আজ_মৌর_বিয়ে (১ম পর্ব)
Shadbin Shakil (শাদবিন শাকিল)
গভীর রাত।
মৌ ছাদের রেলিঙ ধরে একা দাঁড়িয়ে আছে। তার লম্বা খোলা চুল বাতাসে উড়ে নিজের চোখেমুখে লাগছে। ছাদ থেকে দক্ষিন দিকে বিশাল আকৃতির এক তেঁতুল গাছ দেখা যায়। তেঁতুল গাছে তেঁতুল ঝুলছে। মৌ অনেক কৌতূহল নিয়ে সেই তেঁতুল দেখছে। তার আজ ইচ্ছে করছে সে তেঁতুল ছিঁড়বে তারপর তেঁতুল বানিয়ে খাবে। আশ্চর্য! তার এত রাতে তেঁতুল খেতে ইচ্ছে করল কেন?
ইদানীং তার কিছু একটা হয়েছে সেই কিছু একটা কী সে নিজেও জানে না। দুপুর বারোটার দিকে এবং রাত বারোটার পরে তার একা থাকতে ইচ্ছে করে। তখন আশেপাশের মানুষগুলোকে অসহ্য লাগে। এর কারন কী? কারনটা সে বুঝতে চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছে না।
মৌ একজন দুঃখী মানুষ। দুঃখী মানুষদের রাতে ঘুম হয় না। মৌ’র ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। রাত জেগে সে গল্প উপন্যাসের বই পড়ে। ছাদে গিয়ে তেঁতুল গাছের সাথে হাসাহাসি করে। তেঁতুল গাছ তার কথার কী উত্তর দিচ্ছে বোঝার চেষ্টা করে। মৌ’র মা নুসরাত বেগমেরও এমন অদ্ভুত অসুখ আছে। ছোটবেলায় যখন থেকে তিনি বই পুস্তকে পড়েছেন, গাছপালার জীবন আছে তখন থেকেই গাছপালার সাথে কথা বলা শুরু করেছেন। নিজের কথা গাছপালাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন আবার গাছপালার কথা নিজে বোঝার চেষ্টা করেছেন। হঠাৎ নিজের লাগানো কোনো গাছের মৃত্যু সংবাদ শুনলে তিনি মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়ার মতই ইনিয়ে বিনিয়ে কেঁদেছেন।
মৌ ঘুমানোর জন্য ছাদ থেকে নেমে এসে দুটো জোলিয়াম খেয়েছে। রাত বারোটা পার হয়ে গেছে কিন্তু তার ঘুম আসেনি। ঘুমের কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বাইরে থেকে মৃদু বাতাস জানালা থেকে এসে তার শরীরে লাগছে। ধীরে ধীরে তার ঘুম পুরোপুরি কেটে যাচ্ছে। সে বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। আলমারি থেকে নীল শাড়িটা বের করল। আগামীকাল সকাল সকাল এই শাড়িটা পড়ে সে লুকিয়ে কাজী অফিসে গিয়ে সানিকে বিয়ে করবে। সে বাতি বন্ধ করে চোখের উপর শাড়িটা দিয়ে আবার শুয়ে পড়ল।
‘মধু।’ ‘মধু।’
মৌ চোখের উপর থেকে শাড়িটা সরিয়ে নিল। তার নাম মধু নয় মৌ। তবুও মা যে কোনো কারনে মাঝেমধ্যে মধু ডাকে। সে খাট থেকে নামতে গিয়ে পায়ের সাথে খাটের কোনায় ধাক্কা খেল। ঘুমঘুম ভাব যা ছিল সেটাও তখন চলে গেল। তারপর মায়ের শোবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল। দরজা অর্ধেক খোলা অর্ধেক বন্ধ। মৌ সেই দরজার ফাঁক থেকে বলল, “ডেকেছিলে মা?”
নুসরাত বেগম তরল গলায় বললেন, “তোর বাবাকে স্বপ্ন দেখলাম রে মা। তিনি আমার জন্য দুপুরবেলা টক দৈ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন।”
মৌ বলল, “এই কথা বলার জন্যই কি তুমি আমাকে ডেকেছ?”
“হ্যাঁ। কেন তুই কি ঘুমিয়ে গিয়েছিলি নাকি?”
“বাবা কোনোদিনও ফিরবেন না মা। তুমি শুধু শুধু তার জন্য অপেক্ষা করছ। ঘুমানোর আগে তার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমাও তাই এইসব অবাস্তব স্বপ্ন দেখ।”
নুসরাত বেগম বিড়বিড় করে বললেন, “তুই কীভাবে জানিস যে তিনি ফিরবেন না? তুই কি জ্যোতিষী নাকি?”
“এসব জানার জন্য জ্যোতিষী হতে হয় না মা। বাবা বিদেশে বিয়ে করেছেন, নতুন সংসার পেতেছেন। এই সহজ বিষয়টা সবাই বোঝে শুধু তুমি বোঝো না। তুমি তো চৌদ্দ বছর অপেক্ষা করলে আরও চৌদ্দ বছর অপেক্ষা করলেও তার দেখা পাবে না।”
নুসরাত বেগম কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন, “তুই সবসময় আমার সাথে এত কঠিন করে কথা কেন বলিস? তোর বাবার জন্য কখনো কি তোর খারাপ লাগে না?”
“লাগে কিন্তু কান্নাকাটি করার মত খারাপ লাগে না। আমি তোমার জায়গায় হলে কী করতাম জানো মা? এতদিনে নতুন একজনকে বিয়ে করে নতুনভাবে সংসার করতাম। সেই নতুন সংসারেও আমার দু’তিনজন ছেলেমেয়ে থাকতো।”
নুসরাত বেগম চুপ করে রইলেন। মৌ মায়ের ঘরের দরজা পুরোপুরি বন্ধ করে নিজের ঘরে এসে দাঁড়াল।
ঠিক তখনই অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল!
দক্ষিণের জানালা থেকে স্পষ্ট দেখা গেল, তেঁতুল গাছের একটা ডাল খানিকটা সামনের দিকে ঝুঁকে এসেছে। পুরুষালী কন্ঠে কেউ বলে উঠল, “মায়ের সাথে এমন খারাপ ব্যবহার করতে নেই মৌ। তোমার মা তোমার বাবার অপেক্ষায় এমনিতেই কষ্টে থাকেন। তুমি তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে তার কষ্ট আরও বাড়িয়ে দাও কেন?”
মৌ কিছু সময় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার সাথে কী ঘটতে চলছে বোঝার চেষ্টা করল। কিছুদিন ঘুম না হওয়ার কারনে স্নায়ু ঠিকমত কাজ করছে না। এর উপরে সে ঘুমের ঔষধ খেয়ে আছে। শোনার ভুল হতেই পারে। সে সাহসী মেয়ে নয় আবার ভীতু টাইপেরও নয়। তারপরও জানালার দিকে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল।
পুরুষ কন্ঠস্বর আগের চেয়ে আরও জোড়ালোভাবে বলল, “তুমি এক কাপ কড়া করে চা খেয়ে নাও মৌ। চায়ে বেশী করে আদা এবং দু’টো লবঙ্গ ছেড়ে দিবে। তোমার বিগড়ে যাওয়া মেজাজ ঠিক হয়ে যাবে।”
মৌ যন্ত্রের মত বলল, “কে তুমি?”
“আমি তেঁতুল গাছ।”
“তুমি কোনো গাছ নও। গাছ কথা বলতে পারে না। আজ আমার সাথে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তাই কল্পনায় আমি তোমার সাথে কথা বলছি।”
“তুমি আমার সাথে কল্পনায় নয়, সত্যিই কথা বলছ। গাছ কথা বলতে পারে না সেটা তোমার ভুল ধারণা তারা কথা বলতে পারে। তবে মানুষ তাদের কথা বুঝতে পারে না। তুমি বুঝতে পেরেছ তাই তোমার অবাক লাগছে।”
মৌ বিছানায় বসে পড়ল। তার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। কথা জড়িয়ে আসছে। সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল, “আমি স্পষ্ট তোমার কথা শুনতে পারছি। আমার এখন সত্যি ভয় লাগছে। তুমি যদি সত্যি তেঁতুল গাছ হয়ে থাক, আর আমার সাথে কথা বলে থাকো, তাহলে দয়া করে আজ আর আমার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিও না। আমি আজ ঘুমাতে চাই। কাল আমার সানির সাথে বিয়ে।”
তেঁতুল গাছ কথার উত্তর দিল না। মৌ বিছানায় শুয়ে পড়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ল। তার ঘুম ভাঙল সানির ফোনে। একবার রিং বাজার পর পরই মৌ বন্ধ চোখে মোবাইল হাতে তুলে রিসিভ করল।
“হ্যালো মৌ, হ্যালো।”
“কী হয়েছে?”
“আমার ঘুম পাচ্ছে না।”
“কেন?”
“একটা অদ্ভুত চিন্তা মাথায় কাজ করছে। বারবার মনে হচ্ছে কাল শেষ পর্যন্ত তুমি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে, তারপর কাজী অফিসে আসবে না। তোমার ফোনের সুইচ অফ থাকবে। এমনটা কী হতে পারে বলো?”
মৌ ছোট করে নিশ্বাস নিল। সেই নিশ্বাসের শব্দের অনুভূতি যেন সানি ফোনের মাঝেই অনুভব করল।
মৌ বলল, “অবশ্যই এমনটা হতে পারে। কেন পারবে না?”
“তার মানে কাল তুমি আসবে না?”
“আসবো। তবে আসবো না এমনটাও হতে পারে। পৃথিবীতে অনেক কিছুই হুট করেই হয়ে যেতে পারে যা অবিশ্বাস্য। হঠাৎ করে তুমি দেখলে তোমার জানালার পাশের বহুদিনের পুরানো গাছটি তোমার সাথে কথা বলা শুরু করল তোমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও তা কিন্তু তোমার সাথে সত্যি ঘটছে।”
সানি ভীতু গলায় বলল, ” তুমি কীসের সাথে কীসের উদাহরণ দিচ্ছ আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
“তোমার বুঝতে হবে না। তুমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাও। আমি কাল বিয়ে করতে আসবো। এই নিয়ে তোমাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। কাল যদি আমাকে অবাক করে দিয়ে গাছ-পালা, নদী-নালা, আকাশ-বাতাসও বিয়ে করতে যেতে নিষেধ করে তারপরও আমি আসবো।”
“তোমার শরীর ঠিক আছে তো মৌ?”
“এখন পর্যন্ত আছে। কিন্তু তুমি যদি আজকের রাতে আমাকে ঘুমাতে না দাও আমার শরীর অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। দয়া করে যদি এখন ফোনটা রাখতে! আমি ঘুমের ঔষধ খেয়ে নেশার মধ্যে আছি।”
মৌ’র কথা শেষ হওয়ার আগেই সানি ফোন রেখে দিল। জানালা থেকে সাথে সাথে খিলখিল শব্দ করে পুরুষ কন্ঠস্বর হাসল। মৌ বলল, “কে?”
“বারবার কে কে করো কেন? আমি কতবার তোমাকে আমার পরিচয় দেব?”
“তুমি সত্যিই এইমাত্র মানুষের মত হেসে উঠলে?”
“হ্যাঁ”
“আমার ফোনের কথা বলার ধরন শুনে হাসছিলে?”
“হ্যাঁ। কত সহজে তুমি তোমার প্রেমিককে চমকে দিলে তাই ভেবে হাসছি। এতক্ষণ বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে রেখেছিলাম। তুমি ফোন রাখার সাথে সাথে হেসে ফেললাম।”
“তুমি এখনও কথা বলে যাচ্ছ, আবার হাসছ। আশ্চর্য! আমি সব শুনতে পাচ্ছি। অথচ এখন আর আমার ভয় লাগছে না বরং ভালো লাগছে।”
“তুমি ঘুমের ঔষধ খেয়ে এক ধরনের নেশার ভিতর আছ। সেই নেশার কারনে তোমার স্বাভাবিক ভয়ের অনুভূতি কেটে গেছে। নেশা কেটে গেলে আবার প্রচণ্ড ভয় শুরু হবে।”
“সত্যি বলছ?”
“হ্যাঁ সত্যি বলছি।”
“তুমি কি বলতে পারো, কাল আমার সাথে সানির বিয়ে কখন হবে?”
“বিয়ে হবে না।”
মৌ চোখ খোলার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। সে বিরক্ত কন্ঠস্বরে বলল, “কেন হবে না?”
“কাল তোমার সাথে অসম্ভব রকম অবাক করার এক বিষয় ঘটবে তারপর তোমার কাজী অফিসে যাওয়া হবে না।”
“কাল চন্দ্র-সূর্য এক হয়ে গেলেও আমি বিয়ে করতে যাব।”
“কাল তারচেয়েও বড় ঘটনা ঘটবে।”
মৌ সেই কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল, “তোমার কথা শুনে ধীরে ধীরে আমার মাথা ব্যথাটা বাড়ছে।”
“তুমি সোজা হয়ে শুয়ে থাকো। আমি তোমার মাথা টিপে দিচ্ছি।”
“তুমি আমার মাথায় হাত দিবে কেন?”
“আমি তোমার বাবার বয়েসি, তুমি আমার মেয়ের মত। তোমার মাথা টিপে দিলে খুব ক্ষতি হবে না।”
মৌ বাধ্য মেয়ের মত সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল। বাবার বয়সী কথাটার অর্থ সে বুঝতে পারল না বা বোঝার চেষ্টাও করল না। সে কপালে তেঁতুলের খোসার মত খসখসে এক হাত অনুভব করল। কিন্তু চমকালো না। বরং কোমল গলায় বলে উঠল, “বামদিকের ব্যথাটা বেশী। বারবার মনে হচ্ছে, হাতুড়ি দিয়ে কেউ একের পর এক বারি দিচ্ছে।”
পুরুষ কন্ঠস্বর বলল, “আমি বুঝতে পারছি। মাইগ্রেনের ব্যথা। তোমার মায়েরও আছে। তুমি নড়াচড়া করো না। একভাবেই শুয়ে থাক।”
“তুমি কেন বললে কাল আমার সানির সাথে বিয়ে হবে না? আমি যে তাকে কত ভালোবাসি তাকি তুমি জানো?”
“আমরা যাকে ভালোবাসি তাদের সাথেই যে আমাদের বিয়ে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। সবাই কী তাদের ভালোবাসার মানুষকে পায় বলো?”
“আমি কেন পাব না?”
“সানির সাথে তোমার বিয়ে ভাগ্যে নেই।”
“তুমি ভাগ্য বলতে পারো?”
“সবসময় পারি না। মাঝেমধ্যে পারি।”
“আমার সাথে কার বিয়ে ভাগ্যে লেখা?”
“অন্য যে কেউ। কিন্তু সে সানি নয়।”
“তোমার কথা শুনে আমার এখুনি গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।”
“তোমার কান্না করার মত শক্তি নেই। এখন ঘুমাও। কান্না করার জন্য অনেক সময় পরে আছে।”
মৌ ঘুমিয়ে পড়ল। রাতের বাকী সময় তার ঘুম ভালো হল।
চলবে….