অস্পষ্ট_সে ( ৬ষ্ঠ পর্ব)

0
780

গল্পঃ #অস্পষ্ট_সে ( ৬ষ্ঠ পর্ব)
লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার

___আমি তো চাই আপনি ১০০ টা বিয়ে করেন এবং সবার চিপায় পড়ে একদম চেপ্টা হয়ে যান,যত্তসব!

বলেই চিত্রা কাপ হাতে হনহন করে বেড়িয়ে গেলো। এদিকে চিত্রার এমন কথায় দ্বীপ হাসতে হাসতে অস্থির প্রায় অবস্থা। সে নিজেও জানে চিত্রার কথার মানে কি!

অন্যদিকে চিত্রা সবার সাথে সবকিছু হাস্যউজ্জ্বল চেহেরায় ম্যনেজ করতে থাকলেও ভেতরে ভেতরে দ্বীপের উপর প্রচন্ডরকম রাগে সে ফেটে যাচ্ছিলো।
দ্বীপ যদি তার প্রেমিকার জন্য তার থেকে দূরে থাকতো,তাহলেও সে বিষয়টা মেনে নিতে পারতো। কিন্তু দুজনের সাথে এরকম মিথ্যে অভিনয়, আর নিখুঁত ছলচাতুরী করা তো জগণ্য একটা বিষয়।
এমন মানুষ নিঃসন্দেহে ঠকবাজ প্রকৃতির হয়।
এটা নিয়ে তার সাথে যথাসম্ভব আলোচনা করা উচিত।

তারপর সকালের খাবারের পর মেহমানদের ভীড়ে এবং এতো ব্যস্ততায় চিত্রা দ্বীপকে আর দেখেনি। দুপুরের দিকে চিত্রাদের বাড়ি থেকে মানুষ আসলো।
এবং বিকেলের দিকে তারা এই যাত্রার যানজট শেষে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। সকালের পরে দ্বীপকে এই মূহুর্তে কাছে পেয়েছে চিত্রা।
দ্বীপকে ভালো করে সবকিছু জিজ্ঞাসা করে বিষয়গুলো ক্লেয়ার হওয়াটা খুব দরকার। কিন্তু সেই সুযোগটা চিত্রা পাচ্ছেনা।
আর দ্বীপ গাড়ীতে উঠেই চিত্রার দিকে না তাকিয়ে নিজের মতো করে মোবাইলের স্ক্রিনে ডুবে আছে।
আর চিত্রা একপাশে বসে রাগে দাঁত খিঁচ খিঁচ করছে। নিজে থেকে কোনো কথাও বলতে পারছেনা।

পুরো রাস্তায় দ্বীপও চিত্রার সাথে কথা বলেনি আর চিত্রাও নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যায়নি।
অতঃপর এভাবেই তারা পৌঁছালো গন্তব্যে, বাড়ির সামনে গাড়ী থামার সাথে সাথে সবাই যখন তাদেরকে বরণ করার জন্য এগিয়ে আসছে তখনি দ্বীপ হুট করে গিয়ে চিত্রার হাত চেপে ধরে হেসে হেসে বললো..
___ বউ চলো ভেতরে যাই।

চিত্রা অবাক হয়ে একবার নিচে তাকাচ্ছে আরেকবার দ্বীপের দিকে তাকাচ্ছে। তারপর সামনে তাকিয়ে দেখে চিত্রার দুঃসম্পর্কের দুই ভাবী এবং তার যত কাজিন সবাই তাদেরকে ফুল দিয়ে বরণ করতে দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রা ব্যপারটা বুঝতে পেরে দ্বীপের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সেও দ্বীপের হাতের ভাজে হাতটা শক্ত করে ধরে আস্তে আস্তে বাসার ভেতর প্রবেশ করলো। ভেতরে গিয়ে মুরব্বিদেরকে সালাম দেওয়া, ছোটদের আবদারে এটা খাওয়া ওটা খাওয়া, এবং তাদেরকে বকশিস দেওয়া সবগুলো কার্যক্রমে দ্বীপ চিত্রার হাত ছাড়েনি। চিত্রা অনেকবার জোর করেছে হাত ছাড়িয়ে নিতে কিন্তু দ্বীপ ছাড়বেনা। মানুষের সামনে চিত্রা জবরদস্তিও করতে পারছেনা। কি আর করা,বাধ্য মেয়ের মতো এখান থেকে ওখানে এভাবেই হেঁটে বেড়াচ্ছে। আর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছে তার ভাবীরা ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে। এসব দেখে লজ্জায় চিত্রার ইচ্ছে করছিলো এই মূহুর্তে মাটিতে গর্ত করে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে।

অবশেষে প্রায় আধঘন্টা পরে চিত্রাকে বলা হলো জামাইকে নিয়ে রুমে যেতে। এটা শুনে যেন চিত্রা স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারলো। তারাতাড়ি করে রুমের দিকে পা বাড়ালো।
চিত্রা নিজের রুমের সামনে গিয়ে দেখলো দরজা বন্ধ। দরজায় টুকা দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। নাহহ দরজা খুলছেনা। আবারো টুকা দিলো, কিন্তু এবারও সাড়া নেই। এবার চিত্রা ডাকতে শুরু করলো দরজা খোলার জন্য।

চিত্রা বিরক্ত হয়ে শেষবার দরজার উপর জোরে আওয়াজ করতে যাবে তখনি দরজা খোলে গেলো, আর তার সাথে সাথে দ্বীপ চিত্রার হাত ছেড়ে হাতটা নিয়ে চিত্রার কাঁধে রাখলো। এটা দেখে চিত্রা রেগে দ্বীপকে কিছু বলতে যাবে তখনি দেখলো সামনে তার বান্ধবী রাহি আর একজন ফুফাতো বোন দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রা ভেতরে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলো তারা আসলে এতক্ষণ রুমটাকে সাজাচ্ছিল। রাহি বিয়েরদিন এসেছিল কিন্তু থাকতে পারেনি, এবং কনেপক্ষ থেকে জামাইয়ের বাড়িতে যাওয়ার অনুমতিও পরিবার থেকে পায়নি।
কিন্তু তার সন্ধ্যার দিকে আসার পেছনে কারণ আছে তাদের মধ্যে একটা চুক্তি হয়েছিল, দ্বিতীয়দিন এখানের সাজসজ্জা রাহিকেই করতে হবে। রাহি কথা রেখেছে ভেবেই চিত্রা খুব খুশি হলো।
তারপর সবার সাথে দ্বীপের পরিচয় হলো,রাহি দ্বীপের সাথে দুষ্টামী করার এক পর্যায়ে বলেই ফেললো..
___ কি ব্যপার বউকে এক মিনিটের জন্যও ছাড়তে মন চায়না? ওই বাড়ির ভাবী বলে গেলো আপনি নাকি নেমেই বউয়ের হাত যে ধরেছেন আর ছাড়েননি। কি বান্ধবী আপনাকে একদিনেই এতো বশ করে ফেলছে, বাহহ বান্ধবী আমার তাহলে কাজের আছে।

রাহির কথায় সবাই হাসতে লাগলো, দ্বীপও হাসছে কিন্তু চিত্রা আরো রেগে যাচ্ছে। চিত্রা মনে মনে দ্বীপের চৌদ্দগোষ্ঠীকে বকে উদ্দার করে ফেলতেছে।
চিত্রা না পারছে সরে যেতে আর না পারছে দ্বীপকে ছাড়াতে।
এদিকে দ্বীপ সুযোগের ব্যবহারটা দিব্যি করে চলছে।
দ্বীপ জানে চিত্রা রেগে রেগে আগুণ হচ্ছে। তাও আরো রাগিয়ে যাচ্ছে।

কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর পরই রাহির ছোট ভাই এসে খবর দিয়ে গেলো রাহিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার বাবা এসেছে। এখনি চলে যেতে হবে।
রাহির বিদায় নিয়ে রুম থেকে বের হলো, সাথে চিত্রার ফুফাতো বোনও বেরিয়ে গেলো।
তারা বেরুনোর সাথে সাথে চিত্রা জোরে হাতটা ছিটকে ছাড়িয়ে চোখ রাঙাতে রাঙাতে দরজা লক করে বলতে শুরু দিলো …
____ এই সমস্যাটা কি আপনার? মানুষের সামনে আমি কিছু বলতে পারবোনা বলে খুব সুযোগ নেওয়া হচ্ছিলো তাইনা? কি বুঝাতে চাইছেন সবাইকে? আপনি আপনার বউকে খুব ভালোবাসেন? আমাদের মধ্যে খুব ভালো বুঝাপড়া হয়ে গেছে?

___চিত্রা চিত্রা শুনো প্লিজ। দেখো অনেককিছুই আছে যা আমরা জানিনা, কিংবা বুঝতে পারিনা আবার যেটুকু জানি সেটুকুর অনেককিছুই সঠিক না। এসব নাহয় আমরা পরে বুঝে নেবো।
আজকে এখানে সবার নজর আমার দিকে, পরবর্তী আমরা কেমন আছি সেটার খোঁজ করে কেউ দেখবেনা। অথচ আজকে কতো কতো মানুষ আছে এখানে যারা আমাদের দুজনকে খেয়াল করবে এবং আমাদের নিয়ে ভিন্ন জায়গায় কথাও বলবে। তুমি চাওনা সবাই আমাদের দুজনকে নিয়ে পজিটিভ কথা বলুক?

চিত্রা দ্বীপের দিকে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। কথাগুলো কেন জানি তার ভালো লাগলো। সে চোখ মুখ বাঁকিয়ে বললো..
___ওকে ওকে বুঝলাম। আচ্ছা থাকেন আপনি, আমি আসছি একটু।

দরজা খোলে চিত্রা তার মায়ের কাছে গেলো। সেখানে গিয়ে দেখে অনেক আত্নীয়রা বসে আছে। চিত্রাকে দেখেই তারা শশুড়-শাশুড়ী এবং সেখানকার পরিবেশ কেমন লাগলো এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করতে লাগলো। চিত্রাও মিলিয়ে মিলিয়ে সবকিছুর ঠিকঠাক জবাব দিতে লাগলো।
অনেক্ষণ সেখানে গল্প করার পরে চিত্রার মা বললো..

___এরে বাচ্চাগুলোরে বলছিলাম দ্বীপকে নাস্তা দিয়ে আসতে, ওরা তো এখনো এলো না। তুই গিয়ে দেখে আয় তো।

চিত্রা হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে উঠে চলে গেলো। রুমের কাছে গিয়ে দেখে দ্বীপ বাচ্চাদের সাথে কি যেন একটা খেলা খেলছে। খেলাটা এমন, দ্বীপ চার আঙুল বিছানার উপর ভর করে ধরে রেখেছে আর একেকজন নিচে থেকে তার হাতে ছুঁতে চাচ্ছে কিন্তু পারছেনা, কারণ দ্বীপ তার আগেই হাত সরিয়ে ফেলে। চিত্রা সেখানে গিয়ে বসার সাথে সাথে সবাই রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।
চিত্রা জিজ্ঞাসা করলো..
___কি খেলা এটা?

___ চিত্রা তুমি খেলবা এটা? নাহহ থাক তুমি পারবা না। উল্টো হাতে থাপ্পড় খাবা। খেলাটাই থাপ্পড়ের।

___ আমি পারবোনা মনে হচ্ছে? ওকে আমি খেলবো।

বলেই চিত্রা হাত পেতে বললো,
__দেন দেখি।

দ্বীপ বলল..
___ শুনো শর্ত আছে, তোমাকে আমি ছুঁতে না পারলে তোমার এক পয়েন্ট, কিন্তু ছুঁতে পারলে খেলার ১০ ধাপ ওভার হলে যতবার ছুঁতে পেরেছি ঠিক ততবার হাত পেতে দিতে হবে, তখন গুনে গুনে ততবার থাপ্পড় খেতে হবে। পারবা তো? আর ধরো আমি গেইমে আছি তাই যতবার ইচ্ছে হাত উপরে উঠাতে পারবে কিন্তু তুমি যে ছুঁতে চাইবে সেটা মাত্র তিনবার হাত বাড়ালেই এক ধাপ শেষ হবে, আর তখন আমার এক পয়েন্ট হবে। এভাবে ১০ ধাপ পার হলে তোমার পালা আসবে,বুঝছো?

চিত্রা ভাবসাব নিয়ে বললো
___ অবশ্যই আপনি আমাকে ছুঁতে পারবেন না। শুরু করা যাক।

___ আচ্ছা তাহলে আমি আগে হাত দিচ্ছি, তুমি আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করো।

বলেই দ্বীপ আঙুল ভর করে হাত রাখলো। চিত্রাও নিচু হয়ে নিচ থেকে হাত প্রস্তুত করেছে ছোঁয়ার জন্য।
চিত্রা ছুঁতে যায় কিন্তু দ্বীপ হাত সরিয়ে ফেলে এভাবে ছয় ধাপেও চিত্রা দ্বীপকে একবার ছুঁতে পারেনি।
সপ্তম পর্যায়ে গিয়ে একবার ছুঁতে পেরেছে। এরপর বাকি তিনটাও মিস। চিত্রা ভেবেছিল দ্বীপের অনেকগুলো মিস হবে এবং সে দ্বীপের হাতে থাপ্পড় বসাতে পারবে। কিন্তু বেচারি হতাশ। শুধুমাত্র একটা থাপ্পড় দিলো, যেটা দিয়ে উল্টো নিজের হাতেই ব্যাথা পেলো।

তারপর আসলো চিত্রার পালা, চিত্রাও আঙুল ভর হাত রাখলো। দ্বীপ ছুঁয়ে ফেলে এমন ভাব,চিত্রা হাত উঠিয়ে নেয়, কিন্তু দ্বীপ ছুঁতে আসেনা। আবার ভাবভঙ্গি ছাড়াই হুট করে ছুঁয়ে ফেলে চিত্রা বুঝতেই পারেনা। এভাবে নবম ধাপে এসে চিত্রা দেখলো তার মাত্র দুই পয়েন্ট, ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গেলো। শেষটাতে দ্বীপ ছুঁতে না পারলেও হাতের উপর ৭ টা থাপ্পড় খেতে হবে ভেবেই কপালে ঘাম ভেসে উঠছে তার বুক ধুকধুক করছে।কিভাবে এখান থেকে পালাবে এবার?!

চিত্রা নিজেকেই বকতে লাগলো , কেন যে এতো পাকামো করতে গেলো সে!

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here