অল্প থেকে গল্প?
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব:১৮
সারা বিকেল ছবি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটয়েছে।শুদ্ধ তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো।
রাতের বেলা ডিনার শেষে শুদ্ধ ল্যাপটপে মুভি দেখছিলো।রিটার্ন অফ দ্যা কিং!অস্কার প্রাপ্ত মুভি!যদিও এর আগেও মুভিটা দেখেছে সে তবুও খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে।ছবি এসে বললো,
—চলুন না বারান্দায় বসি?
শুদ্ধ ল্যাপটপ থেকে চোখ সরালো,মিষ্টি হেসে বলল,
—মুড ভালো মনে হচ্ছে?
ছবি হাসলো।শুদ্ধ বলল,
—তুমি কফি নিয়ে এসো।আমি আসছি।
দুজনে বারান্দায় গিয়ে বসলো।দুজনের হাতেই কফি।রুমে আলো নেই।ড্রয়িংরুমের বাতিটা জালানো। তার ছাঁটই এখান পর্যন্ত এসে বারান্দাটাকে হালকা আলোকিত করেছে।শুদ্ধ মোড়ার ওপর বসে আছে।ছবি তার থেকে কিছুটা দূরে মেঝেতেই বসে গেছে।
শুদ্ধ কফিতে এক চুমুক দিয়ে কিছুক্ষণ কফির স্বাদ নিলো।ছবি ওর এভাবে কফির স্বাদ নেওয়া দেখে নিজের মগে একটা চুমুক বসালো।শুদ্ধর মত চোখ বন্ধ করে সেও কফির স্বাদ দিলো।শুদ্ধর চোখ চোখ পড়তেই ছবি লজ্জায় হেসে ফেললো। বললো,
—কফি কেমন হয়েছে?
—প্রতিদিন যেমন হয়।তবে আজকে মনে হয় তুমি চিনি দিয়েছো।
—হ্যাঁ একটু।এত তিতা কফি আপনি খান কি করে?
শুদ্ধ হাসলো।
—তিতা লাগে না?
—অভ্যেস হয়ে গেছে।
—আপনি দিনে কয় মগ কফি খান?
—হিসেব নেই।নরমালি তিন চার মগ খাওয়া হয়।আর বেশি স্ট্রেস পড়লে সেদিন একটু বেশিই হয়।ধরো ছয়সাত মগ!
—চা পছন্দ করেন না?
—নো আই এম কমপ্লিটলি আ কফি ম্যান।কফি ছাড়া আমার চলে না।নেশার মত হয়ে গেছে।
—এত মগ কফি খেয়ে যে কি করে আপনার রাতে ঘুম হয় আল্লাহই জানেন।
শুদ্ধ একটু হেসে বললো,
—সারাদিন আমার মত রোগীদের নিয়ে ছোটাছুটি করো তারপর বুঝবে।
এরপর অনেক্ষন দুজনে চুপচাপ বসে রইলো। রাতে সৌন্দর্য টাকে উপভোগ করতে চাইছে দুজনেই।আবছা আলোতে বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখা শহরটাকে একেবারে অন্যরকম লাগছে। হুলুদ শাড়িতে নিজেকে ঢেকে নিদ্রার আয়োজন করছে।ছবি একদৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে রইলো।সোডিয়াম বাতির হলুদ আলোয় রাতের নিশ্চুপ পরিবেশ দেখার আলাদা একটা মুগ্ধতা আছে।উদাসীন ভাবে সেটা উপভোগ করছে সে।
শুদ্ধর কফি শেষ।হঠাৎ ও মগ সহ ছবির হাতটা টেনে এনে সেখান থেকে একটা চুমুক দিলো।তারপর আগেই মতই চোখ বন্ধ করে কফির স্বাদ নিলো।ছবি লজ্জায় অস্বস্তিতে নুইয়ে পড়লেও ব্যাপারটা উপভোগ করছে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষন শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে রইলো।শুদ্ধ একেবারেই শুদ্ধ!ওর মধ্যে অশুদ্ধতার কোন জিনিস নেই।একেবারে পবিত্র!ওর সব কিছুই ছবির মন ছুঁয়ে যায়।শুদ্ধ ওকে এভাবে তাকাতে দেখে ওর সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
—কোথায় হারিয়ে গেলে?
—শুনছি আপনি বলুন।
—কি বলবো?
—আপনি কিছু একটা বলছিলেন না?
—আমি তো কিছুই বলছিলাম না।
ছবি হাতের মগটা দেখিয়ে বললো,
— খালি হয়ে গেছে।বানিয়ে নিয়ে আসবো?
—না।তুমি বসো।
—ঘুমাবেন না?
—কেন ঘুম আসছে তোমার?
—একটু একটু।
—তাহলে তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো।
ছবি উঠে যেতে নিলে শুদ্ধ হঠাৎ ওর ডান হাতটা চেপে ধরে বললো,
—আরেকটু পরে গেলে হয় না?
ছবি শুদ্ধর ধরে রাখা হাতটার দিকে তাকিয়ে আবার বসে পড়লো।দুজনে নানা রকম গল্প জুড়ে দিলো,ব ছবিই বলছে,শুদ্ধ চুপচাপ শুনছে।মাঝে মাঝে হাসছে,বেশিরভাগই ছবি স্কুল লাইফের কথা। ছবি হঠাৎ ইতস্তত করে বললো,
—একটা প্রশ্ন করি?
—কি প্রশ্ন?
—রাগ করবেন না তো?
—রাগ করার মত কোন কথা হলে বলার দরকার নেই।আমি এইমুহূর্তে তোমার ওপর রাগ করতে চাচ্ছি না।
—সুমনা আপুর সাথে বিয়েটা ভেঙ্গে দিলেন কেন?
—জানাটা কি খুব বেশি দরকার?
—হুম।
—জেনে কি করবে?
—ভাতের সাথে মাখিয়ে খাবো।
—খুব টেস্টি হবে বলে মনে হয়?
—থাক লাগবে না বলা।
শুদ্ধ চুপ করে রইলো।ছবি মন খারাপ করে উঠে দাঁড়ালো। বলল,
—আমি ঘুমাবো।
—ঠিক আছে ঘুমাবে।কিন্তু তুমি যেটা জানতে চেয়েছো সেটা জেনে যাও।
ছবি অবাক হয়ে শুদ্ধর দিকে তাকালো।তারপর অভিমান নিয়ে বললো,
—লাগবে না।
—লাগবে না?
—না।
শুদ্ধ ওকে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে দিলো।নরম গলায় বললো,
—রাগ করছো কেন?
ছবি মুখ কালো করে বলল,
—রাগ করলাম কোথায়?আপনি বলতে চান নি, আমি জোর করি নি এখানে রাগের কি হলো?
—হলো।আমি বলবো বলার পরেও তুমি উঠে চলে যাচ্ছো এটাকে রাগ বলে না?
ছবি চুপ করে আছে।
—সুমনার সাথে তোমার কখনো কথা হয়েছিলো?
—হ্যাঁ।এংগেইজম্যান্ট এর আগে একবার দেখা হয়েছিলো।
—কবে?
—উনি বাসায় এসেছিলেন।আপনি তখন ছিলেন না।
—কি বলেছে?
—তেমন কিছুই না।আমার সাথে তেমন কথা হয় নি।তবে আপু আর আন্টির সাথে বেশ জমিয়ে ফেলেছিলো।
—তোমার সাথে পারে নি কেন?
—আমি তো এমনিতেই তেমন একটা কথা বলি না।
—নাটক কিন্তু প্রচুর প্রচুর করতে পারো!
—আমি নাটক করি?
—করতো।একটু আগেও তো করলে?
—সেটা তো রেগে গিয়েছিলাম।
—তুমি মোটেও রেগে ছিলে না ছবি।তুমি মনে মনে খুশি হয়েছিলে আমি তোমাকে ঘটনাটা বলবো বলে।কিন্তু ভাবটা এমন ধরলে যেন শুনতে তোমার কোন আগ্রহই নেই।
ধরা খেয়ে ছবি চেহারা,মুখ,কান,নাক সব লাল হয়ে গেছে।সে কেন এত বাজে অভিনেত্রী?একটা কাজও তার দ্বারা ঠিক মত হয় না।আর শুদ্ধ? লজ্জা দিতে তো ওস্তাদ উনি!মান সম্মান আর কিছু রইলো না।ছবি কথা ঘোরানোর জন্য তড়িঘড়ি করে বললো,
–আপনি সারারাত এখানে বসে যা ইচ্ছা করুন।আমার ঘুম পাচ্ছে আমি…
শুদ্ধ ওকে শেষ করতে না দিয়ে বললো,
–এই যে আবার শুরু করলে!
ছবি মুখ বন্ধ করে বসে পড়লো।ও আর কোন কথাই বলবে না।
শুদ্ধ মিটমিট হাসছে।ছবির রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে।মুখের ওপর কেউ কাউকে এমন ভাবে বলতে পারে সেটা ওর জানা ছিলো না।কি সুন্দর ওর বলে দিলো ও নাকি সুমনার ঘটনা শুনতে পারবে বলে খুশি হয়েছে।হলে হয়েছে!তাই বলে সেটা মুখের ওপর বলে দিতে হবে নাকি।বারান্দায় গ্রিল ধরে মুখভার করে বাইরের দিকে তাকালো সে।
শুদ্ধ উঠে ওর পেছনে এসে দাড়িয়েছে।ছবি হাতের খানিকটা ওপরে নিজের দুহাত রাখলো।ছবির বুক ধড়ফড় করছে,পা দুটো কাঁপছে,পেছনে ঘুরতে পারছে না সে ঘুরলেই শুদ্ধর বুকের সাথে বাড়ি খাবে।শুদ্ধ কাছে আসার উত্তেজনার সাথে যুক্ত হয়েছে ধরা খাওয়ার আতঙ্ক!
দুপুরে শাড়ি পরে সে শুদ্ধর পারফিউম গায়ে মেখেছিলো।জেন্টস পারফিউম!গন্ধটা এখনো ভালোমত যায় নি।শুদ্ধ টের পেলে সর্বনাশ!ছবির বুকে হাতুড়ি পেটাচ্ছে।আঙ্গুলের ফাঁকে গ্রিলের রডগুলো শক্ত করে চেপে ধরলো সে।
রীতিমত ঘামছে সে।শুদ্ধকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তড়িঘড়ি করে বলল,
—সুমনা আপুর মত এত সুইট একটা মেয়েকে আপনার পছন্দ হয় নি কেন? তার কারনটা বলা যাবে?
—তুমি জানো না?
ছবি চুপ করে রইলো।হৃদপিন্ডটাকে খপ করে ধরে আটকে রাখতে মন চাইছে এত জোরে লাফাচ্ছে কেন?হতচ্ছাড়া!একবার খালি শুদ্ধর হাত থেকে ছাড়া পাক সে!বারোটা বাজিয়ে দেবে হৃদপিন্ডে নামক অসভ্য বস্তুটার!কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলল,
—কি বললেন উনাদের?
—কি আর বলবো।সিনেমার নায়কদের মত তিন সেন্টেন্সের লম্বা একটা ডায়ালগ দিয়ে বললাম,” মাফ করবেন।আমার পক্ষে বিয়েটা করা সম্ভব না।আমি বিবাহিত।”
ছবি বিড়বিড় করে বলল,
—আর কিছু বলবেন না প্লিজ!আমি মরে যাবো!সত্যিই মরে যাবো।
শুদ্ধ হঠাৎ ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ওর কাধের ওপর আলতো করে নিজের দুহাত রাখলো।সাথে সাথে একরাশ লজ্জা এসে ছবি চোখের তারায় ভীড় করলো,ওর বুক ধুকপুক করছে।গোল্লায় যাক ধরা খাওয়া, লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো সে।শুদ্ধ ওর নাকটা আলতো করে টেনে দিয়ে বলল,
—এত লজ্জা পেলে হবে?
ছবির শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সারা শরীরের রক্ত সব হীম হয়ে যাচ্ছে,ঠোঁটের সাথে পাল্লা দিয়ে থরথর করে কাঁপছে চিবুক।আর কিছুক্ষন এভাবে থাকলে টলে পড়ে যাবে সে।
শুদ্ধ হঠাৎ নাক দিয়ে কিছু একটা শুঁকে বলল,
—এই তুমি আমার পারফিউম লাগিয়েছো?..ওটা তো জেন্টস পারফিউম।
ছবি লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে মন চাইছে।ধরা সে খেয়েই গেলো?তাও এই মুহূর্তে?এখন কি জবাব দেবে? ইনার ছবি বলছে,’ছবি তুই দৌড় দে!’সত্যি সত্যি দৌড় দিতে মন চাইছে ছবির।ওর সাথেই কেন এমন হয়? চিৎকার করে কিছুক্ষন কাঁদতে পারলে ভালো হত!শুদ্ধকে ভড়কে দেওয়া যেত!এইযাত্রায় বেঁচে গেলো সে।সময়মত শুদ্ধর ফোন বেজে উঠলো।মনে মনে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলো ছবি!
ফোনের আওয়াজ পেয়ে শুদ্ধ ভেতরে চলে গেল।কিন্তু সে নড়তে পারছে না।সমস্ত শরীর অবশ মনে হচ্ছে,বড় বড় নিশ্বাস নিলো সে।যাক!বাচা গেলো!
নিজেকে সামলে নিলো।অস্বস্তি অনেকটা কেটে গেছে।রাজ্যের ভালোলাগা এসে ভর করছে ওর ওপর।আজকে রাতটা ওর জীবনের অনেকে বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকবে।শুদ্ধর পাশে বসে আবছা আলোতে কথা বলা,শুদ্ধর ছবির কফিতে চুমুক দেওয়া,ও রাগ করতেই টেনে নিজের পাশে বসিয়ে দেওয়া।আর সবশেষে ওকে তার নিজের দুহাতের মাঝখানে বন্দি করে ফেলা,ওর নাকটা টেনে দিয়ে মিষ্টি করে হাসা, এসব অনুভূতিগুলো ছবি সারাজীবনেও ভুলতে পারবে না।
শুদ্ধর গলার আওয়াজ পেয়ে তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকলো।শুদ্ধ ওকে ডাকছে।আবার সেই ভয় ভয় অনুভূতি!শুদ্ধকি আবার জিজ্ঞেস করবে?
দ্বিতীয় বারের মত বেঁচে গেলো সে।শুদ্ধ বলল,
—আগামী পরশু তোমাদের ক্যাম্পাস থেকে একটা হেলথ এওয়্যারনেস সেমিনারে আমাকে ইনভাইট করা হয়েছে।তুমি চাইলে আমার সাথে যেতে পারো!
ছবির মন খারাপ হয়ে গেলো।পরশু ওর সিটি আছে।কালকেই ক্যাম্পাসে ফিরে যেতে হবে।
—কোন সমস্যা?
ছবি মুখ ভার করে বলল,
—পরশু যে আমার সিটি পরীক্ষা আছে? কালকে তো যেতে হবে?
—এতে মন খারাপ করার কি আছে? তোমার সিটি শেষ হলে আমাকে কল দিও আমি তোমার সাথে দেখা করে আসবো।ঠিক আছে?
—আপনি ওয়েট করবেন তো?
শুদ্ধ হেসে উঠে বলল,
—করবো!
ছবি ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,
—আপনার জন্য কফি নিয়ে আসি?
—আনবে?..ঠিক আছে আনো।
.
.
চলবে