#অলকানন্দা
#পর্ব-৫,০৬
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
০৫
১৩.
“এই যে মিস? এই সিট টা আমার।”
“তো?”
মেয়েটার এমন নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়া দেখে সার্থকের মেজাজ চড়ে গেলো। আচ্ছা বেয়াদব মেয়ে তো। একে তো উচিত জবাব দিতেই হয়।
“তো মানে! আমার সিট থেকে উঠুন।”
“সামনের সিট খালি আছে ঐখানে গিয়ে বসুন।”
আবারো হলদে ফর্সা মেয়েটার এমন নির্লিপ্ত উত্তর দেখে যারপরনাই ভরকে গেলো সার্থক। এতটা বেয়াদব মেয়ে সে কখনো দেখেনি। এর সাথে কথা বলার আর কোনো মানে নেই। মেয়েটা অতিশয় অদ্ভুত! অগত্যা নিজের কাঁধ থেকে ব্যাকপ্যাকটা নামিয়ে সামনের সিটে বসে পড়লো সার্থক। মেয়েটা উদাস মনে এক নজর তাকালো সার্থকের দিকে। লম্বা সুঠামদেহের অধিকারী সার্থক, মাথা ভরা ঝাঁকড়া চুল, আর একটা খাড়া নাক। অদ্ভুত কালো মণি যুক্ত দুখানা চোখ। মেয়েটা কতক্ষণ তার দিকে তাকিয়েই রইলো। নাইকের ট্রাউজার, পায়ে ক্যাজুয়াল স্নিকার্স আর কালো হুডি পরনে সে । হাতে একটা ঘড়ি। ফর্সা হাতটায় বেশ মানিয়েছে। মেয়েটা কতক্ষণ যাবত তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা যে তার ঘড়িতে কি দেখছে ভেবে পেলোনা সে। সার্থক বার দুয়েক তাকালো ঘড়ির দিকে। আদোও কিছু আছে কিনা রহস্যময়ী তা উন্মোচনের বৃথা চেষ্টা যাকে করলো। তবে আফসোস কিছুই খুঁজে পেলোনা সে। ফোন বেজে উঠলো তার।
“হ্যালো, ডক্টর ফায়রাজ সার্থক স্পিকিং।”
ফোনের রিংটোনে ধ্যান ভেঙেছে হলদে ফর্সা মেয়েটার। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। কেবিনে আর কেউ নেই। তারা দুজনই মুখোমুখি বসে। মেয়েটার চোখ জানালা ছাড়িয়ে চলে গিয়েছে দূরান্তে। পাহাড় আর পাহাড় ঘেরা চারপাশ। ট্রেন চলার সাথে সাথে পাহাড়গুলোও যেন চলছে। সময়টা বিকেল। শীতের কুয়াশারা চাদর বিছিয়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে। আকাশের তিনটে রঙ দেখা যাচ্ছে। উপরে হালকা নীল। একটু নিচে কুয়াশার ধূসর, মেঘেদের সাদা আর চিরায়ত নীলের একটা মিশ্রণ রঙ। আরো একটু নিচে ঐতো পাহাড় ঘেঁষে কেবল ধূসর আর ধূসর রঙের ছড়াছড়ি। পাখিরা চলেছে নীড়ে। মেয়েটাও ফিরছে তার নীড়ে।
কথা শেষে সার্থক আড়চোখে তাকালো মেয়েটার পানে। হলদেটে ফর্সা গাঁয়ের রঙ, কোমড় সমান চুল বোধহয়। চুলগুলো কুঁকড়া ছেড়ে রাখা। গাঁয়ে বেগুনি আর পানপাতা রঙের বাটিকের থ্রি-পিস। উপরে একটা কাশ্মীরী চাদর। ঠিক যেন চিরায়ত কোনো বাঙালি মেয়ে। সার্থক তার ঠোঁট জোড়া দিয়ে আলতো করে উচ্চারণ করলো,
“অলকানন্দা।”
ঝকঝক শব্দ তুলে ট্রেন চলেছে রাজধানীর পথে। সার্থক খেয়াল করেনি, সময় হিসাব করেনি কেবল পলকহীন তাকিয়ে ছিলো হলদে সাদা, কুঁকড়া চুলের, অহংকারী মেয়েটার দিকে।
“কিছু বলবেন?”
“না, মানে।”
মেয়েটার এহেন হঠাৎ প্রশ্নে থতমত খেয়েছে সার্থক। কি জবাব দিবে খুঁজে পেলোনা সে। এই প্রশ্নটা এত কঠিন কেন! এনাটমির জটিল ক্লাসগুলোও তো এতটা কঠিন না!
“না, মানে কি? কি দেখছিলেন তাকিয়ে তাকিয়ে?”
এবার খানিকটা বিরক্ত হলো সার্থক। মেয়েটা যথেষ্ট ত্যাড়া। তাই সেও ত্যাড়া জবাব দিলো,
“আমার চোখ আমি যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে তাকাবো।”
“না, তাকাবেন না।”
“অদ্ভুত মানুষ তো আপনি। আমা….
তখনই ফোন বেজে উঠলো মেয়েটার। ঝগড়াটা জমে উঠেছিলো। সত্যি বলতে সার্থকের ভালোও লাগছিলো। মেয়েটার কন্ঠ অভূতপূর্ব। এতটা সুন্দর কন্ঠ শুনতে সে হাজার বার ঝগড়া করতে রাজি।
১৪.
নাম্বারটা দেখেই অপরাধবোধ জেগে উঠলো মেয়েটার। ফোনের রিংটোনটা তখনো বেজে চলেছে,
“ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে….
“হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। রেজওয়ান ভাইয়া।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম, মাহা। তুমি কোথায় এখন?”
“ট্রেনে আছি। ভাইয়া চৈতির কোনো খবর পেয়েছেন?”
“সিলেটে পুলিশ ফোর্স কাজ করছে। দেখি কি হয়।”
“আমার নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে রেজওয়ান ভাইয়া। আমি আসলে কিছু মনে করতে পারছিনা।”
“তোমার কোনো দোষ নেই মাহা। যা হবার ছিলো তাই হয়েছে। একটা কথা বলোতো চৈতি মূলত কোথায় গিয়েছিলো?”
“আমার মনে পড়ছেনা ভাইয়া। আমার কিছুই মনে পড়ছেনা।”
“আচ্ছা, থাক। তুমি ঢাকা আসো। তারপর কথা হবে। সাবধানে এসো।”
এএসপি রেজওয়ান চৌধুরীর সাথে এতক্ষণ কথা বলছিলো মাহা। সব কেমন অদ্ভুত আর প্যাঁচানো লাগছে তার। সামনের ছেলেটা ফায়রাজ না কি নাম কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে। মাথাটা সবুজ রঙা সিটে হেলান দেওয়া। চোখদুটো বন্ধ। তার ঝাঁকড়া চুলগুলো ট্রেনের ঝাঁকুনির তালে তালে কপালে চলে এসেছে। সুদর্শন হলে কি হবে! এক নাম্বারের বেয়াদব ছেলে! মুখটা কুঁচকে বাইরের দিকে তাকালো মাহা। তার আসলে কিছুই মনে পড়ছেনা। সিলেট কেন এসেছিলো তাও মনে নেই। রুমানা বলছিলো সে আর চৈতি নাকি একসাথে সিলেট এসেছে প্রায় তিনদিন। চৈতি মেয়েটা মাহার বেস্টফ্রেন্ড। আগুন সুন্দরী। কাঁধ সমান চুল। লম্বায়ও অনেক। পাঁচফুট সাতের কাছাকাছি। আর সে তুলনায় মাহা একটু খাটো। চৈতির থেকে দুয়েক ইঞ্চি কম তার উচ্চতা। মাহা আর চৈতি নাকি একসাথে সিলেটও ঘুরেছে। রুমানা আরো কি কি বললো। চৈতিকে নাকি কোন পাগলী হাতে খামছি দিয়েছে, চৈতির নাকি ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্ট হতে যাচ্ছিলো। মাহা নাকি বাঁচিয়েছে। আরো কত কি! মাহা নিজেও মুখে হ্যাঁ, হ্যাঁ করলেও বাস্তবিক অর্থে তার কিছুই মনে পড়ছেনা। কালরাতে যখন ঘুমিয়েছিলো জাহানারা ইমাম হলের তার ঘরটায় তখন মাথায় কেবল ঘুরছিলো আগামীকাল পরীক্ষা। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা। সে চোখ খুললো একটা ছেলের আওয়াজে।
_________________
“আপু? আপু? ঠিক আছেন?”
চোখের পাতা এতটা ভারী লাগছে মনে হচ্ছে কেউ যেন একশমণের ভারী দুটো বস্তু রেখে দিয়েছে মাহার চোখে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। প্রথমে যখন চোখ খোলার চেষ্টা করলো তখন তা পারলোনা সে। চোখটা বন্ধ হয়ে গেলো তার। এবার মনে হলো মাথাটা কারো কোলে। কন্ঠস্বরটা পরিচিত।
“মাহা, এই মাহা। এই কোকিল? কোকিল?”
রুমানার কন্ঠ এটা। অবচেতন মস্তিষ্ক ধরে ফেলে পরিচিত আওয়াজটা। আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায় মাহা। আশেপাশে কৃত্রিম আলোর ছড়াছড়ি। এটা কি কোনো রাস্তা? মাহাকে চোখ খুলে তাকাতে দেখে রুমানা বলে,
“ঠিক আছিস? কোকিল?”
মাথাটা ধরে উঠে বসে মাহা। একটা পিচঢালা রাস্তায় বসে আছে সে। সামনে বিস্তৃত মাঠ। পাশে দু’তালা একটা বিল্ডিং। সময়টা বোধহয় রাত। অন্ধকার চারপাশে। শীতের হিমেল হাওয়া বইছে। পাশে উদ্বিগ্ন চেহারা নিয়ে চারজন অপরিচিত মানুষ দাঁড়িয়ে।
“আমি এখানে?”
১৫.
মাহাকে ধরে দাঁড় করায় রুমানা। ঘরে নিয়ে যায় তাকে। সোফায় বসলে পানি খেতে দেন একজন মহিলা। অনেকটা রুমানার মতোই দেখতে। এটা কি রুমানার মা? বাকি একজন মহিলা, একটা ছোট মেয়ে। কেমন ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে আছে। আরেকটা কিশোর বয়সী ছেলে। মাহা কিছুই বুঝতে পারছেনা। তবে স্বস্তি লাগছে এই ভেবে যে রুমানা আছে।
“আমার কি হয়েছিলো রুমানা?”
“আমি বিকালে তোদের বলেই তো আম্মুকে নিয়ে চেকআপে গেলাম। তারপর ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে গেলো। জিদান বললো তোরা নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিস। আমিও গিয়ে দেখলাম দরজা ভিতর থেকে লক। তাই আর তোদের বিরক্ত করিনি।”
“এখন কয়টা বাজে?”
“এখন তো রাত সাড়ে তিনটা।”
“আমি রাস্তায় কিভাবে…কিছুই তো বুঝতে পারছিনা!”
“ঘুমিয়েছিলাম। হঠাৎ তোর একটা চিৎকার ভেসে এলো কানে। আমি বাইরে এসে দেখি তুই নিচে পড়ে আছিস। আর জিদান তোকে ডাকছে!”
“আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমার মাথাটা অনেক যন্ত্রণা করছে রুমানা।”
বলেই মাথাটা চেপে ধরলো মাহা। রুমানা তার পাশে বসে। এতকিছু হয়ে গেলো অথচ চৈতি নিচে নামেনি। ব্যাপারটা অনেকটা খটকা লাগলো রুমানার। সবাইকে রেখে দৌড়ে উপরে গেলো সে। না, চৈতি কোথাও নেই! সারাবাড়ি মাথায় তুলে ফেললো রুমানা। “টুকি, টুকি কোথাও নেই!”
মাহা ঘাবড়ে গিয়েছে অনেকটা। কোথায় গেলো চৈতি। এতকিছুর মাঝে ঘাড়ের চিনচিন ব্যথাটা তোয়াক্কাই করেনি মাহা।
তারপর কতকিছু ঘটে গেলো। মাহা তার বাবার বন্ধুর ছেলে এএসপি রেজওয়ানের সাথে কথা বললো। সিলেট পুলিশ স্টেশনে ব্যাপারটা অবগত করা হলো। কেটে গিয়েছে দুইদিন। মাহার ভাই মাহিন ফোন করে জানিয়েছে বাবা অসুস্থ। তাই সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে ঢাকা ফিরে যাচ্ছে মাহা। কি হচ্ছে! কেন হচ্ছে! চৈতি কোথায় কিছুই বুঝতে পারছেনা মাহা। পুলিশ তাকে বেশি জিজ্ঞেসাবাদ করেনি। রেজওয়ান ওদের সাথে কথা বলেছেন। তাছাড়া জিদান নাকি নিজ চোখে দেখেছে মাহা নিজের ঘর থেকে বের হচ্ছে। তার ডাকও তোয়াক্কা করেনি সে। বাড়ির সামনের রাস্তায় গিয়ে একটা চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তাই পুলিশও ব্যাপারটা সাময়িক তাই ধরে নিয়েছে। ইনভেস্টিগেশন চলছে। রুমানার মা অসুস্থ হয়ে পড়ায় একাই ঢাকা ফিরছে মাহা।
________________
মেয়েটা কি ভাবে এত! সেই কখন থেকে একধ্যানে বাইরে তাকিয়ে আছে। সার্থক বাইরে তাকিয়ে দেখে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার। দেখার মতো কিছুই নেই। মেয়েটার কন্ঠটা ভয়ংকর সুন্দর। আবার শুনতে মন চাইছে তার। কি বলে কথা শুরু করা যায়! নিজের কর্মকাণ্ডে নিজেই অবাক ডক্টর ফায়রাজ সার্থক। কানাডা থেকে এমবিবিএস, এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করে দেশে এসেছে সে। কত মেয়ে দেখেছে জীবনে! এমন অনেক মেয়েও আছে যারা তার কাছে নিজেকে সঁপে দিতে চায়। কখনো তাদের জন্য তো এমন লাগেনি তার! তাহলে আজ কেনো! এই সাধারণ মেয়েটা, হলদে ফর্সা মেয়েটা। পরনে বেগুনি আর পানপাতা রঙা থ্রি-পিস। কি আছে মেয়েটার মাঝে! ইজ ইট লাভ এট ফার্স্ট সাইট? কি অদ্ভুত ব্যাপার! ডক্টর ফায়রাজ সার্থক তার জীবনের আটাশ বসন্ত পাড় করলো। ঊনত্রিশ তম বসন্ত আসতে চললো আর সে কিনা একটা গম্ভীর, অহংকারী মেয়ের প্রেমে পড়েছে! নিজেকে ইচ্ছে মতো কষে মনে মনে দুয়েকটা চড় মারলো সার্থক। এটা কখনো সম্ভব না। মাহা তাকিয়ে আছে বাইরে আর সার্থক আড়চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এমন সময় হঠাৎ থেমে গেলো ট্রেনটা। কতক্ষণ নিরবতা। অতঃপর আওয়াজ ভেসে আসছে,
“ডাকাত! ডাকাত!”
(চলবে)……
#অলকানন্দা
#পর্ব-৬
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
১৬.
“প্লিজ, আমাকেও আপনার সাথে নিয়ে যান। একটু সাহায্য করুন।” মাহার কাতর সুর।
অন্ধকার চারপাশে। দুইধারেই জঙ্গলে আবৃত। সার্থক ট্রেনের দরজা দিয়ে নিচে নেমে এসেছে। চারপাশে আহাজারি। ডাকাত হামলা করেছে ট্রেনে। এখনো তাদের বগিতে আসেনি। তবে আসতে কতক্ষণ! মোবাইলেও নেটওয়ার্ক নেই। সার্থকের অনেক ইচ্ছে করছিলো আশেপাশের বগিতে থাকা মানুষদের সাহায্য করতে। তা সম্ভব নয়। প্রত্যেক বগির দরজার সামনে ডাকাতের সদস্য দাঁড়িয়ে। তাদের বগিটা সবার শেষে। এই বগিতে মানুষও কম। এখনো ডাকাতের দল এদিকটায় আসেনি।
“কি ভাবছেন? একটু সাহায্য করুন।”
মাহার করুন কন্ঠে ধ্যান ভাঙ্গে সার্থকের।কেবিন থেকে বের হওয়ার সময় মেয়েটাও তার পিছন পিছন এসেছে। সার্থক বুঝতে পারছে এভাবে কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছেনা তার। তবে এখানে থাকলেও কি! সে তো কাউকে সাহায্য করতে পারবেনা! উল্টো জীবন হারাবে।
“আমাকে একটু নামিয়ে দিন।”
আবারো মাহার কন্ঠ। ট্রেনের দরজাটা অনেক উঁচুতে। সার্থক লাফিয়ে নেমে গেলেও থ্রি-পিস পরনে মাহা তা পারছেনা। সার্থকের মাথায় আসছেনা কি করে নামাবে। এদিকে বেশিক্ষণ থাকাটাও বিপদ।
“আপনার হাত দিন।”
নির্লিপ্ত ভাবে বলে সার্থক। যদিও মাহার এই অপরিচিত ছেলেটার সাথে যেতে ভয় লাগছে তবুও ডাকাতের থেকে সম্ভ্রম হারানোর চেয়ে তা অনেকটা ভালো।
“কি হলো হাতটা দিন।”
আবছা আলো এদিকটায়। বগির ভিতরের হলুদ বাতির আলোর ছিটে কিছুটা আসছে। দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগে হাতটা বাড়িয়ে দিলো মাহা। সার্থক ধরে টান দিবে এমন সময় তাদের দেখে ফেললো দুজন ডাকাত।
“ওস্তাদ ঐ যে, ঐ যে। দুইডা পোলা মাইয়া।” হইহই করে উঠলো দুজনে।
মাহা ভয়ে তটস্থ হয়ে গেছে। আল্লাহর কাছে চাচ্ছে কেবল এবার যেন বেঁচে যায়। হঠাৎ একটা হেঁচকা টানে তাকে কোলে তুলে নিলো সার্থক। ট্রেন প্রায় মাটি থেকে এক মিটার উঁচুতে। ভয়ে চোখ মুখ বন্ধ করে নিলো মাহা। এই বুঝি তার জানটা গেলো। অতঃপর তা হয়নি। শূন্যে ভাসছে সে। কারো উষ্ণ বুকের আওয়াজ আসছে তার কানে। ধুকপুক ধুকপুক।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঘেরা চতুর্দিক। আশেপাশে কেবল জঙ্গল আর জঙ্গল। মাঝদিয়ে চলে গিয়েছে একটা রেলপথ। সেই রেলপথ ধরে মাহাকে কোলে নিয়ে ছুটছে সার্থক। তাদের পিছনে ছুটছে দুজন ডাকাত। মাহা ট্রেনে থাকাকালীন একনজর তাকিয়ে ছিলো। বিশাল দানবীয় শরীরের আকার। হাতে দাউদাউ করছে মশাল। আরেক হাতে বর্শা। পিছন থেকে হইহই আওয়াজ ভেসে আসছে। সেদিকে কান নেই সার্থকের। সে বুকের মাঝে একটা অপরিচিত মেয়েকে নিয়ে দৌড়াচ্ছে। প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে।
বিপত্তি ঘটলো এবার। একটা পাথরে পা লেগে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। মাহা ছিটকে পড়ে পাশে। দূরে মশালের আলো আর হাসির শব্দ ভেসে আসছে। দুটো নয় কয়েকজোড়া মশাল। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে মাহা। এবার কি তবে সব শেষ!
১৭.
পাথরের ঘষায় পা ছিলে গিয়েছে সার্থকের। দূরে ডাকাতের দল দৌড়ে আসছে। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে কয়েক জোড়া মশাল। সামনে সরু ট্রেনের রাস্তা। দুইপাশে বন। নিজের কথা এখন ভাবছেনা সার্থক। ভাবছে মেয়েটার কথা। মেয়েটা ব্যথা পেয়েছে বোধহয়। অন্ধকারেও বুঝতে পারছে সার্থক। মেয়েটা ভয়ে ঠকঠক কাঁপছে। কি করা যায়! হাতে সময় আছে কয়েক সেকেন্ডেরও কম। নিজেকে শক্ত করে উঠে দাঁড়ালো সে। অন্ধকার সয়ে এসেছে চোখে। সে দৌড়ে গেলো মাহার পানে। শক্ত করে ডান হাতটা আঁকড়ে ধরলো তার। মাহা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হাতটা মনে হলো অনেক ভরসার। আবারো হেঁচকা টানে মাহাকে নিয়ে দৌড়ে বাম দিকের জঙ্গলে ঢুকে পড়লো সার্থক। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। মেয়েটাকে হয়তো সে কোলে নিতো। এমুহূর্তে পায়ের কারণে তা সম্ভব হচ্ছেনা। সার্থকের কালো হুডির একটা পাশ গাছের সরু ডাল লেগে ছিঁড়ে গিয়েছে। তার মাশালগুলো ফুলে ফেঁপে উঠছে। ডক্টর ফায়রাজ সার্থক এভাবে পালাবে কখনো কল্পনাও করা যায়না। তাহলে এর পিছনে কারণ কি! মাহার হাতটা তখনো শক্ত করে ধরে রাখা। পিছনে আর কেউ আসছেনা এখন। জঙ্গলের অনেকটা গভীরে চলে এসেছে তারা। হরেকরকম ডাক ভেসে আসছে চারদিক থেকে। জঙ্গলের উত্তরাংশ থেকে ভেসে আসছে পেঁচার ডাক। পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো মাহা। ভয়ে এবার কান্নাই করে দিলো। হঠাৎ বাঁধায় থমকে দাঁড়িয়েছে সার্থক। এত ক্ষণ কারো মুখেই কোনো কথা ছিলোনা।
“কি হয়েছে?”
সার্থকের নরম কন্ঠস্বর। এবার ফুঁপিয়ে উঠলো মাহা। নিকষকালো আঁধার ঠেলে উড়ে গেলো দু’একটা বাদুড়। অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো মাহার। আশেপাশের জঙ্গল, বড় বড় গাছপালা। সবকিছু দেখে কেমন মাথা ঘুরাচ্ছে তার। ডালপালায় ভরা চারদিক। আবার কিছু বাদুড়ের দল উড়ে যাওয়ার শব্দ হতেই সার্থক কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মাহা। ঠকঠক করে কাঁপছে সে। শরীরটা বরফের চেয়েও বেশি ঠান্ডা।
“আমা….আমার ভয় লাগছে।”
সার্থকের একটা হাত চলে গেলো মাহার মাথায়। হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে।
“ওরা, ওরা কি আসছে?”
“না, এখন বোধহয় আর আসছেনা। তুমি টেনশন করোনা।”
নিস্তব্ধতা। অজানা জঙ্গল। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে অজানা, অচেনা ছেলের বুকে মাথা রেখে একটা ভরসা খুঁজে পাচ্ছে মাহা। শক্ত বুকটা। অনেক চওড়া। কি সুন্দর ঘ্রাণ শরীরে। কি সম্মোহনী ঘ্রাণ! ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটা। মাহা ভুলে গেলো সকল কিছু। সবকিছু। অন্ধকারের মাঝেও চোখে ছেয়ে গেলো আরেক অন্ধকার। ডক্টর ফায়রাজ সার্থকের শক্ত বুকের মাঝেই ঢলে পড়লো সে। যেন নিজেকে সঁপে দিলো সেই ফর্সা রঙা, অদ্ভুত কালো মণির ছেলেটার কাছে। মেয়েটাকে বুকে লুটিয়ে পড়তে দেখে ভরকে গেলো সার্থক।
১৮.
আঁধারে ছেয়ে আছে চারিদিক। কোথায় কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। একটা সরুরাস্তা। মাহা রাস্তাটা ধরে হেঁটে চলেছে। পরনে নীল রঙের একটা গোলজামা, কালো লেগিংস আর কালো জ্যাকেট। তার কুঁকড়া চুলগুলো ছেড়ে রাখা। সে হাঁটছে আর হাঁটছে। জায়গাটা কোথায়? কেবল অন্ধকার। পাশে কে যেন হাতটা দৌড়ে এসে আঁকড়ে ধরলো।
“মাহা, এই মাহা।”
চৈতির আওয়াজ না এটা। হুম, চৈতিরই তো! তার পাশে হাঁটছে। পরনে তার মতোই কাপড়। খিলখিলিয়ে হেসে কি যেন বলছে! মেয়েটা সত্যিই অনেক সুন্দর। হঠাৎ মাহার কন্ঠস্বর।
“সিলেট যাবি?”
নিজের কাঁধ সমান চুলগুলোকে দুলিয়ে দুলিয়ে দৌড়ে সামনে চলে গেলো চৈতি। চৈতি লম্বা বিদায় তার সাথে দৌড়ে পারছেনা মাহা। তাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। চিৎকার করে প্রশ্ন করলো,
“কিরে বল?”
দৌড়াতে দৌড়াতেই পিছনে তাকালো চৈতি। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“যাবো তো। অবশ্যই যাবো।”
হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো চৈতি। তারপর…..
তারপর আবার অন্ধকার। একটা পিচঢালা রাস্তা ধরে হাঁটছে মাহা। হাঁটছে আর হাঁটছে। এখন আবার ঘাষে ঢাকা এবড়ো থেবড়ো পথ। পা বোধহয় খালি তার। পায়ে লাগছে শিশির বিন্দু। আলোর দেখা পাওয়া গেলো এবার। দূরে। ঐ তো দূরে আলোর দেখা মিলেছে। আবার আশপাশটা আলোকিত হয়ে গেলো। মাহার হাঁটা থামেনি। সে চলছে। আলোর দেখা মিলতেই জামা পাল্টে গেলো তার। গেরুয়া রঙের থ্রি-পিস। উপরে মনিপুরী শাল। হাতে বড় ট্রলি। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে সে। আশেপাশে কত মানুষ! হকারদের ডাক। পাশে এক লোক হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করছে। অপরপাশে আরেকজন ভুট্টা বিক্রি করছে। একটা ছোট ছেলে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে। বুরকা পরা তার মা তাকে কোলে নিয়ে বলছে,
“না, না। বাবা, কাঁদেনা। কাঁদেনা।”
বারেবারে ঘড়ি দেখছে মাহা। চৈতি কোথায়! মেয়েটা সবসময় লেট!
“এই শসা। শসা। পাঁচ টাকা পিস। লবণ, মরিচ দিয়ে শসা।”
হাক ছাঁড়তে ছাঁড়তে পিছন দিক দিয়ে চলে গেলেন এক হকার। আর কতক্ষণ পড়েই ট্রেন ছেড়ে দিবে। কোথায় চৈতি! মোবাইলটা বের করলো মাহা। এমন সময় কে যেন পিছন থেকে চোখ চেপে ধরলো তার।
“এসবে চলবেনা। কানে ধর।”
চৈতি মুচকি হেসে কানে ধরলো। তবে নিজের না মাহার। মেয়েটা এতো দুষ্টু!
একটা ট্রেনের কেবিন। ছিমছাম সুন্দর ফার্স্ট ক্লাস কেবিন। ছোট ঘরটা। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। যাত্রাপথ বোধহয় সিলেট। চিরায়ত ঢাকা শহর ছাড়তেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো মাহার। চৈতি পাশে বসে সমান তালে বকবক করে যাচ্ছে। মাহাও বলছে। কি বলছে মনে করতে পারছেনা। তবে সে বলছে। অনেক কথা বলছে। বাইরে হালকা রোদ। একটা ঠান্ডা হিমেল হাওয়ার ছড়াছড়ি। মনিপুরী সাদা আর কালোর মিশ্রণে শালটা নিজের সরিয়ে আরেকটু জড়িয়ে নিলো মাহা। অনেককিছু হচ্ছে। কি হচ্ছে খেয়াল নেই। তবে হচ্ছে। ট্রেন চলছে। ঝালবুট খাচ্ছে মাহা, চৈতি। ঐ তো দূরে একটা নদী। আচ্ছা, নদীটার নাম কি? কি সুন্দর নদীটা। ছলছল পানি। মাহা কি একটা নাম দিবে? নামটা যদি হয় “উদাসমনা স্রোতস্বিনী?”
আরো কত কি বাইরে। কত গাছপালা! কত দালান কোঠা। ঐতো দেখা যায় কৃষকেরা মাঠে কাজ করছে। পাশে বসে চৈতি। অনেক কথা বলছে দুজনে। অনেক গল্প! কি গল্প! শুনতে পাচ্ছেনা কেন মাহা! একটা শব্দ কানে বাজলো।
“অদলবদল।”
অনবরত সেই শব্দটাই উচ্চারণ করছে মাহা। চৈতি হেসে বলছে,
“কি রে আজ থেকে তুই তো চৈতি!”
মাহা, চৈতি কেন হতে যাবে? মেয়েটা সেই কখন থেকে বলছে চৈতি শুন। এই চৈতি এটা। এই চৈতি ঐটা। আর মাহা তাকে মাহা বলে সম্বোধন করছে। দুজনেই আবার হেসে লুটিয়ে পড়ছে। কিন্তু কেন! আবার অন্ধকার। একটা রাস্তা। এটা তো সেই রাস্তা যেটাতে হাঁটছিলো মাহা। চৈতি নাই। ট্রেন নাই। কান্না করা বাচ্চাটা নাই। ভুট্টা বিক্রেতা নাই। হাওয়াই মিঠাই ওয়ালা নাই। শসা বিক্রেতা নাই। কেবল মাহা। একা। চারপাশে অন্ধকার। ঘুটঘুটে অন্ধকার। এক ফোঁটা আলো নেই। এবার চিৎকার করে উঠলো মাহা। আবার চিৎকার করতে যাবে এমনি একটা শক্ত হাত মুখ চেপে ধরলো তার। একটা উষ্ণ স্থানে সে। কোথ থেকে যেন তবলার তাল ভেসে আসছে। নাকি এটা কারো বুকের শব্দ!
(চলবে)…..