আছি_তোমার_পাশে,পর্ব ৮,৯
লেখায়- Anjum_Tuli
পর্ব ৮
ওখানে যেতেই রোদুসির বাবার দেখা পাই। বাবাকে এডমিট করে উনার সাথে কথা বলতে গেলে উনি বারবারই আমাকে এড়িয়ে যেতে চান। আন্টি মানে রোদুসির মা কেদে কেদে বলতে থাকেন ‘আমার মেয়েটা শেষ বাবা। শেষ’
উনার কথা আমার বোধগম্য হচ্ছিলো না। কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই উনি আমাকে হাতের ইশারা করেন। এগিয়ে যেতেই গ্লাসের ফাকে চার পাচেক রোগীর মাঝে একটা মুখ স্পষ্টভাবে ভেসে উঠে। সে আর কেউ না রোদুসি। হাতে ব্যান্ডেজ। অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। সারা গায়ে সাদা কাপড়ে ঢাকা। চোখ বুজে শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। কিছু সময়ের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কি কিভাবে কেন তা মাথায় আসে নি এসেছে কেবল ‘মেয়েটা না জানি কতটা কষ্ট পাচ্ছে’
রায়ানের মুখে স্পষ্ট বেদনার ছাপ। মনে হচ্ছে সে তার চোখের সামনেই রোদুসির কষ্টটা উপলব্ধি করতে পাচ্ছে। আমি কাপা কাপা কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিভাবে কি হলো? জিজ্ঞেস করেছিলেন? ‘
‘হু করেছিলাম। রোদুসির মায়ের দিকে তাকাতেই বললেন সেদিন সকালে রোদুসিকে নিয়ে উনারা গ্রামে যাওয়ার জন্য রৌনা দিয়েছিলেন। কিন্তু মাঝপথে কয়েকটা ছেলে নাকি তাদের গাড়িতে হামলা করে। ছেলেগুলোর টার্গেডই ছিলো রোদুসি। তারা রোদুসির বাবা মাকে বেধে ড্রাইভারকে মেরে রোদুসিকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। পুলিশের সহায়তায় রোদুসিকে খুজে পেলেও…. ‘
রায়ান মুখে হাত দিয়ে কেদে দেয়। আমি প্রথমবারের মত এই শক্ত মনের মানুষটার চোখে পানি দেখলাম। কিভাবে শান্তনা দিতে হয় তার ভাষা পাচ্ছিলাম না। কাধে হাত রাখতেই রায়ান আমার দু হাত তার হাতের মুঠোয় এনে বলে, ‘আমায় কেউ বোঝে না রোদু। আমার পাশে কেউ নেই। তুমি থাকবে তো!’
রায়ানের চোখের পানি হৃদয়ের ক্ষতবিক্ষত অবস্থা দেখে আমার চোখের পানিও হার মেনে ঝড়তে লাগলো। মুখে বলতে পারলাম না আছি। আছি তোমার পাশে। সর্ব পরিস্থিতিতে। তবে চোখের ইশারায় আস্থা দিলাম।
রায়ান দম ফেললো। হাত ছাড়লো না। হাত ধরে রেখেই বলল, ‘সি ওয়াজ রেপড।’
কথাটা শুনতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো।
‘পুলিশের ধারণা মতে যারা তুলে নিয়েছিলো কাজটা তাদেরই। বাবার অসুস্থতা রোদুসির অবস্থা সব কিছু মিলিয়ে আমি ভীষণ অসহায় হয়ে পরেছিলাম। ধীরে ধীরে রোদুসি রেসপন্স করতে শুরু করলো। তাকালেই কেবল দু-চোখ দিয়ে পানি পরতো। আমার চোখে চোখ রেখে তাকাতো না। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত।
এদিকে বাবার হার্ট ব্লক ধরা পরে। ডাক্তার ইমিডিয়েট অপারেশনের কথা বলেন। এত টাকা কি করে ম্যানেজ করবো না করবো ভেবেই মাথায় বাশ পরে। সেদিনই বেড়িয়ে পরি। এক ফ্রান্ডের সহায়তায় লোন তোলার চেষ্টা করি। সেদিন একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। কলটা ছিলো ভাইয়ের। উনি আমাকে বলেন টাকা নিয়ে চিন্তা যেনো না করি। আমার একাউন্টে উনি টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন বাবার চিকিৎসায় যেনো কমতি না পরে৷ কথাটা বলেই সে কল কেটে দেয়। যেনো প্রয়োজনের বেশি কিছু বলে ফেলেছে।
সেদিনই বাবার অপারেশনের ব্যাবস্থা করি। অন্য হস্পিটালে ট্রান্সফার করি। এদিকে রোদুসির কথাটা ধীরে ধীরে স্প্রেড হতে থাকে। তাদের আত্মীয়স্বজনরা দেখতে আসে। আমাকে দেখে নানা রকমের প্রশ্ন করে। রোদুসি একদিন রেগে আমাকে বলে, ‘আর কতবার যাওয়ার কথা বলবো? এত বেহায়া কেন তুই? যাহ চলে যা। আমি আর তোর যোগ্য নই। আমি অপবিত্র’
কথাটা আমাকে বিন্দুমাত্র কষ্ট দেয় নি। রোদুসি আমাকে একশ বার তাড়িয়ে দিলেও আমি তার পায়ের কাছে পরে থাকতে রাজি ছিলাম। কিন্তু দিন দিন তার পাগলামু কেবল বেড়েই চলছিলো। বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর নিজেকে ঘর বন্দি করে রাখতো। কারো সাথে কথা বলতো না। তাদের বাড়িতে গেলেই মনে হত যেনো কোনো মৃত্যু পুড়িতে গিয়েছি।
বাবার অপারেশনের পর ডাক্তার বাবাকে রেস্টে থাকতে বললো। বাবাকে বাড়িতে রেখে সেদিন কিছুটা সস্থি পেয়েছিলাম। বাবাকে সুস্থ দেখে একটা টেনশন কমেছে ভেবে সস্থি নিতে চাইলেও ভাগ্য মানে নি।
পরেরদিন থেকে চাকরির জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করলাম। রেসাল্ট ভালো হওয়াতে আর পরিচিত বড় ভাইয়ের সহায়তায় একটা ব্যাসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাই। সকাল টু সন্ধ্যা ডিউটি করে রোদুসিকে দেখে। বাবার চেকাপ লাগলে করাতাম অথবা ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ। এক সপ্তাহেই হাপিয়ে উঠেছিলাম। সায়ান ভাইকে মনে মনে ডাকছিলাম। যেনো খুব করে সে সময়টাতে ভাইয়ার অভাব বোধ করছিলাম।
ভাইয়া এসেছিলো। তবে একা নয়। সাথে তার পাহাড়সম অন্যায় সাথে নিয়ে। রোদুসির বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে ছিলাম। অধীর অপেক্ষায় বসেছিলাম। একটিবার তার মুখ দর্শন করার আসায়। কিন্তু না। সে নাকি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে আমার সামনে আর আসবে না। হাজার বার ডাকার শর্তেও সে আসে নি। তাও অপেক্ষায় ছিলাম যদি দরজা খুলে টুক করে ঢুকে যাবো। তাকে দেখার তৃষ্ণায় মন বেকুল ছিলো। সে সময়টাতেই পুলিশের কল আসে। রোদুসির কেইসের সাথে জড়িত আসামীরা ধরা পরেছে। আমি আর রোদুসির বাবা দুজনই আর বসে থাকি নি৷ সাথে সাথেই যাই।
একের পর এক ধাক্কা যেনো আমি কোনো ভাবেই নিতে পারছিলাম না রোদু। পুলিশ স্টেশনে সায়ান ভাইকে দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম। তার মাঝে এ আমি কোন সায়ান ভাইকে দেখছিলাম আমি জানি না। বিদ্ধস্ত অবস্থা। চুল মুখ উষ্কোখুষ্ক। পাগল উন্মাদের ন্যায় বসে আছে। শরীরের হাড়গুলা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিলো। যেনো সে কতদিনের অনাহারী।
পুলিশ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই সে গ্যাং। যারা রোদুসির রেইপ কেইসে জড়িত। এখন রিমান্ডে নিলেই বাকি সব তথ্য বেড়িয়ে আসবে। রোদুসির বাবার সাথে আরো কথা হলো। আমি চুপ করে ছিলাম।
সায়ান ভাইয়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এসব কি ভাই? তুমি?’
ভাই আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো। একটা কথাও বলেনি। আমি পুলিশকে বললাম। আপনাদেত হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে। মানে উনি আমার আপন বড় ভাই। সে যতই খারাপ হোক এমন নিকৃষ্ট কাজে কখনোই সে জড়িত থাকবে না।
উনারা নাকি যথেষ্ট ইনফরমেশন কালেক্ট করে তাদের ধরে এনেছে। এবং সেখানে যথেষ্ট প্রমাণ পেয়েছে এসব কাজের। তবে রিমান্ডে নিলে বাকি তথ্য বেড়িয়ে আসার আগে কিছু বলতে পারছেন না।
কোর্টে চালান দিবে। কথাটা ভেবেই আমি কূলকিনারা হারিয়ে ফেললাম। এবার আমি কার জন্য লড়বো। আমার ভাই? নাকি প্রেমিকার জন্য?
সায়ান ভাই আমার ভাই জানার পর থেকে রোদুসির বাবা মাও আমার সাথে আর ভালো ব্যাবহার করে নি। তাদের ধারণা মতে বড় ভাই এমন হলে ছোটটার উপর তারা কিভাবে ভরসা করবে? কথাটা যথেষ্ট যৌক্তিক হলেও আমাকে তো তারা চিন্তো তাই না বলো? তবুও আমাকে তাদের বাসায় যাওয়া আসা করতে সম্পূর্ণ ভাবে নিষেধ করে দিলো। বাবার অবস্থার কথা চিন্তা করে বাবা মা’কে সায়ান ভাইয়ের কথা না জানাতে চাইলেও এসব ব্যাপার কখনো গোপন থাকে না। মা জেনে যায়।
মা জেনেই যেকোনো উপায়ে সায়ান ভাইকে উনার কাছে ফিরিয়ে আনতে বলে। আমি অথৈ সাগরে পরি।
অনেক ভাবার পর সিদ্ধান্ত নেই। সায়ান ভাই আমার ভাই হলেও সে যদি সত্যি এসবে জড়িত থাকে তাহলে সে একজন অপরাধী। আর অপরাধ করে সে পার পেয়ে গেলে এমন অপরাধ করতে আর কারো গায়েও লাগবে না। একটা মেয়ের জীবন ধংস করে অপরাধী মুক্ত হয়ে ডানা মেলবে কেনো? হুয়াই। প্রকৃত অপরাধীকে সাজা পেতেই হবে।
এভাবেই প্রায় মাসখানেক চলে গেলো। রিমান্ডের শুনানি শুনে ভাইয়ের সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলাম। এর মাঝেই রোদুসি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পরলো। আংকেল আমার হাতে ধরে রিকুয়েষ্ট করলো রোদুসিকে বিয়ে করার জন্য। হুট করে এমন বিহেভে অবাক না হয়ে বিয়েতে মত দিয়ে দিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম। দূরে কোথাও গিয়ে দুজনে সংসার পাতবো। এ দুনিয়ার হিংস্র পশুগুলো থেকে আগলে রাখবো। বিয়ে করে পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ হবো দুজন।’
চলবে….
#আছি_তোমার_পাশে
পর্ব ৯
লেখায়- #Anjum_Tuli
রায়ানের অসহায় কন্ঠে বলা কথাগুলোতে আমি কেমম রিয়েক্ট করবো তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। নিজেকেও অসহায় মনে হচ্ছে। শান্তনা কিভাবে দিতে তাও যেনো ভুলে গেলাম। রায়ান আমার দিকে তাকালো। আমার দু হাত তার হাতের মুঠোয় রেখে বলল, ‘আমায় কেউ বুঝে না রোদু, কেউ না। আজ তোমাকে সবকিছু বলে কেমন শান্তি লাগছে। তোমার সাথে বড্ড অন্যায় করা হয়েছে রোদু। ছেলে হয়ে মায়ের ইমোশনের কাছে হেরে যেতে হয়েছে আমাকে। মাফ করো আমায় রোদু। আমি সত্যি বড্ড অসহায়।’
আমি কিছু বললাম না। কেবল হাতটা শক্ত করে আকড়ে রাখলাম। এতেই যেনো রায়ান ভরসা পেলো।
সে বলতে লাগলো,
‘সে সময়টাতে বিপদ চারিদিক থেকে আমাকে ঘিরে ধরেছিলো। আমি ঠিক কার সাথে লড়বো তাই ভেবে কূল পাচ্ছিলাম না। একদিকে আমার বাবা-মা ভাই অন্যদিকে রোদুসি। রোদুসিকে দেখলেই আমি ভীষণ রকম প্রতিবাদী হয়ে উঠতাম। মন চাইতো সেই মুহুর্তেই অই জানোয়ারকে খুজে বের করে শেষ করে দেই।যে রোদুসির সত্ত্বা টাকে নষ্ট করে দিয়েছে।
যে রোদুসির হাসি ছাড়া ঠোটে বুলি ফুটতো না। সে রোদুসি হাসতে ভুলে গিয়েছিলো। সেই রোদুসি হারিয়ে গিয়েছিলো। যে রোদুসি আমার জন্য পাগল ছিলো। কত শত পাগলামু করে আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছিলো সেই রোদুসি আমাকে দূর দূর করে সে সময়টায় তাড়িয়ে দিত। বুঝতে পারছো রোদু! বুঝতে পারছো?’
রোদুসিকে হাসপাতালে নিয়ে সব ধরনের টেস্ট করানোর পর জানতে পারলাম রোদুসি প্রেগন্যান্ট। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। রোদুসির বাবা সাথে সাথেই ডিসাইড করে ফেললেন এবোর্সনের। বিশ্বাস করো রোদু আমি ঠিক কি চাচ্ছিলাম আমি জানি না। কথাটা শুনার পর ঠিক কতটা সময় নিজের মাঝে ছিলাম না তা আমার সত্যিই অজানা। আমার হুশ আসলো যখন রোদুসির চিৎকার চেচামেচির আওয়াজ কর্ণদয়ে পদার্পণ করলো। ছুটে গেলাম রোদুসির কাছে। সে চিৎকার করে বলছে কেউ পারবে না তার কাছ থেকে তার সন্তান নিয়ে যেতে। সে দিবে না তার বাচ্চা নষ্ট করতে। এইটুক একটা মেয়ে। নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়ে কিনা নিজের বাচ্চার কথা বলছিলো। তুমি ভাবতে পারো রোদু?এর দুদিন আগেও সে কত রকমের পাগলামু করেছে আমার সাথে। কত ধরনের বায়না ধরেছে। প্রাণবন্ত কিশোরীর ন্যায় খিলখিলিয়ে হেসেছে। তার এই অবস্থা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কেবল চোখের পানি ফেলছিলাম। রোদুসির কান্না সেদিন হাসপাতালের প্রত্যেকটা সদস্যের হৃদয় নাড়িয়েছে। মুষ্টিবদ্ধ হাতে যখন রুমের ভেতর কান পেতে ছিলাম। কান্নারত মিষ্টি অসহায় এক মোলায়েম কন্ঠ এসে কানে ঠেকেছে। কত সুন্দর প্রাপ্ত বয়স্কদের মত সে বলছিলো,
‘মা মাগো দেখো ওরা আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে চাইছে। আমার এইটুকু বাচ্চাটাতো আমার পেটে মা। এখনো আসে নি। যার সাথে আমার রক্ত মিশে আছে মা। যে দুনিয়াতে এসে আমাকে মা বলে ডাকবে। আমি যখন তোমাকে প্রথম মা বলে ডেকেছিলাম তুমি তখন খুশি হও নি মা? তাহলে সে যখন আমাকে মা বলবে আমি কতটা খুশি হব ভাবতে পেরেছো? তুমি ওদের বলে দাও মা আমি আমার বাচ্চা দিব না ঠিকাছে?
ও মা কথা বলছো না কেনো? ও বুঝেছি। তুমি মনে হয় বুঝতে পারছো না। কিংবা আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছো তাই তো? আমি আর তোমার কোনো কথা ফেলবো না মা। আমি তোমার আর বাবার সব কথা শুনবো। আমি প্রতিদিন নিয়ম করে খাবো। আমি খেলে তো আমার বাচ্চাও খাবে তাই না মা আমি খাবো। বেশি বেশি খাবো। এই এত্ত এত্ত!. আর শুনো মা তুমার সব কথা শুনবো।
রা.. রায়া.. রায়ানের কাছেও যাবো না। ওর জন্য আর পাগলামু করবো না। ঐ যে সুমাইয়া আছে না? আমাকে হিংসা করতো? ওর সাথে তুমি রায়ানের বিয়ে দিয়ে দাও। ওরা সংসার করুক? হ্যাঁ? এই মা তুমি কাদছো কেনো? কথা বলো না’
রোদুসির বলা শেষের কথা গুলো শুনে আর থাকতে পারি নি। ভেতরে ঢুকে দেখি আন্টি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমি এক টানে ওকে আমার দিকে এনে বললাম, ‘এই কি বললে তুমি?’
সে আমার চোখে চোখ রাখে নি রোদু। সে ভিতু ছিলো। কিন্তু আমাকে বুঝতে দিতে চায় নি। মুখে রাগের লালীমা এনে আমাকে কড়া কন্ঠে বলেছিলো,
‘যা চলে যা। কতবার বলেছি আমার কাছে আসবি না।’
আমি তার হাত ধরে শক্ত কন্ঠে বলেছিলাম। আসবো একশো বার আসবো। আমার হাত ছিটকে সরিয়ে ফেলে সে। ধস্তা ধস্তি হয় আমাদের। আন্টি এসে রোদুসিকে সরিয়ে নিলে সে টেবিলের ওপর থেকে ছুড়ি নিয়ে আমার উপর ছুড়ে মারে। তার টার্গেট আমি ছিলাম না। আর তাইতো আমার কপালে রক্ত দেখে দুহাতে মুখ ঢেকে হুহু করে কেদে দেয়। তার কান্নায় আমার ঠোটের কোণে হাসি এসেছিলো। যতই অস্বীকার করুক আমি তো জানি সে আমায় ছাড়া অসম্পূর্ণ। দুহাতে আগলে নেই তাকে। ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও ব্যার্থ হয়ে আমার বুকেই পরে থাকে। আংকেল আন্টিকে নিয়ে বেরিয়ে যান।
রোদুসি আহ্লাদে কান্না মাখা কন্ঠে বলে উঠে, ‘চলে যেতে বলেছি’
আমি হেসে বললাম, ‘আর আমি নিয়ে যেতে এসেছি’
সে আমার কথার উত্তর দিলো, ‘আমি আর একা নই’
আমি আলতো মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘ভালোবাসায় ভাগ বসানোর মানুষ আসছে সহ্য হবে তো?’
সে আমার গলা জড়িয়ে হুহু করে কেদে দিলো। তার কষ্ট আমি উপলব্ধি করতে পারলেও সে মুহুর্তে তাকে ভেংে যেতে দেওয়া যাবে না কেবল একটা কথায় মাথায় বাজছিলো। যতটুকু পারি বুঝ দিলাম। আমি তার পাশে আছি। কেউ কিচ্ছু বলতে পারবে না। আমার বউ কেবল সেই হবে। মেয়েটা আমার কথা বিশ্বাস করলেও আমি আমার কথা রাখতে পারি নি রোদু’
রায়ান শব্দ করে কেদে দিলো। মুহুর্তের মধ্যে আমাকে জড়িয়ে ধরে তার চোখের কার্নিশ বেয়ে পরা জলে আমার পিঠ ভিজিয়ে দিলো। আমার কাধে মুখ গুজে সে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো। প্রিয়জনের চোখের পানিটাই সহ্য করতে পারছি না আর সে কিভাবে রোদুসিকে ঐ অবস্থায় সহ্য করেছে ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো।
রায়ান আমার সাথে মিশে আছে। আমাদের মধ্যে এক ইঞ্চি পরিমাণও দূরত্ব বিদ্যমান নেই। তবুও মনের মধ্যে কোনো রকম অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে না। কেবল একটাই ইচ্ছা জাগছে ইশ কোনো ভাবে রায়ানের কষ্ট গুলো যদি দূর করে দিতে পারতাম। কোনো এক অদৃশ্য ম্যাজিকের সহায়তায় যদি সম্পূর্ণ অতীতকে মুছে দিতে পারতাম। এসবের কোনটাই সম্ভব নয় আফসোস। তবে রায়ানের পাশে থেকে তার সাপোর্ট হয়ে ভালোবেসে বেচে থাকা সম্ভব। হ্যাঁ সম্ভব। থাকবো আমি তোমার পাশে। তোমার অস্তিতে নিজেকে বিলীন করবো ভালোবেসে। আছি তো, আমি আছি তোমার পাশে। মনে মনে কথাগুলো আওরালাম। অটোমেটিক আমার হাত রায়ানের পিঠ ছুলো। রায়ান আমাকে আরো শক্ত বাধনে বেধে ফেললো।
আস্তে করে সোফার বালিশটা এনে পিঠে দিলাম। রায়ান আমার উপর হ্যালান দিয়েই চোখ বুজে আছে। আলতো করে বললাম, ‘রুমে গিয়ে শুই?’
‘উহু’ -রায়ানের ভাঙ্গা গলা। বাধা দিলাম না। থাক কিছু সময় এভাবে। আলতো হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। রায়ান উঠে বসলো। আমার উড়না নিয়ে মুখ মুছে বললো, ‘দেখো তো আমার চোখ মুখ কি ফুলে গিয়েছে?’
আমি মাথা দিয়ে বুঝালাম হ্যা। সে মলিন হেসে বলল, ‘রোদুসি দেখলে হাসতো। খুব হাসতো। আমাকে নাকি এভাবে খুব পচা লাগে দেখতে।’
আমি মুখ ফসকে বলে ফেললাম, ‘কই নাতো এভাবে অনেক আদুরে আদুরে লাগছে।’
রায়ান চকিতে আমার দিকে তাকালো। কিছু বললো না। কেবল মুচকি হাসলো। আমি কথা ঘুড়িয়ে বললাম, ‘তারপর তারপর কি হয়েছিলো? রোদুসির বাচ্চাটাই কি তুতুল?’
রায়ান এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘হ্যা’
তারপর বললো, ‘রোদুসিকে সেদিন মেডিসিন খায়িয়ে ঘুম পারিয়ে সায়ান ভাইয়ের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরুলাম। রোদুসি শারীরিক মানসিক দুদিক থেকেই দুর্বল থাকায় ডাক্তার কয়দিন হাসপাতালে রাখার সাজেস্ট করলে আমরা আর বাধা দেই নি। রোদুসির বাবার দুহাত ধরে কেবল অসহায় আবদার রেখেছিলাম রোদুসির ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেনো কোনো রকমের পদক্ষেপ নেয়া না হয়। সেদিন সেই মুহুর্ত থেকে রোদুসির সমস্ত দায়িত্ব আমার।
সায়ান ভাইয়ের কাছে গেলে উনি আমার কপালের ক্ষত দেখে ঘাবড়ে যান। আমি তাচ্ছিল্য হাসি। উনি আমার কপালের ব্যান্ডেজ দেখে আমার ব্যথার আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। অথছ দেখো আমার হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণের বণ্যা বয়ে যাচ্ছিলো তা একটা বারও বুঝার চেষ্টা করেন নি। আমি উনার কাছ থেকে সত্য জানার আসায় একটু কঠোর ভাবেই প্রশ্ন করি,
‘কেনো এই পাপের সাথে জড়ালে ভাই? কেনো এমন জঘন্য একটা কাজে নিজের নাম লাগালে?হুয়াই?’
আমি ভেবেছিলাম ভাই সব কিছুই অস্বীকার যাবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ভাই সব স্বীকার করে নেয়। আমার পায়ের তলা থেকে সেদিন মাটি সরে গিয়েছিলো। ইচ্ছে করছিলো দুহাতে ভাইকে মেরে ফেলি। কেনো সে এমন জঘন্য একটা কাজ করলো? তার মস্তিষ্ক এতটা বিকৃত কিভাবে হলো? বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ ব্যাতিত এমন জঘন্য কাজে লিপ্ত হতে কেউ পারে বলো? বলো না রোদু? পারে?’
রায়ানের কান্না গুলো আমি আর নিতে পারছিলাম না। তাই ঠোটে হাত দিয়ে থামিয়ে দিলাম। কপালে কপাল ঠেকিয়ে দুজন কেবল চোখের পানি ঝড়াচ্ছিলাম…
চলবে….