আছি তোমার পাশে,পর্ব ১

0
4081

আছি তোমার পাশে,পর্ব ১
লেখায়- Anjum_tuli

বিয়ের পর হাজারো লজ্জা নিয়ে মেয়েরা বাসর ঘরে বসে থাকে। আর আমি বসে ছিলাম আতংকের সাথে। কখন বর নামক লোকটা আসবে আর তার রাগী চেহারায় আমাকে ভষ্ম করে দেবে।

আমাকে যেদিন দেখতে এসেছিলো সেদিনই এক দেখায় আমাকে পছন্দ করে ফেলেন আমার শাশুড়ী। আমার স্বামী রায়ান আহমেদ উনার মায়ের কথার উপর টু শব্দও করে নি। কেবল বিয়েতে সম্মতি জানিয়ে তিন কবুলে আমাকে তার অর্ধাঙ্গিনী বানিয়ে ফেলেছিলো।

সেদিনই আমাকে ঘরে তুলে আনেন নি আমার শাশুড়ী। এর এক সপ্তাহ পরে সব আনুষ্ঠানিকতার সহীত আমাকে তুলে আনেন।

রায়ানকে বাবার খুব পছন্দ। তার অমায়িক ব্যাবহারে বাবা বরাবরই মুগ্ধ। কিন্তু আমি তার দিকে তাকাতে পারি না। মনে হয় তার চোখ দিয়ে সে তীর নিক্ষেপ করে। রায়ানের পুরো পরিবার রায়ানের এক কথায় চলে। রায়ান কেবল তার মায়ের কথা শুনে। রায়ান যখন আমাকে তার গম্ভীর কন্ঠে ডাকে ‘রোদু শোনো’ থিক তখন অজানা ভয়ে আমার বুক ধক করে উঠে। কোনো এক বিশেষ কারণে সে আমাকে রোদু ডাকে। তার গম্ভীর মুখে একদিন আমায় বলেছিলো রোদু ডাকার পেছনে বিশেষ কারণ আছে। তা নাকি সময় হলে বলবে। তার সময় আমাদের বিয়ের একমাসেও হয়নি।

যাজ্ঞে তার একটা দিক বিশেষ লক্ষণীয় সে বড়দের সম্মান দিতে জানে। আর তার এই সম্মানের জোরেই বাবা এক দেখায় মেয়েকে তার হাতে তুলে দিতে দুবার ভাবে নি।

আমাদের বিয়ের পর রায়ান একদিন আমাকে ফোন দিয়েছিলো। সারা মুখে হলুদ মেখে যখন আমি খিলখিলিয়ে হাসছিলাম। ঠিক তখনি রায়ান আমার ছোট বোন লুতুশিকে ভিডিও কল দিয়েছিলো। আমি লজ্জায় মাথা নুয়িয়ে ফেলেছিলাম। এভাবে হলুদ ভূত সেজে উনাকে ভয় দেখানোর কোনো ইচ্ছে ছিলো না আমার। আমি তাকাতে না পারলেও তিনি ড্যাব ড্যাব করে ঠিকি তাকিয়ে ছিলেন। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না এভাবে তাকিয়ে কি তিনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?

বাবা মাকে ছেড়ে আসতে সব মেয়েদেরই খারাপ লাগে। যে পরিবারে ছোট থেকে বেড়ে উঠা সেই পরিবার আপন মানুষ ছেড়ে আসতে কষ্ট হওয়ারই কথা। যার ফলশ্রুতিকে কেদেছিলাম। খুব কেদেছিলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে আমাকে ফেলেই রায়ান গাড়িতে গিয়ে বসে গিয়েছিলো। সেদিন মনে মনে ভেবেছিলাম, ‘যে আমার কান্না দেখে এত বিরক্ত সে সারাজীবন আমার সাথে সংসার করবে কি করে? আচ্ছা সে আমায় পছন্দ করে তো?

তাদের বাড়িতে প্রথম কদম দেওয়ার সাথে সাথে কোথা থেকে একটা বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরেছিলো। সাথে তার চিকন কন্ঠে ডেকেছিলো মামনি বলে। মিষ্টি মেয়েটাকে দেখে অটোমেটিক ঠোটের কোনে হাসি চলে এসেছিলো। ভেবেছিলাম তাদের আত্মীয় হবে। আমার শাশুড়ি মা চোখের ইশারায় খালাকে বলেন মেয়েটিকে নিয়ে যেতে। কি অন্যায় করেছিলো বাচ্চাটি ? কেবল আমার কাছেই তো একটু এসেছিলো? কিন্তু না তাকে টেনেহিচড়ে নিয়ে গিয়েছিলো। নেহাত নতুন বউ আমি তাই চুপ করে ছিলাম। তবে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক টান অনুভব করেছিলাম।

বাসর ঘরে যখন জনাবের অপেক্ষায় উড়নায় নিজের আঙ্গুল পেচাতে ব্যাস্ত তখনো সেই চিকন মিষ্টি কন্ঠটা এসেছিলো। দরজা ফাক করে উকি দিয়ে আমাকে চুপিচুপি দেখে তারপর পা টিপে টিপে আমার কাছে এসে কানে কানে বলেছিলো, ‘এই মামনি, আমি তুমাল কাছে থাকি?’

বাচ্চা মেয়েটার বলার ধরণ দেখেই আমার ঠোটের কোণে হাসি চলে এসেছিলো। এত কিউট কেনো বাচ্চাটা? মেয়েটা আমার গলা জড়িয়ে ধরে আমার গালের সাথে গাল লাগাতে যখন ব্যাস্ত ঠিক তখনি খট করে দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করে রায়ান। অবাক করা বিষয় মেয়েটি রায়ানকে দেখে একটুও বিচলিত হয় নি। উল্টো আমার কোল থেকে নেমে ঝাপিয়ে পরেছিলো রায়ানের বুকে। রায়ান পরম আদরে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। কপালে চুমু খেয়ে আদর আল্লাদ মিশিয়ে বলেছিলো, ‘আমার মা’টা কি করে?’

বাচ্চাটি খুশিতে গদগদ হয়ে বলেছিলো, ‘মামনির কাছে এসেছি পাপাই’

পাপাই! পাপা মানে তো বাবা। অদ্ভুত মেয়েটা রায়ানকে পাপা ডাকছে কেনো? আবার আমাকে মামনিও ডাকছে। ব্যাপার টা নিয়ে মাথায় তেমন প্রেশার দিলাম না। যা ভাবছি তা নয় নিশ্চই। কত কারণেই পাপা ডাকতে পারে।

মাথা নিচু করে বসেছিলাম আমি। আমাকে যখন রায়ান বলল, ‘ড্রেস চ্যাঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে আসো।‘ আশ্চর্য ঠিক তখনি তার মুখ থেকে হাসি গায়েব হয়ে গেলো। গম্ভীর হয়ে কথাটা বলল। মুখ ভেংচি কেটে চলে গিয়েছিলাম। আমার সাথে একটু হেসে হেসে কথা বললে কি তার মুখ খসে পরবে?

সে রাতে বাচ্চাটি বায়না ধরে আমাদের সাথে ঘুমাবে। রায়ান মেনে নেয় বাচ্চা মেয়েটির আবদার। আমার শাশুড়ি মা এসে বাচ্চাটিকে নিয়ে যেতে চাইলেও রায়ানের কাছে ব্যার্থ হয়ে তাকে ফিরে যেতে হয়েছিলো।

দুপাশে দুজন আর মধ্যে বাচ্চাটি শুয়েছিলো। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখে যখন ঘুম নেমে এসেছিলো তখন নিজের অজান্তেই বাচ্চাটিকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলাম। সকালের আলো ফুটতেই এক সুন্দর দৃশ্য চোখে পড়েছিলো। বাচ্চাটি আমার বুকে পরম আরামে ঘুমিয়ে আর রায়ান আমাকে জড়িয়ে। মনে মনে বাচ্চাটিকে হাজারো ধন্যবাদ দিয়ে মাথায় চুমু খেলাম। এই বাচ্চাটিই আমার সমস্ত অস্‌বস্থি দূর করে দিলো। আমার নড়াচড়ায় রায়ানের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সে একবার আমার আর বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে পাশ ফিরে আবার শুয়ে গেলো। আলতো করে বাচ্চাটাকে বেডে রেখে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।

রান্নাঘরে গিয়ে দেখি শাশুড়ি মা মানে আম্মা চা বসিয়েছেন। আমি গিয়ে হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিতে লাগলাম। আম্মা আমাকে হুকুমের সহিত বললেন,
‘দেখো বৌমা তুতুলকে এত আহ্লাদ দিয়ো না। দেখবে তুমার আচল ছড়বে না’

‘তুতুল কে?’ বেশ কৌতূহলের সহীত প্রশ্ন করলে মা বল্লেন যে বাচ্চাটা কাল রাতে আমার ঘরে থেকেছে। দুবার ঠোট নাড়িয়ে নামটা উচ্চারণ করলাম। অজান্তেই ঠোটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। নামটাও মেয়েটার মত মিষ্টি।

মা আমার হাতে এককাপ গ্রিণ ট্রি দিয়ে বললেন রায়ানকে দেয়ার জন্য। রুমে প্রবেশ করেই দেখি রায়ান কোর্ট টাই লাগিয়ে রেডি। এত সকাল যাচ্ছে টা কই জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলাম না। পাছে না বকা খাই এই ভেবে। তুতুল ঘুম থেকে উঠেই রায়ানের গলা জড়িয়ে থাকলো। রায়ান কোনো ভাবেই যখন ছাড়াতে পারছিলো না আমি হাত বাড়াতেই এক লাফে আমার কোলে চলে আসলো। আলতো করে তার গালে চুমু খেয়ে সাহস নিয়ে রায়ানকে প্রশ্ন করলাম, ‘ভারী মিষ্টি মেয়ে। কে হয় সে?’

রায়ান আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ‘আমার মেয়ে’ বলেই বেড়িয়ে গেলো। উফ এই রাগী চেহারা যেনো জ্বলন্ত এক অগ্নিকুন্ড। তার কথাটা আমার বিশ্বাস হলো না। অবশ্যই বাবা জেনে শুনে আমাকে কোনো বিবাহিত ছেলের সাথে বিয়ে দিবে না এইটুক বিশ্বাস ছিলো।

সারাদিন তুতুলকে নিয়েই সময় কাটলো। সেদিন রাতে রায়ান ফিরে আম্মার রুমে গিয়ে বলে দিলো সে কোনো রকমের বৌভাতের অনুষ্ঠান করতে রাজি নয়। আম্মা তাকে নানা ভাবে বুঝালেও সে রাজি হয় নি। তার এক কথা সে এসব ঝামেলা আর সহ্য করবেনা। আম্মার কথায় বিয়ে করেছে এই টুকুতেই যেনো আম্মা সন্তুষ্ট থাকেন। কথাটা শুনে টুক করে আমার চোখ থেকে এক ফোটা জল গড়িয়ে পরেছিলো। কিন্তু সবার নজরের আড়ালে।

আম্মা তুতুলকে যাই বলে না কেনো তুতুল শুনে না। সে তার ইচ্ছে মত সারাবাড়ি দৌড়ে বেড়ায়। আর তার সাথে আমিও দৌড়ি। আম্মাকে সাহস নিয়ে সেদিন জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা আম্মা তুতুল কি…মানে তুতুল সম্পর্কে আপনাদের কি হয়?’

আমার প্রশ্নে আম্মার মুখ মলিন হয়ে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘আমার বড় ছেলের মেয়ে। আমার নাতনি’

অবাক হয়ে তাকালাম। বড় ছেলে মানে! বড় ছেলে কে? রায়ানের বড় ভাইও আছে?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here