আঠারো_বছর_বয়স,পর্ব-১৭,১৮
লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
পর্ব-১৭
বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি। অন্ধকার ঘরে বইছে দখিনা বাতাস। বিভোর রুহিকে বলছে,
‘একদিন একটা মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো। গ্রামের মেয়ে। কিছু জানতোনা, বুঝতো না। সে ট্রেনে উঠেই ঘুমিয়ে পড়লো। সেই ট্রেনেরই একটা ছেলে হঠাৎ দেখতে পেলো একটা মেয়ে ঘুমুচ্ছে। কামরাটা তখন খালি ছিলো বিধায় মেয়েটির নিরাপত্তার জন্য ছেলেটি মেয়েটির কাছাকাছি সিটে বসে। মেডিকেল কলেজের ছাত্র সে। ছুটিতে বাড়ি ফিরছিলো। তখন বেশ রাত। মেয়েটির কপালে কাঁটাছেড়া ছিলো। ছেলেটি মেয়েটিকে ডাকলো। হঠাৎ সামনে একটা অচেনা লোককে দেখতে পেয়ে মেয়েটি ভয়ার্ত চাহনি নিয়ে তাকায়। ছেলেটি ওকে সহজ করার জন্য বিভিন্ন কথা বলে। একসময় জানতে পারে ডাক্তারদেরকে মেয়েটা খুব পছন্দ করে। ছেলেটি হাসলো। মেয়েটিকে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী। লালচে আভায় গাল দুটি টকটকে রক্তজবা ফুলের মতো স্নিগ্ধ লাগছিলো। ছেলেটি মেয়েটার নাম দেয় রক্তজবা। মেয়েটি জানতোনা সে কোথায় যাবে, ছেলেটা ওকে বকাঝকাও করলো। হঠাৎ কয়েকটা ছেলে ধরেবেঁধে ওদের দুজনকে বিয়ে দিয়ে দেয়।’
রুহি অবাক হয়ে বলল,
‘এটা কোনো গল্প হলো নাকি!’
বিভোর মিষ্টি হেসে বলল,
‘হ্যাঁ। তুমি শুনো আগে।’
তারপর আবার বলা শুরু করলো,
‘হঠাৎ এইরকম একটা কান্ড ছেলেটা মানতে পারলোনা। সে ভাবলো মেয়েটার জন্যই সবকিছু হয়েছে তাই ওকে শাস্তি দিবে। কিন্তু সদ্য ভোরের স্নিগ্ধ আলোতে আঠারো বছর বয়সের সেই ছোট্ট মেয়েটির মুখপানে তাকিয়ে ছেলেটির মনে হলো ওরা দুজনই পরিস্থিতির শিকার। মেয়েটির সাহায্য দরকার ছিলো বিধায় সে সিদ্ধান্ত নিলো মেয়েটাকে সাহায্য করবে এবং ওর বাড়ি দিয়ে আসবে, ফ্যামিলির লোকজনদের সবকিছু বুঝিয়ে বলবে। হঠাৎ হয়ে যাওয়া বিয়েটা ভেঙ্গে দিবে।’
এতটুকু বলে বিভোর থামলো। লক্ষ করলো রুহির চোখে পানি। বিভোর আবারও বলল,
‘কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস। মেয়েটার বাড়ির লোক ভালো ছিলোনা। খুব জঘন্য আচরণ করলো ওর সাথে। ছেলেটা এসব দেখে সিদ্ধান্ত নিলো মেয়েটাকে ঢাকায় নিজের সাথে নিয়ে আসবে। পড়াশোনা করাবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। যেহেতু সে একজন মেডিক্যাল ছাত্র ছিলো সেই সুবাদে তার সাথে অনেকের ভালো সম্পর্ক ছিলো। ঢাকায় নিয়ে এসে সবকিছু বন্দোবস্ত করে দেয় ছেলেটি। ওর এক বান্ধবীর তত্ত্বাবধানে রাখে। এতটুকু পর্যন্ত মেয়েটি ওর সাথেই ছিলো। আঠারো বছর বয়সের সেই মেয়েটির প্রতি তখন ছেলেটার কোনো অনুভূতি জন্মায়নি। ভেবেছিলো বিয়েটা ভেঙ্গে দিবে। কিন্তু সদ্য করা বিয়ে ভাঙ্গা যায়না, অনেক ফর্মালিটি আছে। তাই এই কাজটা করা ছেলেটির পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাছাড়া পড়াশোনার চাপে আর বিদেশে একটা কোর্স করতে গিয়ে ছেলেটি নিতান্তই ভুলে গেলো তার বিয়ের কথা, ছোট্ট বউটির কথা।’
রুহি চুপচাপ হয়ে সবকিছু শুনছে। বিভোরের কথায় বিভোর হয়ে আছে। বৃষ্টির ঝাপটা প্রবল। কেমন মায়াময় আভাস চারদিকে।
‘ছেলেটা আর মেয়েটার বিয়ের কথা তখনো কেউ জানতোনা। কখনো খোঁজও নেয়নি তার বউয়ের। মেয়েদের মন বোঝার ক্ষমতা সবসময়ই কম তার।’
রুহি এবার বলে উঠলো,
‘তা তো অবশ্যই।”
বিভোর গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ কিন্তু ছেলেটা একটা ভুল করে ফেলেছে।’
‘ কী?’
‘সে মেয়েটার খোঁজ নিতে ভুলে যায়।’
এই পর্যায়ে এসে রুহি বলল,
‘ ছেলেটা ঠিক করেনি। কেন সে বউকে ভুলে গেলো? একবারও মনে করার বা খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলো না! সে কী জানে এই তিন বছরেরও বেশি সময় মেয়েটা কত স্ট্রাগল করেছে? সবকিছু খুব সহজ মনে করে কেন ছেলেটা? হেসেখেলে তো জীবন কাটানো যায়না। জীবন তো সিনেমার চেয়েও কঠিন।’
বিভোর বলল,
‘ হ্যাঁ। কিন্তু তুমি ভেবে বলো ওইরকম পরিস্থিতিতে অচেনা একটা মেয়েকে বউ হিসেবে মেনে নেওয়াটা কী এতোই সহজ? ছেলেটার কথা ভেবে বলবে।’
‘ আমি কিছু জানিনা।’
‘ হ্যাঁ। ওটাই পারো।’
‘ মানে?’
‘ নিজের মতো উল্টাপাল্টা ভেবে মানুষকে ভুল বুঝতে ঠিকই পারো। একবারও বিপরীত দিকের মানুষটাকে বুঝতে চাওনা। তুমি যদি কোনোকিছু নেগেটিভ ভাবো ইটস টোটালি ইউর প্রবলেম।’
‘ অবশ্যই।’
‘ বুঝিয়ে বলো।’
‘ কেউ যদি নিজের বিয়ে করা বউয়ের খোঁজ না নেয়, তাহলে সেটা ভুল নয় কী? হতে পারে বিয়েটা হঠাৎ হয়েছে, কেউ কাউকে চিনেনা। কিন্তু হয়েছে তো? এটা কী তার বউকে ঠকানো হলোনা?’
‘ সে মানছে একটা ভুল হয়েছে, কিন্তু ক্ষমা পাওয়ার যোগ্যতাও কী রাখেনা? সে তো বউয়ের কাছে ফিরতে চায়।’
রুহি কথাটা শুনে থম মেরে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ পর শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ না। কারণ পরবর্তীতে ছেলেটার যদি মেয়েটার সাথে দেখা মা হতো, তখন তার বউয়ের কথা সে ভুলেই যেতো চিরজন্মের মতো। বিয়ে করে নিতো অন্য কাউকে।’
‘ শুনো..!’
বিভোরকে কিছু বলতে না দিয়েই রুহি বলল,
‘ তাছাড়া এখন আপনি দেখলেন যে আপনার সেই পিচ্চি বউটি এখন দেখতে খুব সুন্দরী। এটাও ফেরার কারণ হতে পারে। নিশ্চয়তা কী যে, সে অন্য কোনো সুন্দরী নারীতে আকৃষ্ট হবেনা?’
বিভোর ধমক দিয়ে বলল,
‘আমি যদি সেরকমই হতাম তাহলে তোমাকে সাহায্য করতাম না। স্বামীর অধিকার সেদিনই খাটাতে পারতাম। বিদেশে গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে বেলাল্লাপনা করে বেড়াতাম৷ তোমাকে সব খুলে বলতামও না। হাজারটা সুযোগ পেয়েও কোনো খারাপ কাজ করিনি। আর আজ যখন এতগুলো দিন পরে তোমাকে কাছ থেকে দেখছি, বোঝার চেষ্টা করছি আমার মনে হচ্ছে তোমাকেই আমার দরকার। কাউকে যখন তোমার হাত ধরতে দেখি তখন প্রচন্ড কষ্ট হয়, খারাপ লাগে। এরপরও তুমি আমাকে বুঝবেনা রক্তজবা?’
রুহি চুপ করে রইলো।
বিভোর ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,
‘ কীভাবে বুঝালে তুমি বুঝবে?’
‘ আমি কিছু বুঝতে চাইনা।’
‘ আমি কখনো কারোর রুপে আকৃষ্ট ছিলাম না। তোমাকে দেখার পর থেকেই এক অদ্ভুত অনুভূতির দেখা পেয়েছি যেটা আগে কখনো পাইনি। তবুও তুমি যদি আমাকে ফিরিয়ে দাও তাহলে আর কিছু বলবোনা।’
‘ কী?’
‘ তুমি তো আমাকে বিশ্বাস করছোনা। আমি যদি ক্যারেক্টারলেস হতাম তাহলে এই খালি বাড়িতে এতোক্ষণে তোমার কী হাল হতো ভাবতে পারছো?’
‘ হতেও তো পারে, নিজেকে ভালো প্রমাণ করতে চাইছেন।’
বিভোর হেসে ফেললো। বলল,
‘ এজ ইউর উইশ।’
বলে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেলো। বসার ঘরের সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। রুহি ওকে এতোটা অবিশ্বাস করে ভাবতেই বেঁচে থাকাটা বৃথা মনে হলো।
চলবে…ইনশাআল্লাহ!
#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৮
ভোরের মিষ্টি বাতাস বইছে। ঘুম ভেঙে গেল রুহির। শেষ রাতের দিকে চোখটা লেগে গিয়েছিল। সারারাত কান্না করেই কাটিয়েছে। বিভোর ওর কাছে ফিরতে চায়, কিন্তু ও তাতে না করে দিয়েছে। কোনোমতেই বিভোরের সাথে অন্য মেয়ের সম্পর্ক মানতে পারছেনা ও। বিভোরের ঘরেই শুয়ে আছে। চারপাশে একবার চোখ বুলায়। এই ঘরটা হতে পারতো ওর। কিন্তু নিজ হাতেই নষ্ট করে দিয়েছে। ভালোবাসার মানুষকে কী কারো সঙ্গে ভাগ করা যায়? যায়না। রুহি আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ায়। কোমরের ব্যাথাটা এখন একটু কমেছে। চোখগুলো ফোলা ফোলা, গাল লাল।কোনো মতে ফ্রেশ হয়ে নিজের ব্যাগটা খুঁজতে থাকে। বিভোরের ঘরে পায়না। ড্রইংরুমের কথা মনে পরতেই সে দিকে ছুট লাগায়। ডেস্কের উপর একটা ফুলদানির পেছনে ছিলো ব্যাগটা। দেখতে পেয়ে সেটা হাতে নিয়ে নেয় রুহি। পেছন ফিরে দেখে বিভোর কাত হয়ে সোফায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে। লোকটাকে দেখতে খুব মিষ্টি লাগছে। ভোরের বাতাস তার কপাল ছুঁয়ে যাচ্ছে। রুহি সেদিকে তাকিয়ে ভাবে বিভোরকে যদি একবার ক্ষমা করতে পারতো তাহলে ওদের একটা সংসার হতো। পরমুহুর্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুহি ভাবলো ও আসলে যতটা সহজ ভাবছে ততটা সহজ নয় জীবন
বিভোরকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে রুহি বেরিয়ে আসে।
দারোয়ানের কাছে বলে আসছে যে সে চলে যাচ্ছে, কথাটা বিভোর কে যেন বলে দেয়। দারোয়ান ইতস্তত করে বলল,
-আপনি কে মা? কোনোদিন তো দেখিনাই।
রুহি বলল,
-আপনি করে বলবেন না চাচা, তুমি করেই বলেন। আমি আপনার মেয়ের মতো।
-ঠিক আছে মা। তুমি কী বিভোরের কিছু লাগো?
রুহি হেসে বলল,
-না চাচা।
-তাহলে?
-একটা কাজে এসেছিলাম।
দারোয়ান অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টিতে তাকায়। কোনো কাজেই যদি মেয়েটা এসে থাকে তাহলে একা বাড়িতে দুজনে কী করেছে? রাতেরবেলা থেকেছেও। কিন্তু বিভোর তো ওরকম খারাপ ছেলে নয় যে মেয়ে নিয়ে একা বাড়িতে ফুর্তি করবে। তাহলে এর মানে কী? কথাটা এখন সে কাকে জিজ্ঞেস করবে? মেয়েটা তো বললো কাজে এসেছে। এতো সুন্দরী একটা মেয়ে কোন কাজে আসবে বিভোরের কাছে? রুহিকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না দারোয়ান সামাদ। রুহি বিদায় নিয়ে চলে গেলো। মনে মনে একবার ভাবে, এই কথাটা বিভোরের বাবা-মাকে জানানো উচিৎ হবে কিনা। যদিও বিভোরের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস আছে তাও বলা যায়না। আজকালকার ছেলেমেয়েদের ওপর বিশ্বাস করা কঠিন।
সকাল সাতটা ইভাদের বাসায় এসে পৌঁছায় রুহি। ডাইনিংয়ে বসে সবাই নাস্তা করছে। নাদিরা, নাসিমা খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। মেহমান, নতুন বর বউ বসে খাচ্ছে, মাঝেমধ্যে হাসাহাসিও হচ্ছে। ইভাদের ড্রইংরুম পেরিয়েই বাসার ভেতরে ঢুকতে হয়। সাতসকালে এভাবে বাসায় ঢুকতে হচ্ছে ভেবে রুহির কেমন আনইজি লাগছে। হঠাৎ করে ইভা রুহিকে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে বলল,
‘কোথায় গিয়েছিলি তুই? আর এতো সকালেই বা কোথা থেকে এলি?’
সবাই রুহির দিকে তাকিয়ে আছে। রুহি বলার মতো কোনো উত্তর খুঁজে পায়না। ইতস্তত করে বলল,
‘পরে বলবো আপু।’
‘এখন বলতে সমস্যা কী?’
‘সমস্যা নেই আপু। তোমরা খাচ্ছো তো।’
‘আর তুই কাল আমার রিসেপশনেও থাকিসনি, হঠাৎ করেই উধাও। এটা আমি আশা করিনি।’
‘দুঃখিত আপু। আসলে এমন একটা সিচুয়েশনে তোমাকে কিছু জানাতে পারিনি।’
ইভা বলল,
‘ঠিক আছে। ফ্রেশ হয়ে খেতে বস।’
‘খাবোনা এখন।’
নাদিরা কড়া গলায় বলল,
‘বেশি কথা বলবিনা। চুপচাপ খেতে আয়।’
রাতুল হেসে বলল,
‘প্লিজ বোন খেতে বসো। নইলে তোমার বোন খাওয়া ছেড়ে চলে যাবে, সে তোমার ওপর খুব রেগে আছে।’
সবার জোড়াজুড়ি আর অনুরোধে বাধ্য হয়ে খেতে বসতে হলো রুহির। কিন্তু খাবার গলা দিয়ে নামছেনা, দম বন্ধ লাগছে। শুধু কাল রাতের কথাগুলোই ঘুরেফিরে মনে হচ্ছে। রুহির মনে হচ্ছে ও পাগল হয়ে যাবে।
খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ করতে করতে সাড়ে আটটা বেজে গেলো। নাদিরাকে প্লেট,গ্লাস ধুতে সাহায্য করলো রুহি। কাল রাতে কোথায় ছিলো এই নিয়ে কোনো কথা তুললো না নাদিরা। সবকাজ শেষ করে ফ্রেশ হয়ে রুহি ঘরে এসে বসলো। বালিশে মাথা লাগাতেই চোখদুটো বুজে আসতে চাইলো। হঠাৎ বিভোরের মা আসলো ওর ঘরে। চোখবন্ধ করে শুয়ে আছে তখন রুহি। নাসিমা মিষ্টি হেসে রুহির চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিলেন। মেয়েটাকে তার ভীষণ পছন্দ। এতিম একটা মেয়ে কীভাবে স্ট্রাগল করেছে ভাবলেই মমতায় ভরে উঠে মন। তাছাড়া রক্তের সম্পর্কের কিছু না হয়েও নাদিরাকে যেভাবে ভালোবাসে, মাঝেমাঝে অবাক হন তিনি। আস্তে করে ডাকলেন,
‘রুহি মা!’
সাথে সাথেই চোখ খুললো রুহি। নাসিমাকে শিয়রের কাছে বসে থাকতে দেখে লাফ দিয়ে উঠে বসলো বিছানায়। তারপর বলল,
‘জি আন্টি?’
‘উঠলে কেন! শুয়ে থাকো আমি হাত বুলিয়ে দিই তোমার মাথায়।’
‘না না থাক।’
তারপর একটু চুপ করে আবারও বলল,
‘কিছু বলবেন আন্টি?’
‘হুম।’
‘কী? আপনার মাথা টিপে দিবো? চা খাবেন নাকি অন্যকিছু দেবো বলুন!’
নাসিমা হেসে বলল,
‘তুমি ভীষণ মিষ্টি একটা মেয়ে। ওসব লাগবেনা।’
রুহি অবাক হয়ে বলল,
‘তাহলে কী?
আসলে কাল রাতে হঠাৎ বিভোর ফোন দিয়ে বলল তোমাকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছে। কিন্তু কোথায় আর কেন যাচ্ছে সেটা বলেনি। আমি অনেক জোর করেছি,সে বলেনি। আসলে আমার ছেলে এরকম আমি জানি। নিজ থেকে না বললে মেরে ধরেও কিছু বলানো যায়না। আর তাছাড়া এই ক’দিনে আমি দেখিনি তোমার সাথে ওর বন্ধুত্ব আছে। তাই কাল যখন বলল তোমাকে নিয়ে বেরুচ্ছে তখন আমি একটু অবাকই হলাম। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।’
রুহি ভয় পেয়ে গেলো। কাল রাতের ঘটনা নিয়ে কী বলতে চান ওনি? কাঁপা গলায় বলল,
‘কী?’
নাসিমা সহজ গলায় বললেন,
‘কাল রাতে নাকি তুমি আমাদের বাসায় ছিলে?’
রুহির হৃদপিণ্ড কাঁপছে। এই কথা ওনি কীভাবে জানলো? এটা নিশ্চয়ই বিভোরের কাজ। ওকে রিফিউজ করায় এখন মায়ের কাছে বোধহয় সব বলে দিয়েছে। রুহি কোনোমতে বলল,
‘কে বলেছে আন্টি?’
নাসিমা অপরাধী স্বরে বলল,
‘বাসার দারোয়ান৷ একটু আগেই ফোন করে জানালো। আমি খুব অবাক হয়েছি। খালি বাসায় তোমাকে কেন নিয়ে গেলো বিভোর? ও কী তোমার সাথে খারাপ কিছু করেছে মা?’
রুহি তড়িঘড়ি করে বলল,
‘না আন্টি।’
বলেই শান্ত হলো। ও ভেবেছিলো বিভোরের এই কাজ। ওই দারোয়ান তো বাতাসের আগে খবর পৌঁছে দেয়। বাবারে, আরেকটু হলে রুহির হার্ট-এ্যাটাক হয়ে যাচ্ছিলো। বিভোরের মা বলল,
-‘তোমার সাথে যদি আমার ছেলে খারাপ কিছু করে থাকে তাহলে নিদ্বিধায় বলে ফেলো মা। আমি এমন মেয়ে নই যে নিজের পুত্র কোনো দোষ করলে তাকে সাপোর্ট করবো৷ তুমি হয়তো আমাকে বলতে ভয় পাচ্ছো।’
‘না আন্টি৷ আমরা সত্যিই একটা কাজে গিয়েছিলাম।’
নাসিমা ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘সত্যি? তুমি কিছু লুকাচ্ছো না তো?’
‘নাহ৷’
‘কী কাজ ছিলো?’
রুহি ঢোক গিললো। সত্যি কথাটা বলা যাবেনা। কিন্তু এখন নাসিমাকে কী বলবে? অনেক ভেবেচিন্তে বলল,
‘আসলে ইভা আপু আর রাতুল ভাইকে সারপ্রাইজ দিতে একটা প্ল্যান করেছিলাম। দুজনে মিলে সেকাজেই গিয়েছিলাম৷ হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়ে যাওয়ায় আমরা আটকে পড়ি। তারপর ওনি বললেন যে আপনাদের বাসা নাকি ওখান থেকে কাছাকাছি। তা-ই বাধ্য হয়ে যেতে হলো। রাতটা ওখানে কাটাতে হলো এই যা। ভোর হতেই চলে এসেছি আমি। ওনি বাসায়ই আছেন এখন। অন্যকিছু ভাববেন না প্লিজ আন্টি। আমাকে দেখে কী আপনার ওরকম মেয়ে মনে হয়?’
নাসিমা আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ফেলে বললেন,
‘না মা। আসলে আমি সত্যিটা জানতে চাইছিলাম। আর তুমি যে আমাদের বাসায় ছিলে সেটা কিন্তু কেউ জানেনা। ইভা ভেবেছে তুমি বুঝি ফ্রেন্ডের বাসায় গিয়েছো, ওর শ্বশুরবাড়ির কাছেই নাকি তোমার কোন ফ্রেন্ডের বাসা?’
‘জি।’
‘এখন তাহলে সত্যিটা বলে দাও।’
‘থাক আন্টি। কেউ জিজ্ঞেস করলেই বলবো। নয়তো সবাই ভুল বুঝবে।’
নাসিমার সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা হলো রুহির। তারপর নাসিমা চলে গেলো। নাসিমাকে রুহির খুব পছন্দ হয়েছে। মায়েদের তো এমন কোমল আর কঠিন হওয়াই উচিৎ। ছেলের পক্ষ একবারও নিতে চায়নি, বারবার জিজ্ঞেস করেছেন ছেলে ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে কিনা। কিন্তু বাধ্য হয়ে রুহি সত্যিটা বলতে পারলোনা। এই মহিলাটিই যে রুহির শ্বাশুড়ি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, কেউওই কিছু জানেনা।
বেলা করে ঘুম ভাঙলো বিভোরের। নিজেকে সোফায় আবিষ্কার করতেই ওর মনে পড়ে রুহি আছে ভেতরের ঘরে। তৎক্ষনাৎ উঠে ঘরে গিয়ে দেখে রুহি নেই। কোথায় গেলো? ওয়াশরুম, রান্নাঘর, বারান্দা খুঁজে দেখলো। কোথাও নেই রক্তজবা। সারা বাসায় ওর কোনো অস্তিত্বই নেই। মেইন দরজা খোলা দেখে বিভোর অবাক হলো। চলে গেলো নাকি মেয়েটা? দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে কনফার্ম হয়ে নিলো। জানতে পারলো ভোরেই রুহি চলে গিয়েছে। বিভোর ঘরে এসে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো। বিভোরকে না হয় মেনেই নিলোনা৷ তাই বলে একবার বলে যাওয়াটা কী উচিৎ ছিলোনা? ও কী এতোটাই খারাপ? এতোটা অপছন্দ করে রুহি ওকে! বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। বিভোর ঠিক করলো আর ইভাদের বাসায় যাবেনা, মা-বাবাকে ফোন করে আসতে বলে দিবে৷ রুহির যখন ওকে ভালোই লাগেনা তাহলে কেন যাবে ওর সামনে! একটা দৈবাৎ বাতাস যেন হাহাকার করে উঠলো।
বিভোরের মা-বাবা বাড়ি ফিরে এসেছে। এই ঘটনার পর অনেকগুলো দিন কেটে যায়। রুহি নাদিরাকে নিয়ে ইভাদের বাসায়ই থাকে। সবার জীবন স্বাভাবিকভাবেই চলছে। পুরোদমে লেখাপড়া চলছে রুহির। সামনেই একটা চাকরির ইন্টারভিউ আছে ওর। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলে একটু স্বস্তি পাবে ও৷ নিজেকে বোঝা ভাবতে হবেনা। ইভা নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। ইশতিয়াককে উচিৎ শিক্ষা দিয়েছে ইভা৷ ভার্সিটিতে লিখিত অভিযোগ জানানো হয় যে এই ভার্সিটির জুনিয়র স্টুডেন্ট রুহির সাথে ও জঘন্য আচরণ করতে চেয়েছিলো। শ্লীলতাহানি করেছে, রেপের চেষ্টাও করেছে। কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে ইশতিয়াককে ভার্সিটি থেকে বের করে দেয়। রিভেঞ্জ অব নেচার।
অনেকগুলো মাস কেটে যায়। রুহি বিভোর দুজনের সামনাসামনি আর দেখাই হয়নি। বলতে গেলে বিভোর ইচ্ছে করেই রুহির সামনে যায়নি৷ তবুও যখন হঠাৎ হঠাৎ সেই রাতের কথা মনে হয়, বিভোর ভাবে একটাবার যদি রুহি ওকে বুঝতো, ক্ষমা করতো তাহলে জীবনটাই অন্যরকম হয়ে যেতো। রুহির মনে হয় ও যা করেছে ঠিক করেছে। ও তো কোনো পুতুল নয়। বিভোর একটাবারও জানতে চায়নি নতুন এক অজানা শহরে তিন তিনটা বছর ও কীভাবে কাটিয়েছে। একা আছে ভালো আছে। বিভোরও থাকুক, নিজের জীবন গুছিয়ে নিক। রুহির আর কষ্ট হয়না আগের মতো। হয়তো কষ্টগুলো গভীর অভিমানের তলায় চাপা পড়েছে। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে আসবে৷ তবুও নিজেকে সামলে নিয়েছে রুহি। চাকরি পেয়ে গিয়েছে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে। নেই কোনো পিছুটান আর ভাবনা। ভালো আছে সে।এক শহরে বসবাস করেও দীর্ঘ দুই বছর বিভোর নামক ব্যক্তিটির সাথে ওর দেখা হয়নি। ওদের বিয়ের বয়স তখন সাড়ে পাঁচ।
হঠাৎ এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যেতে, রুহি অফিস থেকে ফিরছিলো। একটা গাড়ি এসে থামে ওর ঠিক সামনে। দরজা খুলে বেরিয়ে আসে একটা লম্বামতো ছেলে। রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে রুহির দিকে তাকিয়ে আছে। লম্বা লম্বা পা ফেলে লোকটা এগিয়ে আসে। রুহি ভয় পেয়ে যায়।
চলবে…ইনশাআল্লাহ।