আজি_বিজন_ঘরে,পর্ব-১,০২

0
1591

#আজি_বিজন_ঘরে,পর্ব-১,০২
এমি
১.

শাশুড়ীর রেখে যাওয়া অদ্ভুত সুন্দর নবরত্নের গয়নাগুলো তার হবু ফুপু শাশুড়ী কিছুক্ষন আগে পরিয়ে গেছেন অর্পা কে। তার পরনে সাদা জমিন আর আকাশ নীলের উপর রুপালী কাজের স্বপ্নের মত সুন্দর একটা কাঞ্চিপুরম শাড়ী। অবশ্য এ শাড়ীর দাম সম্পর্কে কোনো ধারনা নেই। অনেক দামী শাড়ী নিশ্চই। পাখির পালকের মত হাল্কা। সে তার এই জীবনে এত সুন্দর শাড়ী দেখেনি। আচ্ছা ভালো পোশাক আর গয়না কি মানুষকে বদলে ফেলতে পারে?

বিশাল গেস্টরুমের একমাত্র জানালাটার কাছে সে এসে দাঁড়ালো। আজ এ বাড়িতে তার দ্বিতীয় দিন। প্রথম দিন অবশ্য চারিদিক দেখবার সুযোগ হয়নি । আজ অনেকটা সময় সে এখানে। এখান থেকে বাড়ির পেছনের দিকটা দেখা যায়। এ বাড়ির সব কিছুই বোধহয় ছবির মত সুন্দর। সবুজ লন, ফুলের বেড, কেয়ারি করা ঝাড়, ছোট্ট একটা পদ্ম পুকুর। সে কি তবে এই ঐশ্বর্যের লোভে পড়ে বিয়েটা করতে চাইছে? নাকি পালিয়ে বাঁচার জন্য একটা আশ্রয় খুঁজছে? কোনটা সঠিক?

দরজা নকের শব্দ হতেই অর্পা ফিরে তাকালো। রিজভী সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। আচ্ছা তার কি ওনাকে সাহেব বলা উচিত। কেননা মধ্য পঞ্চাশের এই লোকটার সাথেই তার একটু পরেই বিয়ে।
-কিছু বলবেন?
-কাজী সাহেব চলে এসেছেন। তুমি কি তৈরী? নাকি আরও কিছুক্ষন একা থাকতে চাও? এখনও সময় আছে। তুমি ভেবে দেখতে পারো।
-নতুন করে ভাবার তো কিছু নেই।
-তাহলে আস।

তারা দুজনে বসার ঘরে এসে ঢুকলো। বসার ঘরে মাঝখানে পর্দা দিয়ে আলাদা করা হয়েছে। মেয়েদের আলাদা বসবার জায়গা। সে সেদিকে এগিয়ে যেতেই অবাক হয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। শান্তা আর মিতা বসে আছে। তাকে দেখে শান্তা উঠে এসে হাত ধরলো।
-তোরা এখানে কি করে?
-উনি ওনার পি.এ কে পাঠিয়েছিলেন আমাদের হলে।
-উনি কি করে তোদের কথা জানলো?
-তা তো আমি জানি না। আয় বসি।
তিনজনে একটা সোফায় বসলো। তার ফুপু শাশুড়ী পাশের সোফায় বসে। কাজের দুজন মহিলাও বসে আছে একটু দূরে।
মিতা তার কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
-তোকে খুব সুন্দর লাগছে।
-দামী শাড়ী গহনা পরলে সবাইকেই সুন্দর লাগে।
-কি যে বলিস।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতেই সবাইকে খাবার সার্ভ করা হল। শান্তা আর মিতাকে ফিরতে হবে হলের গেট বন্ধ হবার আগেই। তাই তারা বেশিক্ষণ বসলো না। রিজভী তার পি.এ কে আবারও পাঠালেন তাদের পৌছে দিতে। মেরী বুয়া অর্পাকে দোতলায় রিজভীর ঘরে দিয়ে চলে গেল। পুরো ঘরটাই দোলনচাঁপায় সাজানো। তার প্রিয় ফুল। এত সুন্দর গন্ধ এই ফুলটার যে একগুচ্ছ হাতে পেলেই মনের বিষন্নতাগুলো চলে যেতে শুরু করে। আর এখন তো চারপাশটাই এই ফুলে ভরা। মন ভাল হয়ে গেল এমনিতেই। সে ঘুরে ঘুরে ঘরটা দেখতে শুরু করল। ঘরের লাগোয়া বিশাল ড্রেসিং রুম আর বাথরুম, এক পাশে বারান্দার বদলে ছাদ। সে দরজা খুলে বেরিয়ে এল। ছাদের এক পাশে একটা শেড। অনেক রকম অর্কিডে সেখানে। একটা দোলনা রাখা। দোলনায় বসে সে আকাশের দিকে তাকালো। বেশ মেঘ করেছে। বৃষ্টি নামবে হয়তো খুব শীঘ্রই।

-তুমি এখানে?
সে চমকে উঠলো। লোকটা কখন এসে দাড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি। চেয়ার টেনে এনে রিজভী দোলনার সামনে বসল।
-চলুন ভেতরে যাই।
-বস। আমার এখানে বসতেই ভাল লাগে। বাসায় থাকলে আমি এখানে অথবা লাইব্রেরীতে থাকি।
-আসলেই এই জায়গাটা অনেক সুন্দর।
-তোমার ভাল লেগেছে?
-অনেক। আচ্ছা আমার বান্ধবীদের কি করে পেলেন?
-এটা তো সবচেয়ে সহজ কাজ। স্পাই লাগিয়েছিলাম তোমার পেছনে।
-কেন?
-কেন মানে? তোমার মত একটা মেয়ে কেন আমার মত আধবুড়ো লোককে বিয়ে করতে চায় তা বের করতে হবে না?
অজানা ভয়ে অর্পার দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো। উনি কি তবে সব জানেন। তাহলে তাকে কেন বিয়ে করলেন? অর্পাকে চুপ হয়ে যেতে দেখে রিজভী উঠে দাঁড়ালো।
-ভেতরে চল ফ্রেশ হয়ে নেবে। তোমার জিনিসপত্র মেরী সব ড্রসিংরুমে গুছিয়ে রেখেছে। আর কিছু লাগলে আমাকে জানিয়ো। দুজনে একসাথেই ঘরে এসে ঢুকলো। তুমি ফ্রেশ ঘুমিয়ে পড়।
-আপনি?
-আমার কিছু কাজ আছে। শেষ করে চলে আসবো।

২.

একমাত্র জানালাটা দিয়ে বিকেলের শেষ আলো এসে স্টাডি টেবিলটার উপর পড়েছে। এখনও বৈদুতিক আলো জ্বালনো হয়নি বলেই আলোছায়ার অদ্ভুত খেলায় কেমন গা ছমছম করছে অর্পার। ওড়নাটা যে টেনে নিল ভাল করে।

পুরো ঘর ভর্তি অসংখ্যা বই। সেই কারণেই হয়তো পুরোনো একটা গন্ধ ঘিরে আছে চারিদিক। কারো বাসায় যে এত বই থাকতে পারে সে স্বপ্নেও ভাবেনি। একটা জীবন শুধু বই পড়েই বুঝি কাটিয়ে দেয়া যায়। হঠাৎ করে মনে হল কেউ তার পেছেনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে ভয়ে ভয়ে একবার পেছনটা দেখে নিল। নাহ্ কেউ নেই। কে জানে কতক্ষন অপেক্ষা করতে হবে। প্রায় একঘন্টা হয়ে গেছে সে এসেছে। সে কি চলে যাবে?

দরজায় শব্দ হতেই সে উঠে দাঁড়ালো। বেশ কয়েকটা আলো হঠাৎ জ্বলে উঠবার কারনেই সবকিছু অস্পষ্ট। কিছুটা সময় লাগলো সামনের মানুষটাকে স্পষ্ট ভাবে দেখতে। রিজভী রায়হান সাহেব হেটে গিয়ে স্টাডি টেবিলের চেয়ার টেনে বসে তাকে বসতে বললেন। সে তার আগের জায়গায় বসে পড়ল। একটা কলম আর কাগজ টেনে নিয়ে তিনি কিছু লিখছেন। অর্পা ভেবেছিল অনেক বয়স্ক কাউকে দেখবে কিন্তু এখন লোকটাকে ততটা বয়স্ক মনে হচ্ছে না। বিজ্ঞাপনের পাত্রী চাই কলামে অবশ্য বয়স্ক লিখা ছিল।

রিজভী বুঝতে পারছেন ভুলটা তারই হয়েছে। বিজ্ঞাপনে নিজের বয়স উল্লেখ করলেও অবশ্যই পাত্রীর বয়স উল্লেখ করবার প্রয়োজন ছিল। ঠিক বয়সে বিয়ে করলে তার নিশ্চই এই বয়সি মেয়ে থাকতো। আর শফিকেও তার স্টুপিড মনে হচ্ছে। এই ছেলে কি করে চিন্তা করল যে সে এমন বাচ্চা মেয়েকে খুঁজছে।

-মিস রিদা জান্নাত।
অর্পা চমকে উঠে সোজা হয়ে বসল।
-জ্বি।
-আপনি কেন এসেছেন বলবেন কি?
-ফেসবুকে যে পেজটাতে আপনি আপনার এ্যাড দিয়েছেন সেটা দেখেই তো যোগাযোগ করেছিলাম আপনার পি.এর সাথে। তার ফোন নাম্বারও তো দেয়া ছিল। তিনিই তো প্রথমে দেখা করলেন আর বায়োডাটা নিলেন। কই তখন তো তিনি কিছু বললেন না?
মেয়েটাকে যতটা কনফিউজ মনে হচ্ছিল প্রথমে এখন ততটা মনে হচ্ছে না।
-আপনার কি মনে হচ্ছে না যে আমি আসলে আরও ম্যাচিউর কাউকে খুঁজছি।
-আপনি তো কোন বয়সের কথা উল্লেখ করেননি। শুধু লিখেছিলেন মননশীল কাউকে খুঁজছেন। যে আপনার একাকিত্বের সঙ্গী হবে।
তিনি চশমাটা একটু নামিয়ে উপর দিয়ে তাকালেন।
-তো আপনার কি মনে হচ্ছে আপনি আমার সঙ্গী হয়ে থাকতে পারবেন।
-আমি আসলে ঠিক বুঝতে পারছি না।
-আসলে এই কয়েকদিনে বেশ কয়েকজনের ইন্টারভিউ আমি নিয়েছি। কেউ আপনার বয়সি ছিল না। আজকেও আমি তেমন কাউকেই আশা করেছিলাম। আপনি কেন এসেছেন বলেন তো?
অর্পাকে চুপ করে থাকতে দেখে তিনি আবার বললেন,
-নিশ্চই কোন গুরুতর কারণ আছে। তাই নয় কি? আমি সেটা জানতে চাইছি না । তবে আপনার যদি মনেহয় আপনি আপনার সমস্যা বলবার মত বা কাউকে বলতে চান তবে আমাকে বলতে পারেন। আর যদি আর্থিক সাহায্যের দরকার হয় তাহলে সেটাও আমি করতে পারি।
সে উঠে দাঁড়ালো।
-নাহ তেমন কিছু না। আমি তাহলে আসি।
-আসুন। বাইরে শফি আছে। আপনার বাসায় যাবার ব্যাবস্থা সে করবে।
শফির ডাক পড়লো একটু পরেই।
-স্যার আসবো?
-আসুন।
-মেয়েটার যাবার ব্যাবস্হ্যা করেছেন?
-জ্বি স্যার গাড়ি দিয়ে পাঠিয়েছি।
-আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি আসুন।
শফি যাবার জন্য ঘুরতেই তিনি আবার ডাকলেন।
-শফি।
-জ্বি স্যার।
-আপনি কি মনে করে এই মেয়েটাকে আসতে বললেন?
-স্যার অনেকের সাথেই তো কথা বললেন। তাদের সাথেও তো প্রথমে আমি মিট করেছি। এই মেয়েটাকে দেখে কেন জানি না মনে হল আপনার জন্য এমন কাউকেই দরকার।
রিজভী শফির কথা শুনে অনেক্ষন হাসলেন।
-রোমান্টিক মুভি অনেক দেখেন নাকি?
-না তো স্যার। স্যার আমি তাহলে আসি।
-আচ্ছা আসুন। আর একটা কাজ করেন এর সম্পর্কে সব রকম ইনফরমেশন জোগাড় করেন।
-আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যাবস্থা করছি স্যার।
-ঠিক আছে।
তিনি উঠে অর্পা যেখানে বসেছিল সেখানে এসে দাঁড়ালেন। দোলনচাঁপার মিষ্টি গন্ধ। এমন কোনো পারফিউম আছে নাকি? নাকি মেয়েটা ফুল সঙ্গে নিয়ে এসেছিল? তিনি লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এলেন। বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে এর মাঝেই।

চলবে…

এমি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here