অলকানন্দা #পর্ব-৩৩,৩৪,৩৫

0
375

#অলকানন্দা
#পর্ব-৩৩,৩৪,৩৫
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৩৩

৯৪.
“যেভাবে এসেছিলে সেভাবেই চলে যাও।”

সার্থকের এমন থমথমে গলায়, বলা কথায় আলবার্ট সোফায় আরেকটু হেলান দিয়ে বসে। হাত দুটো একত্র করে নাড়ায় কতক্ষণ। মুখে হাসি।
“ভয় পেলে?”
আলবার্টের কন্ঠ। সার্থক পায়ের উপর পা তুলে বসেছে। পা নাড়াচ্ছে ছন্দে ছন্দে। কৌতুক সুরে বলে,
“আমি?”
“কেন? তুমি ভয় পাওনা?”
“সেটা তো আমার চেয়ে ভালো তোমার জানার কথা।”
“এখন তো সময় পাল্টেছে।”
“বাঘ শান্ত হয়ে বসে আছে বলে লেজে পা দিতে এসোনা। নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে কি মজা পাবে বলোতো?”
“তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করছো।”
সার্থক উঠে একদম আলবার্টের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। খানিক ঘাবড়ানো ভাবটা প্রকাশে আনলোনা আলবার্ট। সার্থকের মুখে বাঁকা হাসি। কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে কিছু একটা বলতেই আলবার্ট উঠে বেরিয়ে গেলো। আর কখনো এখানে আসবেনা বলে মনস্থির করেছে সে। মুইংচিন, নিভাসহ সকলেই চলে গিয়েছে নিজ ঘরে। রাজার রাজত্বে বাঁধা দেওয়ার বুদ্ধি, ক্ষমতা, শক্তি কোনোটাই তাদের নেই। সার্থক চললো তার অলকানন্দার কাছে।
________________

“এশা, মা। এসব আবার কোন ধরনের কথাবার্তা? হুট করে বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে? তোমার খালামনির সাথেই বা কখন কথা বললে? মনিরা আমাকে এ ব্যাপারে কিছু জানায়নি কেন? তাছাড়া তোমার গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট হয়নি এখনো।”
“আমি খালামনিকে না করেছিলাম, বাবা। আমি আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করতে চাই।”
“সিদ্ধান্ত কি ফাইনাল করে ফেলেছো?”
“জ্বি, বাবা।”

এশা অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশ ছেড়ে পাড়ি জমালো বিদেশে। রেজওয়ান খুবই অনুতপ্ত। সে বুঝতে পারছে মেয়েটির সাথে এরকম অশোভন আচরণ করা ঠিক হয়নি। তবে ততোদিনে পাখি নীড় ছেড়ে পালিয়েছে বহু দূরে। আজ রেজওয়ান এসেছিলো এশার সাথে কথা বলতে। এশার মায়ের কাছে জানতে পারলো এশা দেশে নেই। খালার কাছে চলে গিয়েছে। রেজওয়ান জানেনা কেন হঠাৎ করেই এশা নামের শ্যামবতী, এলোকেশী মেয়েটা তার ভাবনায় এতো আসছে। কেন?

চার বছরের সুখের সংসার সার্থক আর মাহার। সার্থক কখনো মাহাকে কোনোকিছুর কষ্ট দেয়নি। মাহা যেমন চেয়েছে, যেভাবে চেয়েছে সেভাবেই সব হয়েছে। মাহা মাঝে সৎ মা দিনার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু তিনি সাফ মানা করে দিয়েছেন মাহার সাথে তার, তার ছেলেমেয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। মাহা যেন কোনোদিন কোনো দাবি নিয়ে দিনার সামনে না যায়। সেদিন সার্থকের বুকে মাথা রেখে খুব কেঁদেছে মাহা। এই জীবনে আপন বলতে শুধু এই একজনই রইলো তবে। বাকি সবাই তো চলে গিয়েছে যোজন যোজন দূরে। নিভার আচরণে পরিবর্তন ঘটেছে অনেকটা। সে এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। রঙিন জামা পরিধান শুরু করেছে। মাহার সাথে সেই আগের মতোই হাসিখুশি ভাবে কথা বলে। অদ্ভুতভাবে লুবান আর রবার্ট যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। মাঝেমাঝে মনে হয় তাদের কোনো অস্তিত্বই কোনোকালে ছিলোনা এই গুলশানের বাড়িটায়। রুমানা এসেছিলো এই বাসায় কয়েকবার। বান্ধবীর এতো সুন্দর সুখের সংসার দেখে কত দোয়া করলো পাগলীটা। মাহা চিরপরিচিত সেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ। হাতে একটা সাদা খাম। তাতে সার্থকের জন্য বিশেষ কিছু অপেক্ষা করছে। বহু চেষ্টার ফল।

৯৫.
মাহা জানে এখনই সার্থক এসে পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরবে। ঠিক তখনই মাহাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো সার্থক। মানুষটা সত্যিই পাগলাটে। মাহা অনুভব করছে প্রিয় পুরুষের স্পর্শ। বিস্তৃত বারান্দায় টবে লাগানো চার পাঁচেক অলকানন্দা ফুলের গাছ। চাঁদের মিহি আলোয় হলুদ রঙটা অভূতপূর্ব লাগছে। মাহা সেদিকপানে তাকিয়ে বলে,
“আপনার জন্য একটা উপহার আছে।”
“কি উপহার?”

মাহা নিজেকে ছাড়িয়ে সার্থকের মুখোমুখি হলো। চাঁদের আলোয় সবুজ রঙা বাটিক থ্রি-পিস পরনে, নাকে নাক ফুল পরা হলদে ফর্সা মুখটা অপূর্ব লাগছে সার্থকের কাছে। টুক করে গালে একটা ভালোবাসার পরশ একে দিলো সে। মাহা বিরক্ত হয়ে বলে,
“উফ্, আপনিও না।”
“কি?”

দুই ভ্রু নাচিয়ে মজার ছলে জিজ্ঞেস করে সার্থক। মাহা সার্থকের বুকে মাথা রেখে শুধায়,
“দুষ্টু। আপনি ভিষণ দুষ্টু। যে আসবে সেও হয়তো আপনার মতোই দুষ্টু হবে।”
মাহার মাথায় হাত বুলানো থেমে যায় সার্থকের। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“কি বললে?”
“কই কি বললাম?”
“কে আসবে?”
মাহা হাতে থাকা খামটা এগিয়ে দেয় সার্থকের নিকট। সার্থক খানিক অবাক হয়ে খামটা হাতে নেয়।
“কি আছে এতে?”
“খুলে দেখুন।”
দুটো লাল দাগ দেখে অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে সার্থক। হতভম্ব, বিস্ময়ে হা হয়ে একবার হাতে থাকা জিনিসটায় আরেকবার মাহার পানে চায় সার্থক।
“আমি বাবা হবো?”
“হুম”

লজ্জায় কিঞ্চিৎ লাল হয় মাহার কপোল। টুপ টাপ করে দু’খানা ভালোবাসার পরশ মাহার গালে এঁকে দেয় সার্থক। অতঃপর কোলে উঠিয়ে ঘুরায় অনেকক্ষণ। সার্থকের বাম চোখের কার্ণিশ বেয়ে পড়ে একফোঁটা নোনাজল। অন্ধকারের রাজা, দুঃখের রাজার সাথে হয়েছে আলোর রাণীর মিলন মেলা। প্রকৃতি কি সইবে এই অসম সম্পর্ক?

__________

মাতব্বর শরীফ উধাও হওয়ার পর থেকেই যেন ভাটা পড়েছে চৈতির কেস। রেজওয়ান যা একটু তৎপর ছিলো। সিআইডির হাজারো ফাইলের নিচে ধামাচাপা পড়েছে সেই ফাইল। রেজওয়ান পুনরায় কাজে ফেরার পর নতুন কেসগুলোতে এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েছিলো যে আর খোঁজ নেয়নি পুরানো কিছুর। চলছে সার্থক মাহার জীবন। তবে আদোও কি এতো সুখে থাকতে পারবে? অভিমানী এশা আর অনুতপ্ত রেজওয়ানের মিল কি হবে? প্রশ্ন জাগে চৈতি কি করে মাহা হলো? সিলেটে কি ঘটেছিলো? মাহা কেন সব ভুলে গেলো? ছায়ামানব কে? চৈতির সাথে কি ঘটেছে? লুবান, রবার্ট কোথায়? মাতব্বর শরীফকে কে গায়েব করলো? মাহা যেদিন হাসপাতালে ছিলো তাকে কে মারতে চেয়েছিলো? ছায়ামানবকে অভ্যন্তরীণ খবর দেয় কে? মাতব্বর শরীফ ঘটনায় ইনচার্জ আজিজ কি করে আগুন লেগে মারা গেলেন? ওয়েন্ডিগোর সাথে ছায়ামানবের কি সম্পর্ক? সিলেটে মাহার জ্ঞান ফেরার পর কেউ কি ভুল তথ্য দিয়েছে সকলকে? এমিলিনের আসল পরিচয় কি? জুস নিয়ে সকলের এত আতংক কেন? আরো অনেক প্রশ্ন রয়ে যায়।

(চলবে)

#অলকানন্দা
#পর্ব-৩৪
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৯৬.
মাহার দুইমাস চলছে। এক অদ্ভুত জগতে বিচরণ চলছে মাহার। দেহের ভিতর বেড়ে উঠছে ছোট আরেক দেহ। মানবদেহ! সার্থক একটা পাগল! এখন থেকেই কত যত্ন তার। মাহা আজ বহুদিন বাদে রেজওয়ান আর রেজওয়ানের মায়ের সাথে কথা বলেছে। এটা সত্যি সার্থকের পর যদি আপন কেউ হয় তবে তারাই। রেজওয়ান এখনো বিয়ে করেনি। সাবিনা কত করে বুঝান। বয়স তো নেহাৎই কম হয়নি। ত্রিশ পেরিয়েছে সেই কবে। সাবিনা বৃদ্ধ মানুষ কয়দিনই বা বাঁচবেন। ছেলেকে এত করে বুঝান তিনি। ছেলে নাছোড়বান্দা। তাই মাহার শরণাপন্ন হয়েছেন। এখন মাহা যদি একটু বুঝাতে পারে। রেজওয়ানের সাথে কথা বলা শেষে লাইব্রেরিতে বসে একটা বই পড়ছে মাহা। সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন বইটা। এই নিয়ে কতবার পড়েছে মাহা জানেনা। প্রতিবারেই মাহা মুগ্ধ হয়ে বইটি পড়ে।
“দুধের গ্লাসটা যেমন রেখে এসেছিলাম ঠিক তেমনই আছে। খাওনি কেন তুমি?”

বলতে বলতেই মাহার মুখের সামনে দুধের গ্লাসখানা তুলে ধরে সার্থক। মাহা চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলেছে মুহুর্তেই। এই খাদ্য না না খাদ্য না এই অখাদ্যটা মাহার কোনোকালেই পছন্দ নয়। সার্থক কে সে শত বুঝিয়েও পারেনা। জোর করে ফল আর দুধের অত্যাচার চলে তার উপর। গুণে গুণে সকাল, বিকেল, রাতে।
“এভাবে কপাল কুঁচকে থাকলে হবেনা। হা করো।”
“দুধ মজা না।”
“তা কি মজা? চকলেট আর ফুচকা?”
“দেখুন খবরদার আমার প্রিয় খাবার নিয়ে ঠাট্টা করবেন না।”
“হুম, বুঝলাম। এখন ভদ্র মানুষের মতো হা করো তো মাহা।”

অগত্যা দুধটুকু গিলতেই হলো মাহাকে। এই লোক তাকে না খাইয়ে এক চুলও নড়বেনা সে জানে। কে বলবে সে মাস্টার্স কমপ্লিট করা এক মেয়ে! একেবারে বাচ্চাদের মতো সার্থক মাহাকে আগলে রাখে। বাইরের মাহা খুব শক্ত হলেও এই মানুষটার সামনেই তার যত আবদার, দুষ্টুমি। মাঝেমাঝে নিজেকে ন্যাকা ন্যাকা মনে হয়। আয়নার ওপাশে প্রতিবিম্বটা চিৎকার করে বলে,
“ইস্! ন্যাকামি দেখো এর।”
মাহাও ভেঙচি কেটে বলে, “আমার ন্যাকামির লোক আছে দেখেই করি।” ভাবতে ভাবতেই নিজেকে শূন্যে ভাসমান অবস্থায় পেলো মাহা। সার্থক কোলে উঠিয়ে নিয়েছে তাকে।
“উফ্! কি করছেন! বই পড়ছিলাম তো।”
“রাত অনেক হয়েছে, বউ। কালকে পড়ো আবার।”
“হুটহাট কোলে তুলে নেওয়াটা আপনার একটা বদভ্যাস বুঝলেন মিঃ।”

বলেই সার্থকের নাকে আলতো নিজের নাকটা ঘষে দিলো মাহা। সার্থক মাহার ঠোঁটে এক উত্তপ্ত চুমু খেয়ে বললো,
“যা চড়ার এখনই চড়ে নেও বউ। কয়েকমাস বাদে আর পারবেনা। আমার মা টা তখন আমার কোলে থাকবে। তখন তো মেয়েকে নামিয়ে নিজেই চড়ে বসে থাকতে চাইবে।”

সার্থকের উত্তপ্ত ভালোবাসা আর এহেনতর কথায় মাহা অবাক না হয়ে পারেনা। বেহায়া লোক! ঠোঁট টা তার ছিঁড়েই ফেলেছে বোধহয়। আহারে!
“রাখেন তো আপনার কথাবার্তা। আপনি জানলেন কি করে মেয়ে হবে? আমার তো ছেলে চাই।”
“উঁহু, মেয়ে চাই।”
মাহা মোচড়ামুচড়ি করছে। যার অর্থ সে আর থাকবেনা সার্থকের কোলে। সার্থক আত্মসমর্পণের সুরে বললো,
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। সময় হলেই দেখা যাবে।”
“হুম, আল্লাহ যা দেন।”

৯৭.
“এই মাহা, চলো বাড়ির সামনে সুইমিংপুলটার দিকে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসি। তোমারও ভালোলাগবে।”

মাহার পায়ে পানি নেমেছে। হাঁটতে কষ্ট হয় ভিষণ। নিভার হাসি মাখা কন্ঠে বলা কথায় মাহা প্রতুত্তর করলো,
“আপু, হাঁটতে কষ্ট হয়। উনিও বাসার বাইরে বের হতে মানা করেছেন।”
“ভাইয়ার কথা ছাড়োতো তুমি। এই সময়ে একটু হাঁটাহাঁটি না করলে চলে? ভাইয়া তোমাকে সারাদিন ঘরে বন্দি করে রাখে।”
“এভাবে বলোনা আপু। উনি বেবিকে নিয়ে একটু বেশিই পজিসিব।”
“একটু হাঁটাহাঁটি তো করাই যায়।”

নিভার জোরাজোরিতে গুলশানের বহুতল ভবনের সামনে সদ্য নির্মিত সুবিশাল সুইমিং পুলটার সামনে হাঁটতে বের হয়েছে মাহা। শরৎকাল চলছে। বিকেলের আবহাওয়া বড়ই স্নিগ্ধ। আকাশে ভাসমান পেঁজা পেঁজা তুলোর ন্যায় মেঘ। মাহা কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেই একটা আমগাছের তলায় রাখা বেঞ্চে বসলো। মৃদু বাতাসে মাহার কোঁকড়া চুলগুলো দুলছে। মাথায় অবশ্য উড়না দিয়ে ঘোমটা দেওয়া। পিঠে মেলে রেখেছে চুলগুলো। নিভা দাঁড়িয়ে আছে সুইমিংপুলের পাশে। হঠাৎ এমিলিন কোথা থেকে পাশে এসে দাঁড়ালো মাহার। পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও এমিলিন আজো মাহার নিকট এক বৃহৎ রহস্য।
“এই মেয়ে তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে?”

এত বছরে এই প্রথম এমিলিনের কন্ঠ শুনে অবাক মাহা। মায়াবী চোখদুটো বড় বড় করে মেলে দেয় এমিলিনের পানে। এমিলিন এসে বসে মাহার পাশে।
“আমাকে কিছু বলেছেন?”
“আশেপাশে আর কি কেউ আছে?”
“না, এত বছরে কখনো আপনি আমার সাথে কথা বলেন নি।”
“আজ বলবো। অনেক কথা বলার আছে তোমায়।”
মাহা চিন্তায় পড়লো খানিকটা। কি এমন বলবেন এমিলিন?
“আমি সার্থকের ছোট খালামনি। কানাডায় আমরা তিনবোন স্বামী, সংসার নিয়ে বেশ ভালোই ছিলাম। সার্থকের মা অর্থাৎ আমার বড়আপা সাজি খুবই ভালো একজন মানুষ ছিলেন। বড়পার বিয়ের কয়েকমাস বাদেই আমাদের বাবা-মা মারা যায়। বড়পা তখন ফারহান ভাইয়ার সাথে কানাডায়। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর মুহূর্তেই যেন এতিম হয়ে গেলাম আমরা তিনবোন। আমার বাবা-মা পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন। আত্মীয় বলতে আমাদের তেমন কেউই ছিলোনা। বড়পা আমাদের কানাডা নিয়ে গেলেন। আমাদের নিজের কাছে রেখে বিয়ে দিলেন ভালো জায়গায়। মায়ের আসনটা যেন বড়পাকে কবেই দিয়ে দিয়েছিলাম আমি। মেঝো বু এর মেয়ে নিভা। আমারও একটা ছেলে ছিলো। সার্থকের চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট। ভালোই ছিলাম আমরা। হঠাৎ করেই সব এলোমেলো হয়ে গেলো। ঘুরতে যাওয়ার পথে প্লেন দুর্ঘটনায় হারিয়ে গেলেন বড়পা, ফারহান ভাই। দশবছরের সার্থকেরও কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। কানাডার জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছিলো তারা। প্রায় একমাস বাদে উদ্ধার হলো সার্থক। তবে বড়পা আর ফারহান ভাইয়ের খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমার স্বামী স্ট্রোক করে মারা গেলেন হঠাৎ। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম মেঝো বুর বাসায় আমি, আমার ছেলে ইফতি, সার্থক সবাই মিলে থাকবো। ছোটবেলার হাসিখুশি সার্থক কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিলো। সারাদিন একটা অন্ধকার ঘরে নিজেকে আটকে রাখে। রাত হলে চিৎকার করে। বহু ডাক্তার দেখিয়েও এর কোনো বিহিত করা যায়নি। পরে হঠাৎ করেই যেন সব স্বাভাবিক হয়ে গেলো। সার্থক একদম নিরব হয়ে গেলো। মাঝেমাঝে কোথায় যেন হারিয়ে যেতো সে। কানাডায় ডাক্তারি পড়া শুরু করলো একসময়। আমার মেঝ বুয়ের সাথে তার স্বামীর ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিলো। এডওয়ার্ড ভাই ছিলেন খাঁটি কানাডিয়ান। একাধিক নারী সঙ্গ ছিলো তার। তাই মেঝ বু তাকে ডিভোর্স দেন। ডিভোর্সের পর আকস্মিক ভাবে এডওয়ার্ড কে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। খুবই জটিল আর অদ্ভুত পরিস্থিতি তে সময় কাটছিলো আমাদের। সার্থক উচ্চাকাঙ্খী হয়ে উঠে। পার্টি করা, ঘুরে বেড়ানো তার নিত্যদিনের কাজ। অনেক মানুষের আসা-যাওয়া হতো আমাদের বাসায়। যদিও ছোটবেলা থেকেই সার্থক তুখোড় মেধাবী। আমার কেন জানি মনে হতো অসৎসঙ্গে মজেছে সার্থক। আমি বাঁধা দিলাম তাকে। সে আমার কোনো কথাই মানলোনা। লুবান তার অনেক ভালো একজন বন্ধু হয়ে উঠলো। সাথে নিভা, নিভার বর রবার্ট, মুইংচিনও। কিছু একটা করতো তারা। রাতের পর রাত বাড়ি ফিরতো না। এরমাঝে সার্থক ডাক্তারি পাশ করে ইন্টার্নি করছে। আমার ছেলে ইফতিও একসময় তাদের সাথে মিশতে শুরু করলো। রাতের পর রাত বাড়ি ফেরার নাম নেই। মেঝো বু হঠাৎ মারা গেলেন। তিনি অবশ্য বিছানায় পড়েছিলেন বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে। হঠাৎ করেই সার্থক বিধ্বংসী হয়ে উঠলো। তাদের একটা কোড ওয়ার্ড হলো জুস। অনেকবারই তাদের মধ্যে এটা নিয়ে কথা হতো। আমার ছেলে ইফতি একদিন গায়েব হয়ে গেলো। আমি আজো জানিনা আমার মানিক কোথায়। আমার মানিক কে যারা গায়েব করেছে তাদের ধ্বংস আমি নিজ চোখে দেখে মরতে চাই। সার্থক…..

মাহা হতভম্বের ন্যায় শুনছিলো কথাগুলো। এটা ঠিক সার্থকের অতীত নিয়ে মাহা কিছু জানেনা। সার্থকও কিছু জানায়নি। মাহা তো সার্থক কে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। কি সুন্দর মনের মানুষটা! তাকে ঘিরে এসব কথা শুনতে মাহার ভালোলাগছেনা। তখনই সুইমিংপুলের পাশ থেকে নিভার চিৎকার ভেসে এলো। এমিলিন হয়তো আরো কিছু বলতেন। মাহা সেসব না শুনেই সুইমিংপুলের দিকে অনেকটা দ্রুত গতিতে ছুটে এলো। নিভা সুইমিংপুলের পানিতে পড়ে গিয়েছে।
“মাহা, মাহা আমি শ্বাস নিতে পারছিনা। আমাকে বাঁচাও মাহা।”

৯৮.

মাহা কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। এমিলিন দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। শত্রুর ভালোবাসার মানুষের নির্মম পরিণতি তাকে আনন্দিত করছে মনে মনে। তিনি জানেন কি হতে যাচ্ছে। মানুষজন নেই বললেই চলে। এদিকে এবেলায় কেউ আসেনা। নিভা ডুবে যাওয়া অবস্থায় হাতটা বাড়িয়ে দিলো মাহার দিকে। চিৎকার করে বললো,
“আমার হাতটা ধরো মাহা। দয়া করে ধরো।”
মাহার বোধশক্তি লোপ পেয়েছে। এভাবে চোখের সামনে একটা মানুষ কে কিভাবে ডুবতে দিবে সে! নিজের চিন্তা না করেই হাতটা বাড়িয়ে দিলো নিভার পানে। নিভা হেঁচকা টানে মাহাকে পানিতে ফেলে দিলো। মাহা সাঁতার জানেনা। বারবার চিৎকার করে বলছে,
“আমাকে কেন এভাবে কষ্ট দিচ্ছেন, আপু। আমার বাচ্চাটা কষ্ট পাচ্ছে।”

মাহা তখন সুইমিং পুলের মাঝে ডুবন্ত অবস্থায় নিজের জীবন বাঁচাতে চাইছে। আর নিভা বাঁকা হেসে সাঁতার কেটে সুইমিংপুলের পাশে বসে মজা নিচ্ছে। সার্থক নিজেকে কি মনে করে? এবারে একবারে সার্থকের কলিজায় হাত দিয়েছে নিভা। জানে মৃত্যু অবধারিত। তবুও শত্রুর সুখ যে তার সহ্য হচ্ছিলো না। হঠাৎ করেই হিংস্র বাঘের ন্যায় ভয়ানক লাল চোখ নিয়ে সাদা এপ্রোন পরনে দৌড়ে আসলো সার্থক। নিভা সার্থক কে সত্যি এখানে আশা করেনি। ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো তার। যত যাই হোক জানের মায়া আছে তার। সার্থক ততক্ষণে ঝাঁপ দিয়েছে সুইমিংপুলের পানিতে। নিস্তব্ধ মাহা ততক্ষণে হয়তো বরণ করে নিয়েছে মৃত্যুকে।

(চলবে)…

#অলকানন্দা
#পর্ব-৩৫
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৯৯.
মাহাকে ওটিতে নেওয়া হয়েছে। সুইমিংপুলে মাহার ছটফটানির দরুন পেটে চাপ পড়েছে অত্যাধিক। প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে। ভিতরে ডক্টর ওয়াসিফসহ আরো বিজ্ঞ কয়েকজন ডক্টর রয়েছেন। সার্থক একজন সার্জন হওয়ার পরেও ওটিতে যাওয়ার সাহস তার হলোনা। এই দুটো হাতে কত মানুষের বুক চিড়েছে সে। কত ওটি করেছে। কখনো হাত কাঁপেনি। কখনো কোনো দেহের কাঁ’টা ছিঁ’ড়ায় তার কিছুই যায় আসেনি। আজ কাঁপছে সারা শরীর, মন সব। ডক্টর জিনিয়া তাবাসসুম দেশ ছেড়েছে আজ প্রায় বছর দুয়েক হলো। সার্থকের মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে জিনিয়াকে তার বড্ড প্রয়োজন ছিলো। খুবই ভালো মানের একজন চিকিৎসক জিনিয়া। মাথায় অহেতুক চিন্তা ভাবনা ঘুরাঘুরি করছে। তীব্র অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে মস্তিষ্কে। পাগলের মতো পায়চারি করছে সার্থক। এমন সময় বেরিয়ে এলেন ডক্টর ওয়াসিফ।
“ডক্টর ফায়রাজ”

ওয়াসিফের ডাকে দ্রুত গতিতে তার সামনে এসে দাঁড়ায় সার্থক। বহু কষ্টে উচ্চারণ করে,
“আমা.. আমার স্ত্রী কেমন আছে ডক্টর?”
“আপনার স্ত্রী এখন আশঙ্কামুক্ত। তবে..
“তবে কি ডক্টর?”
“আপনার বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারিনি। আপনার স্ত্রীর প্রেগ্ন্যাসিতে অনেক কমপ্লিকেশন ছিল। পেটের উপর প্রচন্ড চাপ পড়ায় ব্লিডিং হয়েছে। তাই…

সাতমাসের বাচ্চাটা এভাবে চলে যাবে ভাবতেই পারছেনা সার্থক। কত স্বপ্ন বুনেছিলো দুজনে। কত আশা ছিলো বাচ্চাটাকে নিয়ে আজ সব শেষ। সব।

“ছেলে নাকি মেয়ে হয়েছিলো?”
“মেয়ে”

দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে সার্থকের বুক চিড়ে। দ্বিতীয়বারের মতো মাকে হারালো তবে। বুকের ভিতর চিনচিনে ব্যথা। কি ভেবেছে সবাই? সার্থকের কলিজায় আঘাত করে পাড় হয়ে যাবে সকলে? শরীর, মন জ্বলছে অনলে। বাঁকা হেসে ঘাড় কাত করে ওয়েন্ডিগো এলো বুঝি! একটা শক্ত কাগজের কার্টুনে ভরে বাচ্চাকে প্যাকেট করে সার্থকের হাতে দেওয়া হয়। বাক্স খুলে একনজর মা টাকে দেখার সাহস হয়নি সার্থকের। দহন, দহন হচ্ছে বুকের মধ্যখানে। সবকিছু ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে জাগছে। মাহাকে দুদিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। তাই আই.সি.ইউ তে রাখা হয়েছে। সার্থক বাইরে থেকে কাঁচের দেয়ালের এপাড় থেকে প্রিয়তমার ক্লান্ত মুখটা দেখলো কেবল একবার। দহনে একটু বৃষ্টি নামলো। অতঃপর বেরিয়ে এলো হাসপাতালের বাইরে। মায়ের দাফন কাজ সম্পন্ন বাকি!

_____________

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি বইছে বাইরে। গুলশানের বহুতল ভবনের অদূরে একটা কবরস্থান। একটু আগেই মাত্র একটা সাতমাস বয়সী বাচ্চার দাফন সম্পন্ন হয়েছে। আস্তে আস্তে বৃষ্টি বাড়ছে। বাচ্চার বাবা কবরের পাশটায় মাটির রাস্তায় বসে একধ্যানে কবরের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে করছে বিগতদিনের স্মৃতি। এই তো কিছুদিন পূর্বে,

মাহার পেটের উপর থেকে ঢোলা গেঞ্জিটা সরিয়ে টুপটাপ করে দু’খানা চুমু পেটে এঁকে দেয় সার্থক। মাহা এতো লজ্জা পায় সার্থকের এমন বেহায়াপনায়!
“কি যে করেন না আপনি। মুখ সরান। আমার সুড়সুড়ি লাগছে।”

মাহার কথা আদোও সার্থকের কানে গিয়েছে কিনা কে জানে। এবারে হরেকরকম গল্প জুড়ে দিলো পেটে থাকা অবুঝ শিশুটার সাথে।
“মা, বুঝলি তোর আম্মু আস্ত একটা হিংসুটে। মেয়েকে আদর করলেও সহ্য হয়না।”
“আপনি এতো শিউর কি করে মেয়েই হবে? এই চলুন না আলট্রাসনোগ্রাফি করে দেখি কি হবে?”
“না, মাহা। বাচ্চা জন্মের পর একেবারে জানবো আমরা। আমি জানি আমার মা ই আসবে।”
“আপনি ভিষণ পাগলাটে সার্থক।”

সার্থক মাহাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে,
“তোমারই তো।”
“হুম, আমার। একান্ত আমার। আ.. আ..

মাহা পেটে হাত রেখে চিৎকার করে উঠলো। সার্থক ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“এই মাহা ঠিক আছো তুমি? মাহা?”

মাহা চোখ-মুখ খিঁচে সার্থকের ডানহাত টেনে নিয়ে পেটে ছুঁয়ালো। বাবু কিক মারছে পেটে। মাহা চোখ-মুখ খিঁচে বললো,
“বাবার মতোই দুষ্টু হবে। খুব মজা পাচ্ছে মাকে মেরে।”

বলতে বলতেই গলা ভেঙে যায় মাহার। কান্না-খুশির অনুভূতিতে বাকরুদ্ধ সে। সার্থক অবাক হয়ে পেটে হাত ছুঁইয়ে রাখে। বাবু থেমে থেমে কিক করছে। সার্থক মাহার কাঁধে মুখ গুঁজে। দু-তিন ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে চোখ বেয়ে।
যেমনটা আজ পড়ছে। সার্থকের চোখের নোনতা অশ্রু আর বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে ধুঁয়ে নিয়ে যাচ্ছে সব। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় সার্থক। হিসাব -নিকাশ বাকি অনেক।

১০০.
“এবারের মতো আমাদের ক্ষমা করা যায় না?”

ক্রন্দনরত দুই মানবীর একজন বলে উঠে। সামনে চেয়ারে বসে বাঁকা হাসে ছায়ামানব। ক্ষমা শব্দটাই তো তার অপছন্দ। ভিষণ ভিষণ অপছন্দ।
“আজ একটা পরের জন্য নিজের আপনদের শেষ করে দিচ্ছো! সেই তোমার ধ্বংস ডেকে আনবে..
“শিস্, চুপ!”

মুখে আঙুল দিয়ে ধমকে উঠে ছায়ামানব। ধমকে কেঁপে উঠে সুউচ্চ বিল্ডিং। একজন মানবী জীবন ভিক্ষা চাইলেও আরেকজন নিশ্চুপ। তিনি যেন জানতেন এমন কিছুই হবে। আর কোনো কথা বলার সুযোগ কেউই পায়নি। বাইরে বৃষ্টির তালে তালে খ’ন্ড হতে থাকে আস্ত দুই মানবী। তাদের র’ক্তের একেকটা ছি’টে আনন্দে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে ছায়ামানবের। তান্ডব করতে ইচ্ছে করছে। খুশির তান্ডব।

_________________

মেরির কাছ থেকে মাহার অসুস্থতার কথা শুনে হাসপাতালে ছুটে এসেছে রুমানা, এশা। রুমানার অফিসের কলিগ এশা। বিদেশ থেকে ফিরে পুরানো সকল কিছু ভুলেই সিলেটে একটা কোম্পানিতে চাকুরি করছে এশা। রুমানা এশাকে চিনতো না। পরে কথায় কথায় একদিন পরিচয় হয়। সেই থেকে কোকিল অর্থাৎ মাহার আত্মীয় বিধায় এশাকে যথেষ্ট স্নেহ করে রুমানা। এক দরকারি কাজে আজ ঢাকা এসেছিলো দুজনে। মাহার সাথে দেখা করতে এসেই মাহার হাসপাতালে থাকার খবর পায় তারা। অদ্ভুতভাবে রেজওয়ান একটা কেসের তদন্তে আজ হাসপাতালে এসেছিলো। রুমানাকে হাসপাতালে দেখে অবাক হয় রেজওয়ান। চৈতি কেসের তদন্তে রুমানার সাথে অনেক কথাই হয়েছিলো রেজওয়ানের। রিসিপশনে কথা বলছে রুমানা। তার পাশে নীল থ্রি-পিস পরনে শ্যামবতী একজন কে দেখে থমকে যায় রেজওয়ান। এই কাঙ্ক্ষিত মুখটা দেখার জন্য মন বড়ই ছটফট করতো তার। চোখের পলকে হারিয়ে গেলো দুজনে। রেজওয়ান দৌড়ে রিসিপশনের কাছটায় এসে চারপাশে তাকাতেই দেখে বামদিকের সিঁড়ি বেয়ে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে উপরে উঠছে রুমানা আর এশা। রেজওয়ানও তাদের পিছুপিছু ছুটে আসে। উচ্চস্বরে ডাক দেয়,
“রুমানা। এই রুমানা।”

তাড়াহুড়ো করে পিছু ফিরে রুমানা। সাথে এশাও। প্রিয় মানুষটাকে এতো বছর পর সামনে দেখে থমকে যায় এশার পৃথিবী। হৃদপিণ্ডের ধুকপুক ধুকপুক শব্দটা বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। নিজেকে সামলে নেয় এশা। রেজওয়ান রুমানার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,
“এত হন্তদন্ত হয়ে কোথায় ছুটছো?”
“আপনি খবর পাননি রেজওয়ান ভাই?”
“কিসের খবর?”
“মাহার এ’ক্সি’ডে’ন্ট হয়েছে। বাচ্চাটাও বোধহয় আর বেঁচে নেই।”
“কি!”

বুকটা কেঁপে উঠে রেজওয়ানের। মাহাকে রেজওয়ান ভালোবাসে। এখনো মনের কোণে লুকিয়ে রেখেছে সে ভালোবাসা সযত্নে।
“কোথায় মাহা এখন?”
“২০২ এ”
তিনজনে মিলে ২০২ নং কক্ষে হাজির হয়। মাহাকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পারিয়ে রাখা হয়েছে। হাতে স্যালাইন। আপাতত চার-পাঁচদিন মাহার বিশ্রাম প্রয়োজন। জেগে উঠলেই পাগলামি করবে মাহা। তখন শরীরে চাপ পড়বে তার। যা সার্থক চাচ্ছেনা। মাহার পাশে বসে আছে সার্থক। চোখদুটো লাল। বিগত তিন-চারদিন চোখের পাতা এক করেনি সার্থক। কেবল চেয়ে দেখেছে। নিশ্চুপ হয়ে নিজের অলকানন্দার হলদেটে ফর্সা মুখটা দেখেছে, ভালোবাসার পরশ বুলিয়েছে। মাথায় হাত বুলিয়েছে। মাহা একবারও তাকে বেহায়া পুরুষ বলেনি। একবারও না। কেন বলেনি! কেন? সার্থকের যে কষ্ট হচ্ছে। ভিষণ ভিষণ কষ্ট।
“ভাইয়া?”
রুমানার ডাকে লাল হওয়া নির্ঘুম চোখে পিছনে ফিরে সার্থক। বড্ড ক্লান্ত সে। জীবনযুদ্ধে সে ক্লান্ত। রুমানা, রেজওয়ান আর এশাকে দেখে উঠে দাঁড়ায় সার্থক। আলতো হাসার চেষ্টা করে তবে তা হয়না। রেজওয়ানের বুকটায় চিনচিনে অসহনীয় ব্যথা শুরু হয়েছে নিস্তব্ধ মাহার মলিন মুখটার পানে তাকিয়ে। এই মেয়ের জন্যই তো নিজের সব সুখ বিসর্জন দিলো সে। তবে আজ কেন মেয়েটার এই দশা!
“ভাইয়া, কোকিল কেমন আছে এখন?”
“কিছুটা সুস্থ।”

ভাঙা গলায় উত্তর দেয় সার্থক। মাহা গভীর ঘুমে। আগামী দু-তিন ঘন্টার পূর্বে ঘুম ভাঙবেনা তার। রুমানা, এশা কতক্ষণ যাবত বসে রইলো মাহার পাশে। রেজওয়ান টুকটাক কথা বললো। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাচ্ছে সে। এতোদিন পর হঠাৎ এশার সাথে দেখা আবার মাহার এমন অবস্থা। অথৈ সাগরে পড়েছে রেজওয়ান। অফিস থেকে জরুরি কল এসেছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রেজওয়ানের এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে।
“রুমানা কোথায় যাবে?”
“আমরা একটু মালিবাগের দিকে যাবো।”

রেজওয়ানের প্রশ্নে উত্তর দেয় রুমানা। তারও মনটা ভিষণ খারাপ।
“আমার সাথে চাইলে আসতে পারো। আমিও মালিবাগের দিকেই যাবো।”
মাহার ঘুমন্ত মুখপানে তাকিয়ে, সার্থকের উদাস চেহারার দিকে তাকালো রুমানা। একটা মানুষ অপর একটা মানুষকে ঠিক কতটা ভালোবাসলে এমন উদাসীন হতে পারে; সেই ব্যাখা রুমানার কাছে নেই। এশা এ সব কিছুর মাঝেই নিরব দর্শক। নিজের অনুভূতি লুকাতে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছে মেয়েটা।
“আমরা তাহলে আজ উঠি সার্থক ভাইয়া?”
“হুম”

কোনোমতে ঘাড় ফিরিয়ে কথাটুকু বলে আবার মাহার পানে তাকালো সার্থক। বিগত একঘন্টা কেবল রেজওয়ানের দুয়েকটা কথায় হু হা জবাব দিয়েছে সার্থক। বাকি পুরোটা সময় একধ্যানে তাকিয়ে ছিলো নিজের ঘুমন্ত অলকানন্দার পানে। যেন ঘরে অবস্থিত তিন প্রাণীর প্রতি কোনো আগ্রহই নেই তার। এশা, রুমানা, রেজওয়ান বেরিয়ে পড়লো কেবিন ছেড়ে। এশা, রুমানারও অফিসিয়াল জরুরি কাজ রয়েছে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছুটে যেতে হবে কর্মক্ষেত্রে। রেজওয়ান আলতো করে তাকালো এশার পানে। শ্যামবতী কিশোরী মেয়েটা এখন পরিপূর্ণ রমণী। বিয়ে হয়ে গিয়েছে বোধহয়। চুলগুলো আগের মতোই আছে হাঁটু সমান। গাড়িতে উঠে বসলো তারা। রেজওয়ান নিজেই ড্রাইভ করছে। পিছনে বসেছে রুমানা, এশা। রেজওয়ান কথা বলতে চাচ্ছিলো এশার সাথে। মূলত ক্ষমা চাইতে চাচ্ছিলো এশার কাছে। সুযোগ হয়ে উঠেনি। মালিবাগ আসতেই তড়িঘড়ি করে দুজনে নেমে চলে যায়। রেজওয়ান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের পানে। মাহার জায়গা সারা হৃদয়জুড়ে তবে একটু ফাঁকা জায়গায় বোধহয় নতুন একজন নাম লিখিয়েছে। কিংবা লিখিয়েছিলো অনেক আগেই রেজওয়ান বুঝেনি। সেই নতুনজন কি তবে এশা?

(চলবে)…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here