অসময়ে_রোদন ( ২য় পর্ব)

0
1728

গল্পঃ #অসময়ে_রোদন ( ২য় পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

যে দম্পতির বিচ্ছেদ ঘটে যায়, তাদের সন্তানের মতো হতভাগা বোধহয় আর কেউ হতে পারে না!
হ্যাঁ অরুণ আর সেই বাচ্চার দিকে তাকিয়ে আমি এটাই ভাবছিলাম।
সত্যি এই বাচ্চা যদি আমার হয়ে থাকে তাহলে সে ভীষণ রকম অভাগা!
কারণ তার মা-বাবা দুজন বেঁচে থাকলেও সে একজনকে পেলে আরেকজনকে পাবেনা।
কারণ ওর বাবা-মা যে আর স্বামী স্ত্রী নয় ।
তবে মাঝখানে অরুণ শুধুই এক সুবিধাবাদী স্বার্থপর, যে একাই সন্তানের ভাগে হাত দিয়েছে!

অরুণ রাস্তার একপাশে হাত নেড়ে রিকশা ডাকছে, আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি সেই বাচ্চাটার দিকে। কেন জানি কাউকে প্রশ্ন করার দরকার মনে হচ্ছিলোনা, আমি মা বুঝতে পেরেছি এই সন্তান আমারই গর্ভের।
না এখানে আমাকে কেউ দেখছেনা, কিন্তু আমি দেখছি বিরাট বিশ্বাসঘাতকতার আনাগোনা!
আমি আর এটা হতে দিবোনা, আমি আমার সন্তানকে আমার বুকে ফিরিয়ে আনবো! আমার সন্তানকে আমি ১০ মাস গর্ভে ধারণ করেছি, তাহলে অরুণ কেন একা অধিকার দেখাবে?

ইতোমধ্যে মেয়েটা আমার বাচ্চাকে নিয়ে রিকশায় উঠছে, কিন্তু বাচ্চাটা ফ্যালফ্যাল করে এবার আমার নেকাবে ঢাকা চোখের দিকেই তাকিয়ে আছে। অরুণও উঠলো, কিন্তু সে পেছনে আমাকে দেখলোনা। রিকশা চলছে কিন্তু সেই বাচ্চা একটা হাত বাড়িয়ে যতক্ষণ দেখা যায় আমার দিকে তাকিয়েই রইলো।
আমার ইচ্ছে করছে দৌঁড়ে পেছনে পেছনে চলে যাই। কিন্তু না এই মূহুর্তে কিছু করা ঠিক হবে না। আমাকে সত্যটা জানতে হবে!

কিন্তু ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম, কীভাবে নিজের গন্তব্যে পৌঁছাবো বুঝতে পারছিনা। পা নড়াতে পারছিনা একদমই। মাথা ঝিমঝিম করে সেখান থেকে চিনচিনে ঘাম ঝরে পড়ছে। খুব অস্বস্তি লাগছে।

বেশ খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে হঠাৎই রাস্তার পাশে একটা টিউবওয়েল চোখে পড়লো। পাশেই একটা মসজিদ, তবে এই মূহুর্তে আশেপাশে তেমন মানুষ নেই।
আমি ধীর পায়ে সেটার দিকে এগিয়ে গেলাম। মুখের উপর থেকে পর্দাটা সরিয়ে মুখটা ধুয়ে হাত দিয়ে ঢকঢক করে পানি খেলাম। হিজাবটা খুলে মাথায় পানি দিতে পারলে বোধহয় ভালো লাগতো, প্রচুর যন্ত্রণা করছে। কিন্তু পাবলিক স্থানে এটা সম্ভব না ভেবে আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পেছন ঘুরলাম। পেছন ঘুরে চোখ খুলতে কিছুটা অবাক হয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললাম,
___ফয়সাল ভাই তুমি?

আমার সামনে বাজারের একটা ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে ফয়সাল ভাই। আমার বড় ফুফুর ছেলে। ফুফুর বাসা এই সামনের গলিটার পরেই। ফয়সাল ভাইয়ের মুখের মধ্যে অস্থিরতা স্পষ্ট। আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে বললো,
___ মাথায় পানি দিবি? হিজাব খুল, আমি পানি তুলছি!

আমি বিব্রত হয়ে বললাম,
___ না না লাগবেনা। তুমি কি বাজার করতে এসেছিলে?

ধমকের স্বরে উনি আবার বললেন,
___কেন এসেছি বুঝতে পারছিস তো। জিজ্ঞাসা করা বন্ধ করে তুই নিচু হ, মাথায় পানি দে, তারপর শুনবো সব।

আমি ভীষণ কষ্ট থেকেও হাসি টেনে বললাম,
___এখনো জেদ কমালে না তুমি! যাকে যা বলো, তাই করতে হবে তাই না?

ফয়সাল ভাই হাসলো। আর বললো,
___যদি সত্যি তাই হতো!

আমি চুপ করে গেলাম। আস্তে আস্তে মাথার দিকে হিজাবটা অল্প খুলে মাথাটা নিচু করে মাথায় হাত দিয়ে দিয়ে পানি দিলাম।
পানি দেওয়ার পরে ফয়সাল ভাই আমার হাতব্যাগটা টেনে নিজের হাতে নিয়ে বললো,
___ কেন এসেছিস এখানে? আর এই পরিশ্রান্ত হওয়ার কারণ কি?

___অরুণকে দেখেছিলাম।

___ অরুণকে দেখলে কি মাথা ব্যথা আপনাআপনি চলে আসে?

___তোমার মনে আছে তিন বছর আগে আমার মৃত সন্তান হয়েছে বলে সবাই আমাকে বুঝিয়েছিলো?

ফয়সাল ভাই ভ্রু কোঁচকে বললো,
___তুই তো তা দেখিস নি। শুধু শুনেছিলি।

আমি উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,
___এইতো আমার কথা বললে, আমি তা দেখিনি। আমার সাথে অরুণ এখানেও প্রতারণা করেছে। আমার সন্তান বেঁচে আছে। ওই যে, ওই যে আমি দেখেছি আমার সন্তানকে। একটা মেয়ে তাকে নিয়ে যাচ্ছে, আমার মেয়ে আমাকে আম্মু বলে ডেকেছে। বিশ্বাস করো ফয়সাল ভাই আমার ইচ্ছে করছিলো একটা টানে আমি ওকে আমার কাছে নিয়ে আসি।

ফয়সাল ভাই অবাক হয়ে বললো,
___তোর সন্তান? কিন্তু কি করে চিনলি? আর সে-ই কি করে আম্মু ডাকলো?

আমি তোতলাতে তোতলাতে বললাম,
___ কি করে ডাকলো তা আমিও জানিনা। তবে এই যে আমার থুতনিতে ডিম্পলটা, সেটা ওই বাচ্চারও আছে। আমার মতো চেহেরা, তুমি দেখলে বুঝতে। কিন্তু সেটাও আমি অবিশ্বাস করতাম যদি বাচ্চার সাথে অরুণকে না দেখতাম! বলো এটা কি করে অবিশ্বাস্য হবে? অরুণ আমাকে ছিন্ন করে, আবার আমার সন্তানকেও ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে পুরো ছিন্নভিন্ন করে দিতে চেয়েছে। এটা আমারই সন্তান!

ফয়সাল ভাই থমকে দাঁড়ালো, আমার দিকে তাকিয়ে বললো..
___আবিদা, তুই চার বছরেও মানুষ চিনলিনারে? এতো বোকা কেন তুই? যদি আমাকে এর অল্পও বুঝতিস!

আমি ফয়সাল ভাইয়ের হাত থেকে আমার ব্যাগটা টেনে নিয়ে বললাম,
___সিএনজি নিয়ে উত্তরের রাস্তায় চলে যাবো। ফুফুকে সালাম দিও।

উনি হতাশ ভঙ্গিতে বললেন,
____১১ বছর হলো, তুই আমাদের বাসায় আসিস না। আজকে তো আসতে পারতি, আচ্ছা ঠিকাছে হিসাবের খাতাটা আরো দীর্ঘ হোক। আয় তোকে গাড়ীতে তুলে দেই।

ফয়সাল ভাই আমাকে গাড়ীতে তুলে দিলো। যাত্রী পূর্ণ হয়ে গাড়ী ছাড়ার আগ পর্যন্ত দাঁড়িয়েই রইলো।
বাতাসের তীব্রতা বাড়তে লাগলো। আর আমার ভেতরে প্রশ্নের ঝুলিটা ততটাই ভারী হতে লাগলো।
কি করে এমন হলো? সবার সাথে আমার বাবা কেন আমায় মিথ্যে বললো? আর অরুণ কেন আমার সন্তানকে এভাবে প্রতারণা করে ছিনিয়ে নিলো?
সৎ মায়ের কাছে আমার সন্তান ভালো নাও থাকতে পারে এটা ভাবা উচিত ছিল না?

বাসায় এসেই আমি একনাগাড়ে কলিংবেলটা চাপতে লাগলাম, অপেক্ষা করার ধৈর্য সারা শরীরে বিন্দু মাত্রও নেই। বাবা কিছুক্ষণ পরে দরজা খোলে বললো,
___কিরে মা এতো অস্থির কেন আজ?

আমি দরজাটা চাপিয়েই বললাম,
___ বাবা তুমিও পারলে আমার সাথে এমন করতে?

বাবা অপরাধহীন চোখে বললো,
___আমি আবার কি করলাম?

আমি সোফার দিকে এগিয়ে বোরকা খুলতে খুলতে বললাম,
___ আমার মৃত সন্তান হয়েছিল বলেছিলেনা?

আমার কথা শুনে বাবার প্রশ্নসূচক মুখটা একদম ফ্যাকাসে হয়ে গেলো।
বোরকা খুলে, হিজাবটা গলায় ঝুলিয়ে ফ্যানটা ফুল স্পিডে ছেড়ে দিলাম। তারপর ধপাস করে সোফায় বসে বাবার উদ্দেশ্য জোর কণ্ঠে বললাম,
___ চুপ কেন তুমি? মিথ্যে বলেছিলে কেন? একটা মায়ের কাছে তার সন্তানের মিথ্যে মৃত্যুর সংবাদ বলতে তোমার বুক কাঁপলো না বাবা?

বাবা আমার কথা শুনে কেঁদে ফেললেন, হাত বাড়িয়ে আমাকে চুপ করতে ইশারা করলেন। আমি এক হাত সোফার হাতলে ঠেস দিয়ে বাবার কাছ থেকে উত্তর পাবার আশায় তাকিয়ে আছি!
বাবা অপরাধ সুলভ হলেন এবার। আস্তে আস্তে বললেন,
___ হ্যাঁ আমি মিথ্যে মৃত্যু সংবাদ বলেছিলাম, কিন্তু সেটা সত্যি সত্যি মৃত্যুর হাতে থেকে বাঁচাতে। তোর আর তোর সন্তানের কথা ভেবেই আমার এই মিথ্যে ছিল।

আমি অবাক হয়ে বললাম,
___কি বলতে চাইছো তুমি? বাঁচাতে মানে?

বাবা উত্তরে বললেন,
___ আমি চাইনি আমার মতো তোর জীবন হোক। এমন একাকিত্ব তোর জীবনে আসুক। আমি জানি সন্তান পেলে বাকি জীবনটা তাকে নিয়েই কাটিয়ে দিবি। আমি চেয়েছিলাম ২য় বার তুই জীবন সাজাবার চেষ্টা কর। এরপরও আমি একজন বাবা হয়ে এতো বড় মিথ্যে বলতে পারতাম না। সেটা বলেছি তোর সন্তানেরই বেঁচে থাকার জন্য। তুই এই পর্যন্ত অরুণকে যতটা খারাপ ভেবেছিস, অরুণ তার চেয়েও ভয়ানক। হাসপাতালে বাচ্চার মৃত্যু সংবাদ তোকে না দিলে সে সত্যি সত্যি বাচ্চার মৃত্যু নিশ্চিত করে দিবে বলে হুমকি দিয়েছিলো, এমনকি ডক্টরকেও এটা বলতে বাধ্য করেছে। আমি জানিনা এটা কেন করেছে সে!

আমি সোফা হতে শরীর হেঁচকে নামতে নামতে একদম ফ্লোরে পড়ে গেলাম। একজন বাবা সন্তান মেরে ফেলার হুমকি দিতে পারে?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here