আঠারো_বছর_বয়স,পর্ব-২৮,২৯
লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
পর্ব-২৮
ভালোবাসা একদিকে যেমন পৃথিবীর সব সুখ বয়ে আনে, এক নিমিষে সে সুখ কেড়ে নিয়ে মানুষকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে। পৃথিবী নামক গ্রহটিতে “ভালোবাসা” জিনিসটি না থাকলে কী এমন হতো? মানুষ বোধহয় পশুর চেয়েও অধম হয়ে যেতো। তবুও সে ভেতরে জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যেতোনা। আত্মার বন্ধন জড়িয়ে আছে ভালোবাসায়। এক আত্মার কষ্টতে অন্য আত্মাকেও জ্বলেপুড়ে ছারখার হতে হয়।
কিন্তু ডাক্তার হওয়া স্বত্তেও যদি নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে সামান্যতম সাহায্য না করতে পারে, তাহলে কী দাম সেই ভালোবাসার। কলঙ্কিত হয়ে যায়না সেই ভালোবাসা? এতে কি “ভালোবাসা” শব্দটার অপমান হয়না! বিভোরের চোখ রক্তবর্ণ, মুখ শুকিয়ে গিয়েছে দু’দিনেই। হসপিটালের বেডে নিথর দেহটিকে পড়ে থাকতে দেখে আবারও তার বুকটা ভার হয়ে এলো। গলা শুকিয়ে যেন লেগে গেলো৷ কন্ঠনালীতে কোনো শব্দ আসছেনা, মুখ দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারিত হচ্ছেনা।
রুহির গায়ে হসপিটালের আকাশী রঙের পোশাক। মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে ক্যানোলা। সেদিনের পর আর জ্ঞান ফেরেনি রুহির। পাশে বসে আছে বিভোর। ঘাড়ে ঝুলানো স্টেথোস্কোপটা ডেস্কে রাখলো, তারপর রুহির হাত ধরে বসলো। ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
‘একটাবার চোখ খুলোনা তুমি। একবার দেখবো তোমায়।’
চোখবোজা মানুষটা তার কথা শুনলোনা। বিভোর একটু রেগেই উঠলো।
‘ঢং করছো তাইনা? আমাকে কষ্ট পেতে দেখে খুব আনন্দ লাগছে তোমার? এতোদিন দূরে রাখার প্রতিশোধ নিচ্ছো?’
কথা বলেনা মেয়েটা। বিভোরের রাগের সাথে সাথে খুব অভিমানও হয়। সে কেন খেয়াল রাখতে পারলোনা ওর জবাফুলটার?
কিছুক্ষণ পর ডাক্তার সায়েম আসেন। তিনিই রুহির চিকিৎসা করছেন৷ বিভোরকে আশ্বস্ত করলো যে খুব দ্রুতই রুহির জ্ঞান ফিরবে। মাথা ফেটে রক্ত বের হওয়ায়
একটু বেশিই সমস্যা হয়েছে। তিনি চলে গেলে বিভোর রুহির পাশে বসে রইলো। নাসিমা বাসা থেকে রাতের খাবার নিয়ে এসেছেন। জোর করে কয়েক লোকমা ভাত তুলে খাইয়ে দিয়েছেন বিভোরকে। মা কেন বুঝতে পারছেনা জবাটাকে ছাড়া ওর গলা দিয়ে খাবার নামছেনা? কেন? বিভোর কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো। সিস্টার কিয়ারা ওর সঙ্গে দরকারি কথাবার্তা বললেন। নাদিরা রুহির সাথে থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু শরীর ততোটা ভালো নয় বলে বিভোর জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। ইভার সাতমাস বয়সী একটা মেয়েবাচ্চা আছে, তাই চাইলেও ও থাকতে পারেনা। তবে সর্বক্ষণ ফোন দিয়ে ওর খোঁজখবর নেয়।
রুহির সাথে নাসিমা চৌধুরী আর বিভোর থাকেন। ছেলের বউয়ের উপর সবচেয়ে বেশি অধিকার যেন তাঁরই। এই মেয়েটাকে তিনি আগে থেকেই খুব পছন্দ করতেন। কখনো ভাবেননি এই মিষ্টি মেয়েটাই তাঁর পুত্রবধূ হবে। কিন্তু পুত্রবধূ হলেও তিনি সেই নজরে রুহিকে দেখেন না। নিজের মেয়ের মতোই আগলে রাখছেন। রুহির এই অবস্থায় তিনি খুবই ব্যথিত। যেদিন হসপিটালে নিয়ে আসে সেদিন বাবর চৌধুরী বিভোরকে আচ্ছামতো ঝাড়েন। কেন সে খেয়াল রাখেনি, ওর জন্য আজ ওর এই অবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি। রাগে-দুঃখে বিভোর সেদিন কেঁদেই ফেলে। নিজের হাসপাতালে থাকার দরুন সবাই দাঁড়িয়ে ওর কান্না দেখছিলো আর অবাক হচ্ছিলো। সবাই ওকে সান্ত্বনামূলক বাণী শোনাচ্ছিলো। বিভোরের এতোটাই রাগ হয় যে করিডোরের ফুলের টবটা এক আছাড়ে ভেঙে ফেলে। সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। ভেতরে তখন রুহির চিকিৎসা চলছে, রক্ত দেওয়া হচ্ছে। ওর সাথে বিভীরের ব্লাড গ্রুপ ম্যাচ করেনা বলে রক্তটুকুও দিতে পারেনি। ক্ষোভে ওর বুক ফেটে যায়। কীসের প্রেমিক, কীসের স্বামী সে? যেখানে মৃতপ্রায় স্ত্রীকে সে সামান্য রক্তও দিতে পারছেনা তখন সে কীসের স্বামী! নাদিরা, ইভা সবাই ওকে দেখে ঘাবড়ে যায়। কিছুতেই সামলানো যাচ্ছিলোনা। ছেলের মেন্টাল কন্ডিশনের কথা চিন্তা করে বাবর চৌধুরীর মনটা নরম হয়।
তিনি ছেলেকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে গালে হালকা থাপ্পড় দিয়ে চোখ রাঙিয়ে গমগমে স্বরে বলেন,
‘তুই আমার গাছ থেকে ফুল খেয়েছিস? আজকাল গরু থেকে ছাগলে আপডেট হলি? তোর এই সাহস কীভাবে হলো যে তুই আমার মেয়েকে সেই খাওয়া ফুল গিফট করিস, আমাকে বললে আমি কি দিতাম না?’
এই ভয়ংকর সিচুয়েশনেও বিভোর বাবার কথা শুনে অবাক। ইভা তো হেসেই দিলো। ছেলেকে এভাবে তাকাতে দেখে তিনি বড়বড় চোখ করে বললেন,
‘এভাবে তাকাবিনা। নজর নিচে রাখ। তুই কি ভাবছিস আমি জানলাম কীভাবে? আসলে আমার মেয়েটার হাতে আমার গাছের সেই কালোগোলাপটি ছিলো। আমার গাছের ফুল আর আমি চিনবোনা? দেখ আমি ওর হাত থেকে নিয়ে এসেছি।’
বাবর চৌধুরী পাঞ্জাবীর পকেট থেকে শুকিয়ে যাওয়া কালোগোলাপটা বের করে দেখালেন। রুহি যখন সিঁড়ি থেকে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে তখন ওর হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রেখেছিলো ফুলটি। বাবর চৌধুরীর চোখে পানি এসে পড়ে এই দৃশ্য দেখে। তিনি ফুলটা নিয়ে নেন, নচেৎ কেউ ফেলে দিতো। রুহিকে তিনি এক মুহূর্তের জন্যও পুত্রবধূ ভাবতে পারছেন না। নিজের সন্তান বলে মনে হচ্ছে। ওনার অনেক শখ ছিলো একটা মেয়ের। কিন্তু আল্লাহ পাক তা দান করে আবার নিয়েও গেছেন। জন্মের এক সপ্তাহ পরেই মারা যায় তাঁদের মেয়েটি। নাসিমা তো আজও সেই মেয়ের কথা ভেবে কাঁদেন, তাঁদের প্রথম সন্তান ছিলো মেয়েটি। রুহিকে তিনি “মা” বলেই ডাকেন।
বিভোর বাবাকে জড়িয়ে ধরে সেদিন কেঁদে দিয়েছিলো। তিনি পুত্রকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করলেন কারণ ও একজন ডাক্তার। এর থেকে ভয়ংকর সিচুয়েশন ওকে পার করতে হয়েছে। কত মানুষের মৃত্যুও দেখতে হয়েছে। তাহলে আজ এমন করছে কেন! ওকে তো শক্ত থাকতে হবে। হায়! ভালোবাসাকে হারানোর ভয় যদি কেমন হয়, কেউ যদি বুঝতো তাহলে কেউ কাউকে
সান্ত্বনা দিতোনা। বাবর চৌধুরী তাও বললেন,
‘এমন করছিস কেন? তুই না ডাক্তার। দেখ, এটা তোর হসপিটাল। তোর কাজের জায়গা। সবাই তোর উপর ভরসা করে, এখন তুই-ই যদি নিজের আপনজনের জন্য এভাবে ভেঙে পড়িস তাহলে তাঁদের কী হাল হবে ভেবে দেখতো। ওদের মনোবল ভেঙে টুকরো হয়ে যাবেনা? তুই কি এটাই চাস যে পেশেন্টরা চিন্তায় চিন্তায় মরে যাক? বল!’
বিভোর রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
‘আমিতো নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছি, পারছিনা।’
‘তেমন কিছুই হয়নি। ঠিক হয়ে যাবে আমার মেয়েটা। তুই শুধু দোয়া কর আর শক্ত রাখ মনটাকে। দ্যাটস ওকে!’
বাবার কথায় যেনো মনোবল ফিরে এলো বিভোরের। সত্যিই কিছু হবেনা তার জবাফুলটার। সে দেখে রাখবে। এভাবেই নিজেকে সামলিয়েছিলো বিভোর। বাবা-মা যদি সবকিছুতে সন্তানের পাশে থাকে তাহলে যেকোনো কঠিন মুহূর্ত পার করা অতোটাও যন্ত্রণাদায়ক
নয়।
______
চারদিকে কেমন শীত শীত আমেজ। কুয়াশাজড়ানো ভোর। দূর দিগন্তের কোনোকিছুই প্রায় চোখে পড়েনা। আবাসিক এলাকায় অতিথি পাখিদের আগমন ঘটেছে। কিচিরমিচির শব্দ অনেকদূর অবধি পৌঁছায়। দূরের লেকটার পানি শান্ত, স্থির। পানির উপরে ফুটে আছে পদ্মফুলের কয়েকটি কলি। তারও উপর মেঘের মতোন ভাসছে কুয়াশারা। পদ্মপাতার উপর জমেছে শিশিরকণা। অতিথি পাখিদের সেই কলরব আর অসাধারণ শীতের আগমনে মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছে বিভোর। আশ্চর্য! চারটা দিন আগেই না কাঠপোড়া রোদ তার তেজ দিয়ে পৃথিবী ঝলসে দিচ্ছিলো! এই পৃথিবী আর প্রকৃতির নিয়ম বড়ই অদ্ভুত!
বিভোরের চোখ রক্তলাল। চারদিনের মধ্যে সে কয়েক মিনিটের জন্যও চোখের পাতা এক করতে পারেনি।
কাল রাতেও জেগে ছিলো, রুহিকে একব্যাগ রক্ত নিতে হয়েছে। তবে জ্ঞান এখনো ফিরেনি। দীর্ঘ একটা রাত ছিলো, শেষ হতেই চাইছিলোনা। জোৎস্নামোড়ানো সেই রাতটাতে ওর জবাফুলটাকেই চাঁদ মনে হচ্ছিলো। বিভোরের বুকের কান্নারা সেই জোৎস্নার আলোর রঙ ধারণ করেছিলো! একা থাকায় কত কষ্ট তা বুঝতে পারে বিভোর। এই গল্পগুলো বলবে সে জবাফুলটাকে। মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে নিশ্চয়ই শুনবে রুহি। বিভোরের মনে পড়ে সেই গান,
‘আমি তোমাকেই বলে দেব
কি-যে একা দীর্ঘ রাত,
আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে।
আমি তোমাকেই বলে দেব
সেই ভুলে ভরা গল্প।
কড়া নেড়ে গেছি, ভুল দরজায়!
ছুঁয়ে কান্নার রঙ, ছুঁয়ে জোৎস্নার ছায়া…(২)
আমি কাউকে বলিনি সে-নাম
কেউ জানেনা, না জানেনা আড়াল…(২)
জানে কান্নার রঙ, জানে জোৎস্নার ছায়া।’
মন হারানো এক সুগন্ধি’তে হঠাৎ পুরো ঘরটা ভরে যায়৷ বিভোর এক পলক রুহিকে দেখে আবার বাইরে দৃষ্টি মেললো। তারপরই প্রচন্ড শব্দ করে কিছু একটা নিচে পড়ার আওয়াজ হলো। চমকে উঠলো বিভোর। পেছন ফিরে দেখলো রুহির পা নড়ছে। কাচের গ্লাসটা ধাক্কা লেগে নিচে পড়ে ফেটে গিয়েছে। বিভোর দ্রুত এলো তার জবাফুলটার কাছে। আশা, তাঁর রুহির জ্ঞান ফিরেছে। তবে সে কেমন যেন করছে। ইশারায় বিভোরকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু মুখ ফুটে সেই কথাটা বলতে পারছেনা। রুহির চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। ওর মনে হচ্ছে বিভোরকে আর দেখতে পারবেনা। ডাক্তারবাবুর চেহারাটা ঘোলাটে দেখছে সে। অনেকক্ষণ পরে বিভোর বুঝতে পারলো তাঁর জবাফুলটির নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে!
চলবে…ইনশাআল্লাহ!
#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৯
আকাশে মেঘরাশিদের মতোন উড়ছে ঘোলাটে কুয়াশার কণারা। তখন পড়ন্ত বিকেল। রাউন্ড শেষ করে রুহির কেবিনে আসে বিভোর। ওর মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। সকালে জ্ঞান ফেরার পরই শ্বাসকষ্টের সমস্যা শুরু হয় রুহির। ডাক্তার এসে দেখলেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। ঘুমের ইঞ্জেকশন দিলেন। জানালেন, খুব দ্রুতই ঠিক হয়ে যাবে রুহি। দুপুরে ঘুম ভাঙার পর রুহিকে নরম খাবার খাইয়ে দিলেন নাসিমা। বিভোর তখন ডিউটিতে ছিলো। ফোন করে জানালে, তৎক্ষনাৎ বিভোর ছুটে এসে দেখলো রুহি আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।
মা’কে খেয়াল রাখতে বলে বিভোর হতাশ হয়ে আবার ফিরে যায় নিজের কাজে। সব কাজ শেষ করে এখন আসলো আর দেখলো রুহির ঘুমটা এখনো ভাঙেনি। নাসিমা আজ বাসায় যাবে, হসপিটালে থাকতে থাকতে ওনি নিজেই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। বিভোর জোর করেই মাকে পাঠিয়ে দিলো। তিনি চলে যাওয়ার পরে বিভোর ঔষধপত্র গুছিয়ে রেখে, ফাইলগুলোতে চোখ বুলাচ্ছিলো তখন দেখলো রুহি নড়ছে। কাগজপত্র রেখে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আস্তে করে ডাকতেই চোখ খুললো রুহি। বিভোর উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কেমন লাগছে এখন? ঠিক আছো তুমি?’
রুহি মাথা নাড়িয়ে জানালো সে ঠিক আছে। উঠে বসতে চায় সেটাও জানালো। বিভোর ওকে সাবধানে ধরে বসালো। তারপর ঔষধ খাইয়ে দিলো। তোয়ালে ভিজিয়ে চোখমুখ মুছে দিলো, আর এলোমেলো চুলগুলোতে পাতলা বিনুনি করার চেষ্টা চালালো। রুহি ওকে বলল,
‘আপনি পারবেন না, রেখে দিন।’
‘পারবো।’
বলেই অনেক চেষ্টা করে কোনোমতে বিনুনি করে দিলো। তারপর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
‘নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে?’
‘নাহ।’
বিভোর রাগী গলায় হঠাৎ বলল,
‘এরকমই করো তুমি। খাবার-দাবার না খেয়ে শরীরের কী অবস্থা করেছ তুমি? আর এতো দুর্বল শরীর নিয়ে অফিস কীভাবে করো? আমাকে বলোনি কেন যে তোমার এই অবস্থা? হ্যাঁ?’
রুহি মাথা নিচু করে আছে। বিভোর তা দেখে আবারো ধমক দিলো।
‘কত বয়স তোমার? জানো তুমি? আন্টির কী এখন সেই অবস্থা আছে যে তোমার পিছু ঘুরে ঘুরে খাওয়াবে? আরে, নিজের ভালো তো পাগলেও বুঝে। সামান্য সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েই তিনদিন অজ্ঞান! স্ট্রেঞ্জ!’
রুহি মিনমিন করে বলল,
‘বকছেন কেন আমায়?’
বিভোর হতাশ ভঙ্গিতে বলল,
‘কাকে কি বলছি আমি? আমি জানতে চাইছি তোমার এই অবস্থা কেন? খাওয়ার প্রতি উদাসীন কেন?’
‘আমি তো খাই-ই।’
বিভোর তাচ্ছিল্য করে বলল,
‘হ্যাঁ, জানিতো কি খাও। সকালে এককাপ চা আর বিস্কিট খেয়ে অফিসে বেরিয়ে পড়ো৷ দুপুরে ডিম দিয়ে একচামচ ভাত আর রাতে শুকনো রুটি আর আলুভাজা। এসব কোনো খাবার? তুমি কী মোটা হয়ে গিয়েছো যে এই চিকনা শরীর নিয়ে ডায়েট করো! তোমার হাজব্যান্ড একজন ডাক্তার। আর তার বউ কিনা সবকিছুতে উদাসীন। এমন হলে তো মাথা ঘুরবেই। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে কেন, হাঁটতে হাঁটতেই পড়ে যাবে। ড্যাম ইট!’
রুহি বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিলো। বিভোর আর রেগে থাকতে পারলোনা। ওর মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বলল,
‘ইশ। আর কাঁদতে হবেনা। নাকের পানিতে কি আমার শার্ট ভিজিয়ে দিবে নাকি!’
এ পর্যায়ে এসে কেবিনে ঢুকলো সিস্টার কিয়ারা। বিভোর থতমত খেয়ে গেলো। রুহির হাসি পেলো। দুজনে ঠিকঠাক হয়ে বসলো। সিস্টার কিয়ারা হেসে বললেন,
‘আমাকে লজ্জ্বা পাবার কিছু নেই। তোরা এরকম করছিস কেন!’
বিভোর মাথা চুলকে বলল,
‘তেমন কিছুই নয়।’
কিয়ারা হেসে বলল,
‘জানি। সেদিনের ঘটনাটা বলি তাহলে তোর বউকে।’
‘না, একদমই না।’
‘তুই বললেই আমি শুনবো কেন? বড়বোনের মুখের উপর একদম কথা বলবিনা।’
রুহি বুঝলো বিভোর আর কিয়ারা দুজনের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক। নইলে কি আর তুই তুই করে কথা বলতে পারে কেউ! অবশ্য বিভোর সবার সাথেই ফ্রি মাইন্ডেড। কিয়ারা রুহির প্রয়োজনীয় কিছু কাজ করতে করতেই সেদিনের পাগলামির কথা জানালেন রুহিকে। ও হাসতে হাসতে খুন, বেশ লজ্জ্বাও পেলো। বিভোর গম্ভীরমুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এখন খুব হাসছে যে খুব, সেদিন তো ওর জানটাই প্রায় কেড়ে নিতে বসেছিলো।
সিস্টার কিয়ারা চলে যাওয়ার পরে রুহি চোখ গরম করে বিভোরের দিকে তাকালো। বলল,
‘এরকম পাগলামি-ছাগলামি করার মানে কী?’
বিভোর অভিমানী গলায় বলল,
‘আমার জায়গায় থাকলে বুঝতে।’
রুহি হাসি হাসি মুখ করে বলল,
‘আপনি কী ভেবেছিলেন আমি মরে যাবো?’
বিভোর রেগে গেলো। ওর গাল চেপে ধরে বলল,
‘এরকম কথা শুধু মুখে নয়, তোমার মনেও জায়গা দেবেনা। আর কখনো আমাকে বলবেনা, তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে। তুমি শুধু আমার হাসিখুশি চেহারা আর ভালোমানুষি দেখেছো। রেগে গেলে আমি কি করতে পারি সেটা কিন্তু ধারণাও করতে পারবেনা তুমি। সো মাইন্ড ইট!’
দুজনের মধ্যে তারপর নীরবতা নেমে এলো। মাতাল হাওয়া ছুঁয়ে দিচ্ছিলো রুহির চোখ, গাল, চিবুক। চুলগুলো উড়ে এসে পড়ছিলো কপালের উপর। বিভোর উঠে চলে গেলো বাইরে। অনেকক্ষণ পরে ফিরে এসে দেখলো রুহি বেড থেকে নামার চেষ্টা করছে। হাতে ক্যানোলা নেই। ও অবাক হলো। নামতে গিয়ে হঠাৎ পা ফসকে পড়ে যেতে নিলে বিভোর দ্রুত ওকে গিয়ে ধরে ফেললো। রাগী গলায় চেঁচিয়ে বলল,
‘মানে কী এসবের? নামছো কেন?’
রুহি বলল,
‘আমার হাঁটতে ইচ্ছে করছে। পিঠ ব্যথা হয়ে গিয়েছে শুয়ে থাকতে থাকতে। আমাকে একটু ধরুন প্লিজ, আমি হাঁটতে চাই!’
‘পাগল হলে তুমি? এখনো পুরোপুরি ঠিক হওনি। আর লাফঝাঁপ দেওয়া শুরু করেছো! আর ক্যানোলা এসব কে খুলেছে? নিশ্চয়ই তুমি?’
‘না। কিয়ারা আন্টি খুলে দিয়েছে, আমার নাকি আর এসবের দরকার নেই।’
বিভোর রেগে বলল,
‘ওনি কী তোমাকে হাঁটতে বলে গিয়েছে?’
‘না। ওনি বারবার না-ই করেছেন। কিন্তু আমার ইচ্ছে হলো তাই নামলাম।’
‘বাহ! ভালো তো। আমার কথার তো কোনোই দাম নেই। না খেয়ে ওনি অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকবে আর আমি টেনশন করতে করতেই মরে যাবো। আবার নিজের যখন যা ইচ্ছা হলো ওনি তা-ই করবেন। আমি কে? আমিতো কেউওই না তাঁর!’
‘আপনি বাচ্চাদের মতোন করছেন কেন? আমি ঠিক আছি। অতো চিন্তা করার কিছু হয়নি। ইভেন আমিতো এক/দুদিনের মধ্যে বাড়িও যেতে পারবো।’
‘হ্যাঁ। তা তো যাবেই। সারাদিন লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে অফিসে যাবে আর গাধার খাটুনি খাটবে। নিজের প্রতি যত্ন নিবেনা। যা ইচ্ছা তা-ই করবে।’
একটু থেমে আবার বলল, ‘তুমি কি আমাকে মেরে ফেলতে চাও রুহানি?’
রুহি অবাক হয়ে বলল,
‘এসব কী বলছেন আপনি? উল্টাপালটা ভাবনা ভাবছেন কেন এতো? আর রুহানি ডাকলেন যে, আমি তো আপনার রক্তজবা! ভুলে গেলেন?’
বিভোর রুহির প্রশ্নটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলো। জোর করে ওকে বেডে শুইয়ে দিয়ে গায়ে চাদর টেনে দিলো। ইভা ফোন করেছিলো। রুহির সাথে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বললো৷ নাদিরা ওকে অনেক বোঝালো, নিজের শরীরের প্রতি খেয়াল না রাখার জন্য অনেক বকাঝকাও করলো। বিভোর শুধু ওকে নিজের বুকে জড়িয়ে আছে। সিঙ্গেল বেডটায় জায়গা হয়না, বিভোর নিজের কেবিন থেকে ডিভানটা নিয়ে এসে বেডের পাশে জুড়ে দিয়েছে। যার ফলে দুজনের জায়গা অতি সহজেই হয়ে গিয়েছিলো।
পৃথিবীর বুকে অসাধারণ এক মায়াবী রাত। যে রাতে দুজন মানব-মানবী তাঁদের ভালোবাসার মানুষের হৃদস্পন্দনের শব্দ শুনে শুনেই পুরোটা রাত কাটিয়ে দিয়েছিলো, হাসপাতালের ওই নীল রঙা কেবিনটাতে। কাঁচের জানালার ফাঁক দিয়ে আসা রুপালি চাঁদের কণারা যখন রক্তজবার চোখমুখে আলো ফেলছিলো, বিভোরের তখন মনে হচ্ছিলো এত সুখের মতো অনুভূতি কোনোদিন সে অনুভব করেনি। আর যা-ই হোক, এই অসাধারণ মানবীটিকে সে বুকের ভেতর সারাজীবন বদ্ধ করে রেখে দেবে৷ কোত্থাও যেতে দেবেনা৷ ওর শুধু জানার ছিলো, একই অনুভূতি কী সেদিন তাঁর রক্তজবারও হয়েছিলো?
চলবে…ইনশাআল্লাহ!