অলকানন্দা #পর্ব-২৮,২৯

0
509

#অলকানন্দা
#পর্ব-২৮,২৯
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
২৮

৮১.
আজ বহুদিন পর রেজওয়ান মাহার সাথে দেখা করতে এসেছে। এভাবে না বলে আসাটা হয়তো ঠিক হয়নি। সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বেল বাজাতে শঙ্কিত রেজওয়ান। এতটা দিন পর মেয়েটার সাথে দেখা করবে। সাথে মিস তাজও রয়েছেন। মূলত একটা অফিসিয়াল জবানবন্দির জন্যই এখানে আসা। চাইলেই মাহাকে পুলিশ স্টেশনে ডাকা যেত। কিন্তু রেজওয়ান যে চায়না তার প্রিয় মানুষটা কষ্ট পাক। তাই সাথে করে মিস তাজকে নিয়ে এসেছে রেজওয়ান। কলিং বেল বাজানোর আগে কতক্ষণ বেলটার পানে তাকিয়ে রইলো রেজওয়ান। মিস তাজ অবাক হলেন। এই কয়েকদিনের পরিচয়ে এতটা আনমনা রেজওয়ান কে কখনো দেখেননি তিনি। সাথে করে দুইটা ক্যাটবেরি চকলেট নিয়ে এসেছে রেজওয়ান। মিস তাজ এমন কখনো দেখেন নি। অফিসিয়াল জবানবন্দিতেও কেউ কারো জন্য উপহার নিয়ে যায় জানা ছিলোনা তার।
“হোয়াট আর ইউ থিংকিং, রেজওয়ান?”

তাজের প্রশ্নে খানিক থতমত খেলো রেজওয়ান। কলিং বেল চেপে বললো,
“নাথিং, মিস তাজ।”

তাজ খুশি হতে পারলেন না। তার চৌকস মস্তিষ্ক বলছে,”সিউরলি দেয়ার ইস এ মাইস্ট্রি হেয়ার। ইস ইট এ মেটার অফ লাভ?” মুখে কিছুই বললেন না তিনি। কাঠের দরজা খুলে দিলো মেরি। পুলিশের পোশাক পরিহিত দুজন ব্যাক্তিকে দেখে প্রথমে খানিক বিচলিত হয়েছিলো তার চোখ। বিষয়টা চোখ এড়ায়নি তাজের। পরক্ষণেই হাসি ফুটে উঠলো মেরির মুখে। পরিচারিকা মেরি পরিচিত মুখের সন্ধান পেয়ে স্মিত হাসলো। স্মিত হাসলো বাইরে দাঁড়ানো দুজন ব্যাক্তিও। মেরি নিজের ইংরেজি বুলিতে আপ্যায়নের সুরে বললো,
“প্লিজ, আপনারা ঘরে আসুন।”

সোফায় বসতে বলে মেরি দাঁড়ালো পাশে।
“কি নিবেন স্যার,ম্যাম? চা, কফি না জুস?”
“বিচলিত হবেন না মিস মেরি। আপনি একটু মাহাকে ডেকে দিন।”

রেজওয়ান আলতো সুরে বললো।
“জ্বি, স্যার ডেকে দিচ্ছি। ম্যাম আর ডক্টর স্যার উপরেই আছে।”

সার্থকও তবে বাড়িতে আছে? রেজওয়ান ভেবেছিলো এসময় সার্থক হয়তো হাসপাতালে থাকবে। রেজওয়ানের যে সার্থক আর মাহাকে একসাথে দেখলে কষ্ট হয়! মাহা নিচে নেমে এলো পিছনে সার্থক। মাহার গাঁয়ে হালকা বেগুনি রঙের বাটিক থ্রি-পিস। হলদে ফর্সা গাঁয়ে ভিষণ মানিয়েছে। রেজওয়ান জানে মাহার বাটিক থ্রি-পিস খুব পছন্দের। গত ইদেও মাহাকে দুটো থ্রি-পিস উপহার দিয়েছিলো রেজওয়ান। যদিও নিজে দেয়নি। মাকে দিয়ে মাহার হাতে দিয়েছিলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো রেজওয়ান। এ ব্যাপারটাও চোখ এড়ায়নি তাজের। চার জোড়া চোখ একে অপরের দিকে তাকালো। চোখাচোখি হলো একে অপরের সাথে। বহুদিনের পরিচিত মানুষের দেখা হলো আবার। সার্থক, মাহা এসে বসলো সোফায়। একদম পাশাপাশি।
“কেমন আছেন রেজওয়ান ভাইয়া? আপনি একটাবারের জন্যও কল দেননি আমায়?”

অনুযোগ মাহার কন্ঠে। রেজওয়ান স্মিত হাসলো।
“চৈতির কেসটায় অনেক ব্যস্ত সময় পার করছি মাহা।”

চৈতি। কর্ণকুহরে নামটা যেতেই সার্থকের হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো মাহা। চোখমুখে অদ্ভুত ভয়। সার্থক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললো,
“মিঃ রেজওয়ান সেই যে আপনি এসেছিলেন আমাদের বিয়ের দিন। এরপর তো আপনার আর দেখাই নেই। বোনের খবরটাতো অন্তত নিতে পারতেন?”

৮২.
বিরক্ত হলো রেজওয়ান। এমনিতেই অদ্ভুত কারণে সার্থক কে পছন্দ না তার। তারউপর কথায় কথায় বোন, বোন আর বোন। রেজওয়ান জবাব দেওয়ার আগেই সার্থক আবার আওড়ালো,
“কি পান করবেন বলুন? চা, কফি না জুস?”

কিছু একটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই বিচলিত হলো একজোড়া চোখ। উঁহু, একজোড়া নয় দুইজোড়া বোধহয়।
“কি হলো বলুন?”

সার্থকের বিচলিত কন্ঠস্বর। মিস তাজ জবাবে বললেন,
“কফি। কফি খেতে পারি?”
“সিউর।”

বলেই রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়লো সার্থক। গলা উঁচিয়ে ডাক লাগালো এমিলিন কে। এমিলিন চিরচেনা গম্ভীর রূপে বেরিয়ে এলেন।
“চারকাপ কফি।”

এমিলিন শুনলেন। অতঃপর আবার রান্নাঘরে চলে গেলেন।
“ডক্টর সার্থক আমরা আজ একটা বিশেষ কাজে এখানে এসেছি।”

রেজওয়ানের সুরটা গম্ভীর শোনালো। সার্থক চিরচেনা ঠোঁট বাঁকানো হাসি দিয়ে বললো,
“জ্বি, কি সাহায্য করতে পারি মিঃ রেজওয়ান?”

এবারে মাহার দিকে তাকালো রেজওয়ান। নিজের হাত দুটো সামনে এনে একসাথে মুঠোয় ভরে বললো,
“মাহা আমরা আজ তোমার একটা অফিসিয়াল জবানবন্দি নিবো।”
“আমার!”

অবাক কন্ঠে বিস্মিত সুরে আওড়ালো মাহা। সার্থক মাহার ডান হাতটা আঁকড়ে ধরে বললো,
“অবশ্যই, মিঃ রেজওয়ান। জিজ্ঞেস করুন।”
“ভাইয়া, সেদিন তো আমি আপনাকে সবকিছু খুলে বলেছি একবার।”
“মাহা, সেদিনের ব্যাপারটা অফিসিয়াল ছিলোনা। তাছাড়া ডিএনএ ম্যাচ হয়েছে। পায়ের খন্ডাংশটা চৈতিরই।”

কথাটা শোনার সাথে সাথেই মাহার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে। ঝিমঝিম করছে মাথা। খানিকক্ষণ নিষ্কলুষ স্তব্ধ নয়নে মাহা তাকিয়ে রইলো রেজওয়ানের পানে। নিজের কি অভিব্যাক্তি প্রকাশ করবে ভেবে পেলোনা। সার্থক আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো মাহার মাথায়। কানের কাছে গিয়ে আলতো করে বললো,
“শান্ত হও, সোনা। আমি আছিতো।”

ভরসা পেলো মাহা। চৈতি নামক মেয়েটা মাহার জীবনে অনেকাংশ জুড়ে ছিলো। তার মৃত্যুর খবর আজ চূড়ান্ত ভাবে পেলো মাহা। মন কাঁদছে তার। বাঁধ ভাঙা কান্না। মাহার কিছু মনে নেই। তবে মাঝেমাঝেই অবচেতন মস্তিষ্কে প্রশ্ন উঠে,
“সে কি দায়ী?”

সেই চিন্তা মাহাকে ঘুমাতে দেয়না। সার্থকের বুকে মাথা দিয়ে কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে মাহা। হঠাৎ হঠাৎ তার ভয় হয়। মনে হয় চৈতির দেহের খন্ডগুলো আছে। আশেপাশে আছে। শূন্যে ভাসছে। তাকে ডাকছে। মাহা তখন ভয় পায়। বিচলিত হয়ে যায়। কামড়ে জখম করে দেয় সার্থকের বুক। সার্থক সব মাথা পেতে নেয়। ঘুমঘুম চোখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাহাকে। মাথায়, চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। কখনোবা চূড়ান্ত ভালোবাসা দেয়। তখনই পাগলামি থামে মাহার। শান্ত, তৃপ্ত, ক্লান্ত মাহা ঘুমিয়ে পড়ে সার্থকের বুকে। সার্থক আর ঘুমায় না। চেয়ে থাকে নিজের অলকানন্দার দিকে। ভাগ্যের কাছে প্রশ্ন করে, “কেন এতো অদ্ভুত তার জীবন?” সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী ছিলোনা সার্থক। হঠাৎ করেই মনের একটা অংশ সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ করে,
“হে রক্ষাকর্তা। আমার মাহাকে তুমি ভালো রেখো।”

৮৩.
“মাহা, তুমি ঠিক আছো?”
“জ্বি, ভাইয়া।”
“তুমি যতটুকু জানো ততটুকু আবার খুলে বলো আমাদের।”

সার্থকের হাত আঁকড়ে ধরে আবার সেই পুরানো স্মৃতি একে একে তুলে ধরলো মাহা। সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনলো সেই স্মৃতির পাতা। শেষটুকু বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো মাহা। কয়েক ফোঁটা অশ্রু নেমে গেলো কপোল বেয়ে। মাত্র আড়াই-তিন মাসের ব্যবধানে বিপুল পরিবর্তন এসেছে তার জীবনে। সার্থক নামক মানুষটা তাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। একটা পরিবারের স্বপ্ন দেখিয়েছে। একসময় মরণ চাওয়া মাহা এখন বাঁচতে চায়। নিজের একান্ত মানুষটার সাথে বাঁচতে চায়। কফি নিয়ে এলো এমিলিন। টি-টেবিলে রেখে স্থান ত্যাগ করলো নিজের। সার্থক আবার পরিস্থিতি হালকা করতে রেজওয়ানের হাতে কফি তুলে দিতে দিতে বললো,
“আপনারা কফিটা একটু টেস্ট করে দেখুন। এমলিন খুব ভালো কফি বানায়।”

বুকে রক্তক্ষরণ নিয়ে কফি হাতে নিলো রেজওয়ান। চোখ শুধু বারেবারে যাচ্ছে ডানহাতে মাহার হাত আঁকড়ে ধরা সার্থকের হাতের দিকে। তখন মুইংচিনের ঘর থেকে গান ভেসে এলো,

“You come out at night
That’s when the energy comes
And the dark side’s light
And the vampires roam
You strut your rasta wear
And your s/u/i/c/i/d/e poem
And a cross from a faith that died
Before Jesus came
You’re building a mystery
You live in a church
Where you sleep with voodoo dolls
And you won’t give up the search
For the ghosts in the halls
You wear sandals in the snow
And a smile that won’t wash away
Can you look out the window
Without your shadow getting in the way?
You’re so beautiful
With an edge and charm
But so careful
When I’m in your arms
‘Cause you’re working
Building a mystery
Holding on and holding it in
Yeah you’re working
Building a mystery
And choosing so carefully
You woke up screaming aloud
A prayer from your secret God
You feed off our fears
And hold back your tears, oh
Give us a tantrum
And a know-it-all grin
Just when we need one
When the evening’s thin
You’re a beautiful
A beautiful ….. up man
You’re setting up your
Razor wire shrine
‘Cause you’re working
Building a mystery
Holding on and holding it in
Yeah, you’re working
Building a mystery
And choosing so carefully
Ooh, you’re working
Building a mystery
Holding on and holding it in
Yeah you’re working
Building a mystery
And choosing so carefully
Yeah, you’re working
Building a mystery
Holding on and holding it in
Oh, yeah, you’re working
Building a mystery
And choosing so carefully
You’re building a mystery”

কানাডিয়ান শিল্পী (Sarah McLachlan) এর গানটায় হঠাৎ ব্যাঘাত ঘটালো সকলের সকল ভাবনার। সার্থক গলা উঁচিয়ে বললো,
“মুইংচিন জরুরি মিটিং হচ্ছে এখানে গান বন্ধ করো।”

থেমে গেলো গান। শুরু হলো আবার ভাবনা। ভয়, ঈর্ষা, কাতরতা, ভালোবাসা, রুক্ষতা, নিষ্ঠুরতা একই ছাদের নিচে কত অনুভূতির সমাহার!

(চলবে)…

#অলকানন্দা
#পর্ব-২৯
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৮৪.
রেজওয়ান আজ আবার মাতব্বর শরীফের সাথে দেখা করতে এসেছে। এ কেমন গোলকধাঁধায় পড়লো সে নিজেও জানেনা। কোনো ক্লু নেই। কোনো সাক্ষ্য, প্রমাণ নেই। সবচেয়ে বড় অবাক করা ব্যাপার হলো মাহার ভুলে যাওয়ার ব্যাপারটা। স্ট্রেঞ্জ! একটা মানুষ কি করে সবকিছু ভুলে যেতে পারে? কথাটা তো মাথায় খেলেনি। মাহাকে ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন। কোনো ভালো সাইকোলজিস্ট। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অন্ধকার সেলের সামনে এসে দাঁড়ায় রেজওয়ান। সেদিনের মতো শিকের এপাড়ে রেজওয়ান আর ওপাড়ে মাতব্বর শরীফ।
“মাতব্বর সাহেব?”

কোনো আওয়াজ এলোনা। কিছুক্ষণ চুপ রইলো রেজওয়ান। আবার ডাকলো,
“মাতব্বর সাহেব আমি জানি আপনি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন।”

কোনো আওয়াজ নেই। কেবল নিকষ কালো অন্ধকারে নিশ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ। চৌকস রেজওয়ান বুদ্ধি খাটালো এবারে। মিথ্যার প্রশ্রয় নিতে হয়েছে যদিও।
“আপনার ওয়াইফ তো ভিষণ কষ্টে আছে মাতব্বর সাহেব। আপনার ইচ্ছে জাগেনা তার সাথে দেখা করতে?”

এবারে গোঙানির আওয়াজ ভেসে এলো। গুরুগম্ভীর গোঙানি। রেজওয়ান বুঝলো হয়তো কাজ হচ্ছে,
“আপনি আমাকে সাহায্য করুন মাতব্বর সাহেব। আমি আপনাকে সাহায্য করবো। আমি জানি আপনি নির্দোষ। দোষী কে একবার ধরিয়ে দিন। আমি প্রমিজ করছি একটা স্বাধীন জীবন আপনাকে উপহার দিবো আমি৷”
“আমি মুক্ত আকাশের নিচে শ্বাস নিতে চাই।”

অতন্ত্য ক্ষীণ, গুরুগম্ভীর সুরে বলে উঠলেন মাতব্বর শরীফ। রেজওয়ান যেন মরুভূমির বুকে জল খুঁজে পেলো। হাতে সময়ও কম। ঘটনার পিছনের ঘটনা উদঘাটন করতে সে সব করতে রাজি।
“আপনি আমাকে খুলে বলুন। কেউ কি আপনাকে ফাঁসিয়েছে? কি কি জানেন আপনি ২০১২ সম্পর্কে?”
“আমাকে একবার সিলেট নিয়ে যেতে হবে।”
এ বড় অবান্তর আবদার। একজন দাগী আসামিকে রেজওয়ান কি করে সিলেট নিয়ে যাবে! সে কি চাইলেই সব সম্ভব! কিন্তু কেসটারও তো একটা বিহিত প্রয়োজন।
“এটা কি আপনার শর্ত হিসেবে ধরে নিবো আমি?”
“হয়তো তাই।”
“আপনি আমাকে কিছুই বলবেন না?”
“বলবো। কিন্তু আমি সিলেট যেতে চাই।”
“ঠিক আছে। আমি আমার সর্বাত্মক চেষ্টা করবো।”

রেজওয়ান স্থান ত্যাগ করলো। ভিষণ অস্থির লাগছে তার। প্রলয় চ্যাটার্জিকে কি বলবে সে!

এই নিয়ে তিন তিনবার। এশা রাস্তায় বসে আছে। আজকে বেচারির গলার চেন টান দিয়ে নিয়ে গিয়েছে ছিনতাইকারী। গলায় টান লাগায় দাগ বসে গেছে। শ্যামলবরণ বলেই বুঝা যাচ্ছেনা। ফর্সা হলে হয়তো লালচে দাগটা স্পষ্ট বুঝা যেতো। কনস্টেবল মুন্সি গাড়ি ড্রাইভ করছিলো। পাশে রেজওয়ান বসে ফাইল চেক করছে। হঠাৎ গাড়ি থামাতে মুন্সির দিকে জিঘাংসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রেজওয়ান। ফাইল হতে মুখ তুলে সামনে চায়নি। সোজা চেয়েছে মুন্সির দিকে। মুন্সি চিন্তিত মুখে বললো,
“স্যার, সামনে ভিড়।”

রেজওয়ান সামনে তাকায় এবার। সত্যিই ভিড়। ফাইল রেখে নেমে যায় গাড়ি থেকে। পুলিশ ইউনিফর্ম পরিহিত রেজওয়ান কে দেখে সরে যায় মানুষজন। রাস্তার পাটাতনে গালে হাত দিয়ে উদাস ভঙ্গিতে ক্রন্দনরত মুখে বসে আছে এশা। রেজওয়ান ভেবে পায়না। পাশ থেকে একজন বলে উঠে,
“মাইয়াডার গলার ছেন লইয়া ভাগছে ছিনতাইকারী।”

রেজওয়ান কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে বুঝতে পারছেনা। এই দেশের সব ছিনতাইকারী কি খালি এই মেয়েটাকেই চোখে দেখে। রেজওয়ান কে সামনে দেখে ছলছল চোখে তাকালো শ্যামবতী। অতঃপর ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। রেজওয়ান এগিয়ে গিয়ে আঁকড়ে ধরলো এশার হাত। গাড়ির কাছে এসে মুন্সিকে বললো,
“মুন্সি, পানির বোতলটা দাও।”
“জ্বি, স্যার।”

মুন্সি পানির বোতল দিতেই রেজওয়ান নিজের হাতে নিলো বোতলটা। এতক্ষণ কেউই কারো সাথে কথা বলেনি।
“নাও।”

রেজওয়ান বলতে দেরি আর সে পানি নিয়ে ঢকঢক করে পান করতে দেরি হয়নি এশার। বেচারি অতিদ্রুত করতে গিয়ে বিপত্তি বাঁধিয়ে ফেললো এবারে। বিষম খেয়ে যাচ্ছে তাই অবস্থা। রেজওয়ান বিরক্ত হলো এবারে। মায়াও হলো মেয়েটার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ পর কাশি থামলো এশার। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে সে।
“একটা কথা বলো তো তুমি। রাস্তায় কিভাবে চলো? এই নিয়ে তিনবার তোমার সাথে এমন হলো। বুঝিনা আমি ছিনতাইকারীগুলোও কি শুধু তোমায় খালি চোখে দেখে? বেশি লেগেছে?”

৮৫.

‘আপনার সাথে দেখা আমার এমন অদ্ভুত সময়েই কেন হয় বলুন তো! আপনি একটা যাচ্ছে তাই। এই পুলিশ, ছিনতাইকারীর কবলে পড়লে যদি আপনার দেখা পাওয়া যায় তাহলে আমি রোজ রোজ ছিনতাইকারীর কবলে পড়তে রাজি। আপনি তো বোকা পুলিশ। আপনি কিছুই বুঝেন না।’ মনে মনে কথাগুলো আওড়ালেও মুখে বলার সাহস নেই এশার। তাই নিচুসুরে বললো,
“বাড়ি যাবো।”

গাড়িতে উঠে বসতেই নিরবতা চললো কিছুক্ষণ। অতঃপর এশা প্রশ্ন করলো,
“মাহা আপু কোথায় এ ব্যাপারে কিছু জানেন? ফুপি তো আংকেল মারা যাওয়ার পর থেকেই নারায়ণগঞ্জ। বাড়িতে ফেরেননি। মাহা আপু সেই যে সেদিন বেরিয়ে গেলো। আপুর সাথে কোনো যোগাযোগই হয়নি আমার।”
“মাহা বিয়ে করে নিয়েছে।”

নির্বিকার উত্তর রেজওয়ানের। কথাটা বলেই ফাইলে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টায় সে। এদিকে বিস্ময়ে হা হয়ে আছে এশা।

নিচতলায় বেশি একটা আসা হয়না মাহার। বেশিরভাগ সময়টাই কাটে উপরে। বাগান, ফুল, ক্যাকটাস, লাইব্রেরি। মাঝেমাঝে নিভার সাথে গল্প বেশ সময় কেটে যায় মাহার। যদিও কিছুদিন বাদে মাহার পরীক্ষা। আর সার্থক! মানুষটা একটা আস্ত পাগল। বাড়িতে থাকলে মাহাকে ঘর থেকে বের হতে দেয়না। বসিয়ে রাখে চোখের সামনে। একদিন মাহা প্রশ্ন করেছিলো,
“কি দেখেন বলেন তো এমন করে তাকিয়ে?”
“আমার পৃথিবীকে।”

সার্থকের অকপট উত্তর। মাহা লজ্জায় দৌড়ে বারান্দায় চলে এসেছিলো। লোকটা একটা পাগল! আজ মাহা নিচে নেমে এসেছে। হঠাৎ ইচ্ছে জাগলো এতদিন তো বাড়িতে এসেছে। নিচটা একদিনও ঘুরে দেখা হয়নি। কেবল নিভার ঘরে গিয়েছিলো কয়েকবার। বিশাল ড্রয়িংরুম। পাশে রান্নাঘর। ড্রয়িংরুম থেকে বেডরুমগুলোতে প্রবেশ করতে হয় ছোট ছোট শামুক, ঝিনুকে নির্মিত বড় পর্দা পেরিয়ে। মেরি, এমিলিন কিংবা কোনো পরিচারিকাকেই নিচে খুঁজে পায়নি মাহা। নিভা বসুন্ধরা কমপ্লেক্সে গিয়েছে শপিং করতে। মাহাকে নিতে চেয়েছিলো। মাহার ভালোলাগছিলোনা বলে যায়নি। পর্দা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে মাহা ঘুরে ঘুরে দেখছিলো আশপাশ। দামি দামি কারুকাজ। প্রাচীণ বিভিন্ন মূর্তি, সু পিস দিয়ে সুন্দর করে সাজানো বাড়ির প্রতিটি কোণা। হঠাৎ একটা ঘর থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখে ঘাবড়ে গেলো মাহা। ঘরটা একেবারে কোণায়। মাহা এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিলো সে ঘরে, রবার্ট একটি কনিক্যাল ফ্ল্যাক্স থেকে অন্য একটি কনিক্যাল ফ্ল্যাক্সে কি যেন মিশাচ্ছে। সেখান থেকেই ধোঁয়ার সৃষ্টি। এছাড়াও ফ্লাস্ক.এইচবেইন্ডস,স্টক,স্পেকট্রোফটোমিটার, বিকার, ফানেল, ব্যুরেট ইত্যাদি দিয়ে ভরে আছে ঘরটা। রবার্টের নজরে পড়তেই রবার্ট তীক্ষ্ণ চোখে চাইলো মাহার পানে। মাহা ভয় পেয়ে গেলো খানিকটা।
“What do you do outside this room? Come in.”

ভিতরে ঢুকার আহ্বান জানালো রবার্ট। সাথে মিষ্টি করে হাসলোও। রবার্টের এমন রূপ এই প্রথম দেখলো মাহা। অদ্ভুত ঠেকলো তার নিকট। রবার্টকে সে মুখচোরা হিসেবেই ধরে নিয়েছে। চুপচাপ থাকে। কথা বলেনা। ফিরে তাকায়ও না। তাহলে আজ এমন অদ্ভুত ব্যবহার কেন। মাহা আড়ষ্ট হয়ে আরেকটু উঁকি দেয়।

৮৬.

একটা বড় আকারের ইঁদুর রাখা খাঁচার ভিতরে। মাহা আর কিছু দেখার আগে রবার্ট আবার বললো,
“What happened? Why don’t you come in? Are you scared? Don’t be afraid. I will not do anything to you. Come on, come on.”

অধৈর্য্য শোনালো রবার্টের গলা। মাহা কি করবে বুঝতে পারছেনা। এমন সময় পিছন থেকে কেউ চোখ রাঙালো রবার্ট কে। ভয়ানক ভয় দেখালো। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো রবার্টের। কাউকে সে ভয়৷ ভিষণ ভয় পায়। চুপসে গেলো রবার্ট। মাহা ভিতরে প্রবেশ করার আগেই কেউ আঁকড়ে ধরলো তার হাত। নরম কোমল হাত। মাহা হাতের দিকে তাকিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখে এমিলিন। মাহা কিছু বুঝে উঠার আগেই এমিলিন টেনে নিয়ে এলো তাকে। ড্রয়িং রুমে এসে ছেড়ে দিলো মাহার হাত। মাহা এমিলিনের কর্মকাণ্ডে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।
“ম্যাম, ডক্টর স্যার আপনাকে ডাকে।”

মেরি ক্ষীণ হেসে বললো। মাহা হতভম্বের ন্যায় উপরে উঠে এলো। কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে সত্যিই সে বুঝতে পারেনা। এই বাড়িটা একটা ধোঁয়াসার রাজপ্রাসাদ। বেডরুমে ঢুকার সাথে সাথে সার্থক কোথ থেকে দৌঁড়ে এসে মাহাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। মাহা অবাক। মাহা কিছু বলার আগেই তার ওষ্ঠদ্বয় সার্থকের অধীনে চলে গেলো। দীর্ঘ সময় পর মাহাকে ছেড়ে আবার জড়িয়ে ধরলো সার্থক। সার্থকের হাত পা কাঁপছে। অন্যদিন হলে হয়তো লজ্জা পেতো মাহা। আজ পেলোনা।
“কি হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেন আপনি?”
“মাহা”

গম্ভীর কন্ঠ সার্থকের।
“আমি তোমাকে ভিষণ ভালোবাসি, মাহা।”

বলেই মাহার চুলে মুখ ডুবালো সার্থক। এমন শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে যেন ছেড়ে দিলে পাখি চলে যাবে নীড় ছেড়ে। দূরে। বহুদূরে। তা কি কখনো হতে দিবে সার্থক? নিজের অলকানন্দা কে কি কখনো নিজের থেকে দূর করে দিবে? সার্থক পারবেনা। কখনো পারবেনা। আবারও আর্দ্র ভালোবাসায় সিক্ত হলো গৃহে বিদ্যমান দুটো প্রাণ। একজন সর্বোচ্চ ভালোবাসা দিয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইলো নিজের প্রাণপাখিকে। অপরজন সিক্ত ভালোবাসায় লজ্জার খোলসে আবৃত হচ্ছে আবার কখনো সাহসী হয়ে উঠছে।

(চলবে)…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here