অল্প থেকে গল্প?,পর্ব:২৪
অরিত্রিকা আহানা
ভার্সিটির কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে শুদ্ধ গাড়ি পার্ক করে। রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকলো ওরা।ছবিকে কে জিজ্ঞেস করে খাবারের অর্ডার দিয়ে দিলো শুদ্ধ।বোঝাই যাচ্ছিলো তার ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে।
পাঁচমিনিটের ভেতর খাবার চলে এসেছে।সেট মেন্যু;ফ্রাইড রাইস,চিকেন কারী,কাবাব,ভেজিটেবল আর সফট ড্রিংকস।
খাওয়ার সময় ছবি আড়চোখে একটুপরপর শুদ্ধকে দেখছে। শুদ্ধর চোখ পড়তেই বলল,
—কি হলো ছবি খাচ্ছো না কেন? খাবার ভালো লাগছে না?
—কই না খাচ্ছি তো।
—তাড়াতাড়ি শেষ করো,তোমাকে নিয়ে একজায়গায় যাবো।
—কোথায়?
—খাওয়া শেষ করে বলি?
ছবি মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।
খেতে খেতে ছবিকে বাসার কথা বলল শুদ্ধ।বাসায় আনোয়ারা বেগম নেই।শুদ্ধর এক চাচার বাসায় গেছেন উনার অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে।উপল গতকাল অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে।ফিরতে ফিরতে আজকে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।বাসায় মেহমান এসেছে।নিহাল ভাই আর উনার স্ত্রী এসেছেন জারাকে ডাক্তার দেখাতে।সপ্তাহখানেক হয়েছে এসেছে।জারার শ্বাসকষ্ট।শুদ্ধ পরিচিত এক ডাক্তারকে দেখাতেই উনাদের ঢাকায় আসা।ডাক্তার দেখানো হলেই চলে যাবেন।জারার স্কুলের এডমিশন আছে।আরো টুকটাক ককথাবার্তা হলো দুজনের।
খাওয়া শেষে বিল পে করে ছবিকে নিয়ে বেরোলো শুদ্ধ।গাড়িতে উঠে ছবি বললো,
—কোথায় যাচ্ছি আমরা?
—বাসায়!
—আপনি যে বললেন আমাকে নিয়ে কোথায় যাবেন?
—হুম।নাহিদের বিয়ে।তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে।ওদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা।আমরা কালকে সকালে রওনা দেবো।আজকে যাবো ভেবেছিলাম।কিন্তু টায়ার্ড লাগছে প্রচন্ড!
নাহিদদের বাড়িতে যেতে হবে শুনে ছবির অস্বস্তি হচ্ছে।সরাসরি না হোক, নাহিদ যে ছবিকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলো সে কথা তো ছবির অজানা নয়!
ওকে অন্যমনস্ক দেখে শুদ্ধ বললো,
—অকওয়ার্ড ফিল করার কিছু নেই ছবি, তুমি আমার স্ত্রী হিসেবে সেখানে যাচ্ছো,সো বি ইজি!
—কালকে কখন যাচ্ছি আমরা?
—ভোর বেলায়।
বাসায় পৌঁছে ছবি নিহাল আর তার স্ত্রীর সাথে দেখা করলো।কুশল বিনিময় করে ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হতে।অনু এসে তাড়া দিয়ে বের করলো।গোছগাছের ব্যাপার আছে।তাই আগে থেকেই সব রেডি করে রাখতে বলল।বিয়েতে কি পরবে সেটাও ঠিক করতে হবে।শাড়ি পরার পরামর্শ দিলো।ছবি দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকলেই শেষমেশ শাড়ি পরারই সিদ্ধান্ত নিলো।
পরেরদিন সকালে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলো ছবি। শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আলমারি থেকে শাড়ি বের করে নিলো।রূপালী রংয়ের হাইনেকের ফুলহাতা ব্লাউজের সাথে মিষ্টি কালারের বেনারসি কাতান শাড়ি।
শাড়িটা পরে বেরোতেই অনুর হাসি শুরু হলো।হাসতে হাসতে বলল,
—তুই তো কুচি উলটো দিকে দিয়েছিস!
ছবি বুঝতে পারলো না,কুচির আবার উল্টো-সিধা দিক থাকে নাকি?
—আয় আমি পরিয়ে দেই।
অনু শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছিলো ছবিকে।শাড়ির আঁচল বুকের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে দিয়ে কুচি দিচ্ছিলো,এমন সময় শুদ্ধ এসে ভেতরে ঢুকলো।জারা তার চশমা নিয়ে দুষ্টুমি করছিলো সেটা খুঁজতেই ঘরে ঢুকেছিলো সে।
—ভাবী আমার চশ…
বাকি কথাটা শেষ করতে পারে নি সে।ছবিকে এই অবস্থায় দেখে দ্রুত বেরিয়ে গেলো।ছবি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো।অনু মুখটিপে হাসছে।একটু পর জারা এসে বললো,
—চাচ্চুর চশমা দিতে বলেছে।
অনু হেসে কুটিকুটি হয়ে বলল,
—তোর চাচ্চুকে গিয়ে বল নিজে এসে নিয়ে যেতে।
—আহ!আপু কি শুরু করলে তুমি?
জারা একদৌড়ে বেরিয়ে যেতে নিলে ছবি আটকে দিলো।শুদ্ধর চশমাটা ওর হাতে পাঠিয়ে দিলো।
শাড়ি পরানো শেষে অনু সুন্দর করে ছবিকে সাজিয়ে দিলো।সাজগোজ শেষে ড্রয়িংরুমে এসে দেখলো শুদ্ধ সোফায় বসে কথা বলছে।তার কোলে বসে জারা গেমস খেলছে।অনু এগিয়ে গিয়ে বলল,
—ছবি রেডি শুদ্ধ!
শুদ্ধ ফোনে কথা বলা অবস্থায়ই ওর দিকে তাকালো।অনুর পাশে ছবি দাঁড়িয়ে আছে।শুদ্ধফোন কেটে হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালো।বলল,
—রেডি? আর কিছু বাকি নেই তো?
অনু বলল,
—একবারে রেডি।আর কিছু বাকি নেই! কেমন লাগছে ওকে?
শুদ্ধ ছবির দিকে তাকালো। পকেট থেকে রুমাল বের করে ছবির কপালের ঘাম মুছে দিলো।ঠোঁটের কোনে
মিষ্টি হাসি ফুটে উঠেছে তার।ওর সেই হাসিতে, একঝলক চাহনিতে যেই পবিত্র মুগ্ধতা ছিলো তার কাছে পৃথিবীর অন্য যে কোন নেশাতুর দৃষ্টি হার মানায়!একমুহূর্তেই বসন্তের মাধুরী মেশানো শিরশির বাতাস এসে ছুয়ে দিলো ছবির সমস্ত শরীর।শরীরের প্রতিটি রক্তকনা অনুভব করলো সে পবিত্রতা।শুদ্ধ পকেটে রুমাল ঢুকিয়ে নিয়ে বলল,
—এসো!
তারপর অনুকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
—আসছি ভাবি!
অনু হাসিমুখে বলল,
—এসো।
জারা এখনো গেমস খেলায় ব্যস্ত।খুব মনোযোগ দিয়ে খেলছে সে।শুদ্ধ একটু ঝুঁকে জারার গালে একটা চুমু খেয়ে বলল,
—আসি মামুনি।
প্রতিউত্তরে জারা তার নরম তুলতুলে বাচ্চা বাচ্চা হাতদুখানা দিয়ে শুদ্ধর গলা আঁকড়ে ধরলো।শুদ্ধ আকেরটু ঝুঁকে ওর হাতের ওপর হাত রেখে বলল,
—আসার সময় তোমার জন্য কি আনবো?
জারা ওর গালে চুমু খেয়ে কানে কানে কি বললো শোনা গেলো না।শুদ্ধ হেসে উঠে বলল,
—আচ্ছা ঠিক আছে।
সকাল সাড়ে এগারোটায় ওরা নাহিদদের বাড়িতে পৌঁছালো।নাহিদদের বিল্ডিং এর সামনের উঠোনে প্যান্ডেল করা হয়েছে।প্যান্ডেলর সামনেই নাহিদ,মৌনতা,সালমান,মেহেদীর সাথে দেখা হয়ে গেলো।নাহিদের দাদুর ইচ্ছেতেই বিয়ের অনুষ্ঠান গ্রামের বাড়িতে করা হচ্ছে।সেজন্যই সকলের গ্রামে আসা।
গ্রামের বাড়িতে বিয়ে মানে বিরাট হৈচৈ ব্যাপার। সবকিছু আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধবদেরই করতে হয়!ক্যাটারিং এর লোকজন থাকলেও খাওয়ার অনুষ্ঠানে আত্মীয়স্বজন সবাই সামিল হয়।তাই নাহিদ,মেহেদী সালমান সবাই হাতে হাতে কাজে লেগে পড়েছে।
ছবিকে মৌনতার সাথে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে শুদ্ধও ব্যস্ত হয়ে পড়লো।যাওয়ার সময় মৌনতার ঝুঁটি ধরে টেনে দিলো।মৌনতা রাগী গলায় বললো,
—তোর বউ কিন্তু আমার হেফাযতে!মনে রাখিস!
শুদ্ধ ছবির দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেলো।
মুক্তা ছবিকে দেখে প্রায় চিৎকার দিয়ে বলল,
—ছবি! তোমাকে তো দারূন লাগছে!একেবারে পুতুলগিন্নি!
ছবি মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
—আপনাকেও খুব সুন্দর লাগছে,মুনা আপুকেও।
মৌনতা ভ্রু নাচিয়ে বলল,
—আমাদের কথা বাদ!শাড়িতে তোমাকে দারূণ মানিয়েছে।এইজন্যই তো বলি শুদ্ধ আমাকে পাত্তা দেয় না কেন?
ওছবির চিবুক তুলে ধরে মিষ্টি হেসে বলল,
—এমন টুকটুকে বউ থাকলে কি আর অন্য দিকে মন যায়? এই ছবি শুদ্ধ তোমাকে রোজ কয়বার চুমু খায়, বলোনা?
মুক্তা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
—কী অসভ্যরে তুই মুনা?ও বুঝি এখন তোকে বলবে যে ওর বর ওকে কয়টা চুমু খায়?
—বললে কি হয়?
মেহেদী এদিক দিয়েই যাচ্ছিলো,মৌনতার কথা শুনে ওকে ধমকে উঠে বলল,
—কি সব উল্টোপাল্টা কথা বলছিস তুই?বেচারি তো লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।
—তুই তোর কাজে যা।
—শুদ্ধ শুনলে তোর খবর আছে।ও কাছে নেই বলে তুই তার বউকে এভাবে জ্বালাবি? আমি গিয়ে এক্ষুনি বলছি!
মুক্তা হাসতে হাসতে বলল,
—যতই হোক ক্রাশ এর বউ তো,তাই জ্বলছে!
মৌনতা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
—বলো না ছবি শুদ্ধ তোমাকে রোজ কয়টা চুমু খায়?
ছবি লজ্জায় কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে ওদের কথা শুনে।ভাগ্যিস শুদ্ধ সামনে নেই।থাকলে যে কি হতো? ছবি তো লজ্জায় মরেই যেতো!
মুক্তা ছবির অবস্থা দেখে হেসে উঠে বলল,
—ছাড় মুনা।বেচারি কে আর লজ্জা দিস না।দেখছিস তো চোখমুখ লাল হয়ে গেছে।
মৌনতা ছবির দিকে ফিরে বলল,
—তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো ছবি?
ছবি জবাব দিতে পারলো না।মুক্তা বলল,
—আবার জিজ্ঞেস করছে,সবাই কি তোর মতো?
—আমার তো বিয়েই হয় নি,চুমু খাবো কি করে?
—সালমান ভাইয়ের মাথাটা তো খাচ্ছিস?
—ওর নাম আমার সামনে মুখে নিবি না।ওর সাথে আমার ব্রেকাপ হয়ে গেছে!
—কতক্ষনের জন্য?
—এইবারই শেষ!আর প্যাচ আপ করছি না।
মৌনতা মুখ ঝামটা মেরে বেরিয়ে গেলো।ছবি অবাক হয়ে মুক্তাকে জিজ্ঞেস করলো,
—কি হয়েছে আপুর?
মুক্তা হেসে উঠে ওকে পুরো কাহিনী খুলে বলল।
নাহিদদের বাড়িতে আসার সময় সালমানের সাথে মৌনতার ঝগড়া হয়েছে।বিয়ে উপলক্ষে মৌনতা খুব ফুর্তি নিয়ে হালকা গোলাপি রংয়ের শাড়ি পরে সুন্দর করে সেজেছে।তার সাথে ম্যাচ করে সালমানের জন্যেও গোলাপি রংয়ের একটা পাঞ্জাবী বানিয়েছিলো।সালমানকে সেটা দিতেই চোখমুখ উল্টে বলল,
—এটা কি মুনা?
—কি আবার? পাঞ্জাবি!
—আমার জন্য?
—তো কি আমার জন্য?
সালমান উল্টেপাল্টে দেখে আবারও গোলগোল চোখে তাকালো মৌনতার দিকে।সন্দিগ্ধ কন্ঠে বলল,
—আর ইউ সিউর?
—ড্যাম সিউর!
—কিন্তু এই কালারের পাঞ্জাবী আমি পরবো না।এটা তো মেয়েদের কালার!
—কে বলেছে তোমাকে?
—কেউ বলা লাগে না।এগুলো ট্রেন্ড!
—আমি এতকিছু জানি না,তুমি পাঞ্জাবিটা পরবে।
—বোঝার চেষ্টা করো মুনা,আমার কলিগরা আছে।তারা দেখলে কি ভাববে?
—তোমার কলিগরা এখানে এলো কোথা থেকে?
—এখানে নয়।তবে তুমি যখন একগাদা ছবি আপলোড দিয়ে আমাকে ট্যাগ দিবে তখন তো ওরা দেখবে।আমার একটা ইমেজ আছে।
—আশ্চর্য আমার থেকে তোমার কলিগরা তোমার কাছে বড় হয়ে গেলো?
—তুমি আমার কথা বুঝতে পারো নি মুনা,আমি বলতে চাইছি..
ব্যস!আর কোন কথা শুনে নি মৌনতা।সালমানের কাছে থেকে পাঞ্জাবিটা ছিনিয়ে নিয়ে গটগট করে চলে এলো।
তারপর থেকেই দুজনের কথা বন্ধ।সালমান অবশ্য দুএকবার উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেছিলো।মৌনতার কাছে পাত্তা না পেয়ে প্যান্ডেলের দিকে চলে গেছে।তবে মৌনতার রাগ কতক্ষন টেকে সেটাই দেখার বিষয়!এক ঘুম দিয়ে উঠলেই সব ভুলে যায়।তবুও বেচারা সালমান অস্থির হয়ে যায়।আসলে মৌনতা ছোটছোট বাচ্চামি গুলো ওকে ভীষণভাবে টানে।ভীষণ ভালোবাসে মৌনতাকে সে।
মুক্তার মুখের পুরোটা শুনে ছবি খিলখিল করে হাসছে।ওদের কথা শেষ না হতেই সালমান এসে ভেতরে ঢুকলো।গায়ে গোলাপি পাঞ্জাবি।পাঞ্জাবিটা দলামোচড়া করে গাড়িতে রেখে ছিলো মৌনতা।ওকে ম্যানেজ করার জন্য সেই দলামোচড়া পাঞ্জাবিটাই পরে এসেছে সালমান।হাতে কচি ডাব।মুক্তাকে দেখে কাচুমাচু চেহারা নিয়ে বলল,
—মুনা কোথায় মুক্তা?
—বাইরে গেছে।
—কই বাইরে তো দেখলাম না।আমি তো বাইরে থেকেই এলাম। ওর জন্য অনেক কষ্টে ডাব জোগাড় করেছি।নাহিদদের কাছের কচি ডাব!
—ডাব কি আপনি পেড়েছেন ভাইয়া?
সালমান কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিলো মৌনতা এসে ভেতরে ঢুকলো।সালমানকে দেখে উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে বেরিয়ে গেলো।সালমান ডাব হাতে নিয়েই ওর পেছন পেছন ছুটলো।
ছবি আর মুক্তা একসঙ্গে হেসে দিলো ওদের কান্ডে।
.
.
চলবে