আছি_তোমার_পাশে,পর্ব ২
লেখায়- Anjum_Tuli
বড় ছেলে মানে! বড় ছেলে কে? রায়ানের বড় ভাইও আছে?
আম্মাকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, ‘আম্মা বড় ছেলে মানে আপনার আরেকজন ছেলে আছে?’
আম্মা এবারেও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘হ্যা মা, আমার বড় ছেলে সায়ান’
কথাটা বলে শাড়ির আচলে চোখ মুখ মুছলেন। এতটুকু কথা বলেই যেনো উনি হাপিয়ে উঠেছেন। তাই আর কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না। ধীরে ধীরে জানা যাবে। কিন্তু বিয়ের সময় পরিবারের পরিচয় দিতে গিয়ে কেবল রায়ানের কথাই কেনো বলেছিলেন আমি ঠিক হিসেবটা মিলাতে পারছিলাম না। উনার যদি বড় ছেলে থাকেই তবে এখানে লুকানোর কি আছে?
রায়ান অফিসে যায় আসে। সে ফিরে আসলে শার্ট প্যান্ট ধুয়ে দেয়া অথবা শুকাতে দেওয়া। যাওয়ার সময় শার্ট কোর্ট টাই এগিয়ে দেওয়া। এই ছোট ছোট কাজগুলা করতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। তবে নিজে সশরীরে গিয়ে রায়ানকে কিছু দিতে পারি না। তার সামনে গেলেই তার গম্ভীর আর রাগী চাহনী আমাকে শত শত আঘাত করে। তাই আরালেই তার ছোট ছোট কাজগুলি করে মনের তৃপ্তি অর্জন করি।
এই এক মাসে না রায়ানের বড় ভাই সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছি। আর না এ বিষয়ে এ বাড়িতে কোনো কথা হয়। সব যেনো থমথমে হয়ে থাকে। আমি আর তুতুলই কেবল সারা বাড়িতে দৌড়ে বেড়াই। আমার আর তুতুলের সম্পর্কটা এখন ঠিক মা আর মেয়ের মত হয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারি তুতুলের সাথে আমার আচার ব্যাবহার সবটাই সে লক্ষ্য করে। মানে আমার একমাত্র বর রায়ান সাহেব। তুতুল যখন রায়ান ফিরে আসলেই তার সাথে গল্পের পশরা সাজায়। আমি আড়াল থেকে দেখি ঐ গম্ভীর হৃদয়হীন লোকটা প্রশান্তির হাসি হাসে। যেনো সে নিশ্চিন্ত।
গত শুক্রবারে বেশ কিছু মানুষদের নিমন্ত্রন করানো হয়। আমি আম্মাকে বার বার জিজ্ঞাসা করি উপলক্ষ্য টা কি! কিন্তু আম্মা বার বারই বলেন এমনি। কিন্তু না। তাদের ব্যাবহার আমাকে অবাক করে। বাড়ির সামনে সারা উঠোন জুড়ে ছোট ছোট বাচ্চারা খায়। মূলত এতিম বাচ্চারা। রায়ান তুতুলকে কোলে নিয়ে হেটে হেটে তদারকি করে। সেদিন তুতুলের খুশি দেখে কে!
আমার খালা শাশুড়ী দরজায় দাঁড়িয়ে বলতে থাকেন, ‘পরের ছেলে মেয়ে নিয়ে এত যে কিসের আদিক্ষেতা’
কথাটা স্পষ্ট আমার কানে আসে। আমি তৎক্ষনাৎ ফিরে তাকাই। চমকাই। মহিলা আমাকে দেখেই যেনো ভূত দেখার মত চমকে উঠে। আমতা আমতা করে বলেন, ‘আরে বৌমা যে! ভালো আছো মা? এসেই কাজে লেগে পরেছি তুমার খোজ টাও নিতে পারলাম না।’
আমি হাসলাম। বললাম, ‘হ্যা খালা ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?’
কোশল বিনয়াদি শেষে খালা চলে যান। যেনো যেতে পেরেই তিনি বেচে গেছেন। মূলত সেদিনের আয়োজনের কিছুতেই আম্মা আমাকে ছুতে দেয় নি। সামান্য খেজুরের থালাটা এগিয়ে দিয়েছিলাম বলেও রাগারাগি করেছেন। শুধু আমি না উনি নিজেও উনার রুম থেকে বের হন নি। কেনো তা কেবল উনিই ভালো জানেন। আমি খেয়াল করেছি তুতুলকেও উনি পছন্দ করেন না। এর কারণ গুলো আমি খুজে বের করতে পারছি না। তবে মনে মনে এটে রেখেছি প্রশ্নগুলো রায়ানকেই করবো। কিন্তু সেই সুযূগটাই হচ্ছে না। আমাদের সম্পর্ক টা কিছুতেই এগুচ্ছে না। ঠিক তাও না আমার মনে হয় রায়ান এগুতে দিচ্ছে না। কোনো এক বাধা আমাদের সম্পর্কে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আচ্ছা আমি কি এই বাধা সরাতে আদৌ সক্ষম হবো?
প্রতিদিন আমার আর রায়ানের মাঝে বর্ডার হয়ে তুতুল ঘুমায়। শাশুড়ী মা হাজার চেষ্টা করেও তাকে নিয়ে যেতে পারেন নি। তা ভয় দেখিয়েই হোক কিংবা আদরে। রায়ানের সামনে চাইলেও শাশুড়ী মা ভয় দেখাতে পারেন না। না পারেন বকাবকি করতে। তাই বাচ্চা তুতুলটারও যেনো সাহস তখন বেড়ে যায়। রায়ানের গলা জড়িয়ে কেবল জপতে থাকে, ‘পাপা ঘুমু দেব’
সে যে পাপার সাথে ঘুমাতে কতটা ইচ্ছুক তা বুঝাতে চেষ্টা করে। আর এতেই যথেষ্ট। রায়ান থেকে আর শত চেষ্টায়ও তাকে সরানো যাবে না। বাচ্চা তুতুলের মায়া ভর্তি কথাগুলো শুনলে আমার নিজেরও মনে মানে না সে চলে যাক। আরো যেখানে আমি জানি মা তাকে পছন্দ করে না। আজ কাল তুতুলকে মা বকা দিলেও আমার খারাপ লাগে। বাচ্চা মেয়েটা দৌড়ে এসে আমার পা খামচে ধরে লুকানোর চেষ্টা করে।
এতদিনে আমি এটা খুব ভালো করেই বুঝে গেছি যে রায়ানের কলিজা হলো তুতুল। তুতুলের এদিক সেদিক কিছুই সে সহ্য করতে পারে না। সামান্য পরে গিয়ে ব্যাথা পেলেও রায়ানের কপালে চিন্তার ভাজ পরে। মনে হয় ব্যাথাটা তুতুল না সে পাচ্ছে। মাঝে মাঝে ভাবি আচ্ছা রায়ানের মনের অন্ত স্থলে পৌছুনোর রাস্তা কি তুতুল?
একটা মাস এই বাড়িটাতে যে কিভাবে কাটালাম জানি না। অবাক করা বিষয় হলো বিয়ের দুদিন পর রায়ান আমাকে একদিনের জন্য বাবার বাসায় নিয়ে গিয়েছিলো। এর ভিতর আর ওবাড়িতেও যাওয়া হয় নি। যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেও মায়ের এক কথা, ‘আমাকে কেনো বলছো? রায়ানকে বলো’
মা’কে কিভাবে বুঝাই। রায়ানের সাথে প্রয়োজনের বাইরে কোনো কথাই বলা হয় না। হয়ে উঠে না। সে চায় না। কিংবা চায়! তবুও হয় না।
মাঝে মাঝে মনে হয় স্বামীর ঘরে এসে রেডিমিট বাচ্চা পেয়েছি। আবার এটাও ভাবনায় এসে উকি দেয়, আচ্ছা আমি ছাড়া অন্য মেয়ে হলে কি এতদিন সংসারে থাকতো? এ বাড়িতে নিজেকে মেহমান মনে হয় আবার মনে হয় না এটা আমার সংসার। কেবলি আমার।
রোজকার একটা রুটিন হয়ে গেছে। ভোরে উঠে নাস্তা বানানো। তুতুলকে খাওয়ানো। তারপর? হাস্যকর হলেও সত্য দূর থেকে রায়ানের দিকে তাকিয়ে থাকাও প্রতিদিনের একটা রুটিন। শাশুড়ী মা নানা কথা বলেন। উনি ইন ডাইরেক্টলি আমাকে সম্পর্ক আগানোর পরামর্শই দেন আমি বুঝি। আমি উনাকে বুঝতে দেই না। বলি এগুচ্ছে। আছে ঠিকঠাক। কিন্তু উনি ঠাওর করতে পারেন আমাদের চলাফেরায়ই।
সামান্য সকালের গ্রিণ টি টাও আমি নিয়ে যাই না রায়ানের কাছে। এটাও টুনির মা দিয়ে আসে। উনি এ বাড়িতে পার্মানেন্ট ভাবেই থাকেন। সবার সব কাজেই হ্যাল্প করেন। বেশ হাসি খুশি প্রানোচ্ছল মহিলা। নিসন্তান বিধবা হলেও তার মাঝে আমি এ নিয়ে কখনো দুঃখ কিংবা আফসোস দেখি নি। মাঝে মাঝে ভাবি। ভাবতে বাধ্য হই। মানুষ কত ভাবেই না সুখ খুজে নিতে পারে। আমার পরিবার টাও তো মন্দ্য নয়। তুতুলকে নিয়ে আমার বেশ দিন যায়। আবার বুকের ভিতর ধক করে উঠে। তুতুল তো আমার নিজের মেয়ে নয়!
আমাদের রুমের কোণায় কোণায় আমার স্পর্শ। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় আচ্ছা রায়ান আমাকে নিজের স্ত্রী মানে তো! তিন কবুলের জোড়ে হলেও আমি তার স্ত্রী মানতে বাধ্য বলে মনকে বুঝ দেই। এভাবেই আমার বিবাহিত জীবনের একমাস পেরিয়ে গেলো।
হঠাৎ পানির কলের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। তাকিয়ে বুঝতে পারলাম রায়ান উঠে গেছে। ঘড়িতে ৫টা বাজে। ঘুম সরে যাওয়ায় উঠে পরলাম। ফজরের নামাজটা ঘুমের কারণে বেশির ভাগ কাজা হয়। রায়ান ওয়াশরুম থেকে বের হলে আমি একদম ওযূ করে ফিরে আসি।
মনের ভেতর অনেকটা সাহস নিয়ে রায়ানকে বলেই ফেলি, ‘উঠেছেন যখন নামাজটা পড়েই ঘুমান?’
কথাটা বলেই লম্বা লম্বা শ্বাস নিলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে রায়ান আবারও ওয়াশরুমে ঢুকে ওযূ করে একদম ফিরে এসে আমার পাশেই জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়েন। মনটা খুশিতে ভরে যায়। ইচ্ছে হয় একটা টাইট হাগ দিয়ে বলি ‘ধন্যবাদ রায়ান কথা রাখার জন্য’
কিন্তু হাগ না দিলেও কেবল ‘ধন্যবাদটা সাহস করে দিয়েই দেই।
‘নামাজ একমাত্র আল্লাহকে খুশি করার জন্যই পড়া উচিত। তবে ধন্যবাদটা তুমার প্রাপ্য। আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য।’
রায়ানের উত্তর শুনে আমি অবাক! না না মাত্রা তিরিক্ত অবাক। তাছাড়া সে আমার সাথে গম্ভীর কিংবা রাগান্নিত স্বরে কথা বলে নি। সবকিছু একদম স্বাভাবিক। জোড়ে শ্বাস নিলাম। হ্যাঁ প্রকৃতিতে যেনো কেমন প্রেম প্রেম গন্ধ পাচ্ছি। নিজের কথায় নিজেই হেসে দিলাম।
আমার হাসি দেখে রায়ান দুই ব্রু কুচকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘এভাবে ব্যাক্কেলের মত হাসছো কেনো? তুমি কি ভেবেছো তোমার হাসি খুব সুন্দর? মোটেও না।’
এক কথায়ই আমাকে সাত আসমান থেকে জমিনে নামিয়ে দিলো। সাথে আমার মুখে না না সর্ব অঙ্গে ধরা দিলো কালো মেঘের ছায়া। মানুষটা এমন কেনো! মিথ্যা মিথ্যিও তো প্রশংসা করা যায় নাকি?
আমার ভাবনার জগতেই কথা দিয়ে বাধাগ্রস্ত করলো সে। যখন বললো, ‘আর কি পড়ালেখা করার ইচ্ছে নেই? ব্যাস্ততায় আমার মাথা থেকেও কথাটাও বেড়িয়ে গেছে।’
পড়ালেখা! আদৌ যে আমি এককালে স্টুডেন্ট ছিলাম। কথাটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। তবে নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখেই বললাম, ‘না মানে বলব বলবো ভাবছিলাম’
‘আর বলা হয়ে উঠে নি’
আমার অসমাপ্ত কথাটাকে সেই সমাপ্ত করে দিলো। তারপর, তারপর এতদিনেও যা ঘটে নি। সেই অবাস্তব জিনিসটাই ঘটে গেলো। অহ মাই গড অহ মাই গড!!! এটা আদৌ সম্ভব?
চলবে…