#অলকানন্দা
#পর্ব-৪২,৪৩,৪৪
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৪২
১১৪.
“আপনি আর কখনো মা হতে পারবেন না মিসেস ফায়রাজ।”
আজ মাহার চেক-আপ ছিলো। ডাক্তারের বলা শেষ বুলিটাই কেবল ঘুরছে মাহার মাথায়। মাহা আর কখনো মা হতে পারবেনা! গাড়িতে বসে জানালা দিয়ে একদৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে মাহা। মনটা ভিষণ বিক্ষিপ্ত। সার্থক পাশে ড্রাইভিং করছে। ধূসর বর্ণের আকাশ। মন কেমন করে উঠা আকাশের মতিগতি। আজ মাহার সাথে পাল্লা দিয়ে আকাশেরও বুঝি মন খারাপ? এক নির্জন রাস্তায় গাড়ি থামায় সার্থক। দুপাশে ঘন সুপারি গাছের বাগান। নাম না কত পাখির ডাক ভেসে আসছে! দুজনেই নিরব হয়ে রইলো। সহস্র সময় বাদে মুখ খুলে সার্থক।
“মাহা?”
মাহা আনমনে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে। সার্থকের ডাক বোধহয় পৌঁছায়নি তার কানে।
“মাহা, শুনছো?”
মাহার হাত ধরে তাকে নিজের দিকে ফিরালো সার্থক। চোখ দুটো উদাসীন মাহার। নিজের সিট বেল্ট খুলে শক্ত করে মাহাকে জড়িয়ে ধরে সার্থক। কি যে হলো মাহার! কান্নার বাঁধ ভাঙে এবার। জীবনটাই গেলো কাঁদতে কাঁদতে। এখন কান্নারাও হার মেনে গিয়েছে যেন। মাহা ছিল শান্ত, ধীর, আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন এক মেয়ে। কঠিন পরিস্থিতিও ঠান্ডা মাথায় কাজ করতো মাহা। আর আজ? কেন একজনের জীবনেই এত কষ্ট থাকে! একটু সুখের দেখা পেয়েও সেই সুখ ছোঁয়ার আগেই হারিয়ে গিয়েছে। নির্জনতা ছাপিয়ে আকাশে বাতাসে প্রতিফলিত হচ্ছে মাহার করুণ কান্নার সুর। এক হৃদয় ভাঙার সুর।
“চুপ, মাহা। আর না প্লিজ।”
মাহার কান্না যে সার্থকের সহ্য হয়না। অপারগ হয়ে বলে উঠে সার্থক। মাহার পিঠে হাত বুলায় অভ্যাসমত।
“আমি আর কখনো মা হতে পারবোনা সার্থক। আমি আপনাকে বাবা ডাক শোনার সুখ দিতে পারবো না। আমার যে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে সার্থক। আমার জন্য আপনি বাবা ডাক শুনতে পারবেন না।”
“চুপ, মাহা। আমার কিছু চাইনা। শুধু তুমি হলেই চলবে।”
“না, সার্থক। এটা হয়না। আপনি..আপনি আরেকটা বিয়ে করে নিন সার্থক। আমি চলে যাবো দূরে কোথাও।”
“বেশি বলে ফেললে না, তুমি? আমাকে ছেড়ে চলে যাবে তুমি? এতো সাহস তোমার? কোথায় গিয়ে লুকাবে? পৃথিবীর যেই প্রান্তে যাও না কেন আমি সেখান থেকেই খুঁজে বের করবো তোমাকে, মাহা!”
মাহাকে ছেড়ে দিয়ে গর্জে উঠে সার্থক। মাহা হতভম্ব। সার্থক এমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে ও কখনো ভাবেনি। সার্থক কোনোদিন মাহার সাথে উঁচু গলায় কথা বলেনা। গাড়িটা খুব দ্রুত চলছে। এমন সামান্য একটা কথায় সার্থক এতটা ক্ষেপে যাবে কল্পনাও করেনি মাহা। এ যেন অন্য সার্থক। এতটা রাগী! সারা রাস্তা আর একটা কথা বলার সাহস হয়নি মাহার।
______________
ঢাকার এক প্রসিদ্ধ বাস স্টেশন। আর কিছুক্ষণ বাদে বাস রওনা দিবে সিলেটের উদ্দেশ্যে। জানালার ধারে সিটে বসে শ্যামবতী এক পূর্ণ বয়স্ক রমনী। গাঁয়ে সাদামাটা হলদে রঙের শাড়ি। হাঁটু সমান চুলগুলোতে সবসময়ের মতো এলোমেলো বেণী। রমনীর চোখদুটো ভিষণ উদাস। আজ আবার বাবা-মাকে ছেড়ে, প্রিয় শহর ছেড়ে পাড়ি জমাবে সিলেটে। সেই সাথে না হওয়া প্রিয় মানুষটাকেও। রেজওয়ানকে এক তরফা ভালোবেসেছে এশা। সেই ছোটবেলা থেকে। তাই তো প্রিয় মানুষটার দেওয়া সামান্য আঘাতই ক্ষত বিক্ষত করেছে এশার হৃদয়কে। পাড়ি জমিয়েছে সুদূর বিদেশে। অপরিপক্ক থেকে পরিপক্ক হয়ে উঠেছে। পথটা বড়ই কঠিন ছিল। কিন্তু সেই মানুষটা? এতগুলো বছর কেটে গেলেও তিনি বিয়ে করেন নি কেন? ত্রিশের কোঠা পেরিয়েছেন সেই কবে। তবে কিসের এত অপেক্ষা? কার জন্য এত অপেক্ষা? পাখি তো নীড় ছেড়েছে বহুদিন আগে। হুম! মাহা অবুঝ হলেও এশা অবুঝ নয়। নিজের চোখে যে তৃষ্ণা ছিলো সেই তৃষ্ণা সে দেখেছে রেজওয়ানের চোখে। আফসোস! নিজের জন্য নয়। মাহা আপুর জন্য। এই কথাটা এশা কখনো কাউকে বলেনি। হৃদয়ের গোপন তালাবদ্ধ এক কুঠুরিতে যত্ন করে রেখেছিলো এতকাল। মাঝেমাঝে ভিষণ হিংসা হতো মাহা আপুর উপর। গাঁয়ের রঙের জন্যই কি তবে রেজওয়ানের ভালোবাসার রাণী মাহা? পরে আবার নিজেকে ধিক্কার দিয়েছে সহস্রবার। না, রেজওয়ান এমন মানুষ নন। মাহার বিয়ের খবর শুনে এতটা খুশি হয়েছিলো এশা! এবার বুঝি রেজওয়ানকে আপন করে পাবে তবে। না, সেটাও হয়নি। একবুক ভালোবাসার বদলে মিলেছে এক আকাশ অপমান, অবহেলা আর উপেক্ষা। এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে এশার বুক চিড়ে। ভালোবাসা না পাওয়ার হাহাকার। হঠাৎ কি মনে করে জানালা দিয়ে পিছনে তাকায় এশা। এটা স্বপ্ন? রেজওয়ান দাঁড়িয়ে। তার গাড়ির সামনে। আশেপাশে কি যেন ঘাড় ঘুরিয়ে খুঁজে চলেছে। ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে এশার বাস। তবে কি এএসপি রেজওয়ান এশাকে খুঁজতে এসেছে? হা হা করে হেসে উঠে এশার অদৃশ্য এক ছায়া। ‘তোমাকে খুঁজতে আসবে? পাগল হলে? তুমি কি হও তার?’ সত্যিই তো এশা তো কিছু হয়না। কিছু না। এশা সন্তপর্ণে চোখের জল মুছে ফেলে। আবারও বাইরে তাকিয়ে রেজওয়ানের প্রায় মিলিয়ে যাওয়া অবয়বটাকে বলে,
“ভালো থাকবেন। ভাগ্যে থাকলে আবার দেখা হবে আমাদের।”
রেজওয়ান হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। কেউ কি তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বললো? রেজওয়ান এখানে এসেছিলো এশার সাথে কথা বলতে। এশার বাড়িতে গিয়েছিলো। সেখান থেকেই জানতে পারে এশা আজ সিলেট চলে যাচ্ছে। বাস স্টেশনে তাই শেষবারের মতো আবার এসেছিলো ক্ষমা চাইতে। রেজওয়ান নিজেও জানেনা কেন এসব করছে? তবে মনে হচ্ছে এ মুহূর্তে ক্ষমা না পেলে তার খুব কষ্ট হবে। কিন্তু এশাকে বহু খুঁজেও পেলোনা রেজওয়ান।
(চলবে)…
#অলকানন্দা
#পর্ব-৪৩
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
১১৫.
দুদিন যাবত সার্থক মাহার সাথে কথা বলছেনা। সার্থকের এমন অদ্ভুত আচরণে বিস্মিত মাহা। ছোট একটা কথাই তো বলেছে। এত রাগ করার কি আছে! এত বয়সে এসেও এমন বাচ্চাদের মতো আচরণ কি মানুষ কে মানায়! মাহা তো নিজেও একটা খারাপ পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। সার্থক কি একটুও বুঝতে পারছেনা মাহার বর্তমান পরিস্থিতি। দুয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে মাহা। সার্থক কোনো কথারই জবাব দেয়নি। তাই মাহাও কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। সব সময় এসব অদ্ভুত আচরণ মেনে নেওয়া যায় না। এই তবে ভালোবাসা! বাগানের এককোণে একটা স্টিলের তৈরি দোলনা রয়েছে। দোলনায় বসে সামনে তাকালে নয়নাভিরাম চমৎকার। দূরে কেবল পাহাড় আর পাহাড়ের সারি। নেশা ধরে যায়। প্রকৃতির মাঝে বিলীন হতে মন চায়। মাহা আনমনে বসে আছে দোলনায়। আজ মন বিষণ্ণ। তাই শত চেষ্টা চালিয়েও প্রকৃতি তে বিলীন হতে পারছেনা মাহা। সার্থক বাসায় নেই। সকালেই বেরিয়ে পড়েছে। নাস্তাও খেয়ে যায়নি। তাই মাহাও খায়নি। মাহা বিষণ্ণ গলায় গুণগুণ করছে রবিঠাকুরের গান,
আরো আঘাত সইবে আমার, সইবে আমারো।
আরো কঠিন সুরে জীবন-তারে ঝঙ্কারো ॥
যে রাগ জাগাও আমার প্রাণে বাজে নি তা চরম তানে,
নিঠুর মূর্ছনায় সে গানে মূর্তি সঞ্চারো ॥
লাগে না গো কেবল যেন কোমল করুণা,
মৃদু সুরের খেলায় এ প্রাণ ব্যর্থ কোরো না।
জ্ব’লে উঠুক সকল হুতাশ, গর্জি উঠুক সকল বাতাস,
জাগিয়ে দিয়ে সকল আকাশ……
চরণ পূর্ণ করার আগেই চুপ করে মাহা। কেউ কি পিছনে আছে? বাজ পাখির মতো তীক্ষ্ণ নজরে চেয়ে কেউ দেখছে কি তাকে? বাতাস বইছে শো শো করে। মাহার হৃদপিণ্ড থমকে আছে অজানা কোনো আতঙ্কে। কেউ কি আছে! মনে হচ্ছে এগিয়ে আসছে মাহার দিকে। একেবারে কাছে। আর একটু হলেই ছুঁয়ে ফেলবে। মাহা হকচকিয়ে যায়। সেই ব্যাক্তি হাত বাড়াচ্ছে। সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ…
মাহা পিছন ফিরে চায়। ডেভিড দাঁড়িয়ে। মাহা দোলনা থেকে উঠে দাঁড়ায়। কালো বৃহদাকার দানবের মতো এক প্রাণ দাঁড়িয়ে মাহার সামনে। মাহা নিজের ওড়নাটা মাথায় টেনে দেয়। ডেভিড এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে মাহার পানে। মাহা চলে আসতে নিলে ডেভিড পিছু ডাকে,
“এই শুনুন”
কি বিকট আর অদ্ভুতুড়ে গলার সুর। মাহা পিছু ফিরে বলে,
“আমাকে বলছেন?”
“হ্যাঁ”
বলেই মাহার সর্বাঙ্গে একবার চোখ ঘুরিয়ে নেয় ডেভিড। মাহা আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে। বিরক্তি এবং রাগ উভয়ের সংমিশ্রণ হচ্ছে তার।
“আপনি এভাবে তাকাচ্ছেন কেন? আপনার কি বলার কিছু আছে?”
এমন কথায় কিছুটা থতমত খায় ডেভিড। এশিয়ার মেয়েদেরকে তার বরাবরই ভালোলাগে। এই মেয়ে যেমন মায়াবী তেমনই তার দেহের গঠন। হিংস্রাত্মক কামনায় হাত কচলায় ডেভিড। মাহা কোনো উত্তর না পেয়ে নিজের ঘরে ফিরে আসে। এই বাড়ির মানুষগুলো বড়ই বিচিত্র। মেরি, নাহার, মুইংচিন এরা হঠাৎ করেই কোথায় যেন উদাও হয়ে যায়। কি যেন রহস্যময় আবহাওয়া বিরাজ করে চতুর্দিকে। ডেভিড দৌঁড়ে যায় মেরির ঘরে। দরজা আটকে দেয়। মেরি তখন সবে গোসল করে বেরিয়েছে। ডেভিড মেরিকে শক্ত করে জড়িয়ে এক উত্তপ্ত চুমো খায়। তারপর পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে মেরির উপর। মেরি প্রথমে খানিক অপ্রস্তুত হলেও পরে ডেভিডের ডাকে সাড়া দেয়। নিজের কামনা মিটিয়ে যখন ডেভিড ফিরে আসতে চাইলো তখন মেরি জড়িয়ে ধরে ডেভিড কে। ডেভিড এক ঝটকায় সরিয়ে দেয় মেরিকে। প্রত্যেকবারের মতো এবারেও কষ্ট পায় মেরি।
“আমাকে কেন বারবার ব্যবহার করো তুমি? আমি কি দোষ করেছি?”
“চুপ!”
“কেন চুপ করবো আমি!”
মেরি চিৎকার করতে নিলে ডেভিড তার মুখ চেপে ধরে। রাগে হিসহিসিয়ে বলে,
“তোমরা সাদা চামড়ার মানুষ। আমি সাদা চামড়ার মানুষদের ঘৃণা করি।”
“তাহলে বারবার আমার কাছে কেন আসো?”
“চাহিদা মেটাতে। তুমি আমার ভোগ্যবস্তু।”
“খবরদার ডেভিড। মুখের ভাষা ঠিক করো।”
মেরি কে ছেড়ে দিয়ে হা হা করে হেসে উঠে ডেভিড। মেরির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“মাহা সকল সৌন্দর্যের ঊর্ধ্বে।”
বলেই শার্ট হাতে নিয়ে বেরিয়ে যায় ডেভিড। পাশে থাকা ফুলদানিটা ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলে মেরি। মাহা, মাহা আর মাহা। লুবান, রবার্ট, সার্থক সবার কেবল একজনকে নিয়েই কেন এত আগ্রহ! কি আছে এই মেয়ের! এখন আবার ডেভিড যুক্ত হলো। নিভা ঠিকই বলতো মাহা মেয়েটা ধ্বংস ডেকে আনবে। এত বছরের সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে এই মেয়ের কারণে। যেই ধ্বংসের খেলা শুরু হয়েছে অনেক আগেই এবার সেটা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। হুট করেই মাহার প্রতি এক ক্ষোভ জন্ম নেয় মেরির।
১১৬.
“কোকিল রে আমার রাতুল কোথায় যেন হারিয়ে গেছে!” ফোনের উপারে কথাটা বলেই কেঁদে উঠে রুমানা।
“মানে! কি সব বলছিস রুমানা!”
বিস্মিত কন্ঠস্বর মাহার।
“প্লিজ, মাহা। তুই একটু রেজওয়ান ভাইকে আসতে বল। চব্বিশ ঘণ্টা না হওয়ায় পুলিশ কেস নিতে চাচ্ছেনা। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মাহা। অনিক পাগলের মতো সারা শহর খুঁজে এসেছে। কোথাও পায়নি আমার রাতুল কে।”
“শান্ত হ প্লিজ। আমাকে একটু বল কখন হারিয়েছে রাতুল?”
“প্রি-স্কুল থেকে প্রতিদিন অনিকই রাতুলকে নিয়ে আসে। আজকে অনিকের একটু লেট হয় যেতে। গিয়ে দেখে রাতুল নেই। সিকিউরিটি গার্ডও বলতে পারছেনা রাতুল কোথায় গেছে। এখন রাত দশটা আমার মানিক কে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কি করছে, কেমন আছে কিছু জানিনা। পুলিশ স্টেশনে গেলাম তারা কিছুই করছেনা। তুই প্লিজ রেজওয়ান ভাইকে কল করে বল উনি যেন সিলেট পুলিশ স্টেশনে একটু যোগাযোগ করেন।”
“আচ্ছা, তুই টেনশন করিস না। আমি দেখছি কি করা যায়।”
রুমানার কল কেটে রেজওয়ান কে কল দেয় মাহা। রেজওয়ানের মোবাইল বন্ধ। খোলা থাকবে কি করে সে তো এখন ফ্লাইটে। বিশেষ প্রয়োজনে কয়েকমাসের জন্য বিদেশ যাচ্ছে। এদিকে বারবার ফোন দিয়ে মোবাইল বন্ধ পাচ্ছে মাহা। তাই সাবিনা বেগম কে কল করে মাহা। রেজওয়ানের বিদেশ যাত্রার খবর শুনে চিন্তায় পড়ে যায় সে। এখন কি হবে! রুমানার বাড়ির এড্রেস মাহার জানা আছে। তাহলে কি সার্থক কে একবার বলবে নিয়ে যেতে? বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে মাহা। সার্থক কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছে হাসপাতাল থেকে। সোফায় হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে সার্থক।
“শুনছেন?”
কোনো জবাব নেই। মাহার হঠাৎ কি যে হলো। প্রচন্ড রাগে সে বললো,
“রুমানার ছেলে রাতুল হারিয়ে গিয়েছে। আপনি কি আমার সাথে যাবেন? নাকি আমি ড্রাইভার কে নিয়ে চলে যাবো?”
“কি!”
অবাক হয় সার্থক। সেসব দেখার সময় মাহার নেই। ও ওড়না মাথায় পেচিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। সার্থকও ছুটলো মাহার পিছুপিছু। কিন্তু মন বলছে অন্য কথা। তবে কি সার্থকের ধারণা সঠিক! যদি এর পিছনে সত্যতা পায় তাহলে কথার খেলাপ করার জন্য ভয়াবহ শাস্তি পাবে সেই ব্যাক্তি।
(চলবে)….
#অলকানন্দা
#পর্ব-৪৪
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
১১৭.
“কোকিল, কোকিল রে আমার রাতুল কই চলে গেলো! আমার মানিক।”
মাহাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো রুমানা। এশা পাশে দাঁড়িয়ে। পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে সে।
“আমার মা মারা যাবার পর এই পৃথিবীতে আপন বলতে আর কেউ ছিলোনা। মাকে আমি কতটা ভালোবাসতাম তুই তো জানিস, কোকিল। আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। অনিক আমাকে রাতুল এনে দিলো। আমার স্বর্গসুখ। আজ কই গেলো আমার মানিক।”
চিৎকার করে কান্না করছে রুমানা। মাহা নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি জবাব দিবে বুঝে উঠতে পারছেনা। সার্থক অনিকের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অনিকের মুখ গম্ভীর। চোখেমুখে গভীর বেদনা ভেসে উঠেছে। সার্থক জিজ্ঞেস করে,
“পুলিশকে জানিয়েছেন?”
“জানিয়েছি। প্রথমে তারা অভিযোগ নিতে চাচ্ছিলো না। পরে উপর মহলের সাথে কথা বললাম। তারা বললো সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। এতঘন্টা পেরিয়ে গেলো কোনো খোঁজই তারা দিতে পারছেনা।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিক। ছেলেদের তো কাঁদতে নেই। রুমানা তো মেয়ে। তাই হাউমাউ করে কান্না করে নিজের বুকের ব্যথা প্রকাশ করতে পারছে। কিন্তু অনিক! বাবা হয়েও সে চাইলেই কাঁদতে পারছেনা। অনিকের যে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ভিষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সার্থক কেবল চেয়ে আছে। স্মৃতিগুলো মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে। নিজের সন্তান হারিয়ে ঠিক এভাবেই ভেঙে পড়েছিলো সে। সব ভুলে নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিলো আপনার চেয়েও আপনজনের সাথে। তা কি হয়! এই জীবন যে সার্থকের জীবন! ‘অ্যা হ্যাপি ফ্যামিলি’ যে সার্থকের জীবনে মানায় না। অনিকের বাবা-মা নেই। রুমানার মতো সেও এতিম। দুজনের সুখী পরিবার যেন রাতুলের আগমনে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো। আজ কোথায় আছে সেই রাতুল! অজানা! রুমানাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে মাহাই অসুস্থ হয়ে পড়ে। মাথাচাড়া দিয়ে উঠে সেই পুরানো স্মৃতি। মেয়েটা! ক’ব’রে একা শুয়ে। মাহাকে ডাকছে। মাহাকে ভিষণ প্রয়োজন। মাহা সোফায় জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। তড়িৎ গতিতে সার্থক ধরে ফেলে মাহাকে। রুমানা তখন নিজের মাঝে নেই। এশা এগিয়ে আসে।
“ভাইয়া, মাহা আপুর কি হয়েছে?”
অনিকও চিন্তিত। সার্থক মাহাকে কোলে নেয়।
“প্রেশার ফল করেছে। আমি ওকে নিয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছি।”
এশা আর বাঁধা দিলোনা। সার্থক একবার রুমানার পানে তাকায়। রুমানার কোনো খোঁজ খবর নেই। বিলাপ করে যাচ্ছে। মাহাকে কোলে নিয়ে অনিকের সামনে বিব্রত ভঙ্গিতে দাঁড়ায় সার্থক।
“চিন্তা করবেন না মিঃ অনিক। আপনাদের বাচ্চা ফিরে আসবে।”
বলেই বেরিয়ে পড়ে সার্থক। মাহাকে পিছনে শুইয়ে দিয়ে ড্রাইভ করছে সার্থক। অবচেতন মন বারবার বলছে, ‘এটা মেনে নেওয়া যায় না। সন্তান তুমিও হারিয়েছো। মর্ম বুঝতে পারো। কতটা কষ্ট হয় বুঝতে পারো।’
বাড়ি ফিরে মাহার শরীরে ইনজেকশন পুশ করে সার্থক। মাহা গভীর ঘুমে।
১১৮.
“বাচ্চাটা কোথায়?”
“জানিনা”
“সত্যিই জানোনা?”
“না।”
“মিথ্যা বলোনা। আমি মিথ্যা পছন্দ করিনা।”
ছায়া মানবের প্রশ্নে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তি নিশ্চুপ।
“চুপ কেন? জবাব চাই আমার!”
টেবিলে ঘুষি দিয়ে চিৎকার করে ছায়ামানব। নিচে বসে থাকা ব্যাক্তি কেঁপে উঠে। এতদিন অন্যের ক্ষেত্রে ছায়ামানবের এই ভয়াবহ রূপ দেখতো ব্যাক্তিটা। আজ দেখছে নিজের বেলায়।
“কি হলো! কথা বলো!”
“আমি কিছু করিনি।”
টেবিলের উপর থেকে নিরবে মাউথ অর্গান তুলে নেয় ছায়ামানব। বাজাতে থাকে পাগলের মতো। অদ্ভুতুড়ে সে সুর! শরীর কাঁপানো, মন ভুলানো সে সুর। মানবদেহে হাজারো বিষ পিঁপড়া ছেড়ে দিলে পিঁপড়াগুলো যখন সারাদেহে ছড়িয়ে পড়ে। বিষাক্ত একেকটা কামড়ে দেহে যেমন ব্যথা অনুভব হয় ঠিক তেমন ব্যথা অনুভব হয় মস্তিষ্কে। ব্যাক্তিটা মাথা চেপে ধরে বলে,
“বন্ধ করো। প্লিজ। আমি সব বলছি।”
বাঁকা হেসে মাউথ অর্গান বাজানো বন্ধ করে ছায়ামানব।
“কোথায় বাচ্চাটা?”
“খেয়ে ফেলেছি।”
“হোয়াট!”
অবাক হয় ছায়ামানব। রাগ দমন করা দায় হয়ে পড়ে তার জন্য।
“কেন এমন করলে তুমি!”
“টুমি জানোনা আমি বাচ্চাদের কচি মাং’স বালোবাসি।”
“চুপ!”
ভয়ংকর চিৎকার করে উঠে ছায়ামানব। সামনে থাকা ব্যাক্তিটা আর কিছু বলার সাহস পায়না।
“আমি মানা করেছিলাম না?”
ভয়াবহ নিরবতা চারপাশে। বহুদিন বাদে আবারো তরল গলগলে উষ্ণ রক্তিম পদার্থে রাঙা হয় ছায়ামানবের শরীর। দেহ খন্ড বি’খ’ন্ড করার সময় প্রথম বারের মতো একটু কেঁপে উঠে ছায়ামানব। যেমনটা বাবাকে করার সময় হয়েছিলো। আজ বহুবছর পর বিশস্ত ব্যাক্তিটা কে হত্যা করলো ছায়ামানব।
_____________
মাহা বিষণ্ণ হয়ে থাকে এখন। কয়েকবার রুমানার বাড়িতেও গিয়েছিলো মাহা, সার্থক। রুমানা বদ্ধ উন্মাদের মতো হয়ে গিয়েছে। আজ রাতুল হারিয়ে যাওয়ার পনেরো দিন চলছে। কোনো খোঁজই পাওয়া যায়নি রাতুলের। রেজওয়ান কথা বলেছে সিলেট পুলিশের সাথে। তারা চেষ্টা করছে। হঠাৎ সার্থক বাইরে থেকে এসে বললো,
“মাহা, চলো।”
“কোথায়?”
“পুলিশ স্টেশনে।”
“কেন?”
“রাতুল কে যে অপহরণ করেছে তার সন্ধান মিলেছে। স্কুলের কিছুটা সামনে এক সিসিটিভি থেকে পুলিশ অপরাধীকে শনাক্ত করেছে।”
বাকি কথাগুলো আর শুনেনি মাহা। গাড়িতে করে কখন পুলিশ স্টেশনে পৌঁছালো তা সে নিজেও জানেনা। এশা, রুমানা আর অনিক বসে আছে৷ মাহা রুমানার কাছে ছুটে যায়। রুমানার মুখে আজ খানিক হাসি। রাতুল কে আবার ফিরে পাবে তারা। পুলিশ অফিসার অনিক এবং সার্থক কে ডেকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। বাইরে রুমানার পাশে এশা আর মাহা বসে।
“আমার রাতুল কে আবার ফিরে পাবো কোকিল। আমার মানিক আমার বুকে ফিরবে।”
সময় যাচ্ছে। একেকটা সেকেন্ড যেন এক বছরের সমান। অনেকক্ষণ বাদে সার্থক, অনিক বেরিয়ে আসে। অনিকের মুখ রক্তশূণ্য। সার্থকেরও মুখ গম্ভীর। রুমানা দৌড়ে অনিকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
“রাতুলকে ওরা খুঁজে পেয়েছে, অনিক?”
অনিক অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে রুমানার দিকে।
“কথা বলছো না কেন তুমি? আমার রাতুল কই?”
অনিক শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রুমানাকে। সমাজের সব নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে অনিক। রুমানা স্তব্ধ হয়ে যায়। অনিকের মতো ছেলে কাঁদছে!
“আমাদের রাতুল আর আমাদের মাঝে ফিরবেনা রুমানা। তোমার ভাই জিদান সম্পত্তি না পাওয়ার ক্ষোভে আমাদের বাচ্চাটাকে পাহাড় থেকে ফেলে দিয়েছে রুমানা। আমাদের রাতুল আর নেই।”
রুমানা জ্ঞান হারায়।
(চলবে)…