অল্প থেকে গল্প? অরিত্রিকা আহানা পর্ব:২০

0
5044

অল্প থেকে গল্প?
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব:২০

অনুরা চিটাগাং থেকে ফিরে আসার মাসখানেক পর ছবির একসপ্তাহের জন্য বন্ধ পড়লো।রাশেদ সাহেব এসে ওকে চিটাগাং নিয়ে গেলেন।সেখান থেকে ফিরতে না ফিরতেই শুনলো আর দশদিনের বন্ধ পড়েছে।ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক গণ্ডগোল চলছে।যার ফলে পরবর্তীতে ছুটি আরো বাড়ার সম্ভাবনা আছে।

হঠাৎ করে অনুর মুখে শুনলো আজকে রাতে শুদ্ধর নানার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সবাই শুদ্ধর নানুর বাড়িতে যাচ্ছে তারা।সব গোছগাছ করে নিতে বললো।অনুষ্ঠান তার দুদিন পরে। দুদিন আগেই যাচ্ছে তারা।আনোয়ার বেগমের অনেকদিন বাপের বাড়িতে যাওয়া হয় না তাই একরকম বাধ্য করে সবাইকে দুদিন আগে যাওয়ার জন্য রাজী করালেন।

পরেরদিন খুব ভোরে চট্টগ্রামের এসে পৌঁছালো ওরা।এসেই কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে উপল,শুদ্ধর দুই ভাই মামাদের সাথে বাজার করতে চলে গেলো।শুদ্ধর নানুর মৃতুবার্ষিকী উপলক্ষে বড়সড় করে মিলাদের আয়োজন করা হবে।তার বাজারই করতে গেছে ওরা।গরু জবাই দেয়া হবে।গরু আগেই কেনা হয়ে গেছে এখন বাদবাকি চাল,ডাল,মসলাপাতি কিনতে গেছে ওরা।
শুদ্ধর ছোটমামা এসে প্রস্তাব দিতেই উপল শুদ্ধ দুজনেই রাজী হয়ে গেলো।বেরিয়ে পড়লো মামাদের সাথে বাজারের উদ্দেশ্যে।

ছবি বাড়ির আশপাশ ঘুরে দেখছিলো।তিনতলা পাকা দালান।দালানটি খুব বেশি পুরোনো হয় নি।বড়জোর বছর পাঁচেক হয়েছে।শুদ্ধর মামারা তিন ভাই।বড়মামার ছেলে মাহিমকে বিয়ে করানোর আগেই তিন ভাই মিলে তৈরী করেছে এই দালান।তিনভাই তিনতলায় থাকেন।দালানের চারপাশে সুপারি আর নারকেলের গাছ লাগানো হয়েছে।সামনের দিকে শহরের সিস্টেমে টবে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন রকমের ফুলের গাছ।

এই বাড়িতে এবারই প্রথম আসা হয়েছে তার।শুদ্ধর মামা মামিরা সবাই যথেষ্ট ভালো মানুষ।খুবই আন্তরিক এবং মিশুক।ছবির কৌতুহলী চোখে একএক করে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করছিলো।শুদ্ধ মেজো মামার ছোট ছেলের একবন্ধু এসেছে ওদের বাসায়।মোটেও সুবিধের লাগছে না ছবির।কেমন যে মাতাল মাতাল টাইপ চেহারা!ভয়ংকর লাগে!বিশ্রীভাবে ওর দিকে তাকিয়েছে কয়েকবার।ব্যাপারটা আনোয়ারা বেগমের নজর এড়াই নি তা নয়।সকাল থেকেই উনি চোখে চোখে রেখেছেন ছবিকে।
ছবির ভীত চেহারা দেখে ভেতরে ভেতরে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে সাগর।অশালীন কিছু ইঙ্গিত দিয়েছে সে।এরপর থেকেই ছবি সারাক্ষন অনুর সাথে সাথেই ছিলো।এই লোকও বেহায়ার মত সারাদিন ছবির পেছনে লেগেছিলো।

বাজার শেষে ফিরতে ফিরতে প্রায় দুপুর হয়ে গেলো শুদ্ধদের।গরমে ঘেমে নেয়ে এসেছে একেবারে।এসেই গোসল করতে ঢুকে গেলো। একসাথে সবাই মিলে দুপুরের খাবার খেলো।
শুদ্ধর একটা কল আসাতে সে উঠে গিয়ে বারান্দায় কথা বলছিলো।সুযোগ পেয়ে ছবি আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।শুদ্ধ আড়চোখে ওকে একবার দেখে ফোনে কথা সংক্ষিপ্ত করে ফেললো।কথা শেষে ফোন পকেটে ঢুকিয়ে বলল,
—কিছু বলবে ছবি?
ছবি ঘাড় হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইলো।কান্না পাচ্ছে তার।লজ্জাও লাগছে।
—কি হলো ছবি? কোন সমস্যা?
নাসূচক মাথা দোলালো ছবি।তবে চোখভর্তি পানি টলমল করছে তার।শুদ্ধ ওর দিকে ঝুঁকে কোমলসুরে ডাক দিলো,
—ছবি? তাকাও আমার দিকে? কি হয়েছে আমাকে বলো!
ছবি ছলছল চোখে তাকালো।কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলল,
—কিছু না।
—সাগর কিছু বলেছে?
অবাক নয়নে শুদ্ধর দিকে তাকালো ছবি।শুদ্ধ কি করে জানলো? ওর মনের কথা বুঝতে পেরে শুদ্ধ বলল,
—মা আমাকে সব বলেছে!
ছবি হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে রইলো।আনোয়ারা বেগম বলেছেন? ওর যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না।ছবির রিয়েকশন দেখে শুদ্ধ হেসে ফেললো।গোল গোল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ছবি।শুদ্ধ ওকে টেনে কাছে নিয়ে এলো।ওর দুহাতের ওপর নিজের হাতদুখানা রেখে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ওকে।থুতনীটা ওর মাথায় ঠেকিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল,
—আর কোন ভয় আছে?
এই ভরসাটুকু ছবির খুব প্রয়োজন ছিলো।মুহূর্তেই নির্ভার হয়ে গেলো সারা শরীর।নিজেকে বড্ড হালকা লাগছে।বুকের ওপর থেকে সমস্ত ভয়,অশনি সংকেত বিদায় নিলো।
মাদকতা ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে।মোহনীয় সেই সৌরভ এসে নাকে লাগলো।সেই সাথে জেঁকে বসলো লজ্জার আকাশসম পাহাড়!সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে।মনে মনে এই মানুষটা নিয়ে নানারকম দুষ্টু চিন্তাভাবনা করলেও সামনে এলে সব গুলিয়ে ফেলে।নিজেকে কিছুতেই স্থির রাখতে পারে না সে।ওলটপালট হয়ে যায় সবকিছু।
শুদ্ধ ওকে চুপ থাকতে দেখে সন্দিগ্ধ কন্ঠে আবার জিজ্ঞেস করলো,
—আছে আর কোন ভয়?
শুদ্ধ হাতের মাঝে আবদ্ধ থাকা ছবির হাতদুটো অনবরত ঝাঁকি মারছে।ধীরে ধীরে মাথা দোলালো সে।না সূচক উত্তর!এই মানুষটা থাকতে ওর কিসের ভয়?
শুদ্ধ ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো।ডান হাত দিয়ে ছবির চিবুক তুলে ধরে বলল,
—সাগর যদি কিছু বলে আমাকে এসে বলবে।ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই।মা,ভাবি আর তোমার স্বামী তোমার পাশে আছে।সাগর যাতে তোমাকে বিরক্ত করতে না পারে সেই ব্যবস্থা আমি করছি।ঠিক আছে?
ছবি জবাব দিতে পারলো না।কি জবাব দেবে সে?বুকের কাঁপুনিটাই তো থামাতে পারছে না।হৃদকম্প!ভয়াবহ হৃদকম্প হচ্ছে ওর!মাথা ঝিমঝিম করে সারা শরীর ঝাঁকি মারছে!চোখ বন্ধ করে খিঁচে দাঁড়িয়ে রইলো সে।শুদ্ধ ওকে টেনে বুকের ভেতর নিয়ে নিলো,
—কি হলো ছবি? কাঁপছো কেন? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?
ছবি জবাব দিলো না।শুদ্ধর টি-শার্ট আকঁড়ে ধরে চুপচাপ মাথা ঠেকিয়ে রইলো ওর বুকে।আস্তে আস্তে হৃদকম্প কমে আসছে।স্থীরতা আসছে শরীরে,এই বুঝি বিষে বিষক্ষয়!
শুদ্ধ ওকে সরিয়ে দিলো না।ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।অনেক্ষন বাদে শান্ত হয়ে ছবি আড়ষ্ট ভঙ্গিতে সরে দাঁড়ালো।লজ্জায় কান পর্যন্ত লাল হয়ে গেছে।শুদ্ধর রিয়েকশনের অপেক্ষা করলো না।ছুটে বেরিয়ে গেলো বারান্দা থেকে।শুদ্ধর যা বোঝার বুঝে নিলো সে।ঠোঁটের কোনে ঈষৎ হাসি ফুটে উঠলো তার। ছবির লজ্জা সম্পর্কে ভালোমত ধারণা আছে ওর।লজ্জা পেলে ছবি কলমিলতার মত নুইয়ে পড়ে একেবারে।বড়মামার গলার আওয়াজ পেয়ে দ্রুত ঘরে ঢুকলো সে।বড়মামা তাকে ডাকছে।আত্মীয়স্বজনদের লিস্ট করতে হবে।সেই নিয়েই আলোচনায় বসেছে সবাই।

রাতে খাওয়াদাওয়ার পর ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো সবাই।দোতলার তিনটে ঘর ওদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হলো।কে কোন ঘরে শোবে আনোয়ারা বেগম ঠিক করে দিলেন।উপল আর অনুর জন্য একটা ঘর,উনার জন্য একটা আর শুদ্ধর জন্য একটা।অনু অবাক হয়ে বলল,
—ছবি কোথায় শোবে আম্মা?
—ছবি শুদ্ধর ঘরে শোবে!
অনু,ছবি পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে একসঙ্গে আনোয়ারা বেগমের দিকে তাকালেন।আনোয়ারা বেগম গম্ভীরকন্ঠে বললেন,
—আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে না থেকে যাও ঘুমাতে যাও সবাই।
অনু বা ছবি কেউই উঠলো না।আনোয়ারা বেগম আবার ধমক লাগালেন,
—কি হলো কথা কানে যায় না?
এবার ছবি অদ্ভুত এক কান্ড করে বসলো।চেয়ার থেকে উঠে ফট করে আনোয়ারা বেগমকে জড়িয়ে ধরলো।আনোয়ারা বেগম স্তম্ভিত হয়ে গেছেন।আবারও ধমকে উঠলেন,
—কি হচ্ছে টা কি?
ছবি কিছু বললো না।চুপচাপ উনাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো।বাচ্চারা যেমন আদর সোহাগের অপেক্ষায় মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে থাকে তেমনভাবে আনোয়ারা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো সে।
অনু পাশে থেকে ফিসফিস করে বললো,
—এইসুযোগে আম্মা ডেকে ফেল ছবি!
আনোয়ারা বেগম প্রথমে কতক্ষন চুপচাপ রইলেন।মাতৃহৃদয় বেশিক্ষণ রাগ ধরে রাখতে পারলেন না।ধীরে ধীরে উনার একটা হাত ছবির মাথার কাছে উঠে এলো।মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
—যাও মা।অনেক রাত হয়েছে শুতে যাও!
ছবি অস্ফুটসরে উচ্চারণ করলো,
—আম্মা!
আনোয়ারা বেগম মৃদু হাসলেন।ওর মুখটা তুলে ধরে বললেন,
—কি বললে?
—আম্মা!
আনোয়ারা বেগমের মুখে এখনো হাসি লেগে আছে।শাসনের সুরে বললেন,
—আমাকে আম্মা ডেকে আমার ছেলের সাথে যেন কোনরকম বেয়াদবি করা না হয়!
ছবি সাথে সাথেই মাথা দুলিয়ে বলল,
—আর হবে না আম্মা!
আনোয়ারা বেগম আবারও হেসে ফেললেন।শুদ্ধ ঠিকই বলেছে এই মেয়েটা বয়সের দিকে থেকে এখনো পরিনত নয়।তাই বুদ্ধিতেও অপরিপক্ব ভাব! তা না হলে এতদিন ধরে উনার মনের কথাটা ঠিকই বুঝতে পারতেন।উনি যে তাকে বউ হিসেবে মেনে নিয়েছে সেইটুকু বোঝার মত বুদ্ধি পর্যন্ত হয় নি এই মেয়েটার!
.
.
চলবে
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here