#অলকানন্দা
#পর্ব-৯,১০,১১
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
০৯
২৫.
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে মাহা। হাতে একটা টাকাও নেই। স্টেশন মাস্টার যেন টিকিট না ধরেন তাই ট্রেন থেকে নেমে লুকিয়ে বাইরে এসেছে। মাথায় কিছুই ঢুকছেনা মাহার। কেন সে সিলেট গিয়েছিলো! এটা এক গভীর ধোঁয়াশা তার কাছে। স্টেশনের সামনে লোহার গ্রিলের ধারে দাঁড়িয়ে সে। তার মনে হচ্ছে এখানে সে এর আগেও এভাবে দাঁড়িয়েছিলো। কারো জন্য অপেক্ষা করছিলো। উফ্! আর ভাবতে পারলোনা মাহা।
“আফা, ভুট্টা নিবেন?”
নীল চ্যাকের লুঙ্গি, সাদা ময়লাটে শার্ট। গলায় গামছা আর হাতে ভুট্টার প্যাকেটের থলি। মধ্যবয়স্ক একজন লোক। মাহার মনে হচ্ছে এই লোককে তো সে আগে দেখেছে। কোথায় দেখেছে!….
হ্যাঁ। স্বপ্নে দেখেছে। একটা সরু রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটার পর এমনই একটা রেলওয়ে স্টেশন। সেখানেই তো ছিলো এই লোকটা।
“ও আফা। নিবেন নাকি?”
লোকটার ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে মাহার। হকচকিয়ে সে বলে,
“না, না। নিবোনা।”
লোকটা বিরক্ত নিয়ে তাকালেন। অতঃপর বিড়বিড় করতে করতে অন্য দিকে চলে গেলেন। আশপাশে অনেক মানুষজন। ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে তার বাবাকে। মাহাদের বাড়ি হাজারীবাগ। কুলাল মহল জামে মসজিদের পাশে। বাড়ি যাওয়ার জন্য সিএনজি নিবে? নাকি মেডিকেলে যাওয়ার জন্য? বাবা কোন ওয়ার্ডে আছেন তাও তো জানেনা সে। ক্ষুধা ও ক্লান্তিতে শরীরও নেতিয়ে পড়েছে। দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে মাহা। রেলস্টেশনের বাইরে ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে আছে সে। চিরচেনা শহরটাকেও অচেনা লাগছে তার। এতটা দ্বিধা দ্বন্দ্বে মাহা কখনো ভুগেনি। সবাই বলে সে বুদ্ধিমতী। সব পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারে। আজ কি তবে তার মাথায় জ্যাম ধরেছে!
“মাহা?”
নিজের নাম শুনে পিছনে ফিরে মাহা। ইউনিফর্মে দাঁড়িয়ে আছে এএসপি রেজওয়ান। চোখে কালো সানগ্লাস। রোদে ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে।
“রেজওয়ান ভাইয়া!”
মাহার দিকে এগিয়ে এলো রেজওয়ান। ঘামে একাকার অবস্থা তার। যদিও শীতল বাতাস বইছে চারদিকে।
“তোমাকে সেই সকাল থেকে স্টেশনে খুঁজে যাচ্ছি আমি। সারারাত তোমার মোবাইল বন্ধ ছিলো কেন?”
“আসলে আমাদের ট্রেনে ডাকাত হামলা করেছিলো। পরে….
তখনই ফোন বেজে উঠলো রেজওয়ানের। মাহা চুপ করে গেলো নিমিষে। কপাল একটু কুঁচকিয়ে ফোনটা ধরে রেজওয়ান। কথা বলার সময় চোখমুখ শক্ত হয়ে যায় তার। ফোনটা রেখে দিয়ে পকেট থেকে রুমালটা বের করে সে। কপালের দুপাশের ঘাম মুছে। মাহা রেজওয়ানের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
“তুমি সিলেট-ঢাকা আন্তঃনগর ট্রেনে আসছিলে না, মাহা?”
“হুম।”
রেজওয়ানের মুখে বিস্ময়। আটাশবছর বয়সী এএসপি রেজওয়ান কি মনে মনে একটু ভয় পেলেন? আবার মানুষটাকে চোখের সামনে দেখে একটা ছোট স্বস্তির নিঃশ্বাস কি বেরিয়ে এলো তার!
“আচ্ছা, চলো তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি। গাড়িতে উঠে বসো।”
“রেজওয়ান ভাইয়া? বাবা কেমন আছেন?”
“আংকেল, ভালো আছেন। বিপি হাই হয়ে গিয়েছিলো। এখন তোমাদের বাড়িতেই নিয়ে আসা হয়েছে।”
রেজওয়ানের পিছন পিছন গিয়ে গাড়িতে বসলো মাহা। স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার সময় বুকটা চিনচিন ব্যথা করেছে তার। কালো হুডি পরা ঝাঁকড়া চুলের, কালো মণির ছেলেটাকে মিথ্যা বলে ঢাকা পালিয়ে এসেছে সে। ছেলেটা কি করছে এখন! আর কি কখনো দেখা হবে তাদের!
“মাহা?”
“হুম।”
“আমি বিকেলে তোমাদের বাসায় একবার যাবো। আমাকে একটু খুলে বলবে গতকাল কি কি হয়েছিল ট্রেনে। আর তুমি কি করে ফিরলে ঢাকা।”
“আপনি চাইলে আমি এখনই বলতে পারি ভাইয়া।”
“না, এখন তুমি ক্লান্ত। বাসায় যাও। রেস্ট করো।”
মাহা মাথা নিচু করে রাখলো।
২৬.
রেজওয়ানকে সে ছোট থেকে চিনে। অনেকটা হাসিখুশি, প্রাণবন্ত মানুষ। মাহার খুবই পছন্দ এই লোকটাকে। বড় ভাইয়ের মতো প্রতিটা সময় মাহার পাশে আছে রেজওয়ান। রেজওয়ান মোবাইল দেখার ফাঁকে ফাঁকে মাহার হলদে ফর্সা মুখটা, লাল হয়ে যাওয়া নাকটা দেখছে। কতদিন পর দেখলো এই প্রিয় মুখ। মাসে একবারো দেখা পাওয়া যায়না। প্রতিদিন কি একনজর দেখার জন্য সাভার ছুটে যাওয়া সম্ভব! মেয়েটা কেন বুঝেনা!
“রেজওয়ান ভাইয়া?”
“কিছু বলবে মাহা?”
মাহার আকস্মিক ডাকে থতমত খেলেও নিজেকে সামলে নিলো রেজওয়ান।
“চৈতির কোনো খবর পাওয়া গেছে?”
“এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।”
“আমার খুবই টেনশন হচ্ছে। ও কোথায় গেলো!”
“চিন্তা করোনা তুমি। সিলেট পুলিশ কাজ করছে।”
বাইরে রাস্তার দিকে মনোযোগ দেয় মাহা। কত মানুষ! কত ব্যস্ততা তাদের! কেবল বাবার জন্যই বাড়িতে যাচ্ছে মাহা। নয়তো সে যেতোনা। এই পৃথিবীতে যার মা নেই তার কেউই নেই। সৎ মানুষ কখনো আপন হয়না। কথাটা হাড়ে হাড়ে বুঝে মাহা। বাবাও বদলে গেছেন। খরচ দিয়েই সব দায়িত্ব শেষ। একটু ভালোবাসা, একটু স্নেহের কাঙাল যে মাহা।
মাঝারি আকৃতির বিল্ডিংয়ের সারি। মাহাদের বাড়ি মেইন রোড থেকে ভিতরে। পুলিশ গাড়িটা ঢুকবেনা সেখানে। গাড়িটা থামতেই মাহা নেমে গেলো গাড়ি থেকে। রেজওয়ানকে কিছু বলার আগেই গাড়ি থেকে বের হয়ে এলো সে। মাহা গাড়ির পাশটায় দাঁড়িয়ে।
“চলো। তোমাকে বাসায় এগিয়ে দিয়ে আসি।”
“আচ্ছা।”
মাহা, রেজওয়ান পাশাপাশি হাঁটছে। দুইপাশে গাদাগাদি করে বিল্ডিংয়ের সারি। মাঝে পাকা রাস্তা। সেই রাস্তা ধরেই হাঁটছে তারা। রেজওয়ানের বাড়ি থেকে মাহাদের বাড়ির পথ দশ মিনিটের। পথিমধ্যেই পড়ে। বাড়ি অতিক্রম করার সময় রেজওয়ান বললো,
“মা, তোমাকে দেখতে চেয়েছিলেন।”
রেজওয়ানের কথায় তার দিকে মুখ তুলে চায় মাহা। আবার মাথাটা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে সে বললো,
“কালকে আন্টির সাথে দেখা করে আসবো।”
আর কোনো কথা নেই। সকাল প্রায় দশটা বাজে। রাস্তার পাশে দুয়েকটা দোকান খুলেছে। দুয়েকজন মানুষের আনাগোনা। পাঁচতলা বিল্ডিংটার সামনে আসতেই দুজনেই থামলো।
“মাহা, তোমাকে কিছু কথা বলি। মনোযোগ দিয়ে শুনবে।”
“জ্বি।”
“চৈতির মিসিংয়ের ব্যাপারটা একটা ধোঁয়াশা। তারউপর কালরাতের ট্রেনের ঝামেলা। তোমাকে জিজ্ঞেসাবাদের জন্য ডাকা হতে পারে পুলিশ স্টেশনে। তুমি ভয় পাবেনা। আমি আছি। যা সত্য তাই বলবে। আমি এখন একটা কাজে যাবো। এখন বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নেও। আমি বিকেলে আসলে ঠান্ডা মাথায় সব বলবে।”
“ভাইয়া, বাবাকে কিছু বলবেন না দয়াকরে। আমি যতটুকু জানি বলার চেষ্টা করবো।”
মাহার কাতর কন্ঠ।
“তুমি টেনশন করোনা। আংকেল কিছুই জানবেন না।”
“আপনিও বাসায় চলেন?”
“ঐ যে বললাম জরুরী কাজ আছে। এখন যাওয়া সম্ভব না। আসি তাহলে।”
“ঠিক আছে। আল্লাহ হাফেজ, ভাইয়া।”
রেজওয়ান ফিরতি পথে হাঁটা দিয়েছে। বুকটা অসম্ভব কাঁপছে তার। তার মাহাপরী যে বড্ড সুন্দরী! ভয়ার্ত হলদে ফর্সা মুখটায় ঠান্ডা বাতাসে তিরতির করে কাঁপা লাল টকটকে নাক। কুঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারা কপালময়। চোখটায় কি যে মায়া!
মাহা বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। মাহাদের নিজেদের বাড়ি। তারা থাকে চারতলার ডানপাশে। মাহা আর রেজওয়ান কি জানে? চারতলার বামপাশের বারান্দা থেকে এক জোড়া চোখ তাকিয়ে ছিলো তাদের দিকে। বিশেষ করে রেজওয়ানের দিকে!
২৭.
কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুললেন দিনা হোসেন। মাহাকে দেখে কপাল কুঁচকালেন তিনি। মাহা মলিন হাসলো। তা দেখেও যেন না দেখার ভান করলেন তিনি। কিছু বললোনা মাহা। সব সয়ে গেছে তার। চারবছর বয়সে মাকে হারিয়ে অনেকটা অনাদরেই বড় হয়েছে সে। ড্রইংরুমের উত্তর দিকে রাখা ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করছে মাহার সৎ ভাই মাহিন। মাহার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট। অপরপাশে দিয়া। মাহার সৎবোন। বয়স দশ বছর। দিনার মা আমিনা এখানেই থাকেন। তিনিও বসে খাচ্ছিলেন।
“আপু, কেমন আছো?”
মাহিন জিজ্ঞেস করতেই তাকে বিকট সুরে একটা ধমক দিলেন দিনা।
“চুপ! খাবারের সময় কিসের কথা। চুপচাপ খাও।”
মায়ের এমন ধমক খেয়ে আর কিছু বলার সাহস পেলোনা মাহিন। দিয়া এমনতেও মাহাকে পছন্দ করেনা। আমিনাও চুপচাপ খাচ্ছেন।
মাহা কাউকে কিছু না বলেই বাবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। এদের সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছেই তার নেই।
“দেখছো মা। কি তেজ! একটা কথাও না বলে চলে গেলো!”
“তোর জামাই আহ্লাদে মাথায় তুলছে। দামরা মাইয়া এটারে নাকি পড়াতে হইবো। বিয়ার বয়স শেষ। কেডা করবো বিয়া?”
“উনি আমার কথা শুনেন। মাস শেষে কতগুলা টাকা দেন একাউন্টে। ছেলে মেয়ে দুইটা বড় হইতাছে সেই খেয়াল নাই। উনি আছেন মাহা মা নিয়া। কই দুইদিন ধইরা হসপিটালে। গাঁধার মতোন তো আমিই খাটলাম। আজ আইলো উনার মা!”
মাহা সবই শুনেছে। জবাব দেওয়ার ইচ্ছা জাগলেও জবাব দিলোনা সে। শরীর ক্লান্ত, মন ক্লান্ত। বাবার সাথে আগে দেখা করা প্রয়োজন। গত কয়েকটা দিন ধরে কি পরিমাণ ঝড় তার উপরে বয়ে যাচ্ছে সেই কেবল জানে! আজ যদি মা বেঁচে থাকতো!
__________________
চিরচেনা শহরে পা রেখেই মনটা একটু ভালো হলো সার্থকের। বিশ্বের সবচেয়ে অযোগ্য শহরের মাঝে ঢাকা নাকি একটি। এই অযোগ্য স্থানটাই যে সার্থকের প্রিয়। ভিষণ প্রিয়। তার খয়েরী টয়োটা এলিয়ন গাড়িটা রাস্তা দিয়ে চলছে আপনগতিতে। গুলশান আবাসিক এলাকার দিকে গন্তব্য। মাথাটা পিছনে হেলান দিয়ে বসেছে সার্থক। সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসা মুইংচিন। চাইনিজ নাগরিক। কানাডায় সার্থকের সেক্রেটারি ছিল। দেশে আসার সময়ও সাথে এসেছে সে। মুইংচিন পয়তাল্লিশ বছর বয়সী একজন পুরুষ। তাকে দেখলে মনে হয় তার বয়স কেবল বিশ। সার্থক কে পিছনে মাথা হেলিয়ে বসে থাকতে দেখে মুইংচিন বলে,
“সাতক। টুমি কি অনেক টায়ার্ড?”
“হুম।”
গম্ভীর শোনায় সার্থকের গলা। মুইংচিন কিছু না বলেই সামনে ফিরে যায়। সার্থক এমনিতে খুবই হাসিখুশি মানুষ। কিন্তু রেগে গেলে ভয়ংকর। অনেক কষ্ট করেও কন্ট্রোল করা যায়না। সার্থকের রাগের প্রথম ধাপ গুরুগম্ভীর ভাব। দ্বিতীয় ধাপ বড় ভয়ংকর! রেগে সব তছনছ করে দেয় সার্থক। মুইংচিন শান ধর্মাবলম্বী। মাৎসু দেবীর পূজারি সে। মনে মনে দেবীর কাছে সার্থকের জন্য প্রার্থনা করে সে। এতো বছর ধরে ছেলেটার সাথে পরিচয়। বাবা-মা হীন সার্থকের জন্য বড়ই মায়া হয় তার।
(চলবে)…..
#অলকানন্দা
#পর্ব-১০
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
২৮.
“বাবা।”
আজাদ হোসেন শুয়ে আছেন খাটে। শরীরটা নেতিয়ে আছে তার। শুকিয়ে রোগা হয়ে গিয়েছেন অনেকটা। মাহা বাবার পাশে এসে দাঁড়ালো। একদম শিয়রের কাছে। ডান হাতটা মাথায় বুলিয়ে আস্তে করে ডাকলো,
“বাবা?”
চোখ খুলে তাকালেন আজাদ সাহেব। মলিন হাসি দিয়ে মেয়ের মুখটা ছুঁলেন। চোখ ভিজে উঠলো তার। মেয়েটার যে এই পৃথিবীতে তাকে ছাড়া আর কেউ নেই।
“মাহা মা।”
ভিজে উঠা সিক্ত গলায় নিজের নাম শুনে ; অশ্রুর দলকে থামাতে ব্যর্থ হয় মাহা।
“বাবা”
বলেই কেঁদে দেয় সে। এই পৃথিবীতে সে যে বড্ড একা। কাঁপা কাঁপা হাতে মেয়ের চোখের পানি মুছিয়ে দেন আজাদ সাহেব।
“মা না আমার। কাঁদেনা মা।”
ছেঁচকি তুলতে তুলতে মাহা বলে,
“আমার যে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে! বাবা।”
আজাদ সাহেব একটু উঠে মেয়ের কপালে চুমু খান। আরো ফুঁপিয়ে উঠে মাহা।
“আহ্লাদ শেষ হইলে ঔষুধ খেয়ে আমাকে উদ্ধার করেন।”
দরজায় দাঁড়িয়ে খেঁকিয়ে উঠেন দিনা। মাহাকে ছেড়ে দিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসেন আজাদ সাহেব। চোখটা হালকা বুজে গম্ভীর গলায় বলেন,
“মাহা, তুমি অনেক জার্নি করে এসেছো। যাও রেস্ট করো।”
মাহা কিছু না বলেই বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তার ঘরটা এখন মাহিনের। বারান্দার পাশে ছোট একটা স্টোর রুম ছিলো। সেখানে তার জিনিসপত্র রেখে দিয়েছিলেন দিনা। একটা চৌকি পেতে রাখা। মাঝে মাঝে বাসায় আসলে এই ছোট ঘরটাতেই সবটা সময় কাটে মাহার। কি অদ্ভুত! এই যে তার হাতে ব্যাগ নেই, মোবাইল নেই। একবার তো কেউ জিজ্ঞেস করলোনা এসব কোথায়! একবারও কেউ জানতে চাইলোনা তার কেন আসতে দেরি হলো! এমনকি বাবাও না। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহা। এই পৃথিবীর এতিম সন্তানগুলোই কেবল বুঝে মা আসলে কি। ড্রয়িং রুমের বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে পুরনো একটা জামা গাঁয়ে দিয়ে চৌকিতে শুয়ে পড়ে মাহা। শরীর ক্লান্ত, মন ক্লান্ত, মস্তিষ্ক ক্লান্ত।
________________
একটা বিশাল বড় মাঠ। চারদিকে ঘেরা পাহাড়। পাহাড়ের পাশেই নদী। মাহা একটা সাদা শাড়ি পরেছে। একেবারে ধবধবে সাদা শাড়ি। তার কুঁকড়া চুলগুলো ছেড়ে রাখা সারা পিঠময়। মিঠা রোদে ঝলমল করছে তার চুলগুলো। মাঠের দুপাশে সাদা ফুলের বাগান। মাহা মুগ্ধ নয়নে চারপাশ দেখছে। হঠাৎ একটা চিৎকার ভেসে এলো মাহার কানে। মাহা হন্তদন্ত হয়ে তাকাচ্ছে চারপাশে। কার আওয়াজ। এতোটা করুণ! কার আর্তনাদ! আবার আওয়াজটা ভেসে এলো কানে। মাহার নাম ধরেই তো চিৎকার করছে। মাহা ছুটে যাচ্ছে শব্দের উৎসের দিকে। একটা বিস্তৃত নদী। নদীর মাঝামাঝি একটা মেয়ে। পানিতে ডুবে যাচ্ছে সে। পরনে নীল শাড়ি। মাহাকে দেখে চিৎকার করলো,
“মাহা, মাহারে। বাঁচা। আমাকে বাঁচা। ভিষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। শরীরটা ভিষণ জ্বলছে আমার।”
এটা তো চৈতি! তার প্রিয় বান্ধবী আতিয়া জামান চৈতি! মাহা লাফ দিলো নদীতে। সে তো সাঁতার জানেনা! তবুও ভাসছে কিভাবে! কাছাকাছি যেতেই নদীর গহীনে তলিয়ে গেলো চৈতি। মাহা সেখানে পৌঁছাতে পারলোনা। তার আগেই তার মুখ চেপে ধরলো একজোড়া কালো হাত। টেনে নিয়ে গেলো নিজের সাথে। ঘাড়ে একটা বিষ পিঁপড়ে কামড়ানোর মতো ব্যথা পেলো মাহা। ভিষণ জ্বলছে ঘাড়টা ভিষণ। কালো হাতদুটোতে সজোরে কামড় বসিয়ে দিলো মাহা। নদীতেই ভেসে বেড়াতে লাগলো উদভ্রান্তের মতো। হঠাৎ….
হঠাৎ নৌকা নিয়ে এগিয়ে আসছে এক যুবক। সাদা পাঞ্জাবি পরনে ফর্সা মতন লোকটা। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। অদ্ভুত কালো চোখের মণি। কি মায়াময় তার চেহারা। নৌকাটা ভরা হলুদ রঙা ফুলে। কি সুন্দর ফুল! চোখ ধাঁধিয়ে, মন নাড়িয়ে দেওয়া সৌন্দর্য।
২৯.
এই মায়াবী পুরুষটাকে তো মাহা চিনে। ফায়রাজ সার্থক। গুরুগম্ভীর যার কন্ঠস্বর। এই সুরটাও তো মাহা চিনে। খুব করে চিনে। মাহার ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক অভূতপূর্ব হাসি। মনের সুখে নিজেকে বিলিয়ে দিলো নদীর ঝলমলে পানিতে। এবার তো ডুবে গেলেও তার শান্তি। উঁহু, না তো। মাহা ডুবলো নাতো। একজোড়া বলিষ্ঠ হাত তাকে টেনে নিলো বুকে। একেবারে বুকের মাঝে। ফিসফিসিয়ে বললো,
“তোমার মরণ হওয়ার আগে আমার মরণ হোক। এই বুকটা ঝাঁঝড়া করে দিয়ে তুমি কোথাও যেতে পারবেনা। আমার বুকটাকে শেষ করতে পারলেই তুমি ছাড়া পাবে, অলকানন্দা।”
অতঃপর নৌকাটা চলতে লাগলো। দূর-দূরান্তে। ঝাঁকড়া চুলের মানুষটার বুকে মাথা দিয়েই আবারো চোখ বুজলো মাহা। এই তো তার স্থান। পরম সুখের স্থান। এই স্থানে মরলেও মাহার কোনো দুঃখ নেই।
“আপু, আপু। এই মাহা আপু?”
ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে মাহা। কোথায় সে। আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে মাহা। এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো সে। মাহিন খাবারের প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চিকন গড়ন। মুখে কৈশোরের ছাঁপ। মাহাকে হতভম্ব হয়ে চারপাশ তাকাতে দেখে মাহিন জিজ্ঞেস করে,
“তুমি কি ঠিক আছো?”
“হুম।”
“মা, খাবারটা পাঠালেন। তুমি খেয়ে নাও।”
বলে চৌকিতে খাবার রাখলো মাহিন। তার আরো অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে। মাহা আপুকে অনেক ভালোলাগে তার। কতটা আদর করে তাকে। মায়ের ভয়ে কথা বাড়ায়নি মাহিন। চুপচাপ বেরিয়ে এলো। মাহার একদম খেতে ইচ্ছে করছেনা। তবুও হাত ধুঁয়ে কয়েক লোকমা ভাত খেলো। মাথাটা বড্ড ধরেছে। কফি প্রয়োজন। হলে থাকলে হয়তো নিজেই বানিয়ে খেতো। নিজের বাড়িতেও যেন শ’খানেক বাঁধা তার। কালো রঙের ওড়নাটা মাথায় দিয়ে ড্রয়িং রুমে বেরিয়ে এলো মাহা। দুপুর গড়িয়ে গেছে। অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে সে। ড্রয়িং রুমে বসে পান চিবুচ্ছেন দিনার মা। দিনা সোফায় বসে দিয়ার চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছেন। মাহাকে দেখে মুখ বাঁকালেন দিনার মা। মাহা দেখেও না দেখার ভান করে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো।
ছাদে যাওয়া প্রয়োজন।
৩০.
বামপাশের ফ্ল্যাটে থাকে দিনার বড় ভাইয়ের পরিবার। মাহা সিঁড়ি দিয়ে উঠবে এমন সময় তাকে পিছু ডাকলো এশা। দিনার ভাইঝি।
“আরে মাহা আপু যে! কেমন আছো?”
মলিন হাসলো মাহা। হাসি মুখে জবাব দিলো,
“হুম। ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”
“ভালো।”
“ছাদে যাচ্ছিলে?”
“হ্যাঁ।”
“যাক ভালোই হলো। চলো আমিও যাবো।”
মাহা না করতে পারলোনা। তার একটু একা থাকতে ইচ্ছে করছে। একা শ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে। এশা মাহার চেয়ে লম্বা। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে এবার প্রথম বর্ষে পড়ছে। শ্যামলা গাঁয়ের রঙ। মায়বী চেহারা। করুনাময় কখনো কাউকে অসুন্দর করে পৃথিবীতে পাঠান না। তারই দৃষ্টান্ত এশা। দীঘল কালো হাঁটু ছাড়িয়ে চুল তার। মায়াময় চেহারার দিকে একবার কেউ তাকালে দ্বিতীয়বার তাকাতে বাধ্য। হালকা শীত পড়েছে। শীতল মিষ্টি হাওয়া বইছে চারদিকে। ছাদের এককোনায় পেতে রাখা দোলনায় দোল খাচ্ছে মাহা। এশা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কথায় কথায় এশা বললো,
“আপু? খবরে দেখালো সিলেট থেকে আসার পথে ট্রেনে নাকি ডাকাতের দল হামলা করেছিল। পাঁচজন মেয়ে নিখোঁজ। দুইজনকে মেরে ফেলেছে। যাত্রীদের সকল টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে গেছে ডাকাতের দল।”
এশার কথায় চমকে তার দিকে তাকালো মাহা। নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
“ভয়াবহ ব্যাপার!”
“আর বলতে। আমার তো মেয়েগুলোর জন্য কষ্ট হচ্ছে আপু। নির্ঘাত তাদের শয্যাসঙ্গী করার জন্য নিয়ে গেছে। যুবতী মেয়েগুলোকে বেছে বেছে ধরে নিয়েছে। ”
মাহা জবাব দিলোনা। আজ হয়তো সেও সেই মেয়েদের দলে থাকতো। যদি না সার্থক তাকে সাহায্য করতো! আচ্ছা, এভাবে না বলে চলে আসাটা কি ঠিক হয়েছে মাহার!
“মাহা?”
রেজওয়ান এসেছে। ইউনিফর্ম নেই গাঁয়ে। একটা সাদা টি-শার্ট আর কালো টাউজার পরনে। পকেটে হাত গুঁজে রাখা। এশা মাথা নিচু করে নিলো। তার শ্যামলা চেহারায় লজ্জার আভা। রেজওয়ানকে দেখে উঠে দাঁড়ালো মাহা। রেজওয়ান এগিয়ে এসেছে মাহার দিকে।
“তোমাদের বাসায় গেলাম। আন্টি বললো তুমি ছাদে। তাই ছাদে এলাম।”
অতঃপর সে তাকালো এশার পানে। কপাল কুঁচকে বিরক্তির সুরে আবার বললো,
“তোমার সাথে আমার কিছু জরুরী কথা আছে মাহা।”
“জ্বি, বলুন ভাইয়া।”
পরে মাহার মনে পড়লো এখানে এশা উপস্থিত। ওর সামনে তো সব কথা খুলে বলতে পারবেনা। এশা তখনও দাঁড়িয়ে। মাহা কিভাবে এশাকে চলে যেতে বলবে বুঝতে পারছেনা। রেজওয়ানই বললো,
“তুমি একটু বাসা থেকে ঘুরে এসো এশা। আমার কিছু জরুরি কথা আছে মাহার সাথে।”
এশা মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলো। তার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো কি? তার মনটা বারেবারে বলে উঠলো কি ‘আপনি অনেক খারাপ’?
ছাদের দক্ষিণ দিকে বেতের চেয়ার সাজিয়ে রাখা। সেখানে পাশাপাশি বসলো তারা। কিছু্ক্ষণ নিরবতা।
“চৈতির ব্যাপারটা আমাকে একটু খুলে বলোতো মাহা।”
_________________
গুলশানের এক বহুতল বিল্ডিং। দুইতালা আর তিনতালা মিলিয়ে ডুপ্লেক্স বাসাটা সার্থকের। রাজকীয়ভাবে সাজানো সবটা। এখন সব তছনছ। ড্রয়িং রুমের সবগুলো শো-পিছ ভাঙা। নিজের ঘরে দুটো ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমিয়ে আছে সার্থক। সার্থকের বন্ধু লুবান, সেক্রেটারি মুইংচিন আর বোন নিভা, বোন জামাই রবার্ট। সবার মুখই চিন্তিত। সার্থক এতো রেগে আছে কেন!
“আমাকে তুমি কষ্ট দিলে অলকানন্দা!”
ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করলো সার্থক। মেয়েটার কতবড় সাহস! সার্থক কে মিথ্যা বলে! এই ফায়রাজ সার্থক কে! ঘুমের ঘোরেই মাথার দুপাশের শিরা দুটো ফুলে উঠে সার্থকের।
(চলবে)
#অলকানন্দা
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-১১
৩০.
“আগামীকাল আমার পরীক্ষা। আগেরদিন খুব টেনশন নিয়ে ঘুমুতে গিয়েছিলাম। রুমানা কে তো চিনেন ভাইয়া?”
“হুম।”
“রুমানার ডাকে ঘুম ভাঙলো আমার। নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা পিচঢালা রাস্তায়। সেই সাথে কিছু অচেনা মুখ। রুমানার মুখে শুনলাম আমি নাকি সিলেট বেড়াতে এসেছি। চৈতির সাথে। রুমানাও ট্রেনে আমাদের সাথে এসেছিলো। দেরি হওয়ায় ও অন্য বগিতে ছিল। বিশ্বাস করুন ভাইয়া আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না!”
“স্ট্রেঞ্জ!”
চিন্তিত দেখালো রেজওয়ানের মুখ। মাহা একজন মেধাবী মেয়ে। সব সময়ই ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দিতে জানে। ওকে এই প্রথম এতটা বিচলিত হতে দেখলো রেজওয়ান। ও যতটুকু জানতো ছুটিতে চৈতির সাথে সিলেট গিয়েছিলো মাহা। মায়ের মুখে শুনেছিলো সে। কা কা করে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো এক ঝাঁক দাঁড়কাক। রেজওয়ান সেদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তারপর?”
“যতক্ষণে বুঝলাম সেটা রুমানাদের বাসা ততক্ষণে জানতে পারলাম চৈতি নিখোঁজ। এত রাতে কোথায় গেলো কেউ বলতে পারছিলো না। মেইনগেটে তালা ছিলো। তারপরই সকালে আপনাকে ফোন দিয়েছিলাম ভাইয়া।”
৩১.
বলেই মাথা নিচু করলো মাহা। পরেরটুকু জানা আছে রেজওয়ানের। মাহার ফোন পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে গিয়েছিলো তার অবাধ্য হৃদপিণ্ড। যখন প্রাণপাখিটার কাঁপা কাঁপা ভীতু স্বরের, সিক্ত গলায় ভিজা আওয়াজটা শুনলো! অবাধ্য হৃদয়ের কম্পন বন্ধ হবার উপক্রম প্রায়। রুদ্ধশ্বাসে কেবল বেরিয়ে এসেছিলো একটা বাক্য।
“আমি আছি তো, মাহা।”
কল্পনার ভাসমান জগৎ থেকে বেরিয়ে রেজওয়ান প্রশ্ন করলো,
“গতকাল কি ঘটেছিলো?”
“তখন বোধহয় সন্ধ্যা। হঠাৎ ট্রেন থেমে গেলো। দুইপাশে ঘন জঙ্গল। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কেন কি হলো! গুঞ্জন ভেসে এলো ডাকাত, ডাকাত। আমার সাথে একজন ছিলেন তিনি ট্রেন থেকে দৌড়ে নেমে গেলেন। আমিও তার পিছুপিছু ছুটলাম। ততক্ষণে চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে। তার সাথে জঙ্গলের দিকে দৌড় শুরু করলাম এলোমেলোভাবে। সামনে একটা সাঁওতাল বসতি। সেখানে রাত কাটিয়ে ভোরে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম ট্রেনে করে।”
সার্থকের কথাটা ইচ্ছে করেই বলেনি মাহা। বলতে ইচ্ছে করছেনা। যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটা ঘটেছিলো সেটা ভুলে যাবে সে। একদম ভুলে যাবে। ঘাড়ে চিনচিন ব্যথাটা বেড়েছে আবার। ডান হাতটা উঠিয়ে ঘাড়ে হালকা ম্যাসেজ করলো মাহা। ব্যথাটা হঠাৎ হঠাৎ হয়। আস্তে আস্তে মাথায় ছড়িয়ে পড়ে।
“তুমি ঠিক আছো? মাহা।”
ঘাড় থেকে হাত সরিয়ে নিলো মাহা। মলিন হেসে বললো,
“আমি ঠিক আছি।”
রেজওয়ানের খুব ইচ্ছে করছে জিজ্ঞেস করতে,
‘তিনি টা কি কোনো ছেলে ছিলো?’
মুখে চলে আসলেও নিজেকে সংযত করলো রেজওয়ান। নিরবতা। ঢাকার বিকেলগুলো অবশ্য নিরব হয়না। দূর থেকে বাস, ট্রাকের আওয়াজ ভেসে আসছে। হিম শীতল হাওয়া বইছে। মাথার উপরে দাঁড় কাকের দল উড়ে বেড়াচ্ছে। এদিকটায় কাকের আনাগোনা আজকাল বাড়লো কিনা!
“রুমানা ঢাকা আসবে কবে?”
“ওর মা অসুস্থ। বলেছে তাড়াতাড়ি ফিরবে।”
“সিলেট পুলিশ তোমাদের সবাইকেই তো জিজ্ঞেসাবাদ করেছে?”
“হ্যাঁ।”
“রুমানার সাথে আমার একবার কথা বলা প্রয়োজন মাহা। তুমি আমার পরিচিত তাই এই কেসটায় আমি ইনভলভ হচ্ছি। নয়তো এটা সিলেট পুলিশের অধীনে। যতক্ষণ না পর্যন্ত চৈতির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত কেসটায় আমি সরাসরি কিংবা অফিশিয়ালি ইনভলভ হতে পারবোনা। তবে ব্যাক্তিগত ভাবে আমি ইনভেস্টিগেট করবো। নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করবো।”
৩২.
“মাহা?”
রেজওয়ানের মুখপানে তাকালো মাহা। হলদে ফর্সা মুখটা, ভারী নেত্রপল্লব, কুঁকড়া চুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারামুখে। মাথায় কালো ওড়না দেওয়া। এমন বিষণ্ণতায়ও কি মায়াবী লাগছে প্রাণপাখিটাকে! ধক করে রেজওয়ানের বুকটা। বেসামাল নিজেকে সামলাতে বারকয়েক শুকনো গলায় কাশলো সে। তখনই বিচলিত দেখালো মাহার মুখ। উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“পানি খাবেন, ভাইয়া?”
“না, না। আজ আমি উঠি।”
বলেই দাঁড়িয়ে গেলো রেজওয়ান। ডানহাতটা গুঁজে দিলো পকেটে।
“ভাইয়া, চৈতিকে ফেরত পাবো তো? ওর বাবা অসুস্থ মানুষ। মুন্সিগঞ্জে ওর ফুফুর বাসায় থাকেন। নিজে চলাফেরা করতে পারেন না। ওর ফুফুর সাথেও তো ওর সম্পর্ক ভালো না। ওর ফুফু চেয়েছিলেন ওকে বিয়ে দিয়ে দিতে। মেয়েটা কতটা যুদ্ধ করে এতটুকু এসেছে আমি দেখেছি ভাইয়া। ওর কিছু হলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা।”
বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো মাহা। ভিষণ কষ্ট হচ্ছে তার। মাহার কান্না যে সহ্য হয়না রেজওয়ানের!
“প্লিজ মাহা। তুমি কেঁদোনা। আমি আছি তো। আমার সর্বাত্মক চেষ্টা আমি করবো।”
বলেই ছাদ থেকে গটগট শব্দ তুলে প্রস্থান করলো রেজওয়ান। বুকটায় জ্বালা করছে ভিষণ!
____________________
অন্ধকারে ছেয়ে গেছে ধরা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকারের মাঝে যেন নিজের জীবনটা খুঁজে পায় মাহা। তার ভালোবাসার মানুষগুলো সবসময় তার থেকে দূরে সরে যায়। বুঝ হওয়ার আগেই মা চলে গেলেন। বাবা ছিলো আপন। সেই বাবাও পর হয়ে গেলো। চৈতি মেয়েটা ছিলো মাহার অসুন্দর, এলোমেলো জীবনের আলোর দিশা। এক ফোঁটা হাসতো না মাহা। সেই মাহাকে খিলখিল হাসি শিখিয়েছে চৈতি। পরিচয়টা আড়াই বছরেরও কম। সেই তো কিছুদিন আগে এডমিশন কোচিংয়ে লম্বা মতন মেয়েটাকে দেখে অহংকারী ভেবেছিলো সে। মেয়েটা যখন ঘুষি মেরে মিনহাজের নাক ফাটিয়ে দিলো তখন তো রীতিমতো তাকে ভয় পেতো মাহা। ঠান্ডা স্বভাবের, নিরবে বসে থাকা মাহা কিনা বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেলো বাচাল, স্বাধীনতাপ্রেমী চৈতির! দুজন তো চান্সও পেলো একজায়গায়। সমাজবিজ্ঞান অনুষদে সবাই ভিষণ অবাক হতো তাদের বন্ধুত্ব দেখে। সবার মনে বোধহয় একটাই প্রশ্ন,
“তেলে জলেও মিশ খায়?”
এই চৈতির জন্য মাহা কত কথা শুনেছে দিনার। সবকিছু ছাপিয়ে ছিলো তাদের বন্ধুত্ব। সেই প্রাণপ্রিয় বন্ধুটা আজ চারদিন ধরে নিখোঁজ। আর মাহা কিছুই করতে পারছেনা! কিছুই না! দেয়ালে হেলান দিয়ে নিচে বসে পড়লো মাহা।
“আমার জীবনের প্রিয় মানুষগুলোই কেন হারিয়ে যায়, আল্লাহ? আমার জীবনটা এতো অদ্ভুত কেন?”
আবারো চোখে নেমে এলো জল। ঠান্ডা কপোলে উষ্ণ জলের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। এই জল মুছিয়ে দিতে কেউ কি আসবে?
৩৩.
“হ্যালো, আংকেল?”
“আমি তোমার দিনা আন্টি।”
“আন্টি একটু মাহাকে দেন। ইমার্জেন্সি।”
আজাদ সাহেবের ফোনে হঠাৎই সকালে ফোন এসেছে রেজওয়ানের। মাহা কে চাচ্ছিলো সে। দিনা মুখ বাঁকিয়ে প্রায় মোবাইলটা ছুড়ে দিলেন মাহার পানে। মনটা এমনিতেই খারাপ মাহার। সে সাথে মাথাব্যথা। রেজওয়ান অধৈর্য্য হয়ে বললো,
“হ্যালো, মাহা?”
“জ্বি।”
“একটা খারাপ সংবাদ আছে।”
কি খারাপ সংবাদ! হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে মাহার। মাহা কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“কি…কি খারাপ সংবাদ?”
“গতকাল বিকালে সিলেট আগুন পাহাড় থেকে একটা ছিন্ন পা পাওয়া গেছে। সেটা আজ ঢাকা মর্গে পৌঁছেছে। তুমি কি একবার এসে শনাক্ত করে যাবে? আরো কিছু জিনিসপত্রও পাশে পাওয়া গেছে।”
বিদ্যুৎ চমকানোর ন্যায় শব্দ হচ্ছে মাহার আশেপাশে। শরীরটা অসাড় হয়ে আসছে। বোকা মন বারেবারে বুঝ দিচ্ছে। উঁহু, ঐটা চৈতি নয়। ঐটা চৈতি হতেই পারেনা! মস্তিষ্ক মানছেনা। সে যে যুক্তিতে বিশ্বাসী। আবেগ তার বড্ড অপ্রিয়।
“হ্যালো, মাহা। তুমি কি শুনতে পাচ্ছো? আমিই আসতাম তোমাকে নিতে। এখানে এখন আমাকে থাকতে হবে। তুমি চলে এসো।”
“আমি আসছি ভাইয়া।”
যে পোশাক পরনে ছিল তা পরেই রওনা দিলো মাহা। ড্রয়িং রুমে টিভিতে সংবাদ দেখাচ্ছে,
“২০১২ সালের ন্যায় খুন আবারো। প্রায় পাঁচ বছর পর একই রকম শরীরবিহীন পা উদ্ধার করলো সিলেট পুলিশ। ঘটনাটি ঘটেছে সিলেটের আগুন পাহাড়ে। গতকাল বিকেলে একজন স্থানীয় উপজাতি সর্বপ্রথম বিষয়টি অবগত করেন সিলেট পুলিশকে। পা টি নিয়ে আসা হয়েছে ঢাকা মর্গে। কার শরীরের অংশ তা এখনো জানা যায়নি। পুলিশ এ ব্যাপারে মুখ খুলতে নারাজ। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে আমাদের সাথে যুক্ত হচ্ছেন……
খবর শোনার সময় এখন নয়। দৌড়ে নিচে নেমে একটা রিকশা নিলো মাহা।
রিকশা যতই এগুচ্ছে ততই বুকটা কেঁপে উঠছে মাহার। এই শীতেও তরতর করে ঘাম বেয়ে পড়ছে তার কপালের দুপাশ দিয়ে। ওড়না দিয়ে কপাল মুছলো সে। একটাবারের জন্যও চৈতির ফুফু কোনো খোঁজ নেন নি। সেই যে মাহা একবার জানিয়েছিলো সিলেট থাকতে ফোন দিয়ে। এরপর আর কোনো খবর তিনি নেন নি। দায়সারা উত্তর ছিলো তার,
“কোনো ব্যাটার সাথে ভাগছে মনে হয়।”
জ্যামে আটকে গেলো রিকশা। ভিষণ বিরক্ত লাগছে মাহার। ঢাকার জ্যামকে মাহা মন থেকে ঘৃণা করে।
গাড়ি করে হসপিটাল যাচ্ছে সার্থক। জ্যামে বসে থেকে গাড়ির জানালা খুলে দেয় সে। পাশে তাকিয়েই চমকে উঠে প্রথমে। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে আবার তাকায় সেদিকপানে। হলদে ফর্সা, কুঁকড়া চুলের, অহংকারী মেয়েটা। বারেবারে কপালের ঘাম মুছতে ব্যস্ত। বেশ চিন্তিত তার মুখ। সার্থক তাকিয়ে আছে। একধ্যানে, প্রাণভরে দেখছে সে। যানজট ভালো লাগছে তার। ভিষণ ভালোলাগছে। হঠাৎ..
হঠাৎ মেয়েটা চলে গেলো। রিকশাটা হারিয়ে গেলো শতগাড়ির মাঝে। বুকটা কেঁপে উঠলো সার্থকের। এই মেয়েটাকে আবার হাতের কাছে পেলে নির্ঘাত তুলে আছাড় দিবে সে। মুইংচিন সামনে থেকে লক্ষ্য করছিলো তাকে,
“কি ডেখো সাটক?”
“কিছুনা, মুইংচিন।”
“টোমারে আজ জরুরি ডাকালো। পা পাওয়া গেসে।”
“হুম।”
গম্ভীর হয়ে গেলো সার্থকের মুখ। হাসপাতালে জরুরিভাবে ডাকানো হয়েছে তাকে। দেড় বছর পর আবারো সিরিয়াল কিলার মাতব্বর শরীফের খুনের ধরনের মতো খুনের ঘটনা ঘটলো। এটা কি করে সম্ভব? মাতব্বর শরীফ তো জেলে! তাহলে কে ঘটাচ্ছে এসব? কেন ঘটাচ্ছে?
(চলবে)