অলকানন্দা #পর্ব-২৫,২৬,২৭

0
538

#অলকানন্দা
#পর্ব-২৫,২৬,২৭
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
২৫

৭৩.
রেজওয়ান আজ এসেছে মাতব্বর শরীফের সাথে দেখা করতে। মাতব্বর কে সেলে রাখা হয়েছে। সাধারণত ফাঁসি প্রাপ্ত আসামিদের এই সেলে রাখা হয়। চারিদিকে অন্ধকার। ছোট একটা ঘর। আলো-বাতাসের বালাই নেই। রেজওয়ান ভিতরে প্রবেশ করবেনা। দাগী আসামি পাশাপাশি সিরিয়াল কিলার। রেজওয়ানের যথেষ্ট সাবধানী হয়ে কথা বলতে হবে। শিকের এপাড়ে রেজওয়ান ওপাড়ে মাতব্বর। তিনি আছেন কিংবা থেকেও নেই। নিঃশ্বাসের শব্দও আসছেনা।
“মাতব্বর সাহেব।”

এপাড় থেকে ঢাকলো রেজওয়ান। জেলার সাহেব আসতে চেয়েছিলেন। রেজওয়ান মানা করে দিয়েছে। রেজওয়ান আবার ডাকলো।

“আমি জানি, আপনি জেগে আছেন। সাড়া দিন মাতব্বর সাহেব।”

নিস্তব্ধতা। রেজওয়ান আরো দুবার ডাকলো। কাজ হয়নি। এবারে কৌশলী হলো রেজওয়ান।

“মিসেস রুৎবা। মিসেস রুৎবা আপনার স্ত্রী না মাতব্বর সাহেব?”

এবার খানিকটা গোঙানির শব্দ ভেসে এলো কানে। রেজওয়ান আবার বললো,
“ফয়সাল। আপনার ছেলে। সিলেট এমসি কলেজের ছাত্র ছিলোনা? চোরাবালি তে ডুবে মারা গেলো? মাতব্বর সাহেব? আপনার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করেনা?”

অন্ধকার থেকে ভেসে এলো কুঁকড়ে যাওয়া, ভিতু একখানা সুর। আঁতকে উঠলো রেজওয়ান। কেমন অশরীরীর ন্যায় হৃদ কাঁপানো সুর।
“না।”
“কেন?”
“চাইনা।”

উঁচু গলার আওয়াজ। রেজওয়ান হাল ছাড়লোনা। আপাতত তার কাছে আর কোনো পথ খোলা নেই। মাহা, চৈতির মোবাইল, কল ট্রেক করেও কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমন কখনো হয়নি রেজওয়ানের। এই অল্প দিনের ক্যারিয়ারে প্রতিটা কেস অল্প সময়ে খুবই দক্ষতার সাথে সমাধান করেছে সে। হাতে সময় আর মাত্র পাঁচদিন। প্রলয়ের কাছ থেকে একমাস সময় নিয়েছিলো রেজওয়ান। ছুটে গিয়েছিলো সিলেট। সেখানে মাতব্বর শরীফের এক চমকপ্রদ অতীত সামনে এসেছে তার। রুৎবা পাগলীর কথাও শুনে এসেছে। কিন্তু বিগত কয়েকদিন যাবত পাগলীকে পাওয়া যাচ্ছেনা! স্ট্রেঞ্জ! যে বা যারা এই ঘটনার পিছনে আছে তারা জানলো কি করে রেজওয়ান সিলেট যাবে? তার যাওয়ার একদিন আগে থেকেই রুৎবা গায়েব। রুমানার বাড়ি ভালো করে ইনভেস্টিগেশন করা হয়েছে। সন্দেহভাজন কোনো কিছুই পায়নি। একদিকে প্রেয়সী হারানোর শোক অপরদিকে দায়িত্ব। অথৈ সাগরে পড়েছে রেজওয়ান। টুকটাক সন্ধান চালাতে চালাতে হাতের একমাস প্রায় শেষের দিকে চলে এলো। শেষ সুযোগটা নিলো রেজওয়ান। গণমাধ্যমগুলোতে বারবার ছিন্ন পা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু ২০১২ এর ন্যায় পরপর অনেক ছিন্ন অংশ না পাওয়া যাওয়ায় সাময়িক ধামাচাপা পড়েছে খবরটা।
“চলে যান। চলে যান। কাউকে চাইনা আমার।”

মাতব্বর শরীফের ভয়ানক চিৎকারে ধ্যান ভাঙে রেজওয়ানের। দাগী আসামিদের ক্ষেপাতে নেই। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তারা ভয়াবহ হয়ে উঠে।
“আপনি শান্ত হোন। আমি আপনার বন্ধু।”

হা হা। হাসির জোয়ার বয়ে গেলো। গগন কাঁপানো, হৃদয়ে অদ্ভুত শিরশিরে অনুভূতির হাসি। হঠাৎ থেমে গেলো সে হাসি। গম্ভীর হলো সুর।
“চলে যান। আমি খারাপ। খুব খারাপ।”
“আমি জানি আপনি খারাপ নন মাতব্বর সাহেব।”
“চলে যান। চলে যান।”
“আজ যাচ্ছি। আবার কিন্তু ফিরবো আমি।”

রেজওয়ান কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে এলো। সে আবার আসবে। আর কোনো রাস্তা তো হাতে পাচ্ছেনা। মাতব্বর শরীফের মনে একটা ছাপ সৃষ্টি করেছে কেবল। ভিতরে ঢুকা বাকি!

৭৪.
আজ আবার এশার সাথে দেখা হলো রেজওয়ানের। মাহা চলে যাওয়ার পর থেকে তাদের বাড়িতে রেজওয়ান আর যায়নি। ইচ্ছে জাগেনা। যার জন্য যেতো সেই তো নেই। এশা মেয়েটা রাস্তায় বসে আছে। চোখ-মুখ বিধ্বস্ত তার। রেজওয়ান জরুরি ফোনে কথা বলবে বলে গাড়িটা থামিয়েছিলো। তখনই মেয়েটাকে দেখতে পেলো সে। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। এশা মাথা নিচু করে পায়ে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।
“এই তুমি এশা না?”

এতদিন পর। এতটা দিন পর প্রিয় মানুষটার আওয়াজে হৃদযন্ত্রের কার্যক্রম বেড়ে যাচ্ছে দ্বিগুণ হারে। সেই সাথে জড়ো হচ্ছে একগুচ্ছ অভিমান। মাথা নুইয়েই রইলো এশা। রেজওয়ান বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,
“কথা বলছোনা কেন? তুমি এশা?”
“হু।”

আস্তে করে বলে এশা। চোখে, মুখে ব্যথার ছাপ।
“এখানে এভাবে বসে আছো কেন?”
“চোর আমার ব্যাগ নিয়ে গেছে। দৌড়াতে গিয়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছি।”

এশার স্বীকারোক্তি। রেজওয়ান অবাক না হয়ে পারলোনা। দুনিয়ার সব চোর কি খালি এই মেয়েটার থেকে চুরি করে। স্ট্রেঞ্জ! এর আগেরবারেও এমন হয়েছিলো।
“হাঁটতে পারবে?”
“তাহলে কি এখানে বসে আছি?”

চিবিয়ে চিবিয়ে বললো এশা। রেজওয়ান অবাক না হয়ে পারলোনা। এতটুকু একটা মেয়ে আর তার সাথে তেজ দেখাচ্ছে! এএসপি রেজওয়ানের সাথে। আশ্চর্য!
“পায়ে বেশি ব্যথা পেয়েছো? হসপিটাল নিতে হবে?”

এশা মনে মনে বিরক্ত হচ্ছে। আচ্ছা লোকটা কি অবুঝ? বুঝেনা কিছু? এই লোক কি করে এতবড় পুলিশ অফিসার হলো বুঝে পায়না এশা। সে কি নিজে থেকে বলবে নাকি। হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি অসুস্থ। আমাকে হসপিটাল নিয়ে যান! বেকুব!

“এই মেয়ে কথা বলো।”
“হু”

রেজওয়ান আর কথা বাড়ালোনা। একটানে এশাকে দাঁড় করালো। কিন্তু ব্যথায় চিৎকার করে উঠলো এশা। চোখ মুখ খিঁচে রইলো।

“বেশি কষ্ট হচ্ছে?”
“হু।”

এই মেয়ে কি হু হা ছাড়া কথা জানেনা! অদ্ভুত! কথা না বাড়িয়ে এশাকে কোলে তুলে নিলো রেজওয়ান। মেয়েটা অসুস্থ। রেজওয়ানের কাছে দায়িত্ববোধ সবার আগে। এশা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রেজওয়ানের পানে। চোখ বেয়ে এক ফোঁটা নোনতা জল গড়িয়ে পড়েছে তার। বিড়বিড় করে বললো,
“ভালো যদি নাই বাসেন তবে কেন মায়া বাড়াচ্ছেন?”

৭৫.
নিজের ক্যাম্পাস, নিজের হল, নিজের ক্লাসরুম। আপন আপন ঘ্রাণ সর্বত্র। মাহা প্রাণভরে শ্বাস নিলো। দীর্ঘদিন পর প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরেছে সে। সাথে রুমানা আছে। কিন্তু নেই কেবল চৈতি। খানিকক্ষণ আগেই সার্থক মাহাকে ক্যাম্পাসে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছে। অনেক তো হলো বাড়িতে থাকা। আজ প্রায় দুমাস যাবত মাহা সার্থকের বাড়িতে আছে। ঘরে থাকতে আর ভালোলাগছিলোনা তার। তাই সার্থকই তাকে আবার ক্লাস শুরু করার কথা বলে। মাহাও দুরুক্তি করেনি। এভাবে বন্দি জীবন কাটাতে তারও ভালোলাগছেনা। রুমানা পাশে আছে। এটা সেটা বলছে। টুকটাক কথা বলছে। মাহার গানের গলা ভালো। তাই তাকে কোকিল বলে ডাকে রুমানা। চৈতিকে ডাকতো টুকি বলে। কিন্তু টুকি তো আর নেই। রুমানারও খুব খারাপ লাগছে। ক্লাস করার পর বুকটা ফাঁকা লাগছে মাহার। এই ভার্সিটিতে আসার পর থেকে চৈতি তার বেস্ট ফ্রেন্ড। আজ সেই ভালো বন্ধুটা সাথে নেই। যেদিকে তাকায় মাহা কেবল তারই স্মৃতি। মাহা দিশেহারা হয়ে উঠলো। দম বন্ধ লাগছে তার। চোখের সামনে ভেসে উঠছে মর্গ, চৈতি, ছিন্ন পা। না, আর নিতে পারছেনা মাহা। রুমানা সব খেয়াল করে বললো,
“তোর কি খারাপ লাগছে কোকিল?”
“আমি, আমি বাড়ি ফিরবো রুমানা।”

বলেই নিজের মোবাইলটা রুমানার পানে বাড়িয়ে দিলো মাহা। কাতর কন্ঠে বললো,
“একটু সার্থককে কল করে আসতে বল। আমার কষ্ট হচ্ছে।”

ফোন পাওয়ার কিছুক্ষণের মাঝেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে সার্থক। মাহা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে। সার্থক দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বললো,
“কি হয়েছে তোমার? মাহা। বেশি কষ্ট হচ্ছে?”

মাহা সার্থক কে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমার ভিষণ কষ্ট হচ্ছে সার্থক।”

মাহা জ্ঞান হারালো।

চলবে…

#অলকানন্দা
#পর্ব-২৬
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৭৬.
একটা রাস্তা। আলো-আঁধারে নির্মিত। দেখতে অনেকটা কংক্রিটের রাস্তার মতোই। দুপাশে গাছগাছালির হিড়িক। মাথার উপরে আকাশের কোনো রং নেই। নেই মানে নেই। কিংবা থাকলেও সেটা কি রং মাহা ঠাউর করতে পারছেনা। মাহা হাঁটছে। কখনো কড়া রোদে তার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে কখনোবা অনেক অন্ধকারে মনে হচ্ছে মাহা তলিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই চৈতির প্রতিচ্ছবি। কি সুন্দর মুখের গঠন! চুলগুলো ভিষণ সুন্দর। গাঁয়ে লালচে শাড়ি। উদাসীন হয়ে হাঁটছে রাস্তায়। মাহার চোখের কাছেই আবার মনে হয় যোজন যোজন দূরে। মাহা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। খুব জরুরি কথা আছে তার চৈতির সাথে। মাহা ডাকলো “চৈতি”। কিন্তু সে আওয়াজ শোনা গেলোনা। অতঃপর মাহা আবার ডাকার চেষ্টা করলো। গলায় মনে হচ্ছে কেউ দড়ি বেঁধে দিয়েছে। কোনো আওয়াজ বের হচ্ছেনা। বাকযন্ত্র শব্দ সৃষ্টির প্রক্রিয়া ভুলে গিয়েছে। মাহা বহু চেষ্টা করেও মনে করতো পারলোনা কি করে শব্দ উচ্চারণ করতে হয়। কি করে ভাষাকে প্রকাশ করতে হয়। কষ্ট হচ্ছে তার। ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। কি আশ্চর্য! সে কথা বলা, শব্দ উচ্চারণ করা ভুলে গিয়েছে! আলোর তীব্রতা বেড়ে গেলো বহুগুণে। কানে বাজলো একটা সুর। মাউথ অর্গানের সুর। খুব পরিচিত মনে হলো সুরটা। কয়েকবার এই সুর শুনেছে সে। আবার অন্ধকার ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছু সময় অতিক্রম হওয়ার পর একটা বালুচরে নিজেকে আবিষ্কার করলো মাহা। দূর-দূরান্তে কেবল বালু আর বালু। হালকা সোনালি রঙের বালুতে চিকচিক করছে চারদিক। এবারও চৈতি দাঁড়িয়ে। দূরে। মুখটা অস্পষ্ট। মাহা এগিয়ে গেলো তার দিকে। হাত বাড়াতে চাইলো। তবে চৈতি দূরে চলে গেলো আবার। হঠাৎ ক্ষীণ সুর ভেসে আসছে মাহার কানে।
“মাহা? কেমন আছিস?”

মাহা কোনো কথা উচ্চারণ করতে পারলোনা। সে তো কি করে শব্দ উচ্চারণ করে বাক্য বলতে হয় তা ভুলে গিয়েছে। চৈতি মৃদু হাসলো। আবার জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন আছিস?”

এবারে মাহা চুপ। এবার রেগে গেলো চৈতি। অদ্ভুতভাবে তার দেহ পরস্পর থেকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে মাথা, পরে হাত, পরে পা। ঐ যে মাহা যেমন ছিন্ন পা দেখেছিলো তেমন একটা পা মাহার দিকে ছুটে আসছে। চৈতির ছিন্ন মাথা হাসছে। মাহা ভয়ে চুপসে আছে। পা টা মাহার কাছাকাছি চলে এসেছে। মাহা দৌড় দিলো। পিছু ফিরে চাইলোনা আর। কিছুক্ষণের জন্য পা টা উধাও হয়ে গিয়েছে। মাহা থেমে একটু শ্বাস নিবে তখনই চতুর্দিক থেকে চৈতির পা গুলো তার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো। একেবারে কাছে আসতেই মাহা চিৎকার করার চেষ্টা করলো। এবার বাকযন্ত্র নিজের আগের রূপে ফিরে এসেছে। মাহার চিৎকার মাহা শুনতে পেলো। সেই সাথে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো মাহা। তড়তড় করে ঘামছে সে। পাশে চিন্তিত মুখে বসে আছে সার্থক। কিছু বলার চেষ্টা করছে। মাহা তো শুনতে পাচ্ছেনা! হঠাৎই সার্থক জড়িয়ে ধরলো মাহাকে। মাহা নিজেকে ধাতস্থ করলো এবার।

৭৭.

আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হলো মাহা। পরিচিত ঘ্রাণটা নাকে যেতেই সজাগ হলো নিউরন। কেঁপে উঠলো বুক। মনে হচ্ছে তার আর কোনো ভয় নেই। মানুষটা আছেনা পাশে! যে মাহার মন, মস্তিষ্ক, হৃদয়ে জায়গা করে নিচ্ছে ধীরেধীরে। মাহাও পরম নির্ভরতায় জড়িয়ে ধরলো সেই ব্যাক্তিটাকে। সার্থক চুমু খাচ্ছে মাহার এলোমেলো চুলে। গলার সুর নরম করে বললো,
“ভয় পেয়েছিলে?”
“ভিষণ।”
“কিসের ভয় মাহা? আমি আছি তো।”
“হুম।”

মাহার বাঁধন শক্ত হলো আরো। হঠাৎই নিভার শব্দে দুজন দুদিকে সরে বসলো। নিভা দরজার বাইরে থেকে প্রশ্ন করলো,
“ভাইয়া আসবো?”
“হুম, আসো।”

নিভা ভিতরে ঢুকে একনজর তাকালো মাহার পানে। সোনালী চুলগুলোকে কানে গুঁজে দিতে দিতে বললো,
“তুমি তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে ভাবি। এখন শরীর কেমন?”
“ভালো।”
সন্ধ্যা সাতটা বাজে। বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। রাস্তায় জ্বলে উঠছে সোডিয়াম লাইটগুলো। আবাসিক এলাকার আশপাশ নিরব। নিস্তব্ধ। নিভা সার্থক কে নিজের কাছে ডাকলো।
“ভাইয়া, একটু শুনবে?”

মাহা খাটে হেলান দিয়ে বসে। সার্থক অবাক হলো খানিকটা। নিভার কাছে এসে বললো,
“কোনো জরুরি কথা আছে কি নিভা?”
“ভাইয়া, জিনিয়া আপু এসেছে।”
“জিনিয়া! মানে ডক্টর জিনিয়া তাবাসসুম। আমার কলিগ?”
“হুম।”

সার্থক নিভার পানে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ এতরাতে এখানে কি ঐ মেয়ের। সার্থক মাহার দিকে তাকালো একবার। অতঃপর নিভাকে বললো,
“তুমি যাও।”
“ভাইয়া, উনি তোমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছেন।”
“হুম, যাও। আমি আসছি।”

গুরুগম্ভীর শোনালো সার্থকের গলা। মাহার খেয়ালে এসব নেই। ও খাটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। মাথাটা ভিষণ যন্ত্রণা করছে। সার্থক মাহার পাশে বসলো। মাহা নিজের মাথাটা হেলিয়ে দিলো সার্থকের কাঁধে। সার্থক মাহার হাতটা টেনে ধরে চুমু খেলো তাতে।
“তুমি আরেকটু ঘুমাও। আমি একটু আসছি।”

মাহা অপর হাতে আঁকড়ে ধরলো সার্থকের বাদামি টি-শার্ট। এই অল্প সময়েই মাহার সকল নির্ভরতা সার্থক। মাহার চোখে মুখে ভয়। সার্থক মাহার সমস্ত মুখে আদর করলো। অতঃপর মুখে বললো,
“এই যাবো এই আসবো সোনা। একটু থাকো। আমি নিভাকে ডেকে দিচ্ছি।”

আলগা হয়ে এলো শার্টের আঁকড়ে ধরা বাঁধন। সার্থক বেরিয়ে যেতেই নিভা ঘরে প্রবেশ করলো হাসিমুখে।

_________________

“কি প্রয়োজন?”
“তোমাকে।”

ভণিতা ছাড়াই বলে ফেললো জিনিয়া। সার্থক পাশের সোফায় বসে বললো,
“তাই নাকি!”

কন্ঠে কৌতুক তার। যেন জিনিয়ার কথায় খুব মজা পেয়েছে সে। পায়ের উপর পা তুলে তা নাচাচ্ছে সার্থক। জিনিয়াকে ভালো করেই চিনা তার।
“ঝেড়ে কাশো। কি প্রয়োজনে এসেছো?”
“প্রয়োজন তো বললামই। তোমাকে চাই।”

সার্থক উঠে এসে জিনিয়ার সামনে দাঁড়ালো। ডানহাতটা চেপে ধরলো জিনিয়ার গালে। মুখে হাসি দিয়ে বললো,
“আবার বলো তো জিনিয়া।”

জিনিয়া বহুকষ্টে বললো,
“তোমাকে।”

সার্থকের হাত আরো শক্ত হলো এবার। জিনিয়ার অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখ দিয়ে কয়েকফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার। সার্থক হাত শক্ত অবস্থায় রেখেই বললো,
“এতটুকুতেই কষ্ট হচ্ছে জিনিয়া?”

জিনিয়া জবাব দিতে পারলোনা। সার্থক ছেড়ে দিলো জিনিয়ার গাল। এমিলিন দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সার্থক ডাকলো,
“এমিলিন।”

এমিলিন কাছে এলেন। সার্থক জিনিয়ার পানে তাকিয়ে বললো,
“ম্যাডামের জন্য জুস নিয়ে এসো।”

এমিলিন কিছু না বলেই চলে যেতে নিলে সার্থক জিনিয়াকে প্রশ্ন করলো,
“তা কি খাবে সরি পান করবে জিনিয়া? রুহ আফজা নাকি কমলার জুস?”

জিনিয়ার কি হলো কে জানে উঠে দাঁড়ালো সে। পাশ থেকে ব্যাগটা নিয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।
“চলে যাচ্ছো যে?”

জিনিয়া কোনো প্রতুত্তর করেনি। সার্থক সেদিকে তাকিয়ে হাসলো খানিকক্ষণ। অতঃপর গম্ভীর হয়ে তাকালো এমিলিনের দিকে।

“ম্যাডামের জন্য স্যূপ করো এমিলিন।”

এমিলিন রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। আর সার্থক চললো নিজের অলকানন্দার কাছে।

(চলবে)…

#অলকানন্দা
#পর্ব-২৭
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৭৮.
মুইংচিন খুবই ব্যস্ত। চাইনিজ হওয়ার সুবাদে চীনের প্রতি দুর্বলতাটা তার বেশি। সুদূর চীন থেকে কিছু উপহার এসেছে তার জন্য। সেগুলো ড্রয়িং রুমে মাটিতে বসে খুলছে সে। পাথরের কয়েকটা মূর্তি এসেছে। একটা কাঙ্ক্ষিত মূর্তি হাতে পেতেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো তার। মূর্তির পায়ের কাছটায় নিজের হাত বুলিয়ে অদ্ভুত তৃপ্তি অনুভব করলো মুইংচিন। হাসলো কতক্ষণ আপনমনে। হাসলে তার চোখের দুপাশে ভাঁজ পড়ে। চোখ দুটি ছোট হয়ে আসে। তখনই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো মাহা। গত দুদিন যাবত সার্থক হাসপাতাল যায়না। ছুটি নিয়েছে। মাহাকে আদরে আদরে ভুলিয়ে দিয়েছে সকল যন্ত্রণা। মাহার হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় এতটা সুখও কি তার কপালে ছিলো! সার্থক কাজ করছে ঘরে। তাই মাহা ভাবলো সার্থকের জন্য কফি করবে। যে ভাবা সে কাজ। নিচে নেমে এলো সে। মুইংচিন কে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো তার পানে। কাকের মতো সরু মুখ, মাথায় গজানো অনেকগুলো হরিণের ন্যায় শিং। সাদাকালো ছবিটায় অদ্ভুত মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট একটা প্রাণী। নখগুলো বড় বড়। নখগুলো লাল, ঠোঁটও লাল। এমন উদ্ভট একটা মূর্তি মুইংচিনের হাতে দেখে খানিক অবাক হলো মাহা। মনে করার চেষ্টা করলো এমন মূর্তি কিংবা ছবি কোথায় যেন দেখেছে সে। মাহাকে সামনে দেখতে পেয়ে থতমত খেলো মুইংচিন। মাহার পিছন থেকে কেউ একজন চোখ রাঙাচ্ছে তাকে। তাই তৎক্ষনাৎ বাক্সের ভিতরে ভরে ফেললো সে মূর্তিটা। ভয়ে হাত কাঁপছে তার।
“আপনার হাতে কি মুইংচিন?”
“কিছুনা।”

মাহা বিষয়টা আর ঘাটালোনা। কেউ যদি প্রশ্ন করলে কিছু বলতে না চায় বারবার তাকে একই কথা জিজ্ঞেস করা মাহার অপছন্দ। কি মনে করে পিছনে ফিরলো মাহা। এমিলিন দাঁড়িয়ে। মাহা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। এমলিন আজো তার কাছে রহস্য। কফি বানানো কালে হঠাৎই পিছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরলো মাহাকে। মাহার অবচেতন মন সায় দিয়ে উঠলো “এটা তোর একান্ত আপনজন”। মুচকি হাসলো মাহা। এবারে আরো সাহসী হলো জড়িয়ে ধরা হাত। তীব্র দুষ্টুমি করার আগেই মাহা ধরে ফেললো সে হাত।
“উফ্! কি শুরু করেছেন আপনি? বাড়ি ভর্তি মানুষ। দেখে ফেলবে কেউ।”
“কেউ দেখবেনা।”

সার্থকের মায়াময় নেশা জড়ানো কন্ঠ। এবারে চরম অবাধ্য হলো সার্থক। মাহাকে সামনে ফিরিয়ে অধর টেনে নিলো নিজ দখলে। ঘটনার আকস্মিকতায় মাহা হতভম্ব। কারো পায়ের শব্দে মাহাকে ছেড়ে দিলো সার্থক। মাহা চোখ রাঙিয়ে তাকালো সার্থকের পানে। হাঁপানো স্বরে বললো,
“আপনি চরম অসভ্য।”
“বউয়ের কাছে এই পৃথিবীর সব পুরুষ অসভ্য। নয়তো….

তাড়াতাড়ি সার্থকের মুখ চেপে ধরলো মাহা। এই লোক যা পাঁজি। নিশ্চয়ই উল্টাপাল্টা কিছু বলে লজ্জায় ফেলবে তাকে। সার্থক হাসলো। মাহা অভিভূত হয়ে দেখছে সে হাসি। হাসলে কি সুন্দর লাগে লোকটাকে। সার্থক আবারো টুপ করে আদর দিলো মাহার হলদেটে ফর্সা গালে। মাহা লজ্জা পেয়ে মুখ লুকালো সার্থকের বুকেই। হা হা করে হেসে উঠলো সার্থক।

এত আনন্দ! এত খুশি! সহ্য করা দায়। বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে কারো।

৭৯.
“ভাইয়া এটা পাবলিক প্লেস।”

নিভার কন্ঠ পেয়ে মাহাকে নিজের থেকে মুক্ত করতে বাধ্য হলো সার্থক। রবার্ট কে নিভার পাশে দেখে লজ্জা পেয়েছে মাহা। সার্থক হাসছে। মাহা কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে।
“নিজের বাড়ি আবার পাবলিক প্লেস নাকি, নিভা! আমার বউ আমি রোমান্স..

মাহা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো সার্থকের টি-শার্ট। সার্থক সেদিকে তাকিয়ে বললো,
“থাক, তোমার ভাবি লজ্জা পাচ্ছে। বাকিটা আর বললাম না।”

সবাই হেসে উঠলো একসাথে। রবার্টের মতো মুখচোরা লোকের মুখে হাসি। রবার্টের চোখগুলো কেমন যেন চেনা চেনা।

________________

প্রলয় ঠাস করে ফাইলটা টেবিলে রাখলেন। তার সামনে তাজ, মোবারক আর রেজওয়ান দাঁড়িয়ে। তাদের দেওয়া একমাস সময় পার হয়ে গিয়েছে। এখনো কেস যেমন ছিলো তেমনি। সময়ের ব্যবধানে মিডিয়াতেও ধামাচাপা পড়েছে ছিন্ন পায়ের খবর। প্রলয় কঠিন কন্ঠে বললেন,
“তোমাদের মতো এতো বাহাদুর অফিসারদের কাছে আমি এমনটা আশা করিনি। ফাইলটাতে বারবার তোমরা মাতব্বর শরীফকে কেন টেনে আনছো! তিনি তো সেলে আছেন। ডিএনএ রিপোর্ট বলছে এটা চৈতি নামক মেয়েটার পায়ের খন্ড। মাহা হোসেনের অফিসিয়াল কোনো জবানবন্দি নেই ফাইলে। ভিক্টিম যে বাসায় উঠেছিলো সিলেট। সে বাসায় খোঁজ করা আগেই উচিত ছিলো তোমাদের। এতটা ইরিসপন্সিবল কি করে হলে তোমরা। স্পেশালি রেজওয়ান তোমার কাছে তো আমি এটা আশা করিনি। আসল অপরাধীদের কোনো চিহ্নই তোমরা খুঁজে পেলেনা! স্ট্রেঞ্জ!”

রেজওয়ান মাথা নত করে বললো,
“স্যার, আর কিছুদিন সময় প্রয়োজন। মাতব্বর শরীফের সাথে আমি আরেকবার দেখা করতে চাই। তিনি এ ব্যাপারে জানেন। আমার মনে হচ্ছে।”
“মনে হয়, মনে হচ্ছে এসব কথা পুলিশের মুখে মানায় না। উপর মহল থেকে চাপ আসছে। ২০১২ আমরা ফিরে পেতে চাইনা। আমি তোমাদের উপর থেকে দায়িত্ব উঠিয়ে গোয়েন্দা বিভাগ কে দেওয়ার পরিকল্পনা করছি। এভাবে তো হয়না। আর মাহা হোসেনের একটা অফিসিয়াল স্টেটমেন্ট প্রয়োজন।”

রেজওয়ান বলে উঠলো,
“স্যার, আমি মাহা হোসেনের স্টেটমেন্ট নিয়েছি। ও এখন অসুস্থ। ওকে চাপ না দিলে….
“স্টেটমেন্ট কি অফিসিয়াল ছিলো মিঃ রেজওয়ান?”

রেজওয়ান মাথা নত করে বললো,
“নো স্যার।”
“মাহা হোসেন কি আপনার ব্যাক্তিগত পরিচিত মিঃ রেজওয়ান?”
“জ্বী।”
“মাহার আরেকটা অফিসিয়াল স্টেটমেন্ট নিতে হবে।”
“স্যার, আমাদের আর কিছুদিন সময় দিন।”

তাজ এবং মোবারকও সেই অনুরোধ করলেন। প্রলয় খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললেন,
“ওয়েল, এক সপ্তাহ সময় পাবেন আপনারা। তারপর কেসটা গোয়েন্দা বিভাগের কাছে হস্তান্তর করবো আমি।”
“ওকে স্যার।”

৮০.

একযোগে বলে উঠলো তিনজনে। রেজওয়ান চাচ্ছে সে নিজে থেকে এই ঘটনার একটা বিহিত করতে। নয়তো মাহাকে প্রচুর হয়রানির শিকার হতে হবে। রেজওয়ান কেসটায় ছিল বলে মাহা রক্ষা পেয়েছে। নয়তো মাহার রিমান্ড হতে পারতো। রেজওয়ান চায়না তার প্রিয় মানুষটা কষ্ট পাক। হোক বিয়ে। রেজওয়ানের প্রিয় মানুষ তো মাহা। এতগুলো বছরের ভালোবাসা কি আর দু-তিন মাসের ব্যবধানে কমে যাবে!
_____________

“ব্যবসায় বিরাট লোকসান দেখা দিচ্ছে। এমন করলে তো হবেনা। আমরা বিপদের মুখে পড়তে পারি।”
“রাজার এমন উদাসীন মনোভাব সবাইকে ভাবাচ্ছে। কি ব্যবস্থা করা যায়!”
“পথের কাঁটা উপড়ে ফেলা যায়।”
“উঁহু, ক্ষতি আমাদের।”
“হুম। রাগের কথা আর নাই বা বলি। সবকিছু ধ্বংস করে দিবে।”
“তার কাছে সেই কাঁটাই ফুল।”
“ফুলটা আমাদের গিনিপিগ।”

একযোগে হেসে উঠলো চারজন ব্যাক্তি। কথোপকথন হয়েছে ইংলিশ ব্রিটিশ এক্সেন্টে।

(চলবে)….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here