আজ_রিক্তার_মৃত্যুবার্ষিকি। #পর্বঃ- চার (০৪)

0
270

#আজ_রিক্তার_মৃত্যুবার্ষিকি।
#পর্বঃ- চার (০৪)

সাজুকে জড়িয়ে ধরে রিক্তার মা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। ঘরভর্তি মানুষে গিজগিজ করছে। সাজুর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে মাহবুব আলম। প্রতিবেশী সব মহিলারা শুধু ভিড় তরেই সন্তুষ্ট নয়, সবাই কানাকানি আর ফিসফিসে শব্দে ঘরটার ভেতর হৈচৈ পড়ে গেল।

দারোগা মাহবুব আলম উপস্থিত সকল মহিলাদের ঘর খালি করার নির্দেশ দিলেন।

– কি ব্যাপার এতো মানুষ কেন এখানে? এভাবে ভিড় করার তো কোনো ঘটনা ঘটেনি। এভাবে সবাই একসঙ্গে দলা পাকিয়ে একটা বিপদ করবেন বলে মনে হচ্ছে। বের হন.. বের হন..!

দারোগার কথা শুনে ঘর সম্পুর্ণ খালি হবার তেমন কোনো লক্ষন দেখা গেল না। দু একজন যারা বের হয়ে গেল তারা মূলত পাড়ার লজ্জাবতী গৃহিণী কিংবা অল্পবয়সী মেয়ে। রিক্তার মা তখনও সমানে কাঁদছে, তার হাতটা ধরে মাথাটা নিজের শরীরে মিশিয়ে রাখলেন সাজু ভাই।

– আরে কি মুশকিল, আপনারা কথা শুনতে পান না নাকি? এখন তো মনে হচ্ছে লাঠিপেটা করে বের করতে হবে। কি অদ্ভুত পাবলিক রে বাবা।

এবারের ধমকে বেশ কিছু মহিলা বের হয়ে গেল। তবে সম্পুর্ন খালি হলো না কারণ সাজু ভাই সেই মুহূর্তে রিক্তার মা’কে বললো,

– চাচী কি হয়েছে? এতবড় একটা ঘটনা ঘটলো আর আপনি এভাবে ফাঁস নিলেন কেন?

রিক্তার মায়ের কান্না বাড়তে লাগলো। তার কান্না দেখে বিরক্ত হলো দারোগা মাহবুব। আর সাজুর প্রশ্নের উত্তর রিক্তার মায়ের মুখ থেকে শোনার জন্য উৎসুক হয়ে আছে অন্যান্য মহিলারাও।

– বলেন চাচী, কি হয়েছে আপনার? আপনি কি রিক্তার স্বামীর মৃত্যুর কিছু জানেন? আমাকে সব বলেন, আমি আছি আপনার ছেলে। আপনারা কোনো বিপদে পড়েন এরকম কিছু আমি কখনো হতে দিবো না ইন শা আল্লাহ।

– আমি কিছু জানি না সাজু, বিশ্বাস কর বাপ আমি জানতাম না এভাবে কিছু হবে।

দারোগা মাহবুব আলম বললেন,
– তাহলে আপনি আপনার মেয়ের হাসবেন্ডকে রাতে খাবার শেষে সতর্ক করেছিলেন কীভাবে? কীভাবে বলেছিলেন বাড়ির পিছনের বাগান দিয়ে পালিয়ে যেতে।

ঘরের ভেতরে আবারও গুঞ্জন উঠে গেল। দারোগা আবারও ধমক দিলেন সবাইকে। কোর্টে জর্জ সাহেব যেভাবে সবাইকে চুপ করতে বলেন ঠিক সেভাবেই চলছে দারোগার কাজকর্ম।

– চাচী বলেন।
অভয় দিয়ে জিজ্ঞেস করলো সাজু৷

মাহবুব আলম বললেন,
– আপনার স্বামী সেদিন আপনার মেয়ের হাসবেন্ড সাব্বিরকে খুন করতে চাইছে আপনি কীভাবে জানলেন।

সাজু ভাই মাহমুবের দিকে তাকিয়ে বললো,
– স্যার প্লিজ, চাচীকে তার নিজের মতো করে বলতে দিন প্লিজ। এমনিতেই বাড়িসুদ্ধ মানুষের জন্য তিনি নার্ভাস হয়ে গেছে।

– কেন, নার্ভাস কেন হবে? নিজে যদি কোনো দোষ না করে তাহলে নার্ভাস হবার প্রশ্নই ওঠে না।

রিক্তার মা বললো,
– জামাইকে খেতে দিয়ে আমি কাছারি ঘরে যাই তোর চাচাকে ডাকার জন্য। ভেবেছিলাম একসঙ্গে খেতে দেবো তাদের। তখন বিদ্যুৎ ছিল না, আমি যে দরজার সামনে গেছি সেটা বাদল আর তোর চাচা কেউই দেখেনি।

– তারপর? তারপর কি হলো সেখানে? আপনি কি তাদের মধ্যে খারাপ কিছু বলতে শুনেছেন।

– তোর চাচার আগে থেকেই রিক্তার স্বামীর প্রতি রাগ ছিল। তিনি কিন্তু কোনদিন চাইতেন না রিক্তার স্বামী এ বাড়িতে আসুক। এমনকি রিক্তা যখন চট্টগ্রাম থেকে ফেরার পথে এক্সিডেন্ট করে মারা গেল। তখনও জামাইকে আসতে দেয়নি তোর চাচা।

ঘর প্রায় নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। দারোগা সাহেব নিজেও তাকিয়ে আছে মনোযোগ দিয়ে শোনার জন্য। সাজু কিছু না বলে চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগলো। রিক্তার মা আবার বললেন,

– চট্টগ্রামের হাসপাতাল থেকে রিক্তার লাশ নিয়ে আসার সময় তোর চাচা সাব্বিরকে বারবার বলে দেন যেন আমাদের বাড়িতে কখনো না আসে।

দারোগা মাহবুব আলম বললেন,
– আপনার মেয়ে কীভাবে মারা গেছে বললেন?

– এক্সিডেন্ট করে, বিয়ের পরে ওর যখন ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল তখন রিক্তা একটা চাকরি নিয়েছিল। সেই চাকরির জন্যই রিক্তা চট্টগ্রামে গেছিল। সেখান থেকে ফেরার পথে এক্সিডেন্ট করেছিল ওরা।

– সাজু বললো, ওই প্রসঙ্গ পরে আসবো চাচী। আপনি সেই রাতের ঘটনা বলেন।

– কিছুদিন আগে তোর চাচা হঠাৎ আমাকে বলেন যে রিক্তার স্বামীকে এবার ওর মৃত্যুবার্ষিকীতে আসতে বলবেন। আমি সন্দেহের সঙ্গে তোর চাচার কাছে বললাম ” হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিলেন কেন। ”
তোর চাচা বললো, ছেলেটার তো কোনো দোষ নেই। আসুক নাহয়, একবার দেখে যাক।

– আপনার সঙ্গে কি রিক্তার স্বামীর সবসময় কথা হতো চাচী?

– হ্যাঁ হতো, সাব্বির নিজেই দু একদিন পরপর কল দিত আমাকে। তোর চাচা কোনদিন কথা বলেনি, তাই আমাকে বললেন আমি যেন সাব্বিরকে রিক্তার এবারের মৃত্যুবার্ষিকিতে আসতে বলি। আমিও ভাবলাম যে মানুষের রাগ তো চিরকাল থাকে না৷ তাই সাব্বিরকে বললাম যে তোমার শ্বশুর তোমাকে আসতে বলছেন। সাব্বির অনেক খুশি হয়ে গেছিল। তারপর বললো ” আম্মা আমি তো চাকরি করি। যেদিন রিক্তার মৃত্যুবাষিকী সেদিন তাহলে আসবো। ”
আমি তোর চাচার কাছে বললাম, তিনি বললেন ঠিক আছে আসুক কোনো সমস্যা নেই। তারপর আর কি, সাব্বির আসলো সেদিন।

মাহবুব আলম বললেন,
– এতো বিস্তারিত বলতে হবে না। এগুলো যখন আদালতে যাবেন তখন বলবেন। আপনি রাতে আপনার স্বামীকে ডাকতে গিয়ে কি শুনেছেন? যখন বিদ্যুৎ ছিল না।

– উনি আর বাদল জামাইকে নিয়েই কথা বলছিল। তাদের কথাবার্তা শুনে আমি ভয় পেলাম। আমার মনে হচ্ছিল সাব্বিরকে ওনারা মেরে ফেলবে।

– কেন মনে হচ্ছিল আপনার?

– কারণ তোর চাচা বারবার বলছিল যে ছেলেটার জন্যই আমার মেয়ে মারা গেছে। ওর সঙ্গে ঝগড়া করে আমার মেয়ে চট্টগ্রামে গেছে। চট্টগ্রামে যাবার জন্য আমার মেয়ের সঙ্গে অনেক খারাপ ব্যবহার করছে। আমার মেয়ের মৃত্যুর জন্য ও-ই দায়ী। বাদল তখন বলে, চাচা তাহলে ওরে জনমের শিক্ষা দিয়ে দেবো? সেটা শুনে তোর চাচা কিছু বলে নাই।

– আর কিছু বলে নাই?

– জানি না, কারণ আমি তখন কাছারি ঘরের সামনে থেকে চলে আসি।

– তাহলে সাব্বিরকে কেন বললেন যে আপনার স্বামী তাকে খুন করতে চায়। মেয়ের হত্যার জন্য প্রতিশোধ নিতে চায় সেটা কেন বলেছেন। যদি সেরকম কিছু না হয়ে থাকে তাহলে কেন শুধু শুধু এরকম কথা বলবেন।

– ভয় দেখানোর জন্য! আমি ভেবেছিলাম যদি মারধর করে কিংবা কিছু করে। তাই একটু আগ বাড়িয়ে বেশি বলে ফেলেছিলাম যেন তাড়াতাড়ি চলে যায়।

মাহবুব আলম হতাশ হয়ে গেলেন। তবে কতটুকু বিশ্বাস করলেন সেটা বোঝা গেল না। মনে মনে বললেন, মহিলা মানুষের এতো প্যাঁচ কেন আল্লাহ। কিসের মধ্যে কি হয়ে গেছে বুঝলাম না।

রিক্তার মা বললেন,
– পরশু রাতে তুই রিক্তার স্বামীকে নিয়ে বাহিরে যাবার পরে তোর চাচা আমার কাছে এসে আমাকে বকাবকি করে।

– কেন?

– সাব্বির নাকি কাছারি ঘরে বসে তোর চাচাকে জিজ্ঞেস করছে ” আব্বা আপনি কি আমাকে খুন করতে চান? যদি খুন করার ইচ্ছে থাকে তাহলে আমাকে বলেন। শুধু শুধু নিজে কেন মারবেন। ”
তারপর তোর চাচা তো অবাক হয়ে গেছে। তখন সাব্বিরকে জিজ্ঞেস করার পড়ে সাব্বির বলছে যে আমি বলেছি তিনি ওকে খুন করবে। তাই তুই সাব্বিরকে নিয়ে যাবার পরে তোর চাচা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করছে। অনেক বকাবকি করলো সাজু৷ বললো যে ” রাগারাগি করতে পারি তাই বলে কি জামাইকে খুন করবো? ” এরকম বেআক্কল মার্কা কথা কেন বললাম।

সাজু ভাই বললো,
– তারপরই আপনি রিক্তার স্বামীর কাছে আবার কল করেছিলেন তাই না? তাকে বলেছিলেন যে আপনার শুনতে ভুল হয়েছে। সে যেন নির্ভয়ে বাড়ি যায় তাই তো।

– হ্যাঁ, তাই বলছিলাম আমি। তারপর তো তুই ওকে বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেলি। আমি সাব্বিরের জন্য বিছানা ঠিকঠাক করে দিয়ে গেলাম। সাব্বির রুমের দরজা বন্ধ করে দিল।

মাহবুব আলম বললেন,
– রাতে কতক্ষণ পর্যন্ত তার রুমের বাতি জ্বালিয়ে রেখেছিল বলতে পারেন? সাজু সাহেব, আপনি তো জানেন সাব্বির ডায়েরি লিখেছিল। সুতরাং সে তো অবশ্যই অনেক রাত পর্যন্ত জেগে তারপর ডায়েরি লিখেছে।
আচ্ছা সকাল বেলা সবার আগে সাব্বিরের লাশটা কে দেখেছে? আপনি নাকি অন্য কেউ।

– আমিই দেখেছিলাম। সকালে ডাকতে এসে দেখি দরজা খোলা বিছানায় সাব্বিরের লাশ পড়ে আছে। বুকের উপর রক্তে সব লাল হয়ে আছে। আমি চিৎকার করে রিক্তার বাপ রিক্তার বাপ বলে ডাকাডাকি শুরু করি।

সাজু কিছু বললো না, শুধু সবগুলো কথা ভাবতে লাগলো। যদি রিক্তার মায়ের কথা সত্যি হয়ে থাকে তাহলে ঘরে ঢুকে পিস্তল দিয়ে গুলি করবে কে? গুলির শব্দ পেল না কেউ, তারমানে কি খুনির পিস্তলে সাইলেন্সর লাগানো ছিল। কিন্তু যদি খুনি এসে থাকে তাহলে দরজা খুলে দিল কে? আর সাব্বির কি সত্যি সত্যি এতকিছুর পরও থাকবে।

সাজু বললো,
– আমার সঙ্গে যখন নদীর পাড়ে গেছিল তখন কি শুধু আপনিই কলে কথা বলেছিলেন। নাকি চাচাও কিছু বলেছিল তাকে।

– তোর চাচাও কথা বলেছিল।

দারোগা মাহবুব আলম বললেন,
– কেন বলেছেন? আদর করে বাড়িতে এনে রাতে গুলি করে মারার জন্য নাকি? আচ্ছা বলেন তো খুনটা করেছে কে, আপনি নাকি আপনার স্বামী।

” এরা কেউ আমার ছেলেকে খুন করেনি অফিসার সাহেব। আমার ছেলেকে খুন করেছে ঢাকার কিছু লোক। ”

দরজার সামনে থেকে আসলো কথাগুলো। সাজু ভাই, মাহবুবসহ সবাই তাকিয়ে রইল দরজার সামনে। দরকার সামনে ভেজা চোখে সাব্বিরের মা দাঁড়িয়ে আছে। তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে।

সাজু বললো,
– আপনিই কি সাব্বির সাহেবের মা?

– জ্বি। আর এই হচ্ছে সাব্বিরের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ইলিয়াস, ওর কাছেই সাব্বিরের মৃত্যুর খবর পেয়েছি। আমি নাটোরে বসেই জানতে পেরেছি আমার ছেলেকে খুন করা হয়েছে।

সাজু বললো,
– আপনি কীভাবে জানলেন যে আপনার ছেলেকে এখানকার কেউ খুন করেনি।

– আমি সাব্বিরকে বারবার বলেছিলাম যা হবার হয়ে গেছে সব ভুলে যা। ওর বউ মারা গেছে সে তো আর আসবে না। তাহলে তার খুনিদের পিছনে লেগে থেকে লাভ কি?

মাহবুব আলম বিস্ময় নিয়ে বললেন,
– রিক্তাকে খুন করা হয়েছিল?

– হ্যাঁ। রিক্তা এক্সিডেন্টে মারা যায়নি। প্ল্যান করে এক্সিডেন্টের মাধ্যমে তাকে খুন করা হয়েছে। এটা আমার ছেলে জানতে পেরেছিল।

সাজু ভাই বললেন,
– স্যার সাব্বিরের মোবাইল কোথায়?

মাহবুব আলম বললেন,
– আমরা তো কোনো মোবাইল পাইনি।
.
.
.
.চলবে…

লেখা:-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here