অলিন্দ্রীয়া,পর্ব_৭_৮_ও_৯
তৃধা আনিকা
পর্ব_৭
ফুফু এলেন ঠিক পাঁচদিন পর। তাঁর কড়া নির্দেশ, বিয়ে হতে হবে সহীহ শুদ্ধভাবে। মোহরানা ছেলে সাথে সাথেই দিয়ে দিবে। লিয়াপু বললেন, তিনি নিচে নামবেন না। উপরেই বসেই কবুল বলবেন।
লিয়াপু’র যার সাথে বিয়ে হচ্ছে তিনি সোফায় বসে আছেন। ছোটচাচার সাথে ভয়ে ভয়ে গল্প করছেন।তিনি ধবধবে সাদা ফুলহাতা শার্ট পরে এসেছেন। শার্ট এতই ধবধবে যে, মনে হয় পাশ দিয়ে গেলেই ময়লা লেগে যাবে। সাথে গাঢ় মেরুন টাই আর কালো প্যান্ট পরে আছেন। তাঁর জুতোও চকচক করছে। একটু পরপর হাত দিয়ে চুলোগুলো পেছনের দিকে ব্রাশ করছেন। তাঁর গায়ের রং ফর্সা আর শ্যামলার মাঝামাঝি। মেয়েদের চোখ টানাটানা হয় বলে কথা আছে কিন্তু এই ছেলের চোখ বোধহয় পেন্সিলে আঁকা!
রূপায়ন আর অংকন তাঁর আশেপাশেই ঘুড়াঘুড়ি করছে। বাবা-দাদুই, কাজী আর হুজুরের সাথে ফিসফাস করছেন। মা এক গাদা রান্না করেছেন। মায়াবু সব কাজকর্ম ফেলে নতুন একটা শাড়ি পরে বসে বসে কাঁদছেন এবং বারবার বলছেন,
—আজকালকার মানুষ এত পাষান কেন আম্মা?আমরার কালে বিয়ার সময় বিয়া ঠিক হওনের পুনরো দিন আগের থাইকা আমরা কানতাম। অহন কেউ কান্দে না গো, কেউ কান্দে না।
—আহ্ মায়ারুন বাদ দিবে? ড্রয়িংরুম থেকে সবাই শুনছে।
—-হুনলে হুনুক গো আম্মা.. আমি লিয়া আপার লাইগা কান্দুমই কান্দুম। ও আল্লাহ গো.. লিয়া আপার তুমি এইডা কি করলা গো.. জাদুর পাখি জামাইর দেশে কেমনে রইবো গো…
রেজিস্ট্রি পেপারে সই করার সময় লিয়া বরের নামটায় চোখ বুলালো,
নাম- জুয়েল আহমেদ।
জন্ম- ২১/০১/১৯৯১
সাধাসিধা নাম।
মানুষটাকে সে কি বলে ডাকবে? দেখতে কেমন? তাঁর কি ভালো লাগে? শীত না বৃষ্টি? তাঁর কি অলিন্দ্রীয়ার মতো কাউকে ভালো লেগেছিলো? অলিন্দ্রীয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আত্মহত্যা করতে যাবার মতো জঘন্য একটা অপরাধ করবার পরও যদি একটা বিয়ে করে বাড়ির সবার কাছে ক্ষমা পাওয়া যায়; মন্দ কি?
অলিন্দ্রীয়া সাইন করে দিলো।
ফুফু একলক্ষ টাকা দিলেন।
—টাকা দিয়ে আমি কি করবো?
—জলে ফেলে দিবি, যা খুশি করবি। তোর দেনমোহরের টাকা।
জুয়েলের এ বাড়িতে এসে মাথা কমপ্লিট আউলা হয়ে গেছে। বিয়ের আগে সে জেনেছিলো তাকে আধাপাগল কোনো ব্রিলিয়ান্ট মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। মেয়েটার মেন্টালিটি স্টেবল করতেই এই বিয়ে।কিন্তু এসে মনে হচ্ছে, সবাই-ই পাগল। ছোটচাচা বলে যার সাথে কথা হলো তিনি বললেন,
—বুঝলে জুয়েল, তোমার নাম ছোট করলে সুবিধা হচ্ছে না। জুল বা য়েল তো হচ্ছে না। ‘জুয়া’ করে দিই? তাছাড়া ‘জুয়া’ যেহেতু একটা ব্ল্যাক গেইম তাই তোমার নাম এটা হলে সবাই ভালোভাবে মনে রাখবে। হিন্দিতে কিন্তু উকুনকে ‘জুয়ে’ বলে, ইন্টারেস্টিং না?
জুয়েল কিছুই না বুঝে মাথা নাড়লো। এরপরে তিনি যতবারই কথা বললেন, জুয়েলকে ‘জুয়া’ বলে ডাকলেন।
আশেপাশে দুটো কিশোরটাইপ ছেলে বৃত্তাকার হয়ে এক ঘন্টা ধরেই ঘুরছে। ডাকলেই বলছে,
—আমরা মিষ্টিকুমড়ো পছন্দ করি না।
সে আর কথা বাড়ালো না। কাছের কোনো রুম থেকে অবিরাম এক মহিলার কান্নার আওয়াজ আসছে।কে এই মহিলা? তিনি এত কাঁদছেনই বা কেন? তাঁর কি কোনো আপনজন মারা গেছেন?
জুয়েলের শ্বশুর যিনি, তিনি এসে বলেছেন,
—আদা-চা খাবে? এতে গলা ভালো থাকে।
জুয়েলকে আদা-চা দেয়া হয়েছে।
শাশুড়ি বলে যেই মহিলার সাথে কথা হলো, তিনি এসে বললেন,
—তুমি কিন্তু এখন থেকে আমাদের বাড়ির মেম্বার।মাসে যতদিন দেশে থাকবে, আমাদের এখানে আসবে।
—আসলে আমার নতুন চাকরি তো! দুই বছর আমার ট্রেনিং টাইম, তাই ঘনঘন বাইরে যেতে হবে।তবে সুযোগ যখনি পাবো, আসবো।
তারপর মহিলা গলা নামিয়ে বললেন,
—এসব চাকরিতে নাকি ঘুষটুষ বেশি! তুমি খাও?
জুয়েল থতমত খেয়ে গেল।
—ইয়ে মানে আমি নতুন তো, ঠিক জানি না।
—ফ্যামিলি নিয়ে বিদেশে ঘুরার জন্য নাকি এরা অফিসারদের ফ্রি ভিসা করে দেয়?
—জি দেয়, তবে কাজের প্রগ্রেস দেখে।
—ইংল্যান্ডের কোনো ভিসার চান্স হলে বলবে, তোমার শ্বশুরকে নিয়ে ঘুড়ে আসবো। সংসারের চাপে কখনো কোথাও যেতে পারিনি বুঝলে।
জুয়েল দীর্ঘশ্বাস ফেললো। যাদের বাড়ির সুস্থ মানুষদের এই অবস্থা, আধা পাগল মেয়ের না জানি কি অবস্থা! গিয়ে দেখা যাবে, গায়ের কাপড় খুলে নাচানাচি।
জুয়েল আর ভাবলো না। ভয়ে ভয়ে ঢোঁক গিললো।
মনে মনে বললো, বিয়েটা করে সটকে পড়লেই হয়। এত কিছুর পরে সে এই বিয়ে করে শরীফা ম্যামের মতো একজনকে মা হিসেবে আজীবনের জন্য পাচ্ছে তা-ই বেশি। তাঁর একটা মাতৃপরিচয়ের দরকার ছিল। তা-তো হলো!
পর্ব_৮
ফর্মালিটিস শেষ হলো রাত সাড়ে আটটা নাগাদ।
জুয়েল একবার ফুফুকে মিনমিন করে বললো,
—চলে যাই ম্যাম! ১০ টার মধ্যে পৌঁছুতে হবে।অফিসের গাড়ির রেসট্রিকশান আছে।
—‘মা’বলে ডাকতে না বললাম? ইট’স এন অর্ডার, এন্ড ইট’স এ মাস্ট।
জুয়েল মাথা নিচু করে বললো,
—চলে যাই মা?
—তোমার অফিসের গাড়ি ছেড়ে দাও। আরো কিছুক্ষণ থেকে যাও। পরে আমার গাড়ি নিয়ে চলে যেও।
—আচ্ছা।
—লিয়ার সাথে কথা বলবে?
জুয়েল না সূচক মাথা নাড়লো।
—অন্তত হাই হ্যালো করে যাও। পরে দেখা যাবে রাস্তাঘাটে দেখা হচ্ছে, কেউ কাউকে চিনতে পারছো না। তোমার বউ, দেখা যাবে তুমিই বলছো আপু একটু সাইড প্লিজ! যাও, দেখা করে এসো।
জুয়েল চুপ করে থাকলো।
—উপরে গিয়ে ডানদিকের ঘর, ব্লু দরজা। দরজায় অলিন্দ্রীয়ার নাম আছে।
জুয়েল দাঁড়িয়ে রইলো।
—দাঁড়িয়ে আছো কেন? আমি নিয়ে যাবো? এটা এখন থেকে তোমার বাড়ি। তুমি এবাড়ির একজন অনারেবল মেম্বার ফ্রম টুডে।
—আমি যে যাবো ‘উনি’ জানে? মানে রুমে যাওয়া কি ঠিক হবে?
—উনি উনি করছো কাকে? তোমার বউ। ধর্মমতে বউ! জানার কি আছে? যাও…..
সিড়ি ভেঙ্গে উঠতে গিয়ে জুয়েল একবার ভাবলো ফিরে যাই। পাগল মেয়ে যদি মেরে টেরে দেয়।কামড়টামড় দেওয়ার অভ্যাস আছে কিনা কে জানে?জুয়েল দোআ ইউনূস পরে বুকে ফু দিলো।
ডানদিকের নীল দরজায়, হোয়াইট কালারে ইংরেজি গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,
“Olindriaa’s World”
নিচে বাংলায় লিখা,
“অলিন্দ্রীয়ার দুনিয়াদারি ”
জুয়েল ভ্রু কুঁচকালো।
World অর্থ দুনিয়াদারিও হয় নাকি?
জুয়েল দরজার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। নক করবে নাকি করবে না?
অলিন্দ্রীয়ার একটু শীত শীত করছে। এত গরমেও শীত কেন? জ্বর এসেছে নাকি? গলাও শুকিয়ে আসছে। বিছানায় কোনো কাঁথা নেই। মা’কে কি বলবে, একটা কাঁথা দিতে? গা গুলাচ্ছে, বোধহয় জ্বর এসেই গেছে। প্যারাসিটামল টাইপ কিছু আছে কিনা মায়ের ঘরে দেখে আসা যাক।
অলিন্দ্রীয়া দরজা খুলেই ভ্যাঁবাচেকা খেলো, একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত লোক দাঁড়িয়ে। প্রায় চাঁপা চিৎকার দিয়েই বললো,
—হু আর ইউ?
ছেলেটা কিছু বলবার আগেই সে আবার দরজা বন্ধ করে দিলো।
অলিন্দ্রীয়া নিজের দিকে তাকালো, সে একটা স্লিভলেস টপস এর সাথে স্কার্ট পরে আছে। গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নিলে কি হতো? ইশ! ছেলেটা কি ভাববে? বর না বরের দিকের লোক কে জানে! বর তো একা আসার কথা না। লোকটা কি আছে নাকি চলে গেছে?
আকস্মিক দরজা খোলা আর বন্ধের ঘটনায় জুয়েল হতচকিত। এটা কি তাঁর বউ নাকি? আহা গো, এতো বাচ্চাবয়সে মেয়েটা পাগল হয়ে গেল! মেয়েটা ভয় পেয়েছে মনে হচ্ছে। সবাই বোধহয় দরজা খুললেই বকে। বেচারীর যদি আরও মাথা খারাপ হয়ে যায়! জুয়েল দরজায় নক করলো এবার, ভেতর থেকে কোনো সাড়া নেই। কি বলে ডাকবে তাওতো বুঝতে পারছে না। তারপরও মিষ্টি করে ডাকলো,
—অলিন্দ্রীয়া ম্যাম! আপনি ভয় পাবেন না, কেউ আপনাকে কিছু করবে না। আপনি নির্ভয়ে দরজা খুলুন। কেউ কিছু বললে, আমি বকে দিবো!
অলিন্দ্রীয়া মনে মনে বললো, আমি ভয় পাবো কেন? লোকটা কি পাগল নাকি?
—অলিন্দ্রীয়া… দরজা খুলুন। ভয় নেই, আমি আছি তো।
অলিন্দ্রীয়া হাঁফ ছাড়লো, এই পাগলটাই তাঁর বর তাহলে। ক্রমাগত নক করে যাচ্ছে। কি মুশকিল!
অলিন্দ্রীয়া ভেতর থেকে বললো,
—দয়া করে আপনি আমার মাকে বলুন তো আমার রুমে একটা কাঁথা আর প্যারাসিটামল টাইপ কিছু দিতে। আমার জ্বর এসেছে।
ইশ্ কি মায়াবী গলা! এরকম কণ্ঠকে কি বলে, মধুরকণ্ঠী! মেয়েটা নিশ্চয় গান জানে!
জুয়েলের মন খারাপ হয়ে গেল। বেচারীর বিয়ের দিনেই শরীর খারাপ হতে হলো।
দরদী গলায় বললো,
—আর কিছু লাগবে, অলি?
—আপনি কি জুয়েল আহমেদ?
জুয়েল দরজার এপাশ থেকে জোরে জোরে মাথা নাড়লো। বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে অলিন্দ্রীয়া তা দেখলো না।
লোকটা নিশ্চুপ কেন? চলে গেছে নাকি?
—আপনি কি অলিন্দ্রীয়ার বর?
এবার জুয়েল মুখে বললো,
—জি।
অলিন্দ্রীয়ার হঠাৎ করে খুব কান্না পেয়ে গেল। এই মানুষটা তার জন্য কষ্ট পাবে!
—অলিন্দ্রীয়া আর কিছু লাগবে আপনার?
অলিন্দ্রীয়া কোনো জবাব দিলো না। তাঁর খুব মন খারাপ লাগছে, খুউউববব। সে আজ কারো সাথে কথা বলবে না।
জুয়েল তারপর আর কিছু বলেনি। ব্যস্ত ভঙ্গিতে নিচে এসে ফুফুকে বললো,
—মা, ও’র জ্বর এসেছে। ভীষণ জ্বর! কাঁথা দিয়ে আসতে বলছে। মা আমি কি ডাক্তারকে কল করবো। আমার এক বন্ধু আছে ঢাকা মেডিকেলে, জহির। ওকে ফোন দিই? এক্ষুণি চলে আসবে।
ফুফু ধমকের স্বরে বললেন,
—ও টা কে? এতক্ষণ তো উনি উনি করলে। আর এখন জ্বর এসে গেছে।
জুয়েল মাথা নিচু করে ফেললো। তারপর জুয়েলের মাথায় হাত রেখে বললেন,
—এত টেনশানের কি আছে? আমি দেখছি। তুমি খেতে বসো।
খেতে বসতে গিয়ে একবার মনে হলো, অলিন্দ্রীয়ার কথা জিজ্ঞেস করবে কিনা; পরক্ষণেই মনে হলো, না-থাক।
চলে যাবার আগে আগে আবার বললো,
—জ্বর কেমন মা? ১০১ক্রস করে গেলে কিন্তু সমস্যা! তিন-চারদিন ভোগাবে। ভাইরাল জ্বর নাকি?
হাই তুলতে তুলতে ফুফু বললেন,
—তুমি রাতে থেকে যাও, বসে বসে জ্বর মাপবে।
দাদুই বললেন,
—জ্বর তো মনে হয় তোমারও এসে গেছে। দেখি কপাল দেখি।
জুয়েল লজ্জা পেয়ে দ্রুত বেড়িয়ে এলো।
বাসায় এসে জুয়েলের মন খারাপ আরো বেড়ে গেল।
পর্ব_৯
অলিন্দ্রীয়ার রুমে ঢুকেই ফুফু বললেন,
—তোর সাথে গল্প করতে এলাম। তোর বাবা, মা সবাইর তো মাথা খারাপ! এদের সাথে গল্প করে আরাম নেই।
অলিন্দ্রীয়া শুয়েছিলো। পাশ ফিরে বললো,
—আমার ভালো লাগছে না ফুফু। কাল গল্প করো!প্লিজ যাও।
ফুফু অলিন্দ্রীয়ার বিছানায় পা তুলে বসলেন। না তাকিয়েই অলিন্দ্রীয়া বললো,
—পা নামিয়ে বসো ফুফু, তুমি সারাবাড়ির মেঝে খালিপায়ে হেঁটেছো।
ফুফু জোর করে অলিন্দ্রীয়ার হাতটা কোলে টেনে নিলেন। অলিন্দ্রীয়া পুরো মুখে কাঁথা টেনে দিলো। মনে মনে বললো, আমি তোমার উপর অনেক রাগ করেছি ফুফু। অনেক রাগ! আমি তোমাকে আর ভালোবাসবো না।
—-অলিন্দ্রীয়া তোকে একটা মজার গল্প শুনাই।বুঝলি, আমরা পাঁচ ভাইবোন তখন সবাই পড়ছি।সবগুলাই তো পিঠাপিঠি ছিলাম। টানাটানির সংসার। তোর দাদুই তখন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক।মা অশিক্ষিত মানুষ। আমাদের পড়াশোনায় তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। আর বাবা মাইনে পেয়েই সবটাকা আমাদের খাতা-কলম বই কিনে শেষ। সারা মাসের রেশনপাতির টাকা নেই। প্রতিদিন মায়ের হাজারটা অভিযোগ, তুমি স্বামী নামের কলঙ্ক! তোমায় আমি কখনোই ক্ষমা করবো না। হেন তেন.. মা খুব কষ্ট করে সংসার টানতেন। জীবনে একটা ভালো শাড়ি পরতে পান নি, ভালো খেতে পাননি। ভালো কি বলছি, মাঝে মাঝে তো পেট পুড়ে খেতেই পেতেন না। কিন্তু বাবা লা-পরোয়া। শুধু আমাদের পড়াশোনা নিয়েই ভাবতেন। মা বলতেন, একটু তো সংসারটা দেখবে।আমি বড় ক্লান্ত যে! তারপর আমরা একজন একজন করে তিন বোনের বিয়ে হলো। বাবা বিয়ের পরও আমাদের পড়াশোনার টাকা পাঠাতেন।
ফুফু চোখ মুছলেন।
—আমরা তিন বোনকে এম এ পাশ করালেন, তোর বাবা ডাক্তারি পাশ করলো, তোর ছোট কাকুও ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করলো। যে বাবা প্রাইমারী স্কুলের টিচার ছিলেন, আজ তাঁর দুই মেয়ে পাবলিক ইউনিভার্সিটির টিচার। একমেয়ে পুলিশের এ এস পি, এক ছেলে ডাক্তার, এক ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। মাকে ন্যাশনালি রত্নগর্ভা এনাউন্স করা হলো।
অলিন্দ্রীয়া চোখ বড় বড় করে বললো,
—তোমরা ব্রিলিয়ান্ট ছিলে তাই।
—মা, যখন রত্নগর্ভার সনদটা নিতে স্টেজে যান।তিনি অঝোরে কাঁদছিলেন। সামনে বসে আমরা পাঁচ ভাই-বোন খুশিতে কাঁদছি। বাবা কোনোমতে তাকে ধরে নিয়ে যান। পুরস্কারটা নেয়ার পর, মা’কে কিছু বলতে বলা হয়। মা অসহায় মুখ করে বললেন,
“এ পুরষ্কার তো আমার না, আমি এটা নিবো না। তারপর বাবার হাতে ক্রেস্ট দিয়ে বললেন, ‘এটা তো উনার পুরষ্কার, উনার পরিশ্রম আর সততার পুরষ্কার।’ বাবা মাকে ধরে স্টেজেই কেঁদে ফেললেন।
অলিন্দ্রীয়া ফুফুকে জড়িয়ে ধরলো।
—জীবন কত বিচিত্র দেখেছিস লিয়া! যে মা আমার বাবাকে সারাজীবন দুষেছেন, সে মা’ই বাবাকে সবথেকে বেশি সম্মানিত করেছেন।
অলিন্দ্রীয়া ফিসফিস করে বললো,
—তুমি আজ আমার সাথে শোও তো। আমরা সারারাত গল্প করবো ফুফু।
—আমার খুব ভয় করছিলো লিয়া। তোর জীবনটা না তোর ছোটচাচার মত হয়ে যায়! বিলুটা তো এরকমভাবেই ছ্যাঁকা খেয়ে বিয়ে করলো না।
—ছোটচাচাকে কিন্তু অত অপমান করে রিজেক্ট করেনি ফুফু। চাচার প্রেমিকা কিন্তু কিছুদিন তাকে ভালোবেসে এরপর চুপচাপ ছেড়ে গিয়েছিলো। আমার খুব কষ্ট ফুফু।
ফুফু একটা ভিজিটিং কার্ড অলিন্দ্রীয়ার হাতে দিলেন।
—জুয়েল ছেলেটা ভীষণ ভালো রে লিয়া, ভীষণ ভালো। সলিড গোল্ড! এখানে তাঁর ফোন নাম্বার আছে, মাঝে মাঝে কথা বলিস!
—তুমি জানো ফুফু নাহিদকে লাইব্রেরীতে পড়তে দেখে, তাঁর খোঁজ নিয়ে আমার মনে হয়েছিলো সে হীরের টুকরো ছেলে, পরে দেখা গেলো নর্দমার কীট!
ফুফু মলিন হেসে বললেন,
—ব্যাপারটা তর্কের নয় লিয়া, ব্যাপারটা অনুভূতির, উপলব্ধির। আমি খুব কাছ থেকে কঠিন জীবনটা দেখেছি। যদি আমার এই সিদ্ধান্ত ভুল হয়, আল্লাহ যেন আমায় কখনো ক্ষমা না করেন।
লিয়া একটু সরে বসলো।
ফুফু হেসে বললেন,
—তোর খুব বুদ্ধিরে লিয়া।
—কিভাবে বুঝলে?
—এই যে ছেলে দেখতে চাইলি না। তুই তো এয়ারলাইন্স অফিসার পদের চাকরির কিছু মেন্ডেটরি রিকোয়ারমেন্টস জানিস। ছেলের প্রোফাইল তুই বুঝে নিয়েছিলি তাই-না?
—তুমি যে কি বলো না ফুফু?
—ঘুমো তুই এখন, যাই আমি। তুই তো ভোরে উঠতে পারিস না। আমি চলে যাবো আর্লি মর্নিং। দেখা হবে না, বাই। একটু কাছে আয় তো, আদর করে দিই।কতদিন তোকে আদর করা হয় না!
অলিন্দ্রীয়া ফুফুর কোলে মাথা রাখলো।
—খবরদার ফুফু, চুমু খাবে না। থুথু লাগে।
ফুফু মুখ বেঁকিয়ে বললেন,
—জুয়েল তোর জ্বর শুনে তো মরেই যাচ্ছিলো। কি আহলাদ!
অলিন্দ্রীয়া তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,
—মনে হয় একটু স্ক্রু ঢিলা।
ফুফু হেসে ফেললেন।
ফুফু চলে যাবার পর অলিন্দ্রীয়া জুয়েলের ফোন নাম্বারটায় চোখ বুলালো। মানুষটা কি সব জানে? সব জেনেও এমন একটা বিয়ে করলো? এত কেন তাঁর মনের জোর? কিসের এত দায় তাঁর?
অনেকক্ষণ শুয়ে থেকেও জুয়েলের ঘুম আসছে না।এসে থেকেই ছটফট করছে। ঠান্ডা পানি দিয়ে একটা শাওয়ার নিলে কেমন হয়? এত অস্থির লাগছে কেন? মেয়েটাকে তো সে ঠিকঠাক দেখেওনি, এত কেন বুক ধুকপুক করছে? একটা ফোন করে দেখবে? জ্বর কি কমেছে মেয়েটার?
ফোনটা হাতে নিয়ে নাম্বারটা ডায়াল করতে নিয়েও কেটে দিলো।
অলিন্দ্রীয়া ফোন নাম্বারটা কন্ট্যাক্টসে সেইভ করে নিলো। বেচারা যদি কখনো ফোন করে, চেনা যাবে।কল দিয়ে কি একবার শিওর হবে? কল দিতে গিয়েও কেটে দিলো। ভিজিটিং কার্ডের নাম্বার ভুল হবে কেন?
পৃথিবীর কোথাও কি কেউ জেনেছিলো, দুটো মানুষ, সেই রাতে একইসাথে ফোন হাতে নিয়েও সংকোচের কারণে কেউ কাউকে ফোন করেনি! পৃথিবী আসলেই বড় বিচিত্র!
(চলবে)