গল্পঃ #অস্পষ্ট_সে (প্রথম পর্ব)
লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার
স্বচক্ষে নিজের হবু জামাইকে অন্য একটা মেয়ের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করতে দেখে ক্ষণিকের জন্য বিমূঢ় হয়ে গেলো চিত্রা! রেস্টুরেন্টে জনসম্মুখ থেকে কিছুটা আড়ালে থাকা টেবিলে বসে আছে তার হবু জামাই দ্বীপ এবং তার সাথে গা ঘেঁষে পাশাপাশি সীটে বসে আছে একটা মেয়ে,যাকে চিত্রা চিনেনা ৷
এদিকের এই ওয়াশরুমে না আসলে হয়তো আজকের এই দৃশ্যটা দেখা হতোনা চিত্রার৷
মেয়েটা বারবার দ্বীপের গালে,হাতে স্পর্শ করতেছে। মেয়েটা সম্ভবত দ্বীপকে কিছু একটা বুঝাতে চাচ্ছে কিন্তু দ্বীপ একটু ছন্নছাড়া অবস্থায় স্থির হয়ে আছে ।
মাত্র চারদিন পর দ্বীপের সাথে চিত্রার বিয়ে, অথচ আজকে তার সেই শত স্বপ্নের পুরুষকে এভাবে অন্যজনের সাথে দেখবে ভাবতে পারেনি।
অচেনা এই মানুষটাকে নিয়ে এই কয়দিনে অনেককিছু ভেবে ফেলেছিল সে!
দ্বীপ এদিকে তাকানো এবং কিছু বুঝে উঠার আগেই চিত্রা দৌঁড়ে চলে আসলো, তার সাথে আসা বান্ধবী রাহির হাতে টেনে সেখান একদম বাইরে চলে গেলো। ভাগ্যিস রাহিকে টেবিলে বসিয়েই চিত্রা ওয়াশরুমে গিয়েছিল,নয়তো আজকে রাহির সামনে এই দৃশ্যটা পড়ে যেতো। আর দ্বীপকে রাহি নিঃসন্দেহে চিনে ফেলতো,কারণ তাকে ছবিতে দেখেছে।
রাহি চিত্রার এভাবে টেনে নিয়ে আসার ব্যপারটায় কিছুই বুঝতে পারলো না, হাত ছাড়িয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বললো..
___এভাবে তড়িঘড়ি করে বাইরে আনলি কেন? আমাকে ট্রিট দেওয়ার জন্য এই রেস্টুরেন্টে নিয়ে আসলি অথচ ওয়াশরুম থেকে এসে আমাকে চেয়ার থেকে উঠিয়ে এতো টেনে নিয়ে আসার মানে কি? জানিস এভাবে ধরাতে আমার হাতে ব্যথা করছে।
চিত্রা কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে গেলো, রাহির হাতের দিকে তাকিয়ে বললো..
___আমি বুঝিনি তোর হাতে ব্যথা লাগবে। আসলে এখানে আমার রিফাত ভাইকে দেখতে পেলাম। বিয়ের আগে এভাবে রেস্টুরেন্টে এসেছি বাড়িতে জানালে তোলপাড় কান্ড শুরু হবে। আমি জাস্ট কয়েকজনকে বিয়ের কার্ড পৌঁছে দিবো বলে এসেছি। চল অন্য কোথাও যাই।
রাহি চিত্রার কথামতো মাথা নাড়লো। রাহিকে একটা ক্যাফেতে বসিয়ে সে যা যা খেতে চায় খাওয়ালো,কারণ ইউনিভার্সিটিতে রাহি তার একমাত্র বন্ধু যে সর্বদা তার পাশে থাকে৷ চিত্রার বিয়ের তারিখ হওয়ার কথা শুনেই বিয়ের আগে ট্রিট দিতে বলে তাকে অস্থির করে তুলছিল।
এদিকে রাহির সামনে স্বাভাবিক ব্যবহার করলেও চিত্রার ভেতরটা জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। সেটা রাহিকে বলতেও পারছেনা, আবার সহ্যও করতে পারছেনা৷ কি-ই বা বলবে তার হবু জামাইকে একটু আগে অন্য একটা মেয়ের সাথে দেখেছে। এটা বললে রাহির কাছে তার মুখ থাকবে?
রাহি হয়তো চিত্রার মধ্যে হঠাৎ এই অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়ার ব্যপারটা ধরতে পেরেছিল তবে কারণটা বুঝতে পারেনি। ভেবেছে কয়েকদিনের মধ্যে নতুন জীবনে পা রাখবে বলে হয়তো কিছুটা অস্বস্তি ফিল করছে। তাদের দুজনের মধ্যে আর কথা বাড়েনি।
বিকেলের দিকে চিত্রা বাড়ি ফিরে প্রথমেই মোবাইলের ওয়ালপেপারে ভেসে থাকা দ্বীপের ছবিটার দিকে তাকালো, তার চোখের অবাধ্য অশ্রু আর বাঁধ মানলোনা। সে অঝোরে কেঁদে চললো, এমনটা তার সাথে কেন হওয়ার ছিলো! বারবার ভাগ্যকে দোষারূপ করতে লাগলো। তাছাড়া আর কিছুই যে করার নেই।
বিয়ের কথাবার্তা চলাকালীন এই পর্যন্ত এখনো চিত্রা এবং দ্বীপের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো আলাপ হয়নি। শুধুমাত্র দেখতে আসা আর আংটি পরানোর মধ্যেই দুজনের যতটা পরিচয়। আর দ্বীপের ছবিগুলো চিত্রাকে দেখতে আসার আগেই ঘটকের মাধ্যমে চিত্রার মার ফোনে ছিল, প্রথম প্রথম লুকিয়ে চিত্রা দেখতো তারপর একদিন তার মায়ের মোবাইল থেকে চুরি করে সেগুলো তার ফোনে নিয়ে আসে।
তার তারিখ হওয়ার পরেরদিন তার ছোট বোন অরিত্রা ফাজলামো করে তার ওয়ালপেপারে থাকা দ্বীপের ছবিটা তার মা’কে দেখিয়ে দিয়েছিল। তারপর কতো লজ্জায়-ই না পড়তে হয়েছিল চিত্রাকে।
এসব ভাবতেই চিত্রার কান্নার বেগ আরো তীব্রতর হচ্ছে।
অতঃপর চিত্রা ভাবছে দ্বীপের এই ব্যপারে তার পরিবারকে জানানো উচিত কী না? কিন্তু কিভাবে জানাবে,তার বিয়ের জন্য চারপাশে এই মূহুর্তে কত হইহট্টগোল, প্রায় আত্মীয়দেকেই দাওয়াত দেওয়া হয়ে গেছে। তার বাবা ব্যাংক থেকে কতো টাকা লোন তুলেছে। গরু কিনাও হয়ে গেছে। এই মূহুর্তে যদি চিত্রার বাবা এটা জানে সহ্য করতে পারবেনা। এসব ভেবে ভেবে সে যেন আরো অস্থির হয়ে যাচ্ছিলো। কোনোভাবেই বুঝতে পারছিলো এখন তার কি করা উচিত।
দুইদিন এভাবেই কেটে গেলো, গায়ে হলুদের আগেরদিন চিত্রা চিন্তা করলো আজকে অন্তত আম্মুকে একটু ইঙ্গিত দেই। নয়তো বিয়ের পরে কিছু একটা হয়ে গেলে বলবে আগে কেন জানালাম না।
চিত্রা ধীর গতিতে তার আম্মুর রুমে গিয়ে বসলো।
সে একবুক সাহস সঞ্চয় করে যেই বলতে যাবে,তখনি তার মা ফোনটা এনে চিত্রার চোখের সামনে ধরে বলল.
___ এই দেখ ওরা গাঢ় খয়েরী রঙের শাড়ী কিনেছে, যেমনটা তুই চেয়েছিলি। আমি তো ঘটককে বলে দিয়েছিলাম। আর ওরাও কতো ভালো ডিজাইনের একটা শাড়ী কিনেছে দেখ,তোকে খুব মানাবে না?
চিত্রা শাড়ীটার দিকে তাকালো, আজকে তার চোখে কোনো উৎসুক ভঙ্গি নেই,অথচ সেদিনের আগে দ্বীপদের বাড়ির ব্যপারে যেকোনো কথা বলেই সে লুকিয়ে হলেও শুনতে চাইতো। এইতো তার আংটিটার ছবি যেদিন পাঠিয়েছিলো সেদিনও চিত্রা এটাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে গেছিলো। প্রতিটা মূহুর্ত তাকে নিয়ে কল্পনায় আকিঁবুকিঁ করতো, তার সবসময় মনে হতো সে যেমন তার কাঙ্ক্ষিত সেই মানুষটাকে এতো অনূভব করে, অপরপ্রান্তে থেকে সেও হয়তো তাকে সেভাবেই ভাবে ভাবে এবং তাকে ভেবে ব্যকুল হয়।
কিন্তু মাত্র দুইদিন আগে চিত্রার সব ভাবনা, চিন্তা, আশা,বিশ্বাস,ভরসা,স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।
তার মনে আর সেই ভাবনাটা নেই,এখন শুধু ভয় আর হতাশা। না পারছে সাচ্ছন্দ্যে বিয়েটা করতে, আর না পারছে ভাঙতে।
সেদিনটাও এভাবেই কেটে গেলো। গায়ে হলুদের সন্ধ্যায়। চিত্রা হলুদ মেখে গোসল করে মাত্র চুল শুকাতে বসেছে। সেসময় তার ফোনের রিংটোন।
অপরিচিত নাম্বার হলেও সে রিসিভ করলো, প্রথমে কথা বললো না। পরবর্তীতে যখন শুনলো এটা একটা মেয়ের কণ্ঠস্বর তখন সে প্রশ্ন করলো..
___কে বলছেন?
___আপনি আমাকে চিনবেন না, আমার নাম অথৈ। আপনার যার সাথে বিয়ে হচ্ছে তার প্রেমিকা৷ পুরো ৫ বছরের সম্পর্ক আমাদের। দ্বীপের সাথে একটা ব্যপারে আমার ঝামেলা চলছে, তাই সে আমার কথামতো বিয়েটা ভাঙতে রাজী হচ্ছেনা। তবে এটা খুব শীগ্রই কাটিয়ে উঠবে। আর তখন পুরোপুরি অন্ধকার নেমে আসবে আপনার জীবনে। কারণ আমরা বিয়ে করে নিবো। তাই এই বিয়েটা আপনার পক্ষ থেকে ভেঙে দিলেই ভালো হবে, আমারও এবং আপনারও! আশা করি আপনি বিষয়টাকে বুঝবেন৷
চিত্রার ঠোঁটজোড়া বিরবির করে কিছু বলতে চাইছে কিন্তু না, সেখান থেকে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছেনা।
তার পাশ থেকে তাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে কে ফোন দিয়েছে,কে ফোন দিয়েছে! তাদের দিকে তাকানোর অবস্থাটাও নেই চিত্রার। কলিজা বারবার মুচড়ে উঠছে। ফোনটা ধরে রাখার শক্তিটাও কেমন লোপ পেয়েছে তার। কিভাবে এই পর্যায়ে বিয়েটা ভেঙে দিবে চিত্রা? কি বলবে সবাইকে?
চলবে….