আছি_তোমার_পাশে,পর্ব ১৩
লেখা- Anjum_Tuli
পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে। সেই উত্তেজনায় হাজার খানেক টেনশন নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলাম। কারণ বিয়ের পর থেকে আমি পড়ালেখা থেকে শ’মাইল দূরে ছিলাম। রায়ান অফিস থেকে ফিরে আমাকে পড়তে বসা দেখে অবাক হয়ে চেয়ে থেকে নিরবে প্রস্থান করলো। আবার ফিরে এসে বলল,
‘তুমি কি সত্যিই পড়তে বসেছো?’
আশ্চর্য এখানে সত্য মিথ্যার কি আছে? আমি ব্রু কুচকে বললাম,
‘চোখে কি কম দেখছেন?’
রায়ান মিটিমিটি হেসে বললো,
‘না বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো।‘
আমি মেকি রাগ দেখিয়ে বললাম,
‘কি বললেন?’
রায়ান তুতুলের কপালে চুমু খেয়ে বললো,
‘কিছু না’
কথাটা বলতেই রায়ানের হাসি হাসি মুখটা গায়েব হয়ে গেলো। চিন্তিত সুরে বললো,
‘আচ্ছা তুতুলের গা গরম হয়ে আছে কেনো? কখন ঘুমিয়েছে?’
আমি বললাম, ‘এই তো ঘন্টা খানেক আগে।‘
রায়ান আবারো তুতুলের কপাল স্পর্শ করে বললো,
‘মনে হচ্ছে জ্বর এসেছে, একটু দেখবে রোদু?’
রায়ানের অসহায় কন্ঠ। আমি এগিয়ে গিয়ে গায়ে হাত দিতেই অবাক হলাম। সত্যিই তো গা বেশ গরম। কই ঘুম পাড়ানোর সময়ও তো এত গরম ছিলো না। হুট করেই গরম হয়ে গেলো। আজকে তুতুল বেশ যন্ত্রনা করেছে। টুনির মা আসতেই আমাকে বলেছিলো। আমি আসতেই আমার সাথে একদম মিশে রয়েছিলো বাচ্চাটা। একটু কোলে রাখতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। রায়ান মেডিসিন নিয়ে এসে বললো,
‘ওকে উঠাও তো রোদু। মেডিসিন খায়িয়ে দেই। এমনিতেও অসুস্থ হলে একদম নিরব হয়ে যায়।‘
আমি আলতু হাতে ডাকলাম,
‘মাম্মা উঠো তো’
কিন্তু তুতুলের কোনো নড়চড় নেই। রায়ান আলতো থাপড় দিলেও সে কোনো সাড়া দেয় না। এবারে ভেতরে ভয় ঢুকে যায়। কি হয়ে গেলো?
রায়ান আমার দিকে তাকিয়ে আর এক মুহুর্তও দেরী করলো না। তুতুলকে কোলে নিয়ে গাড়ির চাবি নিয়ে উঠে বললো,
‘রোদু চলো। হস্পিটালে যেতে হবে।‘
রায়ানের ভেতর ভয় হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি।আমার নিজের বুকের ধুকবুকানিও যেনো বেড়ে গেলো। কিছু না ভেবেই গায়ের জামার সাথে ওরনাটা ভালো ভাবে জড়িয়ে নিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিলাম। রায়ান ড্রাইভ করছে।
হস্পিটালে পৌছে ডাক্তার চ্যাকাপের পরই ভর্তি দিলো। সাথে কিছু টেস্ট। নার্স তুতুলের ব্লাড নিয়ে গেলো সাথে সেলাইন পুশ করে গেলো। এই টুকু শরীরে সুইয়ের ঘা’টা যেনো আমার বুকে লাগছিলো। চোখ থেকে টুপ করে এক ফোটা পানি পরলো রায়ানের। আমি কাধে হাত রাখলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘কি হয়ে গেলো তুতুলের রোদু?’
আমি আশ্বস্ত করলাম। বললাম, ‘আমাদের তুতুলের কিচ্ছু হবে না।‘
কথাটা বললেও টেনশন আমায় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। ডাক্তার সেলাইনের মাধ্যমে মেডিসিন পুশ করলো। রায়ান কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করলে বললেন,
‘চিন্তা করবেন না। কিছুক্ষনের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে। আপনারা অপেক্ষা করুন।‘
অপেক্ষা। বিপদের সময় এই অপেক্ষা নামক শব্দটা যেমন ভীষণ ভারী পরে যায়। আমি তুতুলের বেডে বসলাম। আর রায়ান পাশে একটা টুল টেনে বসলো।
রায়ান আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘কেনো তকদির আমাকে বার বার একই জায়গায় এনে দাড় করায় রোদু’
তার কথার মর্মাথ ধরতে আমার একটুও কষ্ট হয় নি । এই মুহুর্তে এসব নিয়ে কথা বললে রায়ান আরো বেশি ভেঙ্গে পরবে। তাই আমি কেবল আশ্বস্ত করলাম যে, ‘আমাদের তুতুলের কিচ্ছু হবে না’
রায়ান আবারো বললো, ‘আচ্ছা রোদু তুতুলের সত্যি কিছু হবে না তো!
আমি তার দু হাত হাতের মুঠোয় এনে বললাম, ‘উহু কিচ্ছু হবে না।‘
‘আচ্ছা রোদু ভাই……ভাই যে তুতুলের কথা জানে না। না জানিয়ে কি আমি খুব অন্যায় করেছি। মা কেনো বার বার বলছে তুতুল সায়ান ভাইয়ের সন্তান আমার নয়। মা কেনো আমাকে বুঝতে চায় না রোদু। আমি মায়ের একটা কথাও তো ফেলি না তবে? তবে কি কারণে মায়ের পছন্দের ছেলের জায়গায় সর্বদা সায়ান ভাই থাকে?’
রায়ানের ভাঙ্গা স্বর। এ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। তাই হাতটা কেবল আক্রেই ধরে রাখলাম। রায়ান হাত সরিয়ে তুতুলের কপালে আলতু চুমু খেলো। তুতুল নড়ে উঠলো। আমি সেলাইনের হাতটা ধরলাম। রক্ত না বেরিয়ে যায় এই ভয়ে।
ডাক্তার এসে বললো, ‘টেস্টের রিপোর্ট দেখে বুঝা যাচ্ছে, বাচ্চার নিউমোনিয়া, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আমরা তুতুলকে চাইল্ড কেয়ারে স্থানান্তর করবো। কারণ যেকোনো মুহুর্তে অক্সিজেনের প্রয়োজন হতে পারে।‘
তারপর মুহুর্তেই তুতুলকে স্থানান্তর করা হলো। বাচ্চাটা পিটপিট করে তাকিয়েছে। কথা বলেছি। শরীর দুর্বল আর ঔষকের প্রতিক্রিয়ায় আবারো ঘুমিয়ে গেছে। সন্ধায় আম্মা এসেছিলো। জোর করে রায়ান তাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই তুতুলকে পছন্দ না করা আম্মার চোখে আমি আজ পানি দেখেছি। আমি তাকিয়েছিলাম। নিশ্চুপ ছিলাম। কিছু বলি নি। রায়ান জোর করে আম্মাকে পাঠিয়ে দিলো বাসায়। হাসপাতালের পাশের টং থেকে ব্রেড আর কলা নিয়ে এসে জোর করে রায়ানকে খাওয়ালাম। আমি জানি সে সেই দুপুর থেকে কিছুই মুখে তুলে নি।
ঘড়ির কাটা টুং টুং শব্ধ করে গভীর রাতের জানান দিলো। রাত ১২টা বাজে। তুতুলকে এক পলক দেখে এসে রায়ানের পাশে বসলাম। আমি বসতেই রায়ান আমার কাধে মাথা দিয়ে রাখলো। আমি আলতু হাতে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকলাম।
রায়ান হঠাৎ বললো, ‘রোদুসির মা ফোন দিয়েছিলো। তুতুলের কথা জানতে চেয়েছিলো। আমি তুতুলের অসুস্থতার কথা জানাই নি।‘
আমি বললাম, ‘আচ্ছা ভালো করেছো। এমনিতেও এই মহিলাকে আমার ভালো লাগেনি।‘
রায়ান উঠে বসে আমাকে বললো, ‘উনি আমার কাছ থেকে তুতুলকে কেড়ে নিতে চায় । আমি দিবো না।‘
আমি বললাম, ‘তুতুল আমাদের মেয়ে। কেনো দিবো? দিব না তো’
রায়ান খুশি হলো। বললো, ‘ তুতুলের জন্মের পর তুতুলকে এতিম খানায় পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলো। আমার জন্য পারে নি। রোদুসিক্র নানা ভাবে ফোর্স করেছে এবর্শন করার জন্য। তাও পারে নি। এখন আবার কেনো এমন করছে বলো তো? ‘
আসলেই তো কেনো এমন করছেন । উনি কি চান? আমি রায়ানকে বললাম, ‘তুমি কি কিছু আন্দাজ করতে পারছো? মানে এক দিকে হিসেব করলে সায়ান ভাইয়ের সাথে কিন্তু রোদুসির বিয়ে হয় নি। তাই…’
রায়ান কড়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুতুল আমার মেয়ে রোদু।‘
আমি আলতো হেসে বললাম, ‘বাস্তবতা বুঝার চেষ্টা করো। উনি ঠিক কেনো এমন করছেন খুজার চেষ্টা করো। তাছাড়া দেখো রোদুর সাথে করা অপরাধের শাস্তি সায়ান ভাই পেলো। কিন্তু সায়ান ভাইকে দিয়ে কেনো রোদুসিকে তুলে নেয়া হয়েছিলো সেটা তো অজানা তাই না?’
রায়ান বললো, ‘অজানা নয় রোদু। অজানা নয়।‘
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘মানে?’
‘রোদুসির আপন চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো রোদুসির চাচা। কিন্তু তার চাচাতো ভাই ছিলো ড্রাগ এডিক্টেড নেশাখোর। তাই আংকেল না করে দেন। এথেকেই তাদের মধ্যে সম্পর্কের মনমালিন্য শুরু হয়। প্রায় প্রতিদিনই রোদুসিকে ছেলেটা উত্যক্ত করতো। রোদুসি আমার কাছে এসব কিছুই গোপন করে যায়।পরে কেইসের থ্রোতে জানতে পারলেও রোদুসিকে বলি না এসব আর।
রোদুসিকে একদিন চ্যাকাপে নিয়ে গিয়েছিলাম হাসপাতালে। সে তখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। হাসপাতালের করিডোরে কাকে দেখে যেনো আমার হাত খামচে ধরে।আমি তাকালে দেখলাম ভয় পাচ্ছে। বাসায় গেলে বলে সে ফয়সাল। মানে তার সেই চাচাত ভাই। সাথে সাথে পুলিশে ইনফর্ম করি। বাট খুজে পাওয়া যায় নি।
সায়ান ভাইয়ের সাথের লোকগুলা থেকে কেইস চলাকালীন জানা যায় ঐ মেইন কালপ্রিট। সে’ই মোটা অংকের টাকা দিয়েছিলো তাদের দলের লিডারকে রোদসীকে ধরে আনার জন্য। পুলিশ অনেক খোজা খোজি করেও তাকে পায় নি। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো রোদুসিকে ফয়সালের হাতে তুলে দিবে। কিন্তু এর মধ্যেই সায়ান ভাইয়ের সাথে এতসব ঘটে যায়। আর ফয়সাল আর তার পুরো পরিবার পলাতক থাকে।‘
আমি বললাম, ‘এভাবে আসল অপরাধী পালিয়ে যাবে? আর তাছাড়া ঐ ফয়সালের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য কিডনাপ করলে কেনোই বা সায়ান ভাইয়ের সাথে এমন করলো?’
রায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘সবগুলাই তো নেশায় বুধ ছিলো। আর নেশারত অবস্থায় তারা সায়ান ভাইয়ের সাথে এই বিকৃত মজা নেয় সায়ান ভাই রোদুসিকে বাচাতে চাইলে। তাও ভালো ছিলো রোদু , আমার রোদুসিটাকে জানোয়ার গুলো খুবলে খায় নি’
একজন প্রেমিক ঠিক কতটা অসহায় হলে এমন কথা বলতে পারে? ঠিক কতটা? রায়ান যতবার রোদুসির কথা বলে ততবার কাদে। একটা মানুষ নির্সার্থভাবে কেবল ভালোবেসেই গেলো। দুনিয়ায় পাপীরাই কেনো বেচে যায়? আর অসহায়রাই কেনো ভুগ্তভোগী হয়?
চলবে……