#আজ_মৌর_বিয়ে (৩য় ও শেষ পর্ব)
লেখাঃ Shadbin Shakil
মৌ রান্নাঘরে গিয়ে কেটলি তে চা বসানোর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মাথা ঘুরে পড়ে গেল।
সানি দাঁড়িয়ে আছে পুরোনো ধূলোপড়া এক আয়নার সামনে।
এই আয়নাটা তার দাদার আমলের আয়না। আয়নার পাশে জমিদার আমলের কারুকাজ করা। আয়নাটা তার দাদা বিয়ের সময় তার রুপবতী দাদী জমেলা বেগমকে উপহার স্বরূপ দিয়েছিলেন। সে অনেক সময় ধরে নিয়ে নিজেকে দেখল। দাদী কখন থেকে তার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে আছেন সেদিকে খেয়ালই করেনি।
জমেলা বেগম বললেন, “এভাবে হুট করে তুই বাড়ি চলে এলি যে? সব ঠিকঠাক আছে তো?”
সানি পিছনে তাকিয়ে হাসিমাখা মুখে বলল, “সব ঠিক আছে দাদী। শহরের ব্যস্ত জীবন আর ভালো লাগে না। তাই গ্রামে চলে এসেছি।”
“এসেছিস ভালো করেছিস। ক’টা দিন এখানেই থাকবি। আমি এবার তোকে যেতে দেব না। আমার একা কী যে খারাপ সময় কাটে তুই চিন্তাও করতে পারবি না।”
“তোমার মত দেখতে মৌ নামের একজন রুপবতী মেয়ের প্রেমে পড়েছি দাদী।”
“আমার মত রূপবতী কোন মেয়ে নেই। অতীতেও ছিল না। ভবিষ্যতেও আসবে না।”
জমেলা বেগমের উত্তর সানির পছন্দ হল। সে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, “আজ আমার বিয়ের কথা ছিল দাদী। আসি আসি বলে শেষ পর্যন্ত মেয়েটা কাজী অফিসে এল না।”
“বলিস কী?”
“হ্যাঁ দাদী। তাকে বিয়ের জন্য একটা নীল শাড়িও কিনে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সে সেই শাড়ী পড়ে আসবে।”
“লাল শাড়ী দিলি না কেন? লাল শাড়ী দিলে ঠিকি আসতো। বিয়েতে কেউ নীল পড়ে নাকি?”
সানি হাসতে হাসতে বলল, “দাদী পুকুরে গোসল করব। আমি কোনো কাপড় নিয়ে আসিনি। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এসেছি। আবার রৌদ্রতে সেই ভিজা পাঞ্জাবী শুকিয়েও ফেলেছি। এখন কি পড়ব?”
জমেলা বেগম চোখে উৎসাহের ভঙ্গি এনে বললেন, “তোর দাদার পুরানো লুঙ্গি, পাঞ্জাবী আমি আলমারি থেকে বের করে দিচ্ছি। উনার সব কাপড়ই আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। আমার সবসময় কেন জানি মনে হত। তুই একদিন আসবি। এভাবে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে উপস্থিত হয়ে বলবি, ” দাদী আমি এক কাপড়ে তোমাকে দেখতে এলাম।” – বলতে গিয়ে জমেলা বেগমের কথা জড়িয়ে কান্না-কান্না ভাব চলে এল। চোখ টলমল করল। সানি এগিয়ে গিয়ে দাদীর হাত ধরল।
জমেলা বেগম বললেন, “আমি এভাবে তোর বাবার জন্যও অপেক্ষা করতাম। সে তো আর এল না। এল তার লাশের খাটিয়া।”
সানি বলল, “তোমাকে কতবার বলি তুমি আমার সাথে শহরে চলো। এখানে দাদা এবং বাবার কবরের কাছে থেকে তোমার কষ্ট শুধু বাড়ে।”
“এই বাড়িতে বউ হয়ে যখন এসেছিলাম তোর দাদাকে কথা দিয়েছি, লাশ হয়ে এই বাড়ি থেকে বের হব। এই জীবনে আমি আর কোথাও যাব না।”
সানি বাড়ির সান বাঁধানো ঘাটে লুঙ্গি, পাঞ্জাবী রেখে পাশের কবরস্থানে দাদা ও বাবা-মায়ের কবর জেয়ারত করল। তারপর পুকুরে নেমে এপার থেকে ওপারে সাঁতরে পার হতে লাগল। জমেলা বেগম বললেন, “তুই এমনিতেই ভিজে এসেছিস। এখন আবার সাঁতরাচ্ছিস। এই গ্রামে ভালো ডাক্তার ফাক্তার নেই। জ্বর বাঁধালে তোকে নিয়ে কই যাব?”
সানি সেই কথার উত্তরে শুধু বলল, “মোবাইলটা নিয়ে এলে ভালো হত দাদী। আমার সাঁতারের দৃশ্য ভিডিও করে ফেলা যেত।”
মৌ’র মাথায় কিছুক্ষন পরপর নুসরাত বেগম পানি ঢালছেন।
মৌ চোখ খুলে ভারী গলায় বলল, “তুমি না হাসপাতালে ছিলে? কখন এলে? আসিফ সাহেব কোথায়?”
নুসরাত বেগম বললেন, “কী বলছিস তুই? আমি হাসপাতালে থাকব কেন। আজ সকাল থেকে তুই বারবার জ্ঞান হারাচ্ছিস। আর আবোল তাবোল বকছিস। এখন সত্যি আমার তোকে নিয়ে বড্ড ভয় করছে।”
মৌ উঠে বসে আশেপাশে তাকাল।
নুসরাত বেগম বললেন, ” শুয়ে থাক মা, ডাক্তার এসে তোকে ইনজেকশন দিয়ে গেছেন। তুই সুস্থ হয়ে যাবি।”
মৌ বলল, “আমি কী সত্যিই এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম মা? স্বপ্ন এত জীবন্ত কী করে হয়? বাবার রুপে তেঁতুল গাছ এল আমার সাথে গল্প করল। তুমি হাসপাতালে ছিলে এসব কী সব স্বপ্ন ছিল?”
নুসরাত বেগম কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, “তুই এসব কী বলছিস? আমি সবসময় তোর বাবার কথা মনে করে এটা-ওটা বলি বলে আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস তাই না?”
মৌ বিছানায় আবার শুয়ে বলল, “আমার সাথে কী ঘটছে সত্যিই আমি বুঝতে পারছি না। আমার মোবাইলটা দাও তো।”
নুসরাত বেগম মোবাইল এগিয়ে দিল। মৌ সানির নাম্বারে ডায়াল করল। ওপাশ থেকে নারী কন্ঠস্বর ভেসে এল।
“হ্যালো।”
“আপনি কে?”
“আমি অধোরা। আপনি নিশ্চয়ই মৌ বলছেন, তাই না? সানি সকাল থেকে আপনার জন্য অপেক্ষা করল। সে চলে গেছে দশ মিনিটের মত হয়ে গেছে। ফোন আমার কাছে রেখে গেছে।”
অবিকল স্বপ্নের মত কথাগুলো অধোরা এক নাগাড়ে বলল। মৌ বলল, “নিশ্চয়ই সে গ্রামের বাড়ি গেছে?”
“হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কী করে জানলেন? ”
“যাওয়ার সময় বলে গেছে- এই বিয়ে আজ যখন হয় নি আর কখনও হবে না।”
“হ্যাঁ-হ্যাঁ। আপনার সানির সাথে কথা হয়েছে?”
মৌ খপ করে ফোন কেটে দিল। নুসরাত বেগম আড়চোখে মৌ’কে দেখছেন। মৌ বলল, “আমার বিছানার পাশে নীল রঙের একটা শাড়ী পেয়েছ?”
“নাতো।”
“মিথ্যা বলো না মা। পেলে বলো হ্যাঁ পেয়েছি।”
“হ্যাঁ পেয়েছি।”
“শাড়ীটা আমাকে দাও সেটা পড়ে এখন আমি সানিদের বাড়িতে যাব।”
“সানিটা কে?”
“তোমার মেয়ের হবু জামাই।”
নুসরাত বেগম ভয়ে ভয়ে শাড়ী এনে দিলেন। মৌ বলল, “তুমি আমাকে এত ভয় পাচ্ছ কেন মা? আশ্চর্য তো! আমি তোমার মেয়ে, কোনো ভূত-পেত্নী বা তেঁতুল গাছ নই।”
সানির কোঁকড়ানো চুল এলোমেলো। চোখ রক্তবর্ন হয়ে আছে। গোসল শেষে সে দাদার লুঙ্গি পড়ে খালি গায়ে বারান্দার চৌকিতে শুয়ে পড়ল।
জমেলা বেগম বললেন, “সানি আমি তোর জন্য গুঁড়া মাছ আর ডালের বড়া করছি। আর কী কী খাবি বল?”
সানি মুচকি হাসল। তার চোখ জ্বলছে। নাক সিরসির করছে। প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
জমেলা বেগম ডালের বড়া বানাতে বানাতে আনমনে রান্নাঘরে গান গাইছেন, “ও প্রেম করতে দুইদিন ভাঙতে একদিন এমন প্রেম আর কইরো না জননী…প্রেমের মরা জলে ডোবে না…”
মৌ’র সানিদের বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। যখন সে বাড়িতে পৌঁছাল ঠিক তখন থেকেই চারদিকে ঝুম বৃষ্টি শুরু হল। সানির জ্বর ক্রমশ বাড়ছে…
মৌ’কে দেখে জমেলা বেগম বললেন, “তুমিই কী সেই রুপবতী মেয়ে মৌ? জ্বরের ঘোরে আমার নাতি বহুবার তোমাকে সরণ করেছে।”
মৌ বলল, “আপনি আমাকে চিনলেন কীভাবে?”
“নীল শাড়ি দেখে চিনেছি। তুমি একটু ওর পাশে বসো। আমি চোখে কম দেখি, নাহলে আরও আগেই চেহারা দেখে বুঝতে পারতাম আমার নাতির জ্বর এসেছে। পাশের বাড়ি একজন ডাক্তার আছেন। সবসময় তাকে পাওয়া যায় না। আমি একবার গিয়ে দেখে আসি।”
ডাক্তারের বাড়ি ডাক্তার ছিল না। জমেলা বেগম এইবাড়ি ওইবাড়ি ডাক্তারের সন্ধানে ছোটাছুটি করতে লাগলেন। মৌ চৌকিতে সানির পাশে বসল। সে সানির দিকে তাকিয়ে আছে। সানি চোখ বন্ধ অবস্থায় বলল, “তুমি কখন এসেছ?”
“আমার তো আসার কথা আরও আগেই ছিল। বড্ড দেরী করে ফেললাম।”
সানি হাসল।
মৌ বলল, “হাসছ যে? তুমি হঠাৎ এত জ্বর বাঁধালে কী করে? আমি তোমাকে কত কষ্টে খুঁজে বের করেছি জানো?”
সানি বলল, “তুমি কাজী অফিসে এলে না কেন?”
“একটা ঝামেলা হয়ে গেছে জানো? আমি যা স্বপ্নে দেখি তাই আমার কাছে বাস্তব মনে হয়। একটা তেঁতুল গাছ বাবার আকৃতিতে এসে আমাকে অনেক যন্ত্রণায় ফেলে দিয়েছেন।”
সানি কিছু বলল না। মৌ বলল, “তোমারও কী মায়ের মত আমাকে পাগল মনে হয়?”
“না।”
“আমি খুব খারাপ আছি সানি। তেঁতুল গাছ বলল, তোমার সাথে আমার বিয়ে হবে না।”
সানি কাঁপা গলায় বলল, “আমি মৃত্যুর মুখে চলে এসেছি মৌ। ছোটবেলাতেই আমার মৃত্যু হত কিন্তু মা হতে দেয়নি। আজ আবার একবার মৃত্যুর দ্বারে পৌঁছে গেছি। আজ মা নেই। আমার নির্ঘাত মৃত্যু হবে।”
“আজেবাজে কথা বলবে না। এসব কথা আমার পছন্দ না।”
সানি এখন হাঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তার কথা জড়িয়ে আসছে। মৌ তার হাত ধরল। শরীরের উত্তাপ দেখে নিজেই চমকে উঠল। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে বৃষ্টি হচ্ছে। জমেলা বেগম এখনও ডাক্তার নিয়ে ফিরছেন না। এ গ্রামের কোথাও কিছু সে চেনে না। সে একবার বাড়ির মধ্যে হাঁটাহাঁটি করছে আবার সানির পাশে বসছে।
হঠাৎ করে সে দেখতে পেল বাড়ির উঠোনে আসিফ সাহেব হাসি হাসি চেহারায় বৃষ্টিতে ভিজছেন। তার পড়নে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। মৌ এক দৃষ্টিতে বারান্দার খুঁটি ধরে সেদিকে তাকিয়ে রইল। সাথে সাথে সানির রক্তবমি শুরু হল। সে চৌকি থেকে মাটিতে পড়ে গেল। বৃষ্টির বেগ আরও বাড়তে লাগল।
মৌ কোনো উপায় না দেখে নির্ভয়ে দৌড়ে উঠোনে আসিফ সাহেবের কাছে ছুটে এসে বলল, “প্লিজ কিছু করুন। আমার ভালোবাসার মানুষটি মরে যাচ্ছে।”
সাদা পাঞ্জাবীর ছায়ামূর্তি বলল, “আমি কিছুই করতে পারব না মৌ। ভাগ্যে তোমার আর সানির বিয়ে কিছুতেই হতে দেবে না। যে কোনো ভাবে এই বিয়ে বন্ধ হয়ে যাবে।”
“আমি তাকে বিয়ে করতে চাই না। এই মুহূর্তে শুধু তার জীবন বাঁচাতে চাই।”
“জীবন তো শুধু সেই বাঁচাতে পারবে যিনি জীবন দিয়েছেন। আমরা তো শুধু উছিলা মাত্র।”
মৌ কাঁদতে কাঁদতে বলল, “প্লিজ কিছু তো করুন। কিছু একটা করুন।”
বাড়ির ভিতর থেকে সানি ডাকল, “মৌ।”
সাদা ছায়ামূর্তি মৌ’কে এক বাটি তেঁতুলের রস এগিয়ে দিয়ে বলল, “মৌ তোমার হাতে দুটো অপশন আছে। একটা হল তুমি এখন সানিকে বাঁচালে তোমার জীবন হাসপাতালের সেখান থেকে শুরু হবে যেখান থেকে তোমার মা অসুস্থ হয়েছিলেন। আর যদি এখানেই সানির মৃত্যু হয় তাহলে আজ সকালে যখন তোমার মা ঘুম থেকে জাগিয়েছেন সেখান থেকে শুরু হবে। এখন বলো, তুমি কী চাও? তবে একটা কথা মনে রেখ, সেই জীবনে ফিরে গেলে তুমি সানির সাথে যোগাযোগ রাখতে পারবে না। নয়তো ভাগ্যে কোনো না কোনোভাবে তোমাকে আবার এমন মুহূর্তে এনে দ্বার করাবে।”
মৌ বলল, “আমি শুধু তার মৃত্যু চাই না। আর সবকিছু মেনে নিতে রাজি আছি।”
ছায়ামূর্তি বললেন, “তবে যাও এই তেঁতুল তার মুখে দিয়ে এসো।”
মৌ তেঁতুলের রস নিয়ে ছুটে এসে দেখল সানি মাটিতে গড়িয়ে কাতরাচ্ছে। তার মুখ থেকে সাদা ফেনার মত বের হচ্ছে। মৌ বলল, “হে ভালোবাসার মানুষ তোমার সাথে এই আমার শেষ দেখা।”
মৌ সানির মুখে তেঁতুলের রস দেওয়ার সাথে সাথে চারদিকে বজ্রপাতের শব্দ হল। মৌ আবারও ছুটে গিয়ে বারান্দার খুঁটি ধরে তাকিয়ে দেখল সাদা পাঞ্জাবীর ছায়া মূর্তি ক্রমশ বৃষ্টির সাথে মিশে যাচ্ছে। মৌ বলল, “আপনি কে? একবার আমাকে বলে যান, আপনি কে?”
ছায়ামূর্তি বললেন, “আমি কেউ নই। কিন্তু তোমার কাছে আমার পরিচয় আমি তেঁতুল গাছ। তবে এখন তুমি যে জীবনে তুমি ফিরে যাচ্ছ, সেখানে যিনি রয়েছেন তিনি হচ্ছেন তোমার বাবা আসিফ সাহেব।”
ছায়া মূর্তি বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে মৌ’র নাম ধরে কেউ ডাকতে লাগল। সেই ডাক মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করে তার কানে বাজছে। মৌ চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল বড় ফুফু তার চোখের সামনে দাড়িয়ে আছেন।
তিনি বললেন, “তুই এখন বাসায় যা আমরা সবাই তোর মায়ের পাশে আছি। সারাদিন তোর অনেক ধকল গেছে।”
মৌ পাশে তাকিয়ে আসিফ সাহেব কে দেখে চমকে উঠল। বড় ফুফু চাপা গলায় বললেন, “মৌ, উনি তোর বাবা।”
মৌ আসিফ সাহেবকে বলল, “আমাকে আপনি একটু বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসতে পারবেন?”
তিনি চোখমুখ উজ্জ্বল করে বললেন, “অবশ্যই পারব মামুনি।”
মৌ আসিফ সাহেবের সাথে গাড়িতে উঠে নিশ্চুপ হয়ে আছে। গাড়ি ষ্টার্ট দিয়ে আসিফ সাহেব বললেন, “তোমার কী খুব খারাপ লাগছে মামুনি?”
মৌ সিটে হেলান দিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল, “তা নয় বাবা। তুমি এতটা বছর পর ফিরে এসেছ। মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সবকিছু স্বপ্নের মত লাগছে। এই যে তুমি আমাকে মামুনি বলছ আমার যে কত ভালো লাগছে তোমাকে বোঝাতে পারব না।”
আসিফ সাহেব বললেন, “আমি কখনোই তোমাদের ছেড়ে যেতে চাই নি। বিশ্বাস করো যেতে চাই নি। তোমার মা আর আমার……”
মৌ আসিফ সাহেবকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আমি শুনতে চাচ্ছি না বাবা। মা আর তোমার মাঝে যা হয়েছিল সেই বিষয়টা তোমাদের মাঝেই থাক। শুধু আজকের দিনে নয়, আমি আর কখনোই শুনতে চাই না। তুমি ফিরে এসেছ সেই অনেক।”
আসিফ সাহেব চুপ হয়ে রইলেন।
বাসায় এসে হাতমুখ ধুয়ে মৌ মোবাইলের সুইচ অন করল। কাঁপা কাঁপা হাতে সানিকে মেসেজ করল, “আমাকে ক্ষমা করে দিও। এই বিয়ে আমি করতে পারব না।”
তারপর ফোনের সিম বের করে জানালা থেকে তেঁতুল গাছের দিকে ছুঁড়ে ফেলল। মনে মনে বলল, “আমরা কখনোই প্রকৃতির নিয়মের বাইরে যেতে পারব না। কখনোই না।”
তেঁতুল গাছের ডালপালা মৃদু বাতাসে দুলে উঠল।
আসিফ সাহেব সোফায় বসে টিভি অন করল। মৌ হাতমুখ ধুয়ে এসে বলল, “চা খাবে বাবা?”
আসিফ সাহেব বললেন, “আমি তো চা খাই না মামুনি। কিন্তু তুমি বানালে খেতে পারি।”
মৌ দুই কাপ চা বানিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ল।
দশ বছর পর।
টুনটুনি নামের ছ’বছরের মেয়েকে নিয়ে অধোরা সাইকিয়াট্রিস্টের সামনে বসে আছেন।
ডাক্তার চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে হাতের কলমটা ঘুরাতে ঘুরাতে বললেন, “এই মেয়ের কথা বলেছিলেন?”
অধোরা বলল, “জী।”
ডাক্তার বললেন, “ঠিক আছে আপনি বাইরে অপেক্ষা করুন। আমি একটু ওর সাথে একা কথা বলি।”
অধোরা মেয়েকে বলল, “ডাক্তার যা জিজ্ঞাসা করবে সব ঠিকঠাক উত্তর দিবে। নো হাংকি পাংকি।”
টুনটুনি খিলখিল করে হাসল। ডাক্তার বলল, এখন বলো তো টুনটুনি পাখি তোমার পুরো নাম কী?”
টুনটুনি বলল, “আমার নাম শুধু টুনটুনি। সাথে পাখি টাখি নেই।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার বাবা মায়ের নাম কী?”
“সানি আহমেদ এবং অধোরা ইসলাম।”
“তুমি বাড়িতে বাবা আর মা ছাড়াও নাকি কার সাথে একা একা কথা বলো?”
“একটা গাছের সাথে কথা বলি। সে আমার বান্ধবী।”
“তাই নাকি? তার মানে গাছটা মেয়ে গাছ?”
“হ্যাঁ”
“কী নাম গাছটার?”
“মৌ। অনেকে তাকে ভালোবেসে মধু ডাকে।”
“তাই? সেই গাছে মৌমাছি পোঁকা আছে নিশ্চয়ই?”
টুনটুনি চুপ করে রইল।
“শোনো টুনটুনি তুমি নিজেকে পাখি মনে করো তাই গাছের উপর পাখিদের থাকতে দেখে তোমারও নিজেকে পাখি মনে হয়। তাই তুমি গাছের সাথে কথা বলো। আসলে তুমি মানুষ। আমরা সবাই মানুষ। কী বলেছি মনে থাকবে?”
টুনটুনি ফিক করে হেসে বলল, “মনে থাকবে।”
“তাহলে মৌ নামের গাছের সাথে আর কথা বলবে না কেমন?”
টুনটুনি আবারও ফিক করে হেসে বলল, “মৌ’র বিয়ে হয়ে গেলে আর কথা বলব না।”
“সমাপ্ত”