জানিনা তবে তোমার জন্য আমার মনে অদ্ভুত একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। এটা কি ভালোবাসা নাকি আমার মোহ তাও আমার জানা নেই। শুধু মনে হয় তোমাকে আমার চাই। যে করেই হোক চাই। আচ্ছা, আমরা কি এই সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দিতে পারিনা?”
বাইরে নীল দিগন্তের দিকে তাকিয়ে একটানা কথাগুলো বললো সার্থক। এখন তার কিছুটা হালকা লাগছে। মাহা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কতক্ষণ। সেও এটাই ভাবছিলো। বিয়েটা যখন হয়েই গিয়েছে তাহলে একটা সুযোগ দেওয়াই যায়। মাহা তো নিজেও অস্বীকার করতে পারেনা তার মনে একটু হলেও সার্থক জায়গা করে নিয়েছে। নয়তো ঝাঁকড়া চুলের মায়াবী চোখের এই ছেলেটার জন্য তার মন কেমন করে কেন! এই পৃথিবীতে সবাই তো তাকে ছেড়ে চলে গেলো। প্রথমে মা, পরে চৈতি। গতকাল বাবা! আপন বলতে কেউ তো আর নেই। সার্থকের বাড়িতে একটু স্থান হয়েছে। সেই সাথে আপন একটা মানুষ যদি পাওয়া যায় তাহলে একটা সুযোগ দিলে ক্ষতি কি! মাহা যখন ভাবনায় মত্ত তখন সার্থক তার দিকে ফিরে বললো,
“মাহা, আমাকে একটা সুযোগ দাও।”
অদ্ভুত আকুতি সার্থকের কন্ঠে। মাহা সার্থকের চোখে চেয়ে বললো,
“আমাদের বিয়ের সামাজিক স্বীকৃতি চাই।”
বহু কষ্টে আড়ষ্টতা ভেঙে এই কথাটা বলে মাহা চুপ করে গেলো। সার্থক নিজের উত্তর পেয়ে গিয়েছে। মুচকি হাসলো সে। ফোন বের করে কল করলো মুইংচিন কে।
“হ্যালো, মুইংচিন কাজী ডাকানোর ব্যবস্থা করো।”
ওপাশে কি বললো শোনা গেলোনা। তবে লজ্জায় মাহার গাল দুটো লাল হয়ে যাচ্ছে। সে সাথে বুকে চিনচিন ব্যথা। বাবা! আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতেন! নিজের কষ্ট ভুলতে চতুর্দিক অবলোকন করতে শুরু করলো মাহা। বিরাট বারান্দা। ছোটবড় টবে নানা রকম ক্যাকটাস গাছ। কয়েকটা ক্যাকটাস গাছে আবার ফুলও ফুটেছে। সাদা আর বেগুনি রঙের। অভূতপূর্ব দেখতে। সার্থক মুইংচিনের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। মাহা ঘুরে ঘুরে দেখছে চারপাশ। ছোট ছোট ক্যাকটাস গুলো দেখতে ভিষণ সুন্দর। একটা হলুদ অলকানন্দার গাছ। সবুজ থোকায় থোকায় হলদে ফুলগুলোকে ভিষণ সুন্দর লাগছে। একটা মাছের অ্যাকুরিয়ামও আছে। তাতে কালো রঙের অদ্ভুত কয়েকটা মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাহা যারপরনাই অবাক। সার্থক অপরদের থেকে একেবারে ব্যাতিক্রম। মানুষ বাগানে লাগায় গোলাপ, ডালিয়া এসব। আর এই উদ্ভট লোক ক্যাকটাস লাগিয়ে রেখেছে। তাছাড়া মাহা অ্যাকুরিয়ামে গোল্ড ফিশ, গাপ্পি, অ্যাঞ্জেল ফিশ, ফ্লাওয়ারহর্ন ফিশ পছন্দ করে। কত সুন্দর লাগে দেখতে। মাহারও একটা গোল্ড ফিশ ছিলো। কিন্তু এখানে অ্যাকুরিয়ামে কালো কালো কিসব মাছ রাখা। মাহা বিরক্ত হলো খানিকটা। পাশে একটা অদ্ভুত ক্যাকটাসের মতো তবে ক্যাকটাস না এমন একটা গাছ দেখতে পেলো মাহা।
৫৯.
মাহা হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখতে গেলো তাদের। কিন্তু তার আগেই ওর হাত টেনে নিজের হাতে পুরে নিলো সার্থক। চোখেমুখে উৎকন্ঠা। মাহা ভয় পেলো খানিকটা।
“এসব গাছে কখনো হাত দিবেনা।”
“কেন?”
“এই যে এখন যে গাছে হাত বাড়াতে যাচ্ছিলে এটা ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ।”
মাহা নিজের গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে সার্থকের পানে। কোঁকড়া চুলগুলো ছেড়ে রাখা। হলদে ফর্সা মুখটা কি যে আদুরে লাগছে। সার্থকের ইচ্ছে করছে টুপ করে খেয়ে ফেলতে কিংবা গালে একটু আদর দিতে। নিজের ইচ্ছেটাকে দমন করলো সে। ভারী পুরুষালি কন্ঠে বললো,
“তুমি জানো ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ কি?”
মাহা মাথা নাড়লো। যার অর্থ মাহার জানা নেই।
“ঠিক আছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকবে গাছটার দিকে।”
মাহা আগামাথা কিছুই বুঝলোনা। সার্থক কি বুঝাতে চাচ্ছে! মাহা কিছু বলবে তার আগেই তার ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে কথা বলতে নিষেধ করলো সার্থক। মাহা চুপ করে গেলো। সার্থক চোখের ইশারা করলো ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ গাছগুলোর দিকে তাকাতে। মাহা সেদিকে তাকাতেই আৎকে উঠলো। গাছগুলো এতক্ষণ মুখবন্ধ করে শান্ত অবস্থায় ছিলো। হঠাৎ একটা মৌমাছি উড়ে আসতেই হা করে ধারালো কাঁটা বের করে খপ করে মৌমাছিটাকে নিজের ভিতর নিয়ে নিলো একটা ভেনিস ফ্লাইট্র্যাপ ট্রি। ঘটনাটা ঘটেছে খুবই দ্রুত। মাহা এখানো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ মৌমাছির জায়গায় যদি তার আঙুল থাকতো! ভাবতেই গাঁ শিউরে উঠছে তার।
“দেখেছো। এরা কত ভয়াবহ।”
মাহার খুব বলতে ইচ্ছে করছে এতো ভয়াবহ গাছ বাড়িতে রাখার কি প্রয়োজন! যে কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। কিন্তু মুখে কিছুই বললোনা। এ বাড়িতে এসেছে একদিনও হয়নি এখনই যদি সে অধিকার দেখাতে শুরু করে ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। তাছাড়া বাড়িঘর দেখে বুঝাই যায় সার্থক অনেক বড়লোক। ধনী লোকদের এমন অদ্ভুত ইচ্ছে থাকে। যা মাহা প্রতিনিয়ত টিভি, ফেসবুকে দেখে আসছে। মাহাকে আর ভাবার সুযোগ না দিয়ে সার্থক বললো,
“এসব গাছ আমার বাগানে রাখার কোনো ইচ্ছেই ছিলোনা। কানাডায় আমার ছোট একটা ক্যাকটাস বাগান ছিল। সেই অনুযায়ী এখানেও করি। মুইংচিন আমাকে এই ট্র্যাপ গাছ তিনটি উপহার স্বরূপ দিয়েছে। তারমতে এই ফ্লাইট্র্যাপ ট্রি আমাকে সবসময় সতর্ক রাখবে। গোপন শত্রুর কথা স্মরণ করিয়ে দিবে। ও এতো শখ করে দিলো আমি তাই আর ফেলতে পারিনি।”
সার্থক বলে চললো একটানা। মাহা জানেনা কেন তবে সার্থকের তার কাছে সাফাই দেওয়ার বিষয়টি ভিষণ উপভোগ করেছে সে। কখনো কেউ তো এভাবে তার কাছে সাফায় দেয়নি। কারো জীবনে মাহা কোনো সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিলোনা। তাহলে আজ সামনে দাঁড়ানো এত সুদর্শন, স্মার্ট লোকটা তার কাছে সাফাই গাইছে কেন! মাহা কি সত্যিই তার বিশেষ কেউ?
“মাহা শুনছো?”
“হুম?”
“তুমি কি রাগ করেছো?”
“উঁহু।”
“আমি আজই এই গাছগুলো অন্যজায়গায় রাখার ব্যবস্থা করাবো।”
“সেসবের প্রয়োজন নেই সার্থক। আপনি প্লিজ এতোটা বিচলিত হবেন না।”
মাহার কথায় খানিক আস্বস্ত হয় সার্থক। বাইরে হালকা রোদ উঠেছে। খোলা বারান্দা হওয়ায় দুয়েকটা চড়ুই পাখি ভিতরে ঢুকে নিচে বসে রোদ পোহাচ্ছে।
৬০.
সার্থক হঠাৎ করেই টাউজারের পকেট থেকে একটা আংটির বক্স বের করলো। মাহার দিকে তাকিয়ে ডান হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
“তোমার হাতটা একটু দাও মাহা।”
সার্থকের আড়ষ্ট ভঙ্গির এমন ডাকে মাহাও লজ্জা পেলো। মাথা নিচু করে বাম হাত এগিয়ে দিলো সে। সার্থক মাহার অনামিকা আঙুলে একটা ডায়মন্ডের আংটি পরিয়ে দিলো। কতক্ষণ সেদিকপানে তাকিয়ে বললো,
“আমাদের যাত্রা শুরুর চিহ্নটা তোমার আঙুলে পরিয়ে দিলাম মাহা। কখনো এই আংটিটা খুলো না।”
সার্থক হাত ছেড়ে দিয়েছে। মাহা তাকিয়ে রইলো আংটিটার দিকে। একধ্যানে। শুরু হলো কি তবে একটা আঁধার আলোর খেলার?
“ভাইয়া? ভাবিকে একটু ছাড়ো এবারে। আমাদের সাথেও গল্প করার সুযোগ দাও। নাকি তোমার বউকে শুধু তুমি নিজের কাছেই রাখবে?”
নিভার কথায় মুচকি হাসলো সার্থক। নিভা মজার ছলে সার্থকের মনের কথাটাই বলেছে। সার্থক সত্যিই পারলে মাহাকে সারাক্ষণ নিজের কাছেই রাখতো। নিভা এবার মাহাকে বললো,
“ভাবি, চলো আমার ঘরে। তোমার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করি।”
মাহা কি বলবে বুঝতে পারছেনা। নিভা মেয়েটাকে তার কাছে ভালোই লেগেছে। হাসোজ্জল থাকে সবসময়। কথায় অনেক মাধুর্য। মাহার সাথে হয়তো আজই প্রথম পরিচয়। অথচ এমন ব্যবহার করছে যেন বহুদিনের চেনাজানা। সার্থকের ফোন বেজে উঠতেই রিসিভ করলো সে। মাহা তার পানে তাকিয়ে আছে। হয়তো অনুমতি চাচ্ছে। নিভার সাথে যাবে কি যাবেনা। সার্থক মাহাকে কিছু বললোনা। নিভার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার ঘরে বসে গল্প করো তোমরা।”
“আচ্ছা, ভাইয়া।”
ঘরে বসে অনেকটা সময় গল্পে গল্পে কাটলো মাহার। নিভা প্রচুর কথা বলে। মাহা স্বল্পভাষী মানুষ। দুয়েকটা উত্তর দেওয়া আর কথা জিজ্ঞেস করা ছাড়া সে বিশেষ কিছুই বলতে পারলোনা। একসময় ঘুমিয়ে গেলো মাহা।
________________
চারপাশে অন্ধকার। একটা রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটছে মাহা। আশেপাশে বিশাল জঙ্গল। চৈতির চিৎকার হঠাৎ কানে বেজে উঠলো মাহার। মাহা দিকবিদিকশুন্য হয়ে খুঁজতে শুরু করলো চৈতিকে। তবে নেই। চৈতি নেই।
হাঁটছে মাহা। হাঁটতে হাঁটতেই ফোন বেজে উঠলো তার। সেই পুরানো স্মার্টফোন টা। একটা কল এলো। চৈতি কথা বলছে। কি বলছে জানেনা মাহা। তারপর….
তারপর আর মনে নেই। অন্ধকার আর অন্ধকার। মাহার ঘুম ভাঙলো সার্থকের ডাকে। নরম সুরে ডাকছে,
“মাহা, এই মাহা উঠো।”
মাহা তখনও চোখ বুজেছিলো। হঠাৎ সার্থকের ঠোঁটজোড়ার অস্তিত্ব নিজের কপালে অনুভব করতেই লজ্জা পেলো মাহা। সার্থক এখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মাহার কি যে লজ্জা লাগছে! তার গাল গুলো বোধহয় লাল হয়ে যাচ্ছে। এতোক্ষণ ঘুমিয়ে থাকলেও এবার ঘুমের ভান করে আছে মাহা। সার্থকের এহেন কাজে তার যে ভিষণ লজ্জা লাগছে। এখন সে কি করে সার্থকের সামনে মুখ দেখাবে।
সার্থক আবার মাহাকে আলতো করে নরম সুরে ডাকলো,
“মাহা, এই মাহা উঠো।”
মাহা মনে মনে বললো,
“উঠবোনা ডাক্তার। আপনি এখানে থাকা অবস্থায় চোখ খোলা আমার পক্ষে সম্ভব না।”
(চলবে)
#অলকানন্দা
#পর্ব-২১
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৬১.
কাকের মতো সরু মুখ, মাথায় গজানো অনেকগুলো হরিণের ন্যায় শিং। সাদাকালো ছবিটায় অদ্ভুত মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট একটা প্রাণী। নখগুলো বড় বড়। নখগুলো লাল, ঠোঁটও লাল। একটা জঙ্গলের ভিতর স্থির হয়ে বসে প্রাণীটা। দেখে মনে হচ্ছে শিকারের জন্য ওৎ পেতে আছে। পূর্ণিমার রাত। প্রাণীটার পিছনে কালো আঁধারে ঢাকা জঙ্গল। আকাশে বৃহদাকার চাঁদ। মাহা একধ্যানে তাকিয়ে ছবিটা দেখছে। গাঁ হঠাৎ শিউরে উঠলো তার। দুতালায় বদ্ধ ঘরটার পাশে দেয়ালে টানানো ছবিটা। নিচে ছোট করে কি যেন লেখা। মাহা কাছে এগিয়ে গেলো পড়তে।
“ওয়েনডি……
আর পড়তে পারলোনা মাহা। ঘরে ফোন বাজছে। সময়টা বিকেল। দুতালায় আপাতত কেউ নেই। সেসময় মাহাকে ডেকে তুলে বেরিয়েছে সার্থক। মাহার হঠাৎ খেয়ালে এলো সে তো রেজওয়ান কে গুলশান আসতে বলেছিলো বিকালে। রেজওয়ান কে মাহা নিজের বড় ভাই হিসেবে মানে। আপন না হোক ছোট থেকেই অনেক সাহায্য করেছে তাকে। বিয়ের মতো এত বড় একটা সময়ে রেজওয়ান উপস্থিত থাকলে খানিক বল পাবে মাহা, প্রথমে ভেবেছিলো বাইরে দেখা করবে। পরে ভাবলো বিয়েতে তার পক্ষেরও কেউ থাকা দরকার। বাবার মৃত্যুর শোক ভুলানো কঠিন। আশ্চর্যভাবে সার্থক পাশে থাকলে মাহা সব ভুলে যায়। কষ্ট লাঘব হয় তার। তখন মনে এসে ভিড় করে একরাশ লজ্জা। ছবিটার লেখা আর পড়তে পারলোনা সে। এগিয়ে গেলো ঘরের দিকে। কিন্তু তার আগেই ল্যান্ডফোন বেজে থেমে গিয়েছে। নিভার সাথে দেখা করার প্রয়োজনবোধ করলো মাহা। ঠিকানা নেওয়া প্রয়োজন। এই জায়গাটা যে গুলশান তাই জানতোনা সে। সার্থকের মুখে শুনেছে। তাই রেজওয়ান কে বলেছিলো গুলশান আসতে। কিন্তু সকালের পর আর কোনো খবরই ছিলোনা রেজওয়ানের। মাহা ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নামলো। নিভা, সার্থক, মুইংচিন কাউকেই খুঁজে পেলোনা। একজন বৃদ্ধ বয়সী পরিচারিকা রাজকীয় সোফার পাশে রাখা ছোট টেবিল গুছিয়ে রাখছিলেন। তার কাছে এগিয়ে গেলো মাহা। নরম কন্ঠে বললো,
“শুনছেন?”
বৃদ্ধ পরিচারিকা জবাব দিলেন না। তার পরনে একটা কালো ঢোলা পোশাক। একেবারে পা পর্যন্ত। সাদা উড়নাটা মাথায় পেঁচিয়ে রেখেছেন তিনি। শান্ত, অবিচল তার ভাবভঙ্গি। মাহা পিছন থেকে আবার ডাকলো,
“আন্টি, একটু প্রয়োজনীয় কথা ছিলো।”
এবারেও বৃদ্ধ মহিলা চুপ। তখনই সদর দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো লুবান। মাহার মাথা, চুল সবকিছু লাল উড়না দিয়ে ঢাকা। মাহা জানেনা কেন তবে লুবান কে পছন্দ হয়নি তার। কেমন যেন দৃষ্টি। কিভাবে যেন তাকিয়ে থাকে। এই দৃষ্টিতে মাহা খুঁজে পায় লোলুপ হায়নাদের দৃষ্টি। লুবান কথা বলার সময় বারবার তার বুকের দিকে তাকিয়েছিলো সকালে। ব্যাপারটা তার চোখ এড়ায়নি। কিন্তু সার্থক হাসিমুখে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো বিধায় নিজেও মুখে হাসি রেখেছে। বড়ই অস্বস্তি হচ্ছিলো তার। লুবান মুখে হাসি ফুটিয়ে মাহার দিকে এগিয়ে এলো। বৃদ্ধা ততক্ষণে সে স্থান ত্যাগ করেছেন। বাড়িটা বিশাল বড়। নিচে ড্রয়িং রুমটা বৃহৎ।
“ভাবীজান? কোনো প্রয়োজন আপনার?”
বলেই ঈষৎ হাসলো লুবান। এমন ডাক শুনে ভড়কে গেলো মাহা। মাথা নিচু করে বললো,
“না।”
“যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে বলবেন ভাবীজান। সার্থক না থাকলেও আমি আছিতো। আপনার সব প্রয়োজন পূরণ করে দিবো। তাছাড়া….
লুবানের কথায় ব্যাঘাত ঘটালো নিভা।
“লুবান ভাইয়া। ঘরে যান। আপনার জন্য একটা পার্সেল আসছে।”
“হুম, যাই।”
লুবান প্রস্থান করার আগে মাহার বুকের দিকটায় আবার তাকালো। গাঁ গুলিয়ে আসছে মাহার। এমন লোকের সাথে এবাড়িতে কি করে থাকবে সে!
৬২.
“নিভা আপু?”
“জ্বি, ভাবী?”
“উনি কোথায়?”
“কে? সার্থক ভাইয়া?”
“হুম।”
নিভা মুচকি হাসলো। আস্তে করে বললো,
“তোমার উনি কেনাকাটা করতে গিয়েছে। বিয়ের দিনে বউ মানুষ বেনারসি না পরলে বড্ড বেমানান দেখায়। আমি বলেছিলাম কাউকে পাঠাতে। কিন্তু ভাইয়া মানেনি।”
নিভা বয়সে মাহার থেকে অনেক বড়। তাই মাহা তাকে আপু বলেই ডাকে। নিভা ততক্ষণে সোফায় গিয়ে বসেছে। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই ড্রয়িং রুম। সেখানে রাজকীয় কায়দায় ডিজাইন করা সোফা রাখা। দামী আসবাব, উপরে ঝালরে সজ্জিত অসম্ভব সুন্দর ঘর। নিভা সোফায় বসে নিজের সোনালী চুলগুলো ঠিক করতে করতে বললো,
“ভাবী, বসো। একটু গল্প করি।”
মাহা বসলো।
“আপু, এই জায়গার ঠিকানাটা কি একটু দেওয়া যাবে?”
মাহার কথায় খানিক অবাক হলো নিভা। তৎক্ষনাৎ অবাক ভাব কাটিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“অবশ্যই দেওয়া যাবে। কোনো প্রয়োজন ছিলো?”
একটু কেমন যেন শুনালো নিভার গলা।
“না, মানে। আমার একজন পরিচিত আসবেন।”
“সার্থক ভাইয়ার পারমিশন নিয়েছো?”
“মানে?”
“আসলে ভাইয়া বাইরের মানুষ বাড়িতে বেশি একটা এলাউ করেনা।”
“উনি আমার খুবই কাছের একজন বড় ভাই। আমার বিয়েতে আমার পক্ষ থেকেও কেউ একজন থাকা উচিত। তাই আর কি….
মাহার নরম সুর। নিভা মুচকি হেসে বললো,
“এই ভাবী। রাগ করলে। আমি এমনি বলেছি।”
অতঃপর ঠিকানা বললো নিভা। মাহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উপরে উঠে এলো। একা থাকার অভ্যাস তার আছে। সেই সাথে অবাধ স্বাধীন মেয়ে মাহা। সার্থকের রুমে প্রবেশ করে রেজওয়ান কে কলো দিলো সে।
“হ্যালো, হ্যালো মাহা তুমি ঠিক আছো? আমাকে ক্ষমা করো মাহা। তখন আসছি বলেও আসতে পারিনি। এত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ পড়ে গিয়েছিলো। চিন্তা করোনা মাহা। আমি এখন গুলশান আসছি। যেখানেই থাকোনা কেন! তোমায় আমি উদ্ধার করবো মাহা। আমার বাসায় থাকবে তুমি।”
এক নিশ্বাসে কথাগুলো সারলো রেজওয়ান। মাহা তাকে থামিয়ে বললো,
“বিচলিত হবেন না ভাইয়া। আমি ঠিক আছি। আজ জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি, ভাইয়া। আপনি উপস্থিত থাকলে আমি বল পাবো। আপনাকে ছোট থেকেই বড় ভাই মেনে আসছি।”
রেজওয়ান চিন্তায় পড়ে গেলো খানিকটা। কিসের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত! কি করতে চলেছে মাহা!
“তুমি কিসের কথা বলছো মাহা?”
“আপনাকে ঠিকানা জানিয়ে দিচ্ছি। আপনি আসুন ভাইয়া। তারপর না হয় বিস্তারিত বলবো।”
“ঠিক আছে।”
ঠিকানা বলে ফোন কাটতেই ঘরে ঢুকলো সার্থক। গাঁয়ে কালো রঙের শার্ট। ডেনিম প্যান্ট। ঝাঁকড়া চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করা। গালে হালকা দাঁড়ি। মাহা একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। অবচেতন মস্তিষ্ক না চাইতেও ভাবছে, কেন সার্থক তাকে মেনে নিচ্ছে! কেন তাকে আশ্রয় দিচ্ছে? ওর মতো এতিম, চালচুলোহীন মেয়েকে সার্থকের মতো এতো বড় মাপের একজন প্রতিষ্ঠিত ডক্টর কেন বউ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাইছে? এটা কি তবে করুণা? শেষ পর্যন্ত মাহা কারো করুণার পাত্রী হলো! শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে মাহার দিকে এগিয়ে এলো সার্থক। শপিং ব্যাগগুলো এগিয়ে দিয়ে বললো,
“বেশি কিছু কিনতে পারিনি। তোমারও মন ভালোনা। এসব ভালোলাগবে না। একটা লাল বেনারসি আর কিছু গহনা এনেছি। কষ্ট করে একটু পরবে? মন না চাইলে দরকার নেই।”
সার্থকের গম্ভীর, ভারী সুরটা নরম, আকুতিভরা ঠেকলো মাহার কানে।
৬৩.
“ঠিক আছে। কিন্তু আমি শাড়ি পরতে পারিনা।”
হাসি ফুটে উঠলো সার্থকের মুখে। চুলগুলো ডানহাতে পিছনে ঠেলে বললো,
“নিভা পরিয়ে দিবে।”
রাত হয়ে এসেছে। সোফায় বসে আছে রেজওয়ান। এত বড় বাড়িতে মাহা কি করে এসেছে ভেবে পেলোনা রেজওয়ান। কলিং বেল চাপতেই একজন তরুণী সদর দরজা খুলে দিয়েছিলেন। তার পরনে পুলিশ ইউনিফর্ম। তরুণী কিছু না বলেই সরে দাঁড়িয়ে তাকে ঘরে ঢুকতে দিয়েছে। সোফায় বসার কথা বলে কোথায় যেন চলে গেলো। পাঁচ মিনিট যাবত সোফায় বসে আছে সে।
“জ্বি, আপনি কার সাথে দেখা করতে এসেছেন?”
নিভার প্রশ্নে রেজওয়ান বললো,
“একটু মাহাকে ডেকে দিন।”
“আপনি একটু অপেক্ষা করুন। ভাইয়া, ভাবী আর কিছুক্ষণ পরেই নিচে নামবে।”
কথায় যেন দাম্ভিকতা ফুটে উঠলো। রেজওয়ান চুপ করে বসে আছে। ভাবী মানে! কিসের ভাবী!
আস্তে আস্তে ড্রয়িং রুমে মানুষ বাড়ছে। রবার্ট, মুইংচিন, লুবান, নিভা, দুইজন পরিচারিকা, তিনজন পুরুষ কাজের লোক। মুইংচিন কিছুক্ষণ আগেই কাজী নিয়ে এসেছে। ঝালরের আলোয় ঝকঝক করছে চারপাশ। রবার্ট, লুবান কুশল বিনিময় করেছে রেজওয়ানের সাথে। সেও করেছে। কিন্তু কিছুই তার চৌকস মস্তিষ্কে ঢুকছেনা। হচ্ছে কি এসব! মোবাইলেও চার্জ নেই। এসব ভাবনার মাঝেই লাল টকটকে শাড়ি পরে হালকা সাজে সার্থকের পিছু পিছু সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলো মাহা। রেজওয়ান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এমন বউ সাজে মাহাকে সে কতরাত স্বপ্ন দেখেছে হিসেব নেই! মাহার হাত ধরে সার্থক হাসিমুখে রেজওয়ানের সামনে এসে দাঁড়ালো। বউ সাজে মাহার পাশে সার্থক কে দেখে অনেক অবাক হয়েছিলো রেজওয়ান।
“খুব খুশি হয়েছি মিঃ রেজওয়ান । আপনি এসেছেন। মাহার তরফ থেকেও তো কেউ থাকা প্রয়োজন ছিল। আপনি বড় ভাই হয়ে না হয় থাকলেন। কি বলো মাহা?”
মাহা মাথা নিচু করে বললো,
“জ্বি?”
রেজওয়ান অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছে। বিয়ে! তাও সার্থকের সাথে! কোনো কিছু বলার সুযোগই পেলোনা সে। চোখের সামনে বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে গেলো। নিজের ভালোবাসার মানুষ কে অন্যের হতে দেখে বুকটায় অসহনীয় ব্যথা করছে রেজওয়ানের। মাহা! যদি তুমি জানতে আমি তোমায় ঠিক কতটা ভালোবাসি! আমি তোমায় পেলাম না মাহা। আমার যে অনেক কষ্ট হচ্ছে! উপরে হাসিখুশি দেখালেও ভিতরে ভিতরে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে রেজওয়ান। সার্থকের ঠোঁটে ঈষৎ হাসি।
(চলবে)