অলিন্দ্রীয়া,পর্ব_১০_১১_ও_১২

0
1818

অলিন্দ্রীয়া,পর্ব_১০_১১_ও_১২
তৃধা আনিকা
পর্ব_১০

অলিন্দ্রীয়ার বিয়ের পর বাড়িতে আবার পুরোনো রিদম ফিরে এলো। সবাই স্বাভাবিক। বাবা দাদুই ঝগড়া করছেন। অংকন, অংক আবিষ্কারে মন দিয়েছে, রূপায়ন ক্যাডেট কলেজ ভর্তি প্রস্তুতি আবার শুরু করেছে। অলিন্দ্রীয়া রোজ ক্লাসে যাচ্ছে।

প্রায় সপ্তাহখানেক পর জুয়েল ফোন করলো। অলিন্দ্রীয়া ক্লাসে ছিল তাই ধরলো না। ক্লাস শেষে কল ব্যাক করলো।
—হ্যালো!
—ফোন ধরেননি যে?
—ক্লাসে ছিলাম! ভালো আছেন?
—জি। আমি আজকেই আবার দু’সপ্তাহের জন্য অফিস ট্যূরে যাচ্ছি।
—আমাকে কেন বলছেন?
—মা’কে ফোন করেছিলাম। তিনি বললেন, এখন থেকে দেশের বাইরে গেলে সব যেন আপনাকে জানাই। আমার তো আসলে জানিয়ে যাবার মতো আর কেউ নেই।
অলিন্দ্রীয়া চুপ করে থাকলো। তার কি বলা উচিত?সাবধানে যাবেন টাইপ কিছু?
—হ্যালো… অলিন্দ্রীয়া শুনতে পাচ্ছেন?
—জি! তা কখন যাবেন?
—রাত ন’টায় ফ্লাইট।
—অ আচ্ছা! রাখি?
—ইয়ে মানে, আপনার মুখটা তো মনে নেই।
অলিন্দ্রীয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললো, তার নিজের’ই তো জুয়েলের চেহারা মনে নেই।
—ট্যূর করে আসুন এরপর নাহয় মুখ দেখে যাবেন।
—আচ্ছা… আর একটা কথা, আপনার মা বলছিলো দুপুরে আপনাদের বাসায় খেতে।
অলিন্দ্রীয়া বিরক্তির হাই তুললো। এর মধ্যে মাকেও এক রাউন্ড ফোন করে ফেলেছে লোকটা।
—খেতে বলেছে, খাবেন। আর শুনুন, সব আমায় জিজ্ঞেস করে করতে হবে না। প্লিজ বিহেভ লাইক এ ফ্রি ম্যান। ইনজয় ইওর ফ্রিডম! প্লিজজজ!
অলিন্দ্রীয়া ফোন কেটে দিলো। দুপুরে সে বাসায় যাবে না। মার্কেটে ঘুরবে। লোকটা খেয়েদেয়ে চলে গেলে বিকেলে বাসায় যাবে।

জুয়েল দুপুরে বাসায় এসে দেখে বিশাল আয়োজন। একসাথে লাঞ্চ করবেন বলে তার শ্বশুরও হাসপাতাল থেকে এসেছেন। কিশোরটাইপ ছেলে দুটো আজ তার সাথে গল্প করতে বসেছে। তবে তাদের গল্প জুয়েল কিছুই বুঝতে পারছে না। যেমন জুয়েল আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করলো,
—কার কি নাম বলোতো?
—আমার নাম পান, জুয়াভাই।
—আমার নাম অংক, জুয়াভাই।
জুয়েলকে তারা ডাকছে জুয়াভাই বলে।
—পান আবার কারো নাম হয়?
—হয় তো। আপনাকে এলার্ট করে দিচ্ছি জুয়া ভাই, আপনি এবাড়িতে কখনোই পান খাবেন না।
জুয়েল আগামাথা না বুঝেও বললো,
—আচ্ছা পান খাবো না।
—তা তুমি কি করো?
অংক উদাস ভাবে বললো,
—অংক আবিষ্কারের চেষ্টা করছি জুয়া ভাই। আমাকে যে নোবেল পেতেই হবে।
জুয়েল থতমত খেয়ে বললো,
—নোবেল কেন? তাও আবার অংকে!
অংক চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
—দিয়াশলাই আর চুলো নিয়ে একটা অংক বানাচ্ছি, শেষ হোক আপনাকে দেখাবো।
এক ফাঁকে জুয়েল জিজ্ঞেস করলো,
—তোমাদের আপু সবথেকে কি পছন্দ করে?
—ছবি আঁকতে ভালোবাসে। আপু লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি হবে একদিন!
—তোমার আপুর আঁকা ছবি কি আমায় দেখানো যাবে?
—ছবি তো আমাদের কাছে নেই, মায়াবুর কাছে।আপু ছবি আঁকা শেষ করলেই মায়াবু গিয়ে উদ্ভট উদ্ভট মন্তব্য করেন, তাই রাগ করে ছবি মায়াবুকেই দিয়ে দেন।

পান আর অংক কি অবলীলায়ই না কথা বলে যাচ্ছে! জুয়েলের কেন যেন ছেলে দুটোকে ভীষণ আদর করতে ইচ্ছে হলো।
—তোমরা কি গিফট চাও বলো? আমি তো বিদেশে যাচ্ছি, পেলে নিয়ে আসবো।
রূপায়ন বললো,
—কালো সিরামিকের একটা টি-সেট আনবেন, আমি ভাঙবো।
অংক বললো,
—এরকম কোনো ক্যালকুলেটর কি আছে যেটা মুখে বললে তা শুনেই অংক করে দিতে পার? এরকম পেলে নিয়ে আসবেন।
জুয়েলের খাওয়া দাওয়া শেষ। অলিন্দ্রীয়া এখনো ফিরেনি কেন? সে কি আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে নাকি চলে যাবে? দাদুই অবিরত গল্প করে যাচ্ছেন।জুয়েলের প্যাকিং বাকি আছে; গল্পের মাঝখানে সে উঠতেও পারছে না।

অলিন্দ্রীয়া ফিরে এলো বিকেল পাঁচ টায়। এসে দেখে সবাই দুপুরঘুমে শুয়ে আছে। লোকটা কি এসেছিলো?
অলিন্দ্রীয়া রুমের দিকেই যাচ্ছিলো, মা ডাকলেন।
—লিয়া, এত দেরি যে? জুয়েল এইমাত্র গেল।
—ক্লাস ছিল, কিছু এসেনশিয়াল কেনাকানা ছিল।
মা আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বললেন,
—জুয়েল তোর জন্য হাতখরচের টাকা দিয়ে গেছে। তোর ফুফুই নাকি তাকে বলে দিয়েছে। তোর টেবিলে খাম রাখা আছে।
অলিন্দ্রীয়া বিরক্তিভরা গলায় বললো,
—উফ মা… টাকা দিলেই রাখতে হবে! তুমি বলোনি কেন, আমার চাই না?
—না চাইলে তোর দাদুইকে দিয়ে দিস। তিনি খুশি হবেন।
—উনি কি আমার ঘরে গিয়েছিলো?
—হুম। সে’ই তো টাকাটা টেবিলে রেখে আসলো।

অলিন্দ্রীয়া একছুটে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো।
সর্বনাশ! রুমের যে কি অবস্থা আল্লাহ জানেন। সকালে সে চেঞ্জ করে কিছুই গুছায়নি। তাছাড়া তার নিজের আঁকা নাহিদের ছবিটাও আছে। দেখে ফেলেনিতো আবার। কি লজ্জা! কি লজ্জা!
রুমে এসে অলিন্দ্রীয়া হাফ ছাড়লো…
নাহ্! ছবিটা লুকানো জায়গাতেই আছে। দেখেনি তাহলে। ছবিটা সে এক্ষুণি পুড়িয়ে ফেলবে, এক্ষুণি।

অলিন্দ্রীয়া চেঞ্জের আগেই, ছবিটা পুড়ালো।
বিছানায় বসতেই, তার সকালের ছেড়ে যাওয়া কাপড় চোখে পড়লো। ইশ্! লোকটা কি এসব দেখেছে নাকি?

পর্ব_১১

দুই সপ্তাহ কি পেরিয়ে গেছে? জুয়েল কি ফিরেছে? ফোন করেও তো কিছু জানালো না! অলিন্দ্রীয়া কি ফোন করবে? না থাক সে কেন করবে? তার কিসের এত দরকার জেনে?

সন্ধ্যার দিকে রূপায়ন এসে ডাকলো, অলিন্দ্রীয়া তখন শুয়েছিলো,
—আপু,তাড়াতাড়ি নিচে আসো। এই কালো সিরামিকের টি সেটটা আমি এখন ভাঙবো।
অলিন্দ্রীয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,
—টি সেট পেলি কোথায়?
—জুয়াভাই দিয়েছে!
—-জুয়াভাইটা কে??
রূপায়ন উত্তর দিলো না।
—নিচে আসো আপু, উনি তোমার জন্যও গিফট এনেছেন।
—আমার জন্য গিফট?
—হু,
রূপায়ন দৌড়ে ব্যস্তভঙ্গিতে আবার নিচে চলে গেল।
অলিন্দ্রীয়া সিঁড়িতে এসেই শক খেলো। ওহ্ জুয়েল এসেছে! জুয়েলকে এরা জুয়াভাই ডাকছে নাকি? কি সর্বনাশ! ছোটচাচা তো এর নামের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন। অলিন্দ্রীয়া আবার রুমে ফিরে এলো। সে নিচে যাবে না। রাত ১০টা নাগাদ মা ডাকতে এলেন,
—খাবি না?
—পড়ছি তো মা। পরে খাবো।
—ছেলেটা কি প্রতিবারই একা একা খাবে? এতদিন পর এসেছে!
তার মানে এখনো রয়ে গেছে জুয়েল।
—উফ মা, দেখছো না আমি রিডিং ইউনিফর্ম পরে আছি? এভাবে কি যাওয়া যায়? চেঞ্জ করতে হবে। দেরি হবে। তার চেয়ে বরং তাকে খেয়ে চলে যেতে বলো।
—রিডিং ইউনিফর্ম পরে আছিস তো কি হয়েছে? জুয়েল তো নিজের মানুষ। চল..

অলিন্দ্রীয়া একটা ওড়না পেঁচিয়ে নিচে এলো। টেবিলে ও কোথায় বসবে? জুয়েলের পাশের চেয়ারে? দাদুই বললেন,
—জুয়া’র ধারে বস লিয়া। একটু জুয়া টুয়া খেল।
কি সাংঘাতিক! বাসার সবাই তো একে দিব্যি ‘জুয়া’ ডাকছে।
জুয়েলই ব্যাপারটা সামলালো। হেসে বললো,
—পান, আমার পাশে বসো তো। আজ আমি ভাতের সাথে পানও খাবো।
রূপায়ন মহানন্দে জুয়েলের পাশে বসে গেল। এর মাঝে অলিন্দ্রীয়া আর জুয়েলের দৃষ্টি বিনিময় হলো। যে দৃষ্টির মানে হলো, আমরা কিন্তু যার যার মতো ভালো আছি।
খেতে বসে তারা দুজনেই চুপচাপ থাকলো। দাদুই ক্রমাগত কথা বলে গেলেন। একবারতো বললেন,
—বুঝলি লিয়া, তোদের হলো, সোনায় সোহাগা জুঁটি! নামেও কি মিল। কি ছন্দ! লিয়া- জুয়া! জুয়া-লিয়া। তোদের হবে ছন্দময় জীবন। এত মিল তো কবিতায়ও নেইরে।
জুয়েল পানি খাচ্ছিলো। বেচারা ভিড়মি খেয়ে গেল।নাকে পানি উঠে, চোখ জ্বালা করতে লাগলো।
এর মাঝে ছোটচাচা বললেন,
—তোদের ছেলেপুলের নামও ঠিক করে ফেলেছিরে, লিয়া।
অলিন্দ্রীয়া চোখ বড় বড় করে বললো,
—ছেলেমেয়ের নামও ঠিক করে ফেলেছো?
—ইয়েস। এসব ক্ষেত্রে প্রি প্ল্যানিং ভালো। কমবাইন্ড করে মেয়ে হলে নাম রাখবো ‘জুলিয়া’ আর ছেলে হল, ‘জুলিয়ান’।
এবার অলিন্দ্রীয়া ভিড়মি খেলো। তাঁর নাকে ভাত উঠে গেল।

অলিন্দ্রীয়া আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ায়নি।পরীক্ষা আছে, পড়তে হবে তার। এগারোটা নাগাদ জুয়েল এসে দরজায় নক করলো। বই হাতেই অলিন্দ্রীয়া দরজা খুললো,
—ভেতরে আসুন।
—না না, ঠিক আছে।পরীক্ষা আর কয়টা বাকি?
—আরো ৩টা।
—অ আচ্ছা। কিছু গিফট এনেছিলাম! কি করবো?
অলিন্দ্রীয়া মিষ্টি করে বললো,
—নিচে সুইটমিট আছে তো, ওদের কাছে রেখে যান। এন্ড থ্যাঙ্ক ইউ।
জুয়েল হাসলো। অলিন্দ্রীয়া এই প্রথম জুয়েলের দিকে পূর্ণদৃষ্টি নিয়ে তাকালো। বাহ্! বেশ তো।
—গুড লাক পরীক্ষার জন্য।
অলিন্দ্রীয়া কিছু বললো না। জুয়েল চলে যাচ্ছিলো, অলিন্দ্রীয়া পিছু ডাকলো,
—শুনুন, এবার থেকে ট্যূর করে এসে আমায় ফোন করে জানাবেন।
জুয়েল সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো।

রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ অলিন্দ্রীয়াদের বাসার সামনের গলির মুখের, “রহিম রেস্টুরেন্ট এন্ড সুইটমিট” থেকে বাসায় ফোন এলো,
—জুয়েল নামে এক ভদ্রলোক একটা প্যাকেট রেখে গেছেন, অলিন্দ্রীয়াদের বাসার নাম করে; এটা এখন নিয়ে আসার জন্য কারণ একটা নাগাদ তারা রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে ফেলবে। তখন সকালের আগে আর পাওয়া যাবে না।
অলিন্দ্রীয়া মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। লোকটা সুইটমিটেই তাহলে গিফট রেখে গেছে।

পরীক্ষা শেষ হবার পরেরদিন সন্ধ্যায়ই, জুয়েলের ফোন এলো। সে এবার চার সপ্তাহের অফিস ট্যূরে যাচ্ছে। অলিন্দ্রীয়া বিনীত কণ্ঠে বললো,
—এবার কোনো গিফট ফিফট আনবেন না প্লিজ!
জুয়েল মন খারাপ করে বললো,
—আচ্ছা আনবো না।
—আর শুনুন, রূপায়ন আর অংকনকে আমি আদর করে সুইটমিট ডাকি। ইজ ইট ক্লিয়ার?
ফোনের ওপাশ থেকে জুয়েল লজ্জিত ভঙ্গিতে জিভ কাটলো।

এবার ট্যূর করে ফিরে এসে জুয়েল কোনো ফোন করলো না। ফোন করলেন ফুফু।
—লিয়া, ও’র বাসাটা দেখে আয় গিয়ে। অফিস ওকে কত সুন্দর ফ্ল্যাট দিয়েছে জানিস?
—ফ্ল্যাট দেখবো না ফুফু। আমার পড়াশোনা আছে।
—একদিনের জন্য তো আর পড়াশোনা পালিয়ে যাচ্ছে না। একটু গল্প টল্প করবি, ভালো লাগবে। যা না।
অলিন্দ্রীয়া ফোন রেখে দিলো।

সেদিনই রাত ৮টার দিকে জুয়েল এলো। রূপায়ন এসে বললো,
—আপু, জুয়াভাই আজ তোমার ছবি আঁকা দেখবেন। রাতে থাকবেন। তুমি ছবি আঁকার সব রেডী করো। অংক ভাইয়ার ‘অংক’ আবিষ্কারে একটু হেল্প করেই আসছেন।
মানুষটার কি কোনো কান্ডজ্ঞান নেই? রাতে থাকবে। হুহ।
জুয়েল রুমে আসতেই অলিন্দ্রীয়া বললো,
—আমি পড়ছি এখন। আজ রাতে ছবি আঁকবো না। অন্য আরেকদিন ছবি এঁকে দেখাবো।
জুয়েল তাও দাঁড়িয়ে থাকলো।
অলিন্দ্রীয়া জুয়েলের মুখোমুখি গিয়ে নিজের টি শার্ট টেনে ধরে বললো,
—এখানে দেখুন, এখানে কি লিখা দেখুন? ইটস রিডিং টাই……
অলিন্দ্রীয়ার কথা শেষ না হতেই জুয়েল অলিন্দ্রীয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
—সত্যিই দেখবো?
অলিন্দ্রীয়া নিজের দিকে তাকিয়ে টি-শার্ট ছেড়ে দিলো।
জুয়েল মৃদু হেসে বেরিয়ে গেল।
অলিন্দ্রীয়ার নিজেকেই চড় মারতে ইচ্ছে করছে। এত এডভান্স কাজ করার কি দরকার ছিল। ধুর! নিজেই সব দেখিয়ে… ছিঃ।

মা এসে বললেন,
—জুয়েলকে একটু থাকতে বল তো অলি। ছেলেটা চলে যাচ্ছে!
অলিন্দ্রীয়া রেগে বললো,
—সাধাসাধির কি আছে মা? থাকতে মনে না চাইলে থাকবে না। তাঁর ইচ্ছা, তাঁর ইচ্ছাই।
মায়াবু এক্সট্রা বালিশ দিয়ে গেল।
—আপা, খুব দামে থাকবেন কইলাম। সহজে নুইবেন না। বেডা মানুষ হইলো, ‘বান্দরজাত’! লাই দিলেই মাথায়!
অলিন্দ্রীয়া চূড়ান্ত চটে গেল,
—গেট আউট, মায়ারুন বেগম! যাস্ট গেট আউট। মা, এরকম হবার কি কথা ছিল?
মা হাই তুলতে তুলতে চলে গেলেন।

অলিন্দ্রীয়া কোন পাশে শোবে? এপাশে না
ওপাশে? নাকি বারান্দায় পড়াশোনা করে কাটিয়ে দিবে? জুয়েল কোথায় চেঞ্জ করবে? তার সামনে কিভাবে চেঞ্জ করবে? উফ।এত টেনশান যেন নেওয়া যাচ্ছে না।
জুয়েল রুমে এসেই বললো,
—বেশি বোর হলে আমি চলে যাই?
অলিন্দ্রীয়া হতাশ কণ্ঠে বললো,
—একদম ঢং করবেন না। আমায় যতটা বোকা ভাবছেন, আমি অত বোকা না। পাশ চয়েস করে শুয়ে পড়ুন। আমি আরো কিছুক্ষণ পড়বো।
—আমিও পড়বো, গল্পের বই আছে? দিন তো! টিভি নেই কেন আপনার ঘরে? কি বিচিত্র ঘর! এসি আছে টিভি নেই।
অলিন্দ্রীয়া একটা রান্নার রেসিপির বই জুয়েলের হাতে দিয়ে বললো,
—এটা পড়ুন। এন্ড বি কেয়ারফুল, আমার ঘর নিয়ে কোনো কমেন্ট নয়। হুহ।
জুয়েল অলিন্দ্রীয়াকে টেনে ধরলো। অলিন্দ্রীয়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই থাকলো। জুয়েল ফিসফিস করে বললো,
—এরকম শক্ত হয়ে আছো কেন অলি?
—আমার ইচ্ছে।
—আমার যে অন্যরকম ইচ্ছে।
এবার জুয়েল আরেকটু চাপা গলায় বললো,
—তুমি কি ভয় পাচ্ছো অলি? তুমি হয়তো ভাবছো তোমার না আবার প্রেম হয়ে যায়? এম আই রাইট?

নিজেকে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে অলিন্দ্রীয়া এবার চেয়ারে গিয়ে বসলো।
—প্রেম কি অত সোজা যে কেউ ছু্ঁয়ে দিলেই হয়ে যাবে?

পর্ব_১২

—প্রেম হয়তো এতোটা সোজা নয় অলি কিন্তু শরীরী প্রেমটা খুব সোজা। সত্যিকারের যে মনের প্রেম, তা খুব কঠিন। কারো কারো জীবনে তো মনের প্রেম কখনোই আসে না।
—যেমন?
—যেমন ধরো, দুটো মানুষ অনেকসময় সারাজীবন একসাথে থেকেও মনের প্রেম হয় না। আবার কিছু ক্ষেত্রে কেউ কাউকে না দেখেও বছরের পর বছর একজন আরেকজনের কথা ভেবে যায়। এরকম..
—কোন প্রেমটা ভালো?
—আমি জানি না। তবে মনের প্রেমের শক্তি বোধহয় বেশি। এতে কোনো প্রপার কারণ লাগে না, যাস্ট হয়ে যায়! আর মনের প্রেম হলে, শরীরী প্রেম হতে বাধ্য।তাকে ছু্ঁয়ে থাকতে সবসময় মন চাইবে।
—আপনার কোনটা হয়েছে?
জুয়েল এবার অলিন্দ্রীয়ার কাছে গিয়ে টেবিলের উপর বসলো। দু পা দিয়ে শক্ত করে অলিন্দ্রীয়ার চেয়ার আটকে ধরে ঠিক অলিন্দ্রীয়ার মুখোমুখি বসলো।
—আমার বোধহয় মনেরটা হয়ে গেছে। বিয়ের দিন তোমায় দেখতে এসে শুনলাম, জ্বর হয়ে গেছে। ঠিক তখনি হয়ে গেল।
অলিন্দ্রীয়া হাসলো।
—চেয়ার ছাড়ুন, হাত সরান। আপনি তো আমায় এরেস্ট করে রেখেছেন।
—অলি বিয়ের আগে আমায় বলা হলো, তুমি মেন্টালি আনস্টেবল। আমি ভাবলাম অসহায় একটা মেয়েকে বিয়ে করলাম মেবি। আমার ধারণা ছিল তুমি পাগল! কিন্তু পরে মা বললেন, তোমার সাডেন শকটার কথা। নাহিদের কথা। আমি এতে খুব খুশি হলাম, যাক আমার বউটার তাহলে প্রেমে পড়বার ক্ষমতা আছে। আমার কিযে ভালো লাগছিলো!
—অন্য একজনের কথা শুনেও ভালো লাগলো? আপনি খুব অদ্ভূত!
—তোমার যেদিন সত্যিকারের মনের প্রেম হবে, দেখবে মানুষটার সব তোমার ভালো লাগছে। তাঁর মন্দটাকেও ভালো লাগবে।
—কি করে বুঝবো যে মনের প্রেম হয়েছে?
জুয়েল লিয়ার হৃদপিন্ডটার কাছে হাত রেখে মুখটা একদম গালের কাছে এনে বললো,
—তখন তুমি এখান থেকে বুঝবে। সব অনুভূতি এখানে এসে লাগবে! কি যে মধুর ব্যথা….

লিয়া বড় করে শ্বাস ছাড়লো। মানুষটা কি ম্যাজিক জানে? মন্ত্র টন্ত্র কিছু?
—–হাত সরান।
জুয়েল চট করে হাত সরিয়ে বিছানায় চলে গেল।
—লিয়া এটা কি? পিল নাকি? আমি কি একটা খেয়ে নিবো?
লিয়া ঝটকা মেরে জুয়েলের হাত থেকে পিলটা সরিয়ে নিলো এবং হেসে ফেললো। মা রেখে গেছে নাকি?উফ!
অলিন্দ্রীয়া একটু যেন অভিযোগের স্বরে বললো,
—আপনাকে তো লাজুক দেখতে লাগে অথচ কত বোল্ড!
জুয়েল মনে মনে বললো, ইউ ডোন্ট নো অলি হাউ মাচ নটি আই এম। বাট ইন ফিউচার ইউ’ল ডেফিনিটলি নো দ্যাট!
—গুডু গুডু নাইট অলি।
জবাবে অলিন্দ্রীয়া মিষ্টি করে হাসলো। মনে মনে বললো, নাহিদের সাথে তাহলে আমার কোনো প্রেমই হয়নি তাহলে? যাক বাঁচা গেল।
সেইরাতে অলিন্দ্রীয়া সারারাত ছবি আঁকলো। জুয়েল অঘোরে ঘুমালো। অলিন্দ্রীয়া জুয়েলের একটা ঘুমন্ত অবস্থার ছবিও এঁকে ফেললো।

এর প্রায় মাস তিনেক পর জুয়েল আরেকদিন, এসে রাতে থেকে গেল। তবে সে রাতে খুব মজার ঘটনা ঘটলো।
রাতে শুতে গিয়েই জুয়েল জোড়াজোড়ি শুরু করলো।
—একটু ভালো করে তাকাও না প্লিজ!
অলিন্দ্রীয়া চোখ বন্ধ করে কাঠ হয়ে গেল।
—আমি থাকতে পারি না অলি! আমার খুব অসহ্য লাগে। প্লিজজ! প্লিজজজ! আর কতদিন?
—আমার ইচ্ছে করছে না।
জুয়েল অলিন্দ্রীয়াকে শক্ত করে বিছানায় চেপে ধরে বললো,
—তোমার কেন ইচ্ছে করে না, কেন? কি পছন্দ হয় না আমার বলো? কি সমস্যা? কবে ইচ্ছে করবে তোমার?
—পছন্দ অপছন্দ নয়! আমি রেডী নই এখন।
—তুমি কেন রেডী নও, কেন?
জুয়েল অস্থির হয়ে পড়লো। রাগ দেখিয়ে অলিন্দ্রীয়ার ড্রেসিং টেবিলের সব জিনিসপত্র ফেলে দিলো। বইয়ের তাক থেকে সব বই ফেলে দিলো, ড্রেসিংটেবিলের কাঁচ ভেঙ্গে ফেললো এবং সর্বশেষ উল্টো শার্ট গায়ে দিয়ে, অলিন্দ্রীয়ার জুতো পায়ে দিয়ে রাত দুটা নাগাদ চলে গেল। যাবার সময় বইয়ে হোঁচট খেয়ে উল্টে পড়তে গিয়ে নিজেকে সামলালো। বিড়বিড় করলো, আর কখনো আসবো না, আর এসেই বা কি করবো? তোমার পায়ে ধরাটাই বাকি আছে। আমার তো কোনো দাম নেই।

অলিন্দ্রীয়া খুব মজা করে জুয়েলের এই কান্ডকারখানা দেখলো।
জুয়েলের এত রাতে চলে যাওয়ায় মা এসে বললেন,
—চলে গেল কেন রে? ও মাই গড! ঘরের এ কি অবস্থা লিয়া?
অলিন্দ্রীয়া শান্ত ভঙ্গিতে বললো,
—মা, ড্রেসিংটেবিলটা পুরোনো হয়ে গেছে তাই কাঁচটা ভেঙ্গে দিয়েছি। এটা বদলে ফেলো তো।
জুয়েল চলে যাবার পর সেই রাতেও অলিন্দ্রীয়া সারারাত ছবি আঁকলো এবং আশ্চর্যজনক বিষয় তাঁর ছবিগুলো ভীষণ ভালো হলো। জুয়েলের রাগী রাগী অবস্থার একটা ছবিও সে এঁকে ফেললো।

এরপর কেটে গেছে অনেকদিন। জুয়েলের সাথে অলিন্দ্রীয়ার স্বাভাবিক কথাবার্তাও কমে গেল। জুয়েল নিজেই এভয়েড করতে লাগলো। আসতে থাকলো কম। ফোনটাও নিজের থেকে করতো না।
একদিন দুপুরে লাঞ্চে এসেছিলো, সবার ন্যাপের সময়। অলিন্দ্রীয়া রূপায়নকে দিয়ে জুয়েলকে রুমে ডেকে পাঠালো। রুমে এসে অলিন্দ্রীয়ার দিকে তাকিয়েই জুয়েল মাথা নিচু করে ফেললো। অলিন্দ্রীয়া একটা গাঢ় মেরুন কালারের অফশোল্ডার পরে আছে। সাথে একটা স্কিন ফিটিং জিন্স! হলিউড না বলিউডের নায়িকা? মেয়েটা দেখছি মাথা খারাপ করেই ছাড়বে।
সে অলিন্দ্রীয়ার দিকে না তাকিয়েই অজুহাত দেবার ভঙ্গিতে বললো,
—অফিস পার্সোনাল গাড়ি স্যাংশান করেছে। দাদুই দেখতে চাইলেন, তাই আসলাম।
—আমি কি আসতে মানা করেছি?
জুয়েল চুপ করে থাকলো।
অলিন্দ্রীয়া জুয়েলের খুব কাছে এসে দাঁড়ালো,
—হাত খরচের জন্য দাদুইকে কাড়ি কাড়ি টাকা দিচ্ছেন কেন? দাদুই কি আপনার বউ?
—তুমিই তো বলেছিলে দিতে?
—আমি বললেই দিয়ে দিবেন? তিনি এসব টাকা জলে ভাসাচ্ছেন। সেদিন তিনি বিশাল একটা গামলা কিনে নিয়ে এলেন। বাসায় এসে দেখা গেল, গামলা দরজা দিয়ে ঢুকছে না। গামলা দিয়ে করবেটা কি উনি?
জুয়েলের কানটান গরম হয়ে গেল। মেয়েটার গা থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে। মাথা ঝিম ঝিম করছে।এক্ষুণি না আবার কিছু ঘটে যায়!
জুয়েল তাড়াহুড়ো করে বললো,
—আমি যাই তাহলে?
অলিন্দ্রীয়া একটু নরম স্বরে বললো,
—সেই রাতের জন্য খুবই দুঃখিত আমি। স্যরি!
—ইট’স ওকে। আমিই ওভাররিয়েক্ট করেছিলাম।আমার লিমিট আমারই বোঝা উচিত ছিল। আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে জুতো স্বর্ণের হলেও মানুষ তাকে পায়েই পরে।
—ছিঃ এভাবে কেন বলছেন?
—আমি এতিম খানায় বড় হওয়া মানুষ।ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত যা পড়েছি, যা করেছি সব নিজের চেষ্টায় করেছি। কেউ কখনোই মাথায় হাত বুলিয়ে দুটো ভালো কথা বলেনি। ভালো খেতে দেয়নি।
অলিন্দ্রীয়া লজ্জিতভাবে জুয়েলের হাত চেপে ধরলো। বললো,
—আমি মন থেকে ক্ষমা চাইছি জুয়েল।
—তুমি কেন ক্ষমা চাইবে? আমিই তুচ্ছ! জানো অলি, ঢাকা ভার্সিটিতে সিলেকশান লিস্টে এসেও আমি যখন ভর্তি হতে গেলাম, আমার পকেটে তখন কোনো টাকাকড়ি নেই। ইউনিভার্সিটিতে ঘুড়াঘুড়ি করতে থাকলাম। মনে মনে ঠিক করলাম কোনো বয়স্ক শিক্ষক পেলে পায়ে ধরে ফেলবো। বলবো, স্যার আমায় ভর্তি করে দিন। ওখানের একজনই তখন তোমার ফুফুর কথা বলেন। আমি হন্য হয়ে ছুটে গেলাম। শরীফা ম্যামকে আমি কিছু বলতে পারলাম না, কাঁদতে কাঁদতে তাঁর পায়ের ধারে বসে পড়লাম।টাকাপয়সার কষ্ট অলি বুঝলে, বড় কষ্ট!
অলিন্দ্রীয়া ঠোঁট কামড়ে কান্না আকালো।
—মা তখন আমায় ভর্তি করালেন। থাকার জন্য কলাবাগানের বাসায় একটা রুম দিলেন। খাবার, টাকাপয়সা দিলেন। তাঁর টাকায় আমি আমার জীবনে প্রথম এক গ্লাস দুধ একসাথে নিশ্চিন্ত মনে খেয়েছি। টিউশনি করতে দিলেন না। সব খরচ চালিয়ে নিলেন।
জুয়েল যেন লজ্জায় মিশে যাচ্ছিলো। অলিন্দ্রীয়া সান্তনার সুরে বললো,
—আপনি চুপ করুন তো। আমি কিন্তু সত্যিই অপরাধী…
—জব হওয়ার পর, মাকে পাবার পর, আমি আমার লিমিট ভুলে গিয়েছিলাম অলি। আমি সহজেই ভুলে গেলাম, যে রাস্তার মানুষ এত সহজে সব পাবে কেন?

অলিন্দ্রীয়া এরপর আর কিছু বলেনি। সারা সন্ধ্যা অন্যরকম স্যাডনেস তাকে ঘিরে ধরেছিলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here