#অলকানন্দা
#পর্ব-৩,০৪
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
০৩
৭.
“আমাকে জিজ্ঞেস করছে গলায় কি হয়েছে?”
“কি বললি?”
“বলেছি ঠান্ডা জনিত সমস্যা।”
“ঠিক আছে।”
কথোপকথনটা চললো রুমানার আড়ালে। সুবানঘাট থেকে লেগুনায় করে রুমানা, মাহা আর চৈতি চলেছে প্রকৃতিকন্যা জাফলং এর পথে। ঘননীল আকাশ। দুইপাশে সারি সারি সবুজেঘেরা পাহাড়। পাহাড়ের চূড়ায় থোকায় থোকায় আপনমনে বিন্যস্ত মেঘের কুন্ডলী। পাহাড়ের পাশ দিয়ে বহমান পিয়াইন নদী। নদীর পানির অদ্ভুত শব্দ কানে ভেসে বেড়াচ্ছে। ছলছল ছলছল। দিগন্ত থেকে দিগন্তে উড়ে বেড়াচ্ছে নাম না জানা অজানা পাখির দল। আহা! কিচিরমিচির কিচিরমিচির আওয়াজ। সে আওয়াজে কি অদ্ভুত মায়া। আকাশচুম্বী পাহাড়গুলোর বুক চিড়ে বয়ে চলেছে অবিরাম জলধারা। মাহা, চৈতি অবাক নয়নে, পুলকিত মস্তিষ্কে উপভোগ করছে সে দৃশ্য। বেলা এগারোটা ছুঁই ছুঁই। নদীর উপরে কুয়াশারা জমাট বেঁধেছে। আকাশে মেঘ আর তটিণী-র উপরে কুয়াশার মেলা যেন একই সূত্রে গাঁথা। মাহা ভুলে গেলো সকল মৃত্যু চেতনা, ভুলে গেলো অজানা আতঙ্ক। তার মন প্রকৃতির প্রেমে পুলকিত। রুমানার কাছে এসবই পুরাতন। তাই হয়তো ঢাকা শহরে বড় হওয়া মাহা আর চৈতির মতো তার মন অজানা অনুভূতিতে পুলকিত, শিহরিত হচ্ছেনা। তার রক্তে রক্তে অজানা কোনো স্রোত বয়ে বেড়াচ্ছেনা।
“অভূতপূর্ব।”
গানের সুরের মতো শুনায় চৈতির কন্ঠ। তার কোমড় সমান চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে বাতাসে। কালচে সবুজ কুর্তিটায় বেশ মানিয়েছে তাকে। রুমানা অবাক নয়নে চেয়ে আছে।
“কি রে কি দেখিস?”
“তুই অনেক সুন্দর রে কোকিল।”
খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো চৈতি। তার হাসির শব্দ ঝংকার তুললো পিয়াইন নদীর আনাচে কানাচে।
“তোর টুকির মতন অমন আগুন সুন্দরী রেখে শেষে আমাকে ধরেছিস?”
“টুকি সুন্দর। তবে তুই সুন্দর, মায়াবতী। তোর মুখে কি যেন আছে রে কোকিল।”
“তোর যত আজগুবি কথা।”
মাহা চুপ করে উপভোগ করছে সবকিছু। কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা তার। সবুজ সায়রে ডুবিয়ে দিয়েছে নিজেকে। পাশাপাশি বসে মাহা, চৈতি। সামনা সামনি বসে রুমানা। লেগুনাটা তাদের রিজার্ভ করা। আর মানুষ নেই তাতে। লেগুনার পাশ ঘেঁষে চলে গেলো একটা বাইক। বাইকে দুজন মানুষ বসে। চৈতির মনে হলো কেমন অবাক দৃষ্টিতে তারা তাকিয়ে ছিলো তাদের দিকে। তবে ভাবনাটা মাথা থেকে ঝরে ফেললো সে।
“টুকি? চুপ কেন? শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?”
“না, ঠিক আছি।”
নিরবতা। শো শো করে শীতল বাতাস বইছে। ঠান্ডা হাড় কাঁপানো অদ্ভুত হাওয়া যেন মনে প্রভাব ফেলে কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে। তিনজনে চলেছে মনোমুগ্ধকর এক গন্তব্যে। লেগুনা চলছে আপন গতিতে। গাড়িতে বসে দুইপাশের সৌন্দর্য দেখা যেন বিস্ময়কর এক অভিজ্ঞতা। পাহাড়ের পাশে নদী। অপর পাড়ে গজারিবন, সুপারীবনের মেলা।
“একটা গান শুনাবি? মাহা?”
রুমানার মনে হলো সে কিছু ভুল শুনেছে। মাহার দিকে ফিরে সে বললো,
“কি বললি? আবার বলতো?”
চৈতির ইশারায় কি যেন বলতে গিয়েও থেমে গেলো মাহা। লেগুনার ছোট দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললো,
“কোকিলকে বলেছি একটা গান শুনাতে।”
“তাই বল। হ্যাঁ রে কোকিল। একটা গান শোনা প্লিজ।”
চৈতি অন্য মেয়েদের মতো ন্যাকা নয়। গানের গলা ভালো বিধায় অনেকেই গান শুনতে চায় তার কাছে। সেও আপনমনে শোনায়। কোনো বাহানা নেই তার মাঝে। চলন্ত লেগুনা তখন অতিক্রম করছে একটা বিস্তৃত সবুজ মাঠ। বাতাসে গানের নাচন শুরু হয়ে গেলো।
আমার ভিনদেশী তারা
একা রাতেরই আকাশে
তুমি বাজালে একতারা
আমার চিলেকোঠার পাশে
ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে
তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে
মুখ লুকিয়ে কার বুকে
তোমার গল্পো বলো কাকে
আমার রাত জাগা তারা
তোমার অন্য পাড়ায় বাড়ী
আমার ভয় পাওয়া চেহারা
আমি আদতে আনাড়ী
আমার আকাশ দেখা ঘুড়ি
কিছু মিথ্যে বাহাদুরি
আমার আকাশ দেখা ঘুড়ি
কিছু মিথ্যে বাহাদুরি
আমার চোখ বেধে দাও আলো
দাও শান্ত শীতল পাটি
তুমি মায়ের মতই ভালো
আমি একলাটি পথ হাটি
আমার বিচ্ছিরি এক তারা
তুমি নাও না কথাখানি
তোমার কিসের এতো তাড়া
সে রাস্তা পার হবে সাবধানি
তোমার গায়ে লাগেনা ধুলো
আমার দু-মুঠো চাল চুলো
তোমার গায়ে লাগেনা ধুলো
আমার দু-মুঠো চাল চুলো
রাখো শরীরে হাতে যদি
আর জল মাখো দুই হাতে
প্লীজ ঘুম হয়ে যাও চোখে
আমার মন খারাপের রাতে
আমার রাত জাগা তারা
তোমার আকাশ ছোয়া বাড়ী
আমি পাইনা ছুতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারী
আমার রাত জাগা তারা
তোমার আকাশ ছোয়া বাড়ী
আমি পাইনা ছুতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারী
হুম হুম………………
৮.
এতটা আবেগ নিয়ে কখনো কোকিলকে গান করতে শুনেনি রুমানা। এতোটা আবেগ। কার জন্য এতো আবেগ! চোখ বুজে গান সেরে তখনো পল্লব খুলেনি চৈতি।
“এতটা গভীর হয়ে কার জন্যে গান করলি বলতো?”
“তেমন কেউ নেই।”
“সত্যি তোর কোনো ভিনদেশী তারা নেই?”
বলে হেসে দিয়েছে রুমানা। সাথে যোগ দিয়েছে মাহাও। নিচে তাকিয়ে মুচকি হাসছিলো চৈতি। আছে কি তার কোনো ভিনদেশী তারা?
পথিমধ্যে একবার লেগুনা বিগড়ে গিয়েছিলো। দু’ঘন্টার জার্নি। চারঘন্টায় সেরেছে তারা। জাফলং পৌঁছাতে পৌঁছাতে তখন বিকেল সাড়ে তিনটে।
“এটা কোনো কথা! জাফলং ঘুরবো কখন আর খাসিয়া পল্লী ঘুরবো কখন। পুরা মজাটার বারোটা বাজিয়ে দিসে।”
রুমানার কন্ঠে বিরক্তি।
“থাক বাদ দে।”
“কি বাদ দিবো টুকি। এটা কোনো কথা বল। আমার শহরের সবচেয়ে সুন্দর জায়গাটা তোরা দেখতে পারবিনা।”
মাহা, চৈতি চুপ করে আছে। আপাতত তারা ভারতের মেঘালয় ঘেঁষে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত, পাহাড় আর নদীর অপূর্ব সম্মিলন জাফলং দেখতে ব্যস্ত। রঙ, বেরঙের পাথর চারপাশে। নদীর স্বচ্ছ পানির ভেতরে অপরূপ পাথুরে ঝলকের খেলা।
তিনজনে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে সব। তবে পেট তো আর কথা মানেনা। জানান দিলো খাদ্য দরকার তাদের।
“ক্ষুধা লেগেছে প্রচুর। নদী পেরিয়ে ওপারে গিয়ে সর্বপ্রথম খাবো। তারপর ঘুরবো। কি বলিস টুকি,কোকিল?”
“আচ্ছা।”
ছোট একটা ডিঙি দিয়ে স্বচ্ছ জলধারা পাড়ি দিলো তারা। কত রকমের পাথর নদীর গহীনে। নদীর এপাড়ে হরেক রকম খাবার নিয়ে বসেছে উপজাতি গোষ্ঠী। রুমানা ডিঙি থেকে নেমে দৌড়ে গেলো সেদিক পানে।
“আরে পাগলী আস্তে। তোর খাবার কেউ ছিনিয়ে নিবেনা।”
কে শোনে কার কথা। চৈতির কথা তোয়াক্কাই করলোনা রুমানা। রুমানার এহেন কান্ডে হেসে উঠলো দুজনে।
৯.
একটা টেবিল দখল করে খাওয়াও শুরু করেছে রুমানা। মাহা আর চৈতিও খেলো। ডিম ভোনা, আলুর ভর্তা, ডাল আর ভাত। নদীর তীরে অস্থায়ী পেন্ডেলে বসে খেতে ভালোই লাগলো তিনজনের। বিল দেওয়ার সময় একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটলো। চৈতির মনে হলো হুন্ডারে থাকা লাল হুডী পরনে একজনকে দেখেছে সে। বিষয়টাকে এখন আর হেলায় ফেলায় নিলোনা চৈতি। অদ্ভুত ভয় ঝেঁকে ধরেছে তাকে। তবে তা প্রকাশ করলোনা সে। অটো করে খাসিয়া পল্লী ঘুরবে তারা। একটা অটো রিজার্ভ করে তাতে উঠে বসলো তিনজনে।
“আমি যখনই খাসিয়া পল্লী আসি আমার অনেক ভালোলাগে। এতটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তারা। মনে হয় যেন অন্য এক জগৎ এই খাসিয়া পল্লী।”
রুমানা স্থানীয় মানুষ। ঘুরে বেড়ানোটাই স্বাভাবিক। তবে অটো যখন আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকলো তখন দুইপাশের পানক্ষেত আর সুপারি ক্ষেত দেখে কেমন ভয় ভয় লাগছিলো চৈতির। তার নানি বলতো পানক্ষেতে নাকি জ্বীন থাকে। জুতা খুলে প্রবেশ করতে হয়। একটু উপর নিচ হলেই তারা মেরে ফেলে। হলদে সাদা মুখটা লালচে হয়ে উঠলো। কেউ তা লক্ষ্য করেনি। রুমানা আপন মনে বলছে।
“এটা হলো খাসিয়াদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কি সুন্দর না তাদের বাড়িঘর?”
সত্যিই অনেক সুন্দর। দুতালা পুরানো দিনের রঙ বেরঙের বাড়ি। অসাধারণ কারুকার্যময়। পুরানো ধাঁচে তৈরি। ভয়টা একটু ঘুচলো চৈতির। লোকালয়ে তারা এখন।
“দেখ টুকি এটা হলো খাসিয়াদের গীর্জা।”
হরেকরকম রঙের কাপড় পরা দুয়েকজন চ্যাপ্টা নাকের খাসিয়াও দেখা গেলো ততক্ষণে। নারীতন্ত্র খাসিয়া সমাজের নারীদের দেখলে মনে হয় একেকটা রাণী। তাদের ভাব গাম্ভীর্যই অন্যরকম।
অটো থামাতে বললো রুমানা।
“তোদের একটা চা বাগানে নিয়ে যাবো। একটু ভিতরে। হেঁটে যেতে হয়। পাশে তেজপাতা, গোলমরিচ আর কমলা ক্ষেতও আছে। কি রে টুকি মন ভালো হলো?”
“খুউব।”
অটো থামিয়ে তারা চললো খাসিয়া পল্লীর পাশে চা বাগানের ভিতর। কথা বলতে বলতে কিছু দূর আগাতেই তিনজন খাসিয়া পুরুষ পথ রুখে দাঁড়ালো তাদের। বাঁধা পেয়ে অবাক হলো তিনজনেই। তাদের ভাষার কিছুই বুঝলোনা তারা। কিছু সময় অতিক্রম হওয়ার পর একজন খাসিয়া নারী এগিয়ে এলেন। রুমানার সাথে কথা বললেন তিনি। তার কথার সারমর্ম এই যে,
“তাদের খাসিয়া একলোক চায়ের বাগানের পাশে এক গাছে গলায় দড়ি পেঁচিয়ে ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন দুদিন আগে। তার বউ, বাচ্চাকে পাওয়া যাচ্ছিলো না। অতঃপর কয়েক টুকরা শরীরের অংশ পাওয়া গিয়েছে তাদের।”
আবারও ভয় ঝেঁপে ধরলো মাহাকে। শরীর কাঁপছে তার। যেকোনো সময় পরে যেতে পারে সে।
“রুমা…রুমানা এখান থেকে চল।”
অতিশীঘ্রই খাসিয়া পল্লী ত্যাগ করলো তারা। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। হাঁড় কাঁপানো শীত পড়েছে চারদিকে। লেগুনায় চৈতির কাঁধে মাথা দিয়ে বসে মাহা। মনটা আবার বিষিয়ে উঠেছে তার। হঠাৎই লেগুনাটা থেমে গেলো। তখন……
(চলবে)
#অলকানন্দা
#পর্ব-৪
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
১০.
“আপারা, লেগুনা নষ্ট হয়ে গেছে। আপনাদের নামতে হবে।”
শীতের রাত। মাগরিবের আজান দিয়ে দিয়েছে সেই কখন। পিয়াইন নদীর পাড় ঘেঁষে বিস্তৃত পিচ ঢালা রাস্তা। লোকজন একেবারে নাই বললেই চলে। দুয়েকটা যানবাহন চলে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। যেন আপন গতিতে মত্ত তারা। অপরপাশে সুপারিবাগান আর গজারিবাগানের বিস্তৃত মেলা। এমন হাঁড় কাঁপানো আধার কালো রাতে লেগুনা চালকের এহেন কথা অনেকটা বজ্রাঘাতের মতো ঠেকলো তিনজন তরুণীর কানে। এদিকে মাহার অবস্থা খারাপ।
“মানে কি! ঠাট্টা করেন আমাদের সাথে। মাঝরাস্তায় কোথায় পাবো গাড়ি?” খেঁকিয়ে উঠলো রুমানা।
লেগুনা মালিক নির্বিকার। তার কিছুই এসে যায় না। এটা স্পষ্ট। লেগুনা মালিকের পীড়াপীড়িতে অগত্যা নামতে হলো তাদের। মাহাকে ধরে রেখেছে চৈতি। সুপারি বাগানের পাশে রাস্তার কিনারা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তিনজন। রাগে গজগজ করছে রুমানা। তারপর যা ঘটলো সত্যিই বিস্ময়কর ব্যাপার। লেগুনা ঠিকই আছে। তাদের নামা মাত্রই ছোঁ মেরে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো তা। গাড়ির ড্রাইভারকে ওরা কেউ দেখেনি। মোটা একটা কালচে খয়রী চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে ছিলো লোকটা।
“দেখলি কারবার। এটা কেমন ফাইজলামি। গাড়ি তো ঠিকই আছে!”
চৈতির বজ্রাহত কন্ঠস্বর। এমন কান্ড সে ইহজন্মে দেখেনি।
“টুকি? ঠিক আছিস?”
“হুম।”
“কি করবো এখন!”
রুমানার আক্ষেপে জবাব দেয় চৈতি। সে অনেকটা দৃঢ়চেতা, ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ। কোন পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দিতে হয় ভালো করে জানা আছে তার।
“চল হাঁটা শুরু করি। কোনো না কোনো গাড়ি পেয়ে যাবো।”
“তাই করতে হবে। তবে টুকি হাঁটতে পারবে তো? এই টুকি হাঁটতে পারবি?”
“হ্যাঁ।”
মুখে বললেও মাহার ভিতরে বিন্দুমাত্র হাঁটার শক্তি নেই। তা বুঝেই তার একটা হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো চৈতি।
আধারকালো রাত। আকাশে আলোর ছিটেফোঁটা নেই। হাঁড় কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া বইছে চারদিকে। পাশের বন থেকে ভেসে আসছে হরেকরকম ডাক। তিনজন তরুণী হেঁটে চলেছে। তিনজন থাকলেও মন থেকে তারা যেন একা। সামনে রুমানা মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পিছনে রাস্তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মাহা। অপরপাশে তাকে ধরে চৈতি। দু একটা ট্রাক মাঝেমাঝে অতিক্রম করছে তাদের। পিয়াইন নদীর পাশ ঘেঁষে যে পাহাড়গুলো দাঁড়িয়ে আছে তাদের অনেকটা দানবের মতো লাগছে। অথচ আলোতে তারা কত সুন্দর! হাঁটতে হাঁটতে চৈতির মনে হলো পিছনে কেউ বা কারা আছে। কেন মনে হলো সে জানেনা। বার দুয়েক পিছনে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পায়নি সে। তবে স্পষ্ট শুকনো পাতার খচখচ আওয়াজ শুনেছে। পিচ ঢালা রাস্তার পাশটায় শীতকালীন শুকনো পাতা ভরে আছে। তাতে পা লাগলেই খচখচ আওয়াজ তুলে। মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দেয় চৈতি। হাতের বাঁধন আলগা হয়ে কখন মাহা রাস্তায় উঠে পড়েছে সে খেয়াল হয়তো কারো নেই। সামনে একটা ছোট টঙ দোকান দেখা যাচ্ছে। তাতে কিছু মানুষের ভিড়। এমন সময় চৈতি পাশে তাকিয়ে দেখলো মাহাকে পিছন থেকে ধাক্কা দিতে উদ্যত হচ্ছে ভয়ংকর বড় একটা ট্রাক।
“চৈতি”
বলে চিৎকার করে উঠলো চৈতি। বাম হাতে হেঁচকা টানে সরিয়ে আনলো তাকে। ট্রাক ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে চলে গেছে। বুকটা ধকধক করে উঠলো তিনজনেরই। রাস্তার পাশে টঙ দোকানের লোকেরা এসে ততক্ষণে ভিড় জমিয়েছে। চৈতির চিৎকার পৌঁছেছিলো তাদের কান পর্যন্ত। মাহা ভয়ে তখনো ঠকঠক করে কাঁপছে। এটা কি নিছকই এক্সিডেন্ট নাকি বড় কোনো প্রহসন! মাহাকে জড়িয়ে ধরলো চৈতি। রুমানাও ঠিক কি ঘটেছে তা জানতে না পেরে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে। উপস্থিত লোকগুলো ভিষণ ভালো। একটা লেগুনার ব্যবস্থা করে দিলো তাদের। তবে একটা কিন্তু রয়ে যায়। চৈতি মাহাকে কেন চৈতি বলে সম্বোধন করলো?
১১.
হোটেল মুসাফির। ছোটখাটো ছিমছাম হোটেল। ভিতরটা বেশ পরিপাটি আর গোছানো। হোটেলে পৌঁছেছে প্রায় একঘন্টা হলো। রুমানা পাশে বসে আছে। মাহা খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে। বিগত সময়গুলোতে যা ঘটে গেলো তাতে কারো মুখেই কোনো বুলি ফুটছেনা। নিরবতা ভাঙলো রুমানা।
“তোরা আজ রাতেই আমার বাড়ি যাবি। ফাইনাল!”
চৈতি মিইয়ে যাওয়া সুর নিয়ে বললো,
“তা কি করে হয়? আন্টি তো অসুস্থ। তাছাড়া..
“আর একটা কথা বললে তোদের দুটোর দাঁত ভেঙে দিবো আমি। এখন যাবি মানে এখন যাবি।”
রুমানা উড়নচণ্ডী মানুষ। হুটহাট রেগে যাওয়ার বাতিক আছে। অনেকটা পাগলাটেও বটে। একবার যা বলে দেয় মানে দেয়। তা অনেক চেষ্টা করেও কেউ পরিবর্তন করাতে পারেনা। তাই তো ভার্সিটিতে সকলে তাকে ক্ষেপাটে রুমা বলেই সম্মোধন করে। যদিও ডাকটা দেয় আড়ালে। এদিকে চৈতির কথার শোনার প্রয়োজনবোধ করলোনা রুমানা। চামড়ার খয়রী রঙা ব্যাগ থেকে নিজের কালো পার্সটা বের করলো। তাতে মোবাইল রাখে।
“হ্যালো, মা। আমি আসছি। সাথে চৈতি আর মাহাকেও নিয়ে আসছি।”
ওপাশের কথা শোনা গেলোনা। ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে মাহা আর চৈতিকে তোয়াক্কা না করেই তাদের ব্যাগ গোছানো শুরু করেছে রুমানা। মাহা বুঝলো এই মেয়ে আজ ক্ষেপেছে। ওর সাথে আজ না গিয়ে উপায় নেই।
হোটেল মুসাফির থেকে সব পাঠ চুকিয়ে তারা দাঁড়িয়ে আছে মাজার রোডের পাশে। রাস্তাটা অনেক সুন্দর, পরিচ্ছন্ন। ঢাকা শহরের মতো কোনো ইলেকট্রিক তার নেই, ইলেকট্রিক খুঁটি নেই। দেশে একখণ্ড বিদেশ যেনো। এসব ভাবতে ভাবতেই নিজের কাশ্মীরী চাদরটা আরো গভীর ভাবে শরীরে জড়িয়ে নিলো চৈতি। মাহার একটা হাত রুমানার হাতে নিবদ্ধ। তখনই ট্যাক্সি নিয়ে এলো জিদান।
“রুমাপু, এই শীতের রাতে এভাবে না খাটালেও পারতি। উঠে বস।”
গাড়িতে উঠে বসলো তিনজনে। জিদান রুমানার চাচাতো ভাই। এবার সিলেট কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। রুমানা অবশ্য একা। ভাই-বোন নেই। বাবাও নেই। সে আর তার মা, তার চাচা-চাচি, তাদের ছেলেমেয়ে জিদান, জিমা একত্রে থাকে রুমানাদের বাড়িতে। বাবা মতিউর ছিলেন বড় ব্যাংকার। অঢেল সম্পত্তি রেখে গিয়েছেন রুমানার নামে। মেয়ে যখন থেকে পাড়ি জমিয়েছে ঢাকা তখন থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন রুমানার মা। অগত্যা রুমনাকে হরহামেশাই ঢাকা সিলেট যাতায়াত করতে হয়। চৈতি এসব ভাবতে ভাবতেই একটা দুতালা বাড়ির সামনে এসে থামলো ট্যাক্সি। অন্ধকারে কিছুই স্পষ্ট নয়। তবে বিশাল বড় জং ধরা একটা লোহার গেট। গেটের একপাশে একটা বাগানবিলাস গাছের উপরের অংশ বেরিয়ে। পুরোটাই বাইরে কেবল গোড়াটা ভিতরে। সেই গাছ হলুদ টিমটিমে লাইট দিয়ে সাজানো। গেটের অপরপাশে টিমটিমিয়ে জ্বলছে একটা সাদা বাতি৷ তার থেকে অপর পাশটা অর্থাৎ বাগানবিলাস গাছের দিকটাই বেশি আকর্ষণীয়।
১২.
“আমার বাড়িতে তোদের স্বাগতম।”
এতক্ষণে মাথা ঠান্ডা হয়েছে মেয়েটার। হাফ ছেঁড়ে বাঁচলো মাহা আর চৈতি। এই মেয়ে যা রাগী!
“এই যে বাড়িতে নিয়ে আসলি। আর আমরাও খালি হাতে চলে এলাম। কি একটা বেয়াদবি কান্ড বলতো। আন্টি কি ভাববেন?”
মাহার কথা শুনে হা হা করে কতক্ষণ হাসলো রুমানা।
“আরে গর্দভের দল। বান্ধবীর বাসায় আবার এত ফর্মালিটি কিসের! আমার মা তোদের মতো ব্যাকডেটেড না। আজাইরা কথাবার্তা।”
এহেন কথার পরিপ্রেক্ষিতে ঠিক কি উত্তর দেওয়া যায় বুঝে পেলোনা মাহা। মাঝে ছোট একটা খালি জায়গা। জিদান ততক্ষণে দৌঁড়ে চলে গেছে ভিতরে। বাড়ির ভিতরে দুতালায় উঠার সিঁড়ি। ছোটখাটো ছিমছাম বাসা। অদ্ভুতরকম সুন্দর। রুমানা গটগট আওয়াজ তুলে হেঁটে যাচ্ছে ভিতরে। মাহা আর চৈতি তার পিছুপিছু। তাদের হাতে লাগেজ। বেশি ভারী না তাই মাহার টানতে তেমন কষ্ট হচ্ছেনা।
রুমানার চাচি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। তবে চৈতির মনে হলো হাসিটা কৃত্রিম। দুতালায় পাশাপাশি তিনটা রুম। সুন্দর করে সাজানো, গোটানো, পরিপাটি। সামনে খোলা বারান্দা। বারান্দার পাশে একটা আমগাছ। সামনে বাড়িঘর থাকলেও পিছনে বিশাল জঙ্গল। কোনার রুমটায় অর্থাৎ আমগাছের পাশের রুমটায় মাহা আর চৈতিকে থাকতে দিয়েছে রুমানা। অপরপাশের টা রুমানার ঘর। রুমানার মা ঘুমিয়ে আছেন বিদায় তাকে আর বিরক্ত করেনি তারা।
ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে নিচে যখন তিনজনে খাবার খেতে আসলো তখন রাত সাড়ে এগারোটা। রুমানার চাচি বসে আছেন খাবার নিয়ে। খাবার শেষে মাহা, রুমানা চলে গেলেও রয়ে গেলো চৈতি। পানি খেতে খেতে কানে এলো রুমানার চাচি বলছেন,
“পেয়েছেটা কি? রাত বিরাতে মানুষ নিয়ে হাজির হয়। আমি ওর কিনা গোলাম! আশ্রয় দিয়েছে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে?”
তখন ভেসে এলো একটা পুরুষালি কন্ঠ।
“আহ্, সেতু। শুনতে পাবে।”
“পেলে পাক। ভাইজান সবকিছু এই হতচ্ছাড়া মেয়েটার নামে লিখে দিয়ে গেছেন। উনার তো ছেলে নাই। তুমি তার ভাই হয়ে কি একটুও তার সম্পত্তি পাওনা হওনা?”
আর কিছু শুনতে পেলোনা চৈতি। মাহা ডাকছে। মানুষের কত রূপ! অবশ্য কাকে কি বলবে সেও তো একই পথের যাত্রী।
পরদিন সকালটা কেটে গেলো আড্ডায় আড্ডায়। বিকালে রুমানা তার মাকে নিয়ে চেকাপে বেরিয়েছে। রেডি হচ্ছে চৈতি আর মাহা। মাহাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো চৈতি। এতোদিনের অবসান শেষ। এবার সামনে আসতে চলেছে সেই ফোনের অপরপ্রান্তে কথা বলা পুরুষটা। মাহা বিরসমুখে চৈতির পানে তাকিয়ে বললো,
“কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?”
“ভালোবাসার পরীক্ষায় কোনো ঠিক বেঠিক নেই।”
“তবুও…
” হুস। যা হচ্ছে হতে দে। আমি পিছনেই থাকবো। লেট দ্যা গেম বিগিন।”
কি খেলা খেলছে দুজনে? কি পরিণতি হবে সেই খেলার? নাকি তারাই কোনো খেলার শিকার!
(চলবে)……