#আজল
#পর্ব-চৌদ্দ
২৮.
সেই যে শুরু হলো আমাদের সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক চলেছিলো প্রায় দেড় বছর। আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, তোমার জীবনের শ্রেস্ঠ সময় কোনটা? আমি চোখ বুজে বলবো,ঐ দেড়টা বছর আমার জীবনের শ্রেস্ঠ সময়। এমন না যে দেড় বছর সুখেই কেটেছে একদম, সুখ দুঃখ মিলে ভালো কেটেছে। সপ্তাহের চারদিন ওদের পড়াতাম, এই চারদিন পড়ানো শেষ করে দুজনে একসাথে হাটঁতে হাটঁতে রেহনুমার নানির বাড়ি পর্যন্ত যেতাম। বাড়ির আগের গলি পর্যন্ত ওর সাথে যেতাম, তারপর আমি ফিরে আসতাম।আমরা একটু ঘুর পথে যেতাম যেন বেশি সময় ধরে হাঁটা যায়। বাকী দিনগুলোতে বের হওয়া সম্ভব ছিলো না। প্রতি শুক্রবার করে রেহনুমার বাবা আসতেন ওকে দেখতে। মাঝে মাঝে ওকে সাথে করে নিয়েও যেতো বাড়িতে। বাবার ওখানে থাকলে রেহনুমা আমার সাথে কথাই বলতো না পাছে ওর বাবা কিছু বুঝে যান। ওখান থেকে আসার পর মাঝে মাঝে খুব কান্না করতো, মন খারাপ করে থাকতো। আমি জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলতে চাইতো না। বলতো-” আপনি প্লিজ আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না, আমার কষ্ট হয়। আপনি শুধু একটা কাজ করবেন,আমি যতক্ষণ আপনার সাথে থাকবো ততোক্ষণ আমায় হাঁসাবেন। এই সময় টুকু আমি দুনিয়ার কোনো কিছুই মনে রাখতে চাই না। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করে কষ্ট দেবেন না দয়া করে।”
আমার আর কিছু জানা হতো না। পাছে আমি কিছু বললে ও কষ্ট পায় এই ভয়ে আমার আর কিছু বলা হয়ে ওঠে না। তবে যেদিন ওর মন খারাপ থাকতো ও আমার কাছে কবিতা শুনতে চাইতো। আমি বুঝে যেতাম ওর মন খারাপ।
সত্যি কথা বলতে কি, পড়ালেখায় আমার অবনতি হয়েছিল। ফার্স্ট ইয়ারে আমি গড়পরতা রেজাল্ট করলাম। সেকেন্ড ইয়ারে তার চেয়ে একটু ভালো। উন্নতি হয়েছিল কিন্তু সে রকম না যে রকমটা আমার করা উচিত। অন্যদিক দিয়ে আবার বেশ নাম করে ফেললাম। ভার্সিটির অনুষ্ঠান হলে আমার ডাক পড়ে। আমি আবৃতি করি, হাল্কা গান টান গাই। রেহনুমা আমার পড়ালেখার ব্যপারে খুব উৎসাহ দিতো,কিন্তু ওর মন খারাপ,ওর অশান্তি গুলো আমাকে না বললেও খুব ইফেক্ট করতো। আমার মনে হতো আমি ওকে যে আশা দিয়ে সম্পর্ক করেছিলাম সেটা পূরন করতে পারিনি।
বাবা মনেহয় কিছু খবর পেয়েছিলেন। কারন এই দেড় বছরে ঈদের ছুটি ছাড়া বাড়ি যাইনি। আমার পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো, বাড়িতে না যাওয়া সব কিছু মিলে বাবা দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে নিলেন৷ তবে আমাকে কিছু বললেন না। পরের ঈদে যখন বাড়ি গেলাম তখন সে শুরুর দিনেই আমাকে ডেকে পাঠালেন। পড়ালেখার খোজ খবর নিলেন। রেজাল্ট জানলেন। আশ্চর্য ব্যাপার বাবা আমাকে কিছুই বললেন না। শুধু ঠান্ডা মাথায় এটাই বললেন –
“পরবর্তী সেমিস্টারের রেজাল্ট যদি ভালো না হয় তাহলে আমাকে কিছু বলবেন না, প্রিয়তার বিয়ে দিয়ে দেবেন।”
উনি এতো ঠান্ডা গলায় কথাটা বললেন যে, আমি বুঝে গেলাম বাবা সত্যি সত্যি তাই করবেন। কারন আমরা সবাই জানতাম, বাবা খুব জেদি আর একগুয়ে মানুষ। সে কোনোকিছু ঠিক করে ফেলে সেটা করেই ছাড়ে। কিন্তু তবুও কেন যেন আমি ভয় পেলাম না। আমার মনের কোনে হয়তো একটু বিশ্বাস ছিলো যে, বাবা প্রিয়তার সাথে এরকমটা করবেন না। হাজার হোক, নিজের মেয়ে বলে কথা! মাত্র ক্লাস নাইন পড়ুয়া প্রিয়তা আমাদের সবারই বড় আদরের ছিলো।
বছর খানেক এভাবেই ভালো মন্দ টানাপোড়েনে কেঁটে গেলো। মিলিও আমাদের ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পেরেছিলো হয়তো। একদিন ও আমাকে ডেকে নিয়ে গেছিলো আলাদা করে-
“ফুয়াদ, ভাই যেটা করছিস সেটা মোটেও ভালো হচ্ছে না? ”
“কেন? আমি কি করেছি?”
“কি করেছিস সেটা তো তুই ভালোই জানিস? আমার কাছে শুনতে চাচ্ছিস ক্যানো? তবে যেটা করছিস সেটা অন্যায় হচ্ছে। ও বাচ্চা মানুষ, ভীষন কষ্ট পাবে রে? এমনিতে তো আর কম কষ্টে নেই?”
আমি কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিলাম মিলি আমায় থামিয়ে দিলো-
“একদিন ঠিকই বুঝবি আমি কি বলছি? কেন বলছি?”
সেদিন মিলির কথা শুনে সত্যিই আমার রাগ হয়েছিল। আমি কি এমন করেছি যে সবাই এতো নেগেটিভ কথা বলছে। একটা দুঃখী মেয়ের হাত ধরেছি তাই এতোসব। মনেহলো,পৃথিবীটাই অনেক নিষ্ঠুর, অসহায় কে আরো অসহায় বানিয়ে দেয়। সবকিছু মিলে আমি বেসামাল ছিলাম। পড়তে বসতাম ঠিকই কিন্তু পড়া হতো না। ক্লাসে থাকতাম কিন্তু কিছুই মাথায় ঢুকতো না। আমার সেই সেমিস্টারের রেজাল্ট ও এ্যাজ ইউজুয়াল হলো।
এদিকে রেহনুমার এইচ এস সি পরীক্ষা এগিয়ে আসছিলো। আমার পড়ানো কমে যাচ্ছিলো। মাঝে মাঝে যেতাম মডেল টেস্ট নেওয়ার জন্য। রেহনুমা কেও কেমন যেন দেখতাম সবসময় অন্যমনস্ক আর মন খারাপ থাকে। জিজ্ঞেস করলে বরাবরের মতই কিছু বলে না। আমিও জোর করি না আর। রেহনুমার পরীক্ষার পর পর আমার পঞ্চম সেমিস্টারের ফাইনাল এক্সাম। এবার আমি খুব চেষ্টা করছিলাম যেন পরীক্ষা গুলো ভালো হয়। এর মধ্যে আর রেহনুমার সাথে দেখা হয়নি, ফোনে কথা হতো। ও মাঝে একদিন জিজ্ঞেস করলো পরীক্ষা কবে শেষ হবে? আমি যে ডেট বললাম ও শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কিছু একটা বলতে যেয়েও যেন বলতে পারে না। আমরা দুজনে মিলে ঠিক করলাম, একেবারে আমার শেষ পরীক্ষার দিনে দেখা করবো।
পরীক্ষা শেষে পরদিন দেখা করি রেহনুমার সাথে। পরিচিত কফি শপে যেয়ে বসি। অনেকদিন পরে দেখা, প্রায় দু মাসের বেশি। খেয়াল করলাম ও অনেক শুকিয়ে গেছে, চোখগুলো কোটরে ঢুকে গেছে। উষ্কখুষ্ক চেহারা, দেখে মনে হচ্ছে কোনো রকমে চুলটা বেধে চলে এসেছে। আমি কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে ওর হাত ধরলাম-
“রেহনুমা কি হইছে?এই অবস্থা কেন?”
ও ছলছল চোখে আমার দিকে তাকায়, চোখ ভরা জল, ঠোট দুটো চেপে ধরে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করছে। ওর কান্না যেন আমার বুকে যেয়ে লাগলো। রেহনুমা অনেক শক্ত মেয়ে, ও তো সহজে কাঁদে না?আমি অস্থির হয়ে ওর হাত ধরি-
“এই রেনু, পাগলী, কি হইছে? কাঁদো ক্যান?”
এবার রেহনুমা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না, ঝরঝর করে কেঁদে দেয়। আমি ওকে একটু স্থির হতে সময় দেই, কিছুক্ষণ পর ওর দিকে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দেই। ও কান্না নিয়ন্ত্রণ করে পানি খায়। দু হাত দিয়ে মুখটা মুছে, তারপর বলে
“বাবা আমাকে নিতে আসছে অনেকদিন, আপনার সাথে দেখা করবো বলে যাই নাই।”
“ও। তো এতে কান্নার কি আছে? যাও ঘুরে আসো? তারপর তো তুমিও ভার্সিটিতে ভর্তি হবা!”
” এই বার গেলে বাবা আর আসতে দিবে না। আর পড়াবেও না আমাকে। বাবার বউয়ের বাচ্চা হবে, তাই তার আগেই আমাকে বিদায় করতে চায়।”
“মানে? বিদায় করতে চায় মানে?”
আমি বোকার মতো প্রশ্ন করি।
“বাবা, আমার বিয়ে ঠিক করছে। ছেলে ব্যাংকে চাকরি করে। এইবার আমাকে নিয়ে যায়ে বিয়ে দিবে। ”
“কি বলো,রেনু? কবে বিয়ে ঠিক করসে? তুমি আমাকে জানাও নাই ক্যান?”
“কি লাভ জানায়ে? আপনি কি আমাকে বিয়ে করবেন?”
“কেন করবো না? কিন্তু আমাকে একটু সময় দিবা না? আমি তো বলছি যে আমি তোমাকেই বিয়ে করবো। পড়ালেখা শেষ হোক?”
“আর ততোদিন আমি কার কাছে থাকবো? কে আমাকে আশ্রয় দিবে? আর তাছাড়া আপনার পরিবার মানবে? আমার বাবাকে তো আমি বলতেই পারবো না। এমনিতেও সৎমা সারাক্ষণ মাকে নিয়ে কথা শোনায়। এখন যদি আমি এই বিয়ে না করি তাহলে তো তার আরো সুযোগ হবে বাবাকে উল্টো বুঝ দেয়ার।”
“আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলি? ”
“নাহ, দরকার নাই। যদি আপনার ফ্যামিলি নিয়ে আসতে পারেন তাইলে আসেন। না হলে দরকার নাই।”
“তুমি একটু চেষ্টা করো না? আমি পাশ করা পর্যন্ত সময় দাও আমাকে। আর তা না হলে চলো বিয়ে করি এখনি। তোমাকে চলাইতে পারবো, টিউশনি করে।”
আমি ওর হাত ধরি, অনুনয় করি।
“তারপর একসময় যেয়ে মনে হবে আপনি ভুল করছেন। পরিবারের সাপোর্ট পাবেন না,আমি তো এমনিতেই একা, আপনারও যদি কেউ না থাকে তাহলে চলতে পারবেন? আমি জানি পারবেন না। আর যে ব্যাথ্যা আমি সহ্য করছি তা আপনাকে কিভাবে পেতে দেই?”
আমি কি বলবো বুঝে পাই না। এতটুকু মেয়ে ও যা বুঝে আমি কেন তা বুঝি না, আগেও কেন বুঝলাম না। এইজন্যই কি মিলি বলেছিলো ঐ কথা। আমি নিরুপায় হয়ে বসে থাকি।
“জানেন, আমি জানতাম এমনই কিছু হবে? এই জন্যই আমি কোনো সম্পর্কে জড়াতে চাই নাই। অথচ আপনি আমায় বাধ্য করেছিলেন। যাক, বেপার না। এই দিনগুলো তো সুখে কেটেছে? এই স্মৃতি নিয়ে বাঁচতে পারবো আমি।”
“রেনু, প্লিজ এভাবে বইলো না। আমি তোমাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো। প্লিজ,বোঝার চেষ্টা করো, ভালোবাসার মানুষটা পাশে থাকলে সব পারা যায়। আমরাও পারবো দেখো?”
“শোনেন, ঠান্ডা মাথায় ব্রেকাপ বুঝেন? আমি আপনার সাথে সেটাই করতেছি। আমি জামি, আপনি আগেও আমার পরিস্থিতি বুঝেন নাই, এখনও বুঝবেন না। তাই আমিই আপনার সাথে ব্রেকাপ করলাম। আপনি সারাজীবন নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিবেন যে আমি আপনাকে ছেড়ে চলে গেছি, বুঝলেন? তাহলে আর আপনি কষ্ট পাবেন না।”
আমার কান্না আসে, কিন্তু কাঁদতে পারিনা। জানি,রেহনুমা রেগেই কথাগুলো বলছে। আসলেই তো আমি তো কিছু ভাবি নাই, ওকে স্বপ্ন দেখাইছি শুধু। স্বার্থপরের মতো জোর করে ওকে ভালোবাসতে বাধ্য করছি। আমার চোখ লাল হয়, আমি হাতের মুঠো চেপে ধরি। অথচ রেহনুমা কি সুন্দর নিজের কান্না গিলে নিয়েছে। কত অবলীলায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে।
“আচ্ছা, আমি যাই। আমাকে এগিয়ে দেবেন না? আজ শেষবারের মতো এই দায়িত্বটা পালন করুন। এরপর আপনি মুক্ত। ”
রেহনুমা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আমি জানি ও কান্না লুকাতে চাইছে। আমি আর ও পাশাপাশি হাটছি। একটু পথ বাকী থাকতে আমি রেহনুমার হাত চেপে ধরি-
“রেনু চলোনা আমরা বিয়ে করি। বিয়ে করলে সব ঠিক হয়ে যাবে। হ্যা কিছুদিন কষ্ট হবে তারপর দেখবা সব ঠিক।”
” জানেন তো আমি প্রেম,ভালোবাসায় বিশ্বাস করি না। যেটা আজ আছে কাল নাই তার কি বিশ্বাস! আর বাবাকে কিভাবে কষ্ট দেই বলেন তো? যে বাবা আমার আট বছর বয়স থেকে আমাকে পেলেপুষে বড় করেছেন তাকে কিভাবে কষ্ট দিবো? দরকার হলে নিজের জীবনটা দিয়ে দেবো বাবাকে তবুও মায়ের মতো কষ্ট তাকে দিতে পারবো না।”
আমার আর কিছু বলার থাকলো না। কি বলবো? ও তো ঠিকই বলেছে? আমিই ভুল। ও হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁটে-
“একটা কবিতা শুনবেন? এতোদিন তো আপনি আমাকে শুনিয়েছেন, আজ আমি শোনাই, আমার নিজের লেখা। আমি মাথা নাড়ি, ও বলে-
★
আমার একটা জনম আমি দিতে চেয়েছি তোরে
তুই হেলা করে ফিরিয়ে দিয়েছিস মোরে।
দিতে চেয়েছি
একটি সোনালী সকাল
আমার ভেজা চুলের আলতো ছোয়ায় তোর ঘুম ভাঙা।
দিতে চেয়েছি
রোদ্দুর জ্বলা দুপুর
একই ছাতার নিচে তোর কাঁধের সাথে আমার কাঁধের ঠোকাঠুকি।
দিতে চেয়েছি
একটি গোধুলী বিকেলে
এক কাপ ধোয়া ওঠা গরম চায়ের পেয়ালা।
দিতে চেয়েছি
বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যা
তোর আমার ভিজে যাওয়া শরীরের তাপের আদান প্রদানের ব্যগ্রতা।
আমার একটা জনম আমি দিতে চেয়েছি তোরে
তুই হেলা করে ফিরিয়ে দিয়েছিস মোরে।
★
ও বলছিলো আর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছিলো পানি। ও চলে গেলে আমি আমার ভেজা চোখ নিয়ে অপলক ওর যাওয়ার পথে চেয়ে থাকি। প্রিয়জন চলে গেলে কেমন লাগে আমি তখনো বুঝতে পারছিলাম না। দুদিন পর আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিলাম….. কি যে এক অদ্ভুত শুন্যতা, ও তো আমার অভ্যাস ছিলো, দিনে তিনবার ফোন…খাইছো নাকি…ঘুমাইছো নাকি…পরীক্ষা কেমন দিলা…পড়তে বসছো নাকি…কেন বসো নাই…এইরকম হাজারো অভ্যাস কে মিস করতে শুরু করলাম। ওকে ফোন দিলে ফোন বন্ধ পাই…নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগে আমার…আমি ওর কলেজের সামনে এসে দাড়িয়ে থাকি অকারনে ঘন্টার পর ঘন্টা। বাড়িতেও যেতে ইচ্ছা করে না।আমি শুধু ভাবি ও কিভাবে এতো সহজে নিজেকে মানিয়ে নিলো এই পরিস্থিতিতে।
তিনদিন পর একদিন হঠাৎ মায়ের ফোন-
” বাপ, বাড়িতে আসবি না? প্রিয়র তো বিয়ে ঠিক করলো তোর বাবা।?”
একদিকে রেহনুমার সাথে আমার সম্পর্ক আর একদিকে আমার একমাত্র ছোটোবোনের বিয়ে। মাথা আমার নষ্ট হওয়ার অবস্থা। সেই পাগল পাগল অবস্থায় আমি পরদিন সব দুঃখ ভুলে বাড়ির দিকে ছুটি। প্রিয়তাকে কিছুতেই বিয়ে দিতে দিবো না। এতো অল্পবয়সে কিছুতেই ওর জীবন নষ্ট হতে দেবো না। বাড়িতে পৌঁছে সবকিছু স্বাভাবিক ই মনে হলো। মাকে জিজ্ঞেস করতেই মা বললো, প্রিয়র বিয়ের কথা পাকাপাকি করেছে বাবা। পরদিন আংটি পড়ানো হবে। এক দেড় বছর পর বিয়ে।
আমি বাবার সাথে কথা বলতে গেলাম। মা আমাকে অনেক আটকানোর চেষ্টা করলেন আমি শুনলাম না। বাবাকে যেয়ে বিয়ের কথা বলতেই বাবা আমার দিকে ঠান্ডা চোখে তাকালো, তারপর বিছানা থেকে উঠে এসে সজোরে চড় মেড়ে বসলেন। আমি হতচকিত হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম, এতো বড় ছেলের গায়ে বাবা হাত তুললেন? আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। বাবা আরো একবার হাত তুললেন, মা বাঁধা দিলো। বাবা হিসহিসিয়ে বললো-
” তুই কি ভাবছিস,আমি জানি না কিছু? যার নিজের পড়া লেখার কোনো ভবিষ্যৎ নাই সে বোনের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে কোন অধিকারে? এখন ওকেও তোর মতো বানাতে চাচ্ছিস? আমার মেয়ে আমি যা খুশি করবো, তোর তাতে কি? তুই আমাকে কথা দিয়েছিলি, সে কথা রেখেছিস?”
মা কিছুই না বুঝে শুধু একবার বাবার দিকে একবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। আমি ঐ দিনই ঢাকায় ফেরত আসি। একা একা হোস্টেলের রুমে গুমরে মরছিলাম। ঐ মুহুর্তে আমার মতো একা কেউ ছিলো কি না আমার জানা নাই। আমার জন্য, শুধু আমার জন্য দুই দুইটা মেয়ের জীবন নষ্ট হলো, এটা আমার মাথার মধ্যে ক্রমাগত ঘুরতে থাকে।
আমি টোটালি চেঞ্জ হয়ে গেলাম। এই বন্ধের মধ্যে একা একা হোস্টেলে আমি পড়া শুরু করলাম। আমার এতোদিনের যতো গ্যাপ হয়েছিলো সব সব একসাথে নিয়ে হামলে পরলাম। মাঝে মাঝে না পেরে ফোন দিয়ে দিতাম রেহনুমাকে। নাম্বারটা বন্ধই পেতাম। সব ভুলতে পড়ালেখাই হলো আমার সঙ্গি। তার ফলাফল আমার সার্টিফিকেটের ওজন, যে ওজনের ওপর আজকের সাকসেসফুল আমি দাড়িয়ে। বাড়ি থেকে ফোন এলে আর ধরতাম না। মাঝে মাঝে চাচারা আসতেন আমাকে দেখার জন্য, আমি দুচার কথা বলে ওদেরকে বিদায় দিতাম। বাবার টাকা আর নেইনি, নিজেই টিউশনি করে নিজের খরচ জোগার করতাম। পাশ করার আগ পর্যন্ত আমি আর বাড়ি যাইনি।
বন্ধের পর যখন ক্লাস চালু হলো, মিলি কেমন যেন আমার সাথে কথা বলে না। আমারও লজ্জা লাগতো। ওর কথা ঠিক আর আমি ভুল প্রমান হলাম এই গ্লানিতে আমি ওর থেকে লুকিয়ে বেড়াতাম। একদিন মিলির সাথে মুখোমুখি পড়ে গেলাম-
“মিলি,রেহমুনা কেমন আছে?”
মিলি কেমন একটা বাঁকা হাসি দিলো-
” তুই ওকে ভালো থাকার মতো রেখেছিস? ভালোই করলি রে? তোরা ছেলেরা কেবল স্বপ্ন দেখাতে জানিস??”
আমার আর সাহস হয়নি কিছু বলার। ঠিকই তো বলেছে মিলি। আমি যা তাই তো বলেছে। আমার জন্য দু দুটো মেয়ে অল্প বয়সে কঠিন শাস্তি পেয়ে গেলো। আমি তো জানি রেহনুমা, প্রিয় এরা কেউ ভালো নেই। এই অপরাধবোধ আমাকে আজও তাড়া করে বেড়ায়। আমি সস্তি পাই না, বিশ্বাস করো সাঁচি….আমি ভীষন কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি…আমার….
“দু জন নয় তিনজন…তিনজনের জীবন নষ্ট করেছেন….”
সাঁচি থামিয়ে দেয় ফুয়াদ কে।
“আমিও আছি তে আপনার তালিকায়…”
ফুয়াদ অবাক চোখে তাকায়..সাঁচিও তাকিয়ে আছে ফুয়াদের দিকে…ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে… সাঁচি উঠে দাড়ায়…”
আজ বুঝলাম, ভালোর ভিতরেও মন্দ থাকে…উপরে ভালো দেখা গেলেই ভিতরটা পঁচা হবে না তার কোনো গ্যারান্টি নাই। ”
“তুমি আমাকে ভুল…বুঝছো…সাঁচি…” হাতের ইশারায় ফুয়াদকে থামিয়ে দেয়-
“দেখুন সকাল হয়ে গেছে এখন না ঘুমালে আমার শরীর খারাপ করবে”
ফুয়াদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সাঁচি ঘরে ঢুকে যায়…ফুয়াদ দাঁড়িয়ে থাকে ওখানেই…….হতাশ হয়ে…
চলবে—-
Farhana_Yesmin