আছি_তোমার_পাশে,পর্ব ৬,৭
লেখায়- Anjum_Tuli
পর্ব ৬
ছোট বেলা থেকেই আমি বেশ আদরে আদরে বড় হয়েছি। বাবা আমার ছোট থেকে ছোট কোন কথাও ফেলতে পারে নি। পরিবারে সবচেয়ে আদরের মেয়ে ছিলাম। আমার ভেতর মেচুরিটির বড্ড অভাব ছিলো। হুট করেই নিজেকে বেশ বড় বড় ফিল হলো ভেতরে যেনো মেচুরিটি ভরপুর। আচ্ছা এর কি কারণ? আমি মা বলে? এ বাড়িতে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত যতটুক না রায়ানের প্রতি টান পড়েছে। তার থেকে শতাধিক বেশি টান, মায়ায় বাধা পড়েছি তুতুলের সাথে। মেয়েটা আমাকে মাম্মা বলে ডাকে। কেমন যেনো মাতৃত্বের স্বাদ পাই। মা না থাকার কষ্ট আমি বুঝি। ভাইকে দেখে বুঝি। আমি আমার বাবার দ্বীতিয় পক্ষের। বাবার প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বাবা ভাইয়ার জন্য আবারো বিয়ে করেন। কিন্তু প্রথম প্রথম ভাইয়া মাকে মা বলে সম্মোধন করে নি। মা’কে মা মানতেই সে নারাজ। তার ধারণা ছিলো মা তাকে মারবে বকবে। মা তার কিছুই করে নি। আবার ভালোবেসে আগলেও নেয় নি। কিছু একটাতে বাধা ছিলো। ভাইয়া এখনো মাকে কিছু বলতে সংকুচ বোধ করে। আমি তখন ভাইয়ার চোখে কষ্ট দেখি। উপলব্ধি করি। মা’কে বুঝাই। মা আমার কথা শুনেও না শুনার ভান করে। কেনো? এমন কেনো করে? নিজের পেটে ধারণ না করলে কি মা হওয়া যায় না?
তুতুলের প্রতি আমার টানটা ঠিক কেমন তা জানি না। তবে তুতুলকে কাছে টেনে আনলে কোলে নিলে সে আমার গায়ের গন্ধ শুকে। গালে গাল ঘষে। দুহাতে আমাকে তার ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। একদম আমার সাথে মিশে থাকে। এই বাচ্চাটা এতটা মায়াবী কেনো? তার সাথে আমার সম্পর্ক কি? কিছুই না। তবে কি আমি তার মা না? মা হতে পারবো না? মা হতে গেলে কি নিজের গর্ভে ধারণ করে জন্ম দিতেই হয়?
আম্মা যেদিন আমাকে বলেছিলো তুতুল সায়ানের মেয়ে। উনার চোখে মুখে আমি কোনো অস্বস্থি কিংবা অপরাধবোধ দেখি নি। কথাটা ছিলো স্পষ্ট। সেদিনই আমি বুঝেছি কিছু একটা আমার থেকে আম্মা আর রায়ান লুকালেও তুতুল রায়ানের মেয়ে না।
টুনির মায়ের সাথে রান্না ঘরে বেশির ভাগ সময়ই কাজ করা হয়। তুতুলকে নিয়ে বলে, আহারে মাইয়াডার লাইগা যেই কষ্ট লাগে। কেউ নাই মাইয়াডার। প্রতিবাদ করি বলি আছি আমি আছি। রায়ান আছে। টুনির মা আমার দিকে তাকায়। মাথায় হাত দেয়। টলমলে চোখে বলে তুমি এত ভালো কেন গো? এর উত্তর আমার কাছে নেই। আমি ভালো, মহান নাকি খারাপ জানি না। তবে আমি আমার মত। বাবা মা বড় আশা নিয়ে মেয়েকে শশুড় বাড়ি পাঠায়। তা দু একদিন সংসার করার জন্য নয়। বরং সারাজীবনের জন্য। তাছাড়া আমি এই পরিবারের মায়ায় পরেছি। আমার তুতুলের মায়ায় পড়েছি। আর আমার জনাবের ভালোবাসার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। আমি বুঝতে পারছি। রায়ানের কোনো এক অতীত আছে। যা তাকে পীড়া দেয়। আমারও আছে। সেদিনের কথা আমার মনে পরলেই বুক ধক করে উঠে। ভাইয়া না থাকলে এই আমি আর কখনোই এখানে এসে পৌছুতাম না। তাহলে! রায়ানের অতীতের কালো অধ্যায় মুছে বর্তমান নিয়ে কি আমি ভালো থাকতে পারি না? অবশ্যই পারি। আমি হারতে শিখি নি। পরাজয়ের গ্লানি মেখে রোদফাটা দুপুরে হাহাকার করার মেয়ে আমি নই। আমি আমার পরিবারের ঢাল হয়ে থাকবো।
কফি মেকার থেকে কফি নামিয়ে বারান্দায় গেলাম। জনাব চোখ বন্ধ করে দেয়ালে হ্যালান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। অথচ আমার ঘুম হারাম করে কফি বানাতে পাঠালো। পাশে বসলাম। ধোয়া উঠা গরম কফির মগে চুমুক দিতেই মুখ বিতৃষ্ণায় তেতু হয়ে উঠলো। শব্দ করলাম না। পাছে না রায়ানের ঘুম ভেঙ্গে যায়। পাশে বসে পরলাম। আর ঘুমেরা দল বেধে এসে নিমন্ত্রন করলো। আয় কাছে আয়। আয় আয়।
চমৎকার সুন্দর এক সকাল দেখলাম। আযানের প্রতিধ্বনি কানে এসে বাড়ি দিলো। রায়ানের দিকে তাকিয়ে দেখি এখনো ঘুমাচ্ছে। উঠে বসতেই ঘাড়ে ব্যাথা অনুভব করলাম। এভাবে বসে ঘুমানোর বাজে প্রভাব পরলো। আমার ঘাড়ের বারোটা বেজে গেলো। এভাবে আর কিছুক্ষন রায়ান শুয়ে থাকলে আরো কষ্ট হবে। আলতো করে তাকে ডাকলাম। এক ডাকেই ধরফরিয়ে উঠলো। সকাল হয়ে গেছে বুঝতে পেরে কি জানি মনে করার চেষ্টা করলো। উঠে দাঁড়িয়ে ছোট্ট একটা শধ উচ্চারণ করলো। ‘সরি’। ব্যাস এইটুকই তারপর চলে গেলো রুমে। কি হলো টা কি তার?
রায়ান অফিসে। আমি তুতুলের চুল বেধে দিচ্ছি। বাচ্চাটা আয়নার সামনে গিয়ে দুই ঝুটি দুই হাত দিয়ে টেনে টেনে দেখছে। আর খিলখিলিয়ে হাসছে। আমাকে ডেকে বলল,
‘মাম্মা দেতো, সুন্নর’
বলেই ছোট ছোট দুই হাত দিয়ে মুখ ডেকে রেখে লজ্জা পাচ্ছে।
আমি হেসে দিলাম। গাল টেনে দিলাম। বললাম, ‘ইস! মা টা লজ্জা পাচ্ছে।’
সেও আমার গাল টেনে দিয়ে বলল,’ মাম্মা নজ্জা নজ্জা’
আমরা মা মেয়ের খুনসুটিতে সময় পেরিয়ে গেলো। দুপুরে মা বাবা ভাইয়া আসবে। রান্না বাড়া সেরে তুতুলকে তৈরি করে দিলাম। মেয়েটা আজ আমার উড়নাই ছাড়ছে না। আমার পিছু পিছু টুকটুক করে হাটছে।
খাবারের সময় রায়ান বাসায় ফিরলো। আম্মা কড়া হুমকি দিয়ে বাসায় নিয়ে এসেছেন। মা বাবা প্রথম এসেছেন বলে। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষে বাবা রায়ানের হাতে দুটো টিকেট দিলেন। কক্সবাজার ঘুরে আসার জন্য। রায়ান প্রথমে নিতে নারাজ হলেও পরে নিলো। আমি জানি বাবা তুতুলের জন্য টিকেট দেয় নি বলেই রায়ানের চেহারায় একটা মলিন চিহ্ন প্রকাশ পেয়েছে।
বাবা মা চলে যাওয়ার পর আমি রায়ানকে বললাম, ‘আমি যাবো না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।’
রায়ান অবাক হয়ে বললো, ‘কেনো যাবে না কেনো? পরে তোমার বাবা আমাকে বলুক উনার দেয়া উপহারের অসম্মান করেছি আমি?’
তার কথায় কিছুটা রাগ মিশ্রিত ছিলো। আশ্চর্য আমি কখন তা বলেছি? আমি নরম হয়ে বললাম, ‘আমি এমন কিছু বুঝাই নি। ‘
বুঝলাম না তার হঠাৎ রাগের কি কারণ। আর কথাই বলল না বেড়িয়ে গেলো। কি জানি কেনো কষ্ট লেগে গেলো।
বিকালে রায়ান আর আম্মার মধ্যে তুমুল ঝগড়া লেগে গেলো। আম্মা যেনো কোথায় যেতে চাচ্ছেন। কিন্তু রায়ান নিয়ে যেতে নারাজ। আম্মা বার বার শুধু এতুটুকুই বলছেন, ‘একবার চোখের দেখা দেখেই চলে আসবো বাবা’
রায়ানের এক কথা, ‘কোনো খুনির সাথে এ পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই’
আমি তাদের কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আম্মার সামনে গিয়ে বললাম, ‘কোথায় যাবেন আম্মা?’
আম্মা চোখের পানি মুছে বললেন, ‘সায়ানটাকে কতদিন দেখি না রে মা। একটাবার চোখের দেখাটাও দেখতে দেয় না এই পাষাণ হৃদয়ের ছেলেটা। আমি ত মা। এতগুলা বছর। কম সাজা তো পায়নি ছেলেটা।’
মাকে দেখে দুঃখ লাগছে। রায়ানের দিকে তাকালাম। কোলে তুতুল। খুব মনোযোগের সাথে সে রায়ানের শার্টের পকেটে একবার কলম ঢুকাচ্ছে তো একবার বের করছে।
আম্মা বলল, ‘তুতুলটাকে দেখার ইচ্ছাও তো সায়ানের হয় নাকি!’
রায়ান তাচ্ছিল্য হেসে বলল, ‘না হয় না। কারণ তুতুল আমার মেয়ে’
আমি আম্মাকে বললাম, ‘উনি কোথায় আম্মা। আমাকে বলেন আমি নিয়ে যাই’
আম্মা রায়ানের দিকে তাকালো। রায়ান বিরক্ত হয়ে বলল, ‘রেডি হয়ে থেকো কাল নিয়ে যাবো’
কাল নিয়ে যাবো কথাটাতেই আম্মা খুশি হয়েছে তা বেশ বুঝা যাচ্ছে। আমি আম্মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সায়ান ভাই এখানে থাকে না কেন আম্মা? উনি কই থাকেন?’
আম্মা আমার কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, ‘অতি সুখ আমার কপালে সয় নি বউমা সয়নি’
বলে রুমের দিকে হাটা ধরলেন। রায়ানের কাছে গেলাম। সে উপুর হয়ে শুয়ে আছে। আর তুতুল রায়ানের পিঠে উঠে খেলছে। আমি বেডে বসে বললাম, ‘কালকে রাতের অসমাপ্ত কথাগুলো বলবেন না?’
রায়ান আমার দিকে তাকালো। বলল, ‘বলবো, আমাকে একটু সময় দাও’
মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম। আর অপেক্ষায় থাকলাম তার চেয়ে নেয়া সময়ের সমাপ্তির।
চলবে…
#আছি_তোমার_পাশে
পর্ব ৭
লেখায়- #Anjum_Tuli
বহুদিন পর প্রতিক্ষিত এক সূর্যের দেখা পেলাম। ভোরের আলোয় তার লালছে আভা যেনো আমায়ও আলোকিত করছে।
সায়ান ভাইয়ের সাথে দেখা করে আসার আজ দুদিন। সেদিন যখন কেন্দ্রীয় কারাগাড়ের সামনে রায়ান নিয়ে গেলো। বুকটা ধক করে উঠলো। আশ্চর্য রায়ান এখানে এসেছে কেনো? মনের মধ্যে কেবল এই কথাটাই বার বার প্রতিধ্বনি হচ্ছিলো। আমার ভেতরে ভয় আতংক কৌতূহল সব একসাথে ধরা দিতে লাগলো। রায়ান পার্মিশন নিয়ে মাকে নিয়ে ভেতরে গেলো। আমি যেতে চাইলেও সে দেয় নি। নিয়ম নেই বলে ধমক দিয়ে বাইয়ে দাড় করিয়ে রেখেছে। জেদ ধরে আমি তাদের সাথে গিয়েছিলাম। রায়ান কোনো ভাবেই সেখানে নিয়ে যেতে নারাজ। মা সায়ান ভাইয়ের সাথে দেখা করে আসার পর কেমন মলিন মুখে গাড়িতে গিয়ে বসলেন। আমি তাদের মা ছেলেকে বার বার লক্ষ্য করছিলাম। তুতুল বায়না ধরলো ‘আইত্তিম আইত্তিম’ বলে। সে আইসক্রিম খাবে। আইসক্রিম পার্লারটার পাশেই একটা হস্পিটাল। রায়ান আমাকে ইশারা করে বললো, ‘ঐ যে ঐখানে, হ্যাঁ ওখানেই। ওখানেই আমার তুতুলের মা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে।’
আমি তাকালাম। আবার রায়ানের দিকে তাকালাম। তার চোখে মুখে হারানোর বেদনা। সেই মুহুর্তে আমি তাকে কিছুই জিজ্ঞাসা করলাম না। করতে ইচ্ছাও হলো না। তবে ভেতরে এক চাপা কষ্ট অনুভব করলাম। রায়ান কাউকে ভালোবাসতো? তাহলে কি তুতুলের মা’ই সে? কিন্তু কিভাবে? অজানা ভয় গুলো সেই মুহুর্তে আমাকে ঘায়েল করে যাচ্ছিলো।
রাতের বেলা তুতুলকে ঘুম পাড়ানোর পর। রায়ান নিজ থেকেই বলল, ‘অসমাপ্ত কথাগুলো শুনবে না?’
আমি সায় দিলাম। চাদের আলোয় বারান্দা একদম লাইটের মতই উজ্জ্বল ছিলো। স্পষ্ট ছিলো রায়ানের মুখমন্ডল। মলিন মুখে সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
সেদিন বাসে মেয়েটির কথা শুনে আমি যখন বেকুব বনে গেলাম। মেয়েটি হেসে চলে গেলো। যেনো কোনো জোকস বলে ফেললো সে আমায়। তবে যাওয়ার আগে আমার দিকে একটা কাগজ ছূড়ে গেলো। যাতে গোটা অক্ষরে লেখা ‘রোদুসি”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম। রোদুসি? এটা তো আমার নাম? রায়ান আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘বলেছিলাম না কোনো এক বিশেষ কারণে তোমাকে রোদু বলে ডাকি? কারণ রোদুসি নামে তোমাকে যতবার ডাকবো। ততবারই আমার তার কথা মনে পড়ে যাবে তাই’
বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আমি চুপ করে রইলাম। সে বলল,
এর পর পরীক্ষা চলে আসলো। বেশ ভালো ভাবেই দিলাম। কিন্তু অবাক করা বিষয় মেয়েটিকে প্রায়ই ক্যাম্পাসে দেখতাম। একদিন আমাদের সিনিয়র একজন ভাই এসে আমাকে রিকুয়েস্ট করলো যাতে করে আমি তার মামাতো বোনকে পড়াই। ভাবলাম ভালোই হবে। হাত খরচের টাকাটাও চলে আসবে এ থেকে। তাই রাজি হয়ে গেলাম। গেলাম ভাইয়ের সাথে। বাট গিয়ে দেখি ছাত্রী আর কেউ না। সেই রোদুসি। ইন্টারে পড়ুয়া আবেগের ভেলায় ভাসা সদ্য কিশোরী মেয়ে ছিলো সে। তবে তার মায়াবী চেহারায় চটপট কথাগুলোয় আমি হাসতাম। খুব হাসতাম। এক বছর তার নানা রকম যন্ত্রনা সহ্য করে পরে বাধ্য হয়ে টিউশনিটা ছেড়ে দিলাম।
কিন্তু সে এতটাই ডেসপারেট ছিলো যে আমায় ছাড়লো না। ক্যম্পাসে সিনিয়র ভাই যে বললাম উনার সাথে এসে আমার খোজ করতো। আমি হল থেকে বেরুলেই আমার পেছন পেছন আসতো। একদিন এক গাদা বাক্স বাটি নিয়ে এসেছিলো। আমি রাগে এসব ছূড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। এসে কি বলেছিলো জানো? জীবনের প্রথম সে আমার জন্য রান্না করে নিয়ে এসেছে। রাগের মাথায় খাবার গুলো ফেলে দেয়ার পর আফসোস করেছি। মেয়েটা নিতান্তই বাচ্চা। তাকে বোঝানো প্রয়োজন। প্রিতম ভাই মানে সেই সিনিয়র ভাই। রোদুসির রিলেটিভ। তাকে বললাম খুলে সব। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না। উলটো আমাকে খুজে বের করার কাহিনী বললো সে। সেদিন বাসে আমাদের সাথের অনেকের গায়েই বুয়েটের টিশার্ট ছিলো। আরও অবাক করা বিষয় কি জানো? সে তখন আমার ছবিও তুলেছিলো। প্রিতম ভাইকে জালিয়ে সে আমায় খুজে বের করেছে।’ কথাটা বলেই রায়ান হাসলো।
বলল, ‘প্রিতম ভাইকে সব বলার পর উনি বলে রোদুসি নাকি তাকে সব বলেছে।উলটো আমাকে রোদুসির সাথে প্রেম করতে বলে। এও বলে মেয়েটা নাকি খুব বেশি জেদি। তার প্রমাণও পেলাম কিছুদিন পর।
সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল চলে তখন। খুব মনোযোগ দিয়েছি পড়ায়। হঠাৎ একটা ফোন কল আসলো। যা আমার কল্পনায়ও কোনোদিন ছিলো না। রোদুসির বাবা কল দিয়ে বলল রোদুসি সুইসাইড এটেমপ্ট করার চেষ্টা করেছে। আমি যাস্ট কিছু বলার মত অবস্থায় ছিলাম না। তৎক্ষনাৎ ছুটে গেলাম।
হস্পিটালের বেডে শুয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে বাকা হাসলো। পরে বলে সবই নাকি তার প্ল্যান ছিলো। যদি রাজি না হই তাহলে আবারো নিজেকে শেষ করে দিবে। আবেগের বসে আবার কি করে ফেলে এসব ভেবে তখন চুপচাপ তার কথাগুলো শুনছিলাম।
তার বাবা আমাকে আবারো রোদুসিকে পড়ানো কনটিনিউ করতে বলে। তাদের একমাত্র মেয়ের ক্ষতি তারা কোনো ভাবেই চায় না। এমনকি এও বলে দরকার হলে এখনি তারা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিতে প্রস্তুত।
পড়ানো শুরু করলাম। কিন্তু রোদুসির মনোযোগ থাকতো সম্পূর্ণ আমার উপর। তারপরও টেনে টুনে পাশ করে ফেলে। একটা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করাই। তখন থেকে আমি নিজেও রোদুসির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। তার পাগলামু গুলো আমাকে বাধ্য করবছিলো তার প্রেমে পরতে। প্রতিদিন নিজ হাতে আমার জন্য রান্না করে আনতো। একগুচ্ছ লাল গুলাপ এনে বলতো দাও তো দাও এগুলো আমাকে দাও। তার কাছে এগুলোই ছিলো খুশি সুখ। আমার একটু ভালো ব্যাবহারে খুশিতে সে কেদে ফেলতো। ‘
আমার চোখে পানি চলে আসলো। এত ভালোবাসতো মেয়েটা রায়ানকে? রায়ান আমার দিকে তাকিয়ে হাতে একটা টিস্যু দিলো। চোখের পানি মুছলাম।
রায়ান আকাশের দিকে তাকিয়ে আবারো বলতে লাগলো,
‘গ্রাজুয়েশনের পর আমার মাথায় বাইরে যাওয়ার ঝোক চাপলো। যেতে হবে মানে যেতেই হবে। সেই সময়টাতে বাবার ব্যবসার অবস্থাও খুব একটা ভালো না। সংসারের অবস্থা খুব একটা ভালো না। বেশ ভালো একটা জবের অফারও আমি নাকোচ করেছি বিদেশ যাওয়ার আশায়। বাবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন উনি চেষ্টা করবেন। তবে কথা দিতে পারছেন না। ভাই বললো সে টাকা দিবে। আমি তখন অন্য কোনো কিছু ভাবি নি ভাই টাকা দিবে শুনে এতই খুশি হয়েছিলাম যে সে টাকাটা কোথা থেকে পাবে তা একবারও চিন্তা করি নি।
ছয় মাসে সব ধরনের কাজ কমপ্লিট করে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। রোদুসির মনটা প্রায়ই খারাপ থাকতো। সে আমাকে এ নিয়ে কিছু না বললেও হুট করে একদিন বললো ‘চলো বিয়ে করে ফেলি’
রোদুসির মুখের দিকে তাকিয়ে আমি না করতে পারি নি। বরং এটাকে আমার যুক্তিযুক্তই মনে হয়েছে। মা’কে কথাটা জানালে মা না করেন। বাবাও সায় দেন না। সায়ান ভাইয়ের আগে আমার বিয়ে এটা বাবা মা মানতে নারাজ। তাই আমি আর রোদুসি লুকিয়ে কোর্ট ম্যারেজটা করে ফেলবো ভাবলাম। পরে ফিরে এসে সবাইকে জানাবো। দুদিন পর বিয়ের ডেইট ঠিক করলাম। কিন্তু হুট করে বিয়ের দিন সকাল থেকে রোদুসির ফোন সুইচ অফ আসছিলো। আমি কোনো ভাবেই তার কিংবা তার ফ্যামিলির কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। তাদের বাসায় গিয়েও দেখলাম যে তালা।
পাশের বাসার তাদের জিজ্ঞাসা করলে জানায় তারা কাল মানে এর আগের দিন কোথাও গিয়েছে ফিরে নি। রোদুসি বলেছিলো সে তার গ্রামের বাড়ি যাবে। সকালে গিয়ে রাতে ফিরে আসবে। আমার সাথে আর কথা হয় নি। রাতে টায়ার্ড ছিলাম তাই একবারে সকালেই ফোন দিলাম। কোনো ভাবেই তার খোজ আমি পাচ্ছিলাম না। প্রিতম ভাইকে নিয়ে তাদের আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে জিজ্ঞাসা করলেও পাই না। সবাই মোটামোটি টেন্সড ছিলো ব্যাপারটায়। যাবেটাই বা কই? এর মধ্যেই সায়ান ভাইও নেই। মা সায়ান ভাইয়ের জন্য পাগল প্রায় অবস্থা। এদিকে রোদুসির খবরও নেই। আমার যাওয়ার ডেইট ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগলো। এর মধ্যেই একদিন বাবা বুকের ব্যাথায় লুটিয়ে পরেন। হস্পিটালে নিয়ে যাই। যেতেই দেখি..
চলবে…