আঠারো_বছর_বয়স,পর্ব-৩০,৩১
লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
পর্ব-৩০
হসপিটালের একঘেয়ে দিনগুলো কাটিয়ে রুহি ফিরে এলো বাসায়। নাদিরা, ইভা ওর খেয়াল রাখছে। বিভোর হসপিটালের কাজে, বিভিন্ন কনফারেন্সে ভীষণ ব্যস্ত। তবুও সর্বক্ষণ ফোন করে খোঁজখবর নিচ্ছে। রুহির চাকরিতে যাওয়া মানা। সুস্থ না হওয়া অবধি বাসা থেকে বের হওয়ায় পারমিশন নাদিরা-বিভোর কেউই দেয়নি।
কুয়াশাঘেরা এক গোধূলি বিকেল। হলদে আলোয় ছেয়ে আছে পুরো ব্যলকনি। রুহি বসে বসে বই পড়ছিলো। ইভা ওর মেয়েটাকে ঘুম পাড়িয়ে সবেমাত্র গোসল সেরেছে। আজকাল ওর মেয়েটা বড্ড চঞ্চল হয়েছে। সাত মাসের বাচ্চাটা দাঁড়ানো শিখেছে, হাঁটতে চায়। আবার দুটো দাঁতও ওঠেছে। একদম রাতুলের কার্বন-কপি যেন। এরকম মিষ্টি একটা বাচ্চাকে রুহি সারাক্ষণ কোলে নিতে চায়। কিন্তু ইভা ওর এই বদঅভ্যাসের জন্য ভীষণ রকম বকাবকি করে। নিজের জান নিতেই নড়তে পারেনা, তার উপর বাচ্চা নিয়ে লাফালাফি। রুহি মুখ ভার করে বসে থাকে। ওকে বই পড়তে দেখে পাশের চেহারায় বসলো ইভা। রুহি একনজর দেখে আবারও মনোযোগ দিলো বইয়ে। ইভা বলল,
-কথা বলতে চাসনা আমার সাথে? রাগ করেছিস?
রুহি মাথা নাড়িয়ে অভিমানী গলায় বলল,
-হুম। মিষ্টিটাকে একটু কোলে নিলে কী এমন হতো?
-আরে, তুই তো এখনো পুরোপুরি ঠিক হসনি রে বোন।
-আমি একদম ঠিক আছি।
-তা তো থাকবিই। ডাক্তারের বউ বলে কথা!
রুহি বিড়বিড় করে বলল,
-ডাক্তার না ছাই৷ আমাকে কতশত রুটিনের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে।
-এটাই দরকার তোর৷ ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করিসনি এখন ফল ভোগ কর।
রুহি ভেঙচি কেটে বলল,
-তোমার ভাই আস্ত একটা শয়তানের নানা।
ইভা হেসে বলে,
-তোর বরের কাছে ফোন দিয়ে এসব কথা না জানাইলে আমিও রাতুলের বউ না।
-আপু প্লিজ। তোমার ডাক্তার ভাইটুর কথা বাদ দাও।
-কেন রে?
রুহি মুখ ফুলিয়ে বলল,
-সুযোগ পেলেই আমাকে হুমকি-ধমকি দিয়ে আধমরা করে ফেলে।
ইভা বলল,
-আর তুই যে এতোদিন ডুবে ডুবে জল খেলি তা কিছুনা?
-ডুবে ডুবে জল খেলাম মানে? কীসের কথা বলছো?
রুহির কথা শুনে ইভা হাসলো। হাসিটা চেপে রেখে গলাউ গাম্ভীর্য এনে বলল,
-বাহ! এখন তো তুই ধোয়া তুলসীপাতা। কিছুই জানিস না। তোর সাথে যে আমার ভাইয়ের ইটিশপিটিশ চলে তুই আমাদের কাছে একবারও বললি না!
-কই ইটিশপিটিশ করলাম? কোনোদিন দেখেছো?
ইভা ভ্রু কুঁচকে বলল,
-না দেখিনি।
-তবে বললে কেন?
ইভা মুখটা বাঁকা করে বলল,
-বলবোনা? কি বলিস রে তুই? আমার ভাইয়ের বউ। ছয়বছর হতে চললো তোদের বিয়ে হয়েছে। অথচ দুজনের কাউকে দেখেই আমরা তা বুঝতে পারিনি। আসলে তোরা বুঝতে দিসনি। আমাদেরকে অন্ধকারে রেখে দিলি। এটা কী ঠিক হলো? আমরা কি তোর পর ছিলাম? বোনের মতো ভালোবাসিনি তোকে?
ইভার কথা শুনে রুহির মুখে ছায়া নেমে এলো। প্রাণবন্ত মুখটা মুহূর্তেই অস্বস্তি আর লজ্জায় নুইয়ে নিলো। ইভা কী ওকে সুবিধাবাদী, লোভী মেয়ে ভাবছে? ভাবাটা স্বাভাবিক। কারণ রুহি নিতান্তই এই বাড়িতে আশ্রিতা। যতই ওরা ভালোবাসুক, তবুও সত্যটা তো আর পালটে যাবেনা। নিজের জীবনের প্রতি বড্ড বিতৃষ্ণা নেমে এলো হঠাৎই। হায়, ওর এখন কি করা উচিৎ!
ইভা ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখ দেখে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে। আচমকাই ওর পা জড়িয়ে ধরলো রুহি। তারপর কান্নারত কন্ঠে বলে ওঠলো,
‘আমাকে ক্ষমা করে দিও আপু। আমি স্রেফ পরিস্থিতির শিকার। ওনারও কোনো দোষ নেই। দোষ সব বোধহয় আমার কপালের। সারাটাজীবন আমার সাথে ভালো কিছুই হয়নি। আমার জীবনের গতিপথ উল্টাপাল্টা। তোমাদের কখনো এই বিষয়টি জানাতে পারিনি, কিন্তু জানানো আমার উচিৎ এবং কর্তব্য ছিলো। তোমাদের নুন খেয়েছি, অথচ তার চেয়ে বেশি কষ্টও দিয়েছি। এখন তোমরা যদি বলো তাহলে আমি ওনার থেকে দূরে চলে যাবো, চিরদিনের জন্য…’
ইভা ওর এমন কান্ডে হতবাক। ও তো শুধু মজা করছিলো, রুহিটাও না! ভাবলো সত্যিই বুঝি কিছু একটা হয়েছে। ইভা ওকে কাছে টেনে নিলো। তারপর হাসতে হাসতে খুন হওয়ার ভঙ্গি করে বলল,
‘বোকা মেয়ে। আমিতো মজা করলাম। তোর সাথে আমি বা আম্মু কেউ কখনো এরকম করতে পারি? তোর জীবন সেটা তোকেই ভাবতে হবে৷ আমরা তো তোর বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, যদিও দূরে করতে চাইনি তোকে। কিন্তু আমার ভাইয়ের সাথেই যখন এক সুতোয় বাধা পড়লি তখন আমাদের আর কোনো চিন্তা নেই। এবার নাচতে নাচতে তোর বিয়ে খাবো।’
রুহি চোখমুখ মুছে ইভার দিকে তাকালো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘নাচতে নাচতে বিয়ে খাবে মানে?’
‘মানে তোর বিয়ে। আগামী মাসের পাঁচ তারিখ। হাতে আর পনেরোদিন বাকি।’
রুহি অবাক হয়ে বলল,
‘এটা কখন ঠিক হলো? জানিনা তো।’
‘সারপ্রাইজ। তোর ডাক্তারবাবু নিষেধ করেছিলো। নিষিদ্ধ কথা আমি বাপু বলিনা।’
রুহি হেসে ফেললো। ইভা মুগ্ধ হয়ে তার বোনটাকে লক্ষ্য করলো। ওর চোখে পানি এসে গেলো। মেয়েটার জীবনে এবার সুখপাখিরা ধরা দেবে তো? হঠাৎ মনে পড়ায় ইভা জিজ্ঞেস করলো,
‘বাড়ি যাবি রে রুহি?’
‘আমার বাড়ি?’
‘হুম। তোর গ্রামে, তোর বাড়িতে?’
‘না।’
‘কেন?’
‘আমার পরিচিত কেউ নেই ওখানে। সাত বছর আগে যে গ্রাম ছাড়তে আমি বাধ্য হয়েছিলাম সেখানে গিয়ে আমি আর কি পাবো বলো তো, ইচ্ছে হয়না যে তা নয়। কিন্তু ওই অসভ্য, নোংরা, স্বার্থপর মানুষদের আমার প্রচন্ড ভয় লাগে। দ্বিতীয়বার ওদের মুখোমুখি হওয়ার কোনো শখ বা ইচ্ছা আমার নেই।’
‘তার মানে পুরোপুরিভাবে ছেড়ে দিলি নিজের আসল পরিচয় আর অস্তিত্ব?’
‘নাহ। ইচ্ছে করলে ঠিকই যাবো। শেকড়ের টান বলে একটা কথা আছে জানোতো, ওই টানে টান দিলে তবেই যাবো। আমায় জন্মদানকারীদের বাস ছিলো, আছে তো ওই গ্রামে। যেতে তো হবেই।’
ইভা ওর কথা শুনলো। তখন শহরের আকাশ আঁধারে ঢেকে গেছে। হাজারো কৃত্রিম আলোতে ঝলমল করা শহরটা এভাবেই তার রুপের বর্ণনা করছিলো। কোথায় সেই নির্মলা বাতাস, সোদা মাটির ঘ্রাণ আর জোনাকিদের খেলা? কোথায়? নেই কোত্থাও…
বড্ড বেশি ব্যস্ত আছে বিভোর ওর কাজকর্ম নিয়ে। আজ তিনটে ওটি, কনফারেন্স, অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত একটা জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমে ওকে বক্তব্য রাখতে হয়েছে। তার উপর রোগীদের চিকিৎসা দেওয়াসহ আরও টুকটাক কাজে ভীষণ ব্যস্ত সে। নিজের কপাল নিজেরই চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। একবার ফোন করে রক্তজবার খোঁজটা অবধি নিতে পারলোনা। রাগে,দুঃখে নিজের কেবিনে এসেই হোয়াইট এপ্রোনটা ছুঁটে ফেললো সোফার উপর। মাঝেমধ্যে মনে হয় ডাক্তার না হয়ে রিকশাওয়ালা হলে ভালো ছিলো। সারাদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে ইচ্ছে করলে রিকশা করে বাড়ি চলে যেতে পারতো, টুকটুকে বউটার দেখাশোনা করতে পারতো। সেখানে কোনো নিয়ম মানতে হতোনা, যখন ইচ্ছা রুহিকে আগলে ধরে বসে থাকতো। এসির টেম্পারেচার বাড়িয়ে ক্লান্ত শরীরটা চেয়ারে হেলিয়ে দিতেই ফোন বেজে উঠলো। চোখদুটো নিবদ্ধ রেখেই হাতড়ে হাতড়ে টেবিলের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে রিসিভ করলো। কানে ঠেকিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল,
‘কে বলছেন?’
ওপাশ থেকে সুধাময়ী রক্তজবার কন্ঠ শুনতে পেয়েই এক নিমিষে পনেরো বছরের কিশোর আবেগ গ্রাস করলো ওকে। বলল,
‘তুমি জানো আজ সারাদিন কত খাটুনি গিয়েছে আমার? শুধু মনে হচ্ছিলো একটাবার তোমার কন্ঠ শুনতে পেলে সব খাটুনির কষ্ট ভুলে যেতাম। এখন শুনলাম আর মনে হচ্ছে তুমি আমার পাশেই আছো।’
রুহি বিব্রত হয়ে বলল,
‘তো কান্নাকাটির কী হলো?’
‘কাঁদছিনা তো।’
‘আপনার কন্ঠ কান্না কান্না শুনাচ্ছে।’
‘ওফ, এটা কান্নাকান্না কন্ঠ নয়। এটা হচ্ছে আবেগ। যে আবেগে মিশে আছে তোমাকে না দেখার একবুক কষ্ট, যন্ত্রণা।’
‘এতো কষ্টিত হওয়ার কিছু হয়নি। সারাদিন তেমন কিছইই করেননি আমি জানি। সো কিপ…’
‘তুমি মজা করছো?’
‘না।’
‘বুঝি আমি।’
রুহি ওকে চমকানোর জন্য বলল,
‘আমাদের বিয়ে তো পনেরোদিন পর। জানেন তো?’
কিন্তু বিভোর চমকালো না। হাসিহাসি কন্ঠে বলল,
‘সারপ্রাইজটা কেমন লাগলো?’
‘বাজে, খুব বাজে।’
বিভোর মৃদু হেসে বলল,
‘আর কতকাল থাকিবে দূরে
আসতে হবে আমারই বুকে!’
বিভোরের কথা শুনে একরাশ লজ্জা নিয়ে ফোন কাটলো রুহি। মুখে লজ্জ্বামিশ্রিত আভা ছড়িয়ে পড়লো। আহা! রং লেগেছে বুঝি চারপাশের প্রকৃতিতে। হ্যাঁ, অবশেষে সবকিছু রুহির হতে চলেছে। হ্যাঁ পৃথিবী! তাঁর ভালোবাসার মানুষটা তাঁর হতে চলেছে। এতো সুখকে কোথায় বন্দী করে রাখবে সে? কিন্তু সুখকে কি আদৌ বন্দী করা যায়?
চলবে…ইনশাআল্লাহ!
#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩১
রৌদ্রকরোজ্জ্বল মিষ্টি বিকেল। প্রকৃতিতে মৃদু শীতের আমেজ । বাতাসে কেমন মিষ্টি ঘ্রাণ। বাসা ভর্তি মেহমান। তার মাঝে সেজেগুজে বসে আছে রুহি। আজ ওর গায়ে হলুদ। কাঁচা হলুদ শাড়ি আর ফুলের গয়নার ওকে দারুণ দেখাচ্ছে। শরীর দুর্বল বলে তাড়াহুড়ো করেই অনুষ্ঠানটা শেষ করা হলো। ছবিটবি তুলে, যা যা নিয়মটিয়ম পালন করার সেসবই করা হলো। যদিও রুহি চায়নি এসব করতে। কিন্তু সবাই বলল,এই মুহূর্তগুলো খুব আনন্দের, তাইনা! স্মৃতি হিসেবে রেখে দিতে সমস্যাটা কী? এরকম বিভিন্ন কথা শুনে রুহিকে বাধ্য হয়ে রাজি হতে হয়েছে। রাত দুটোর সময় ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা লাগাতেই ইভা এসে ওর ফোনটা হাতে দিয়ে ধমকে বলল,
‘তোর ফোন বন্ধ দেখে তোর বর আমাকে ফোন দিয়ে জ্বালাতন করছে। বেচারাকে ঠান্ডা কর। আমি গেলাম।’
রুহি ক্লান্ত গলায় বলল,
‘হ্যালো।’
‘হুম, বলো।’
‘আমি কী বলব? আপনি ফোন দিয়েছেন আপনি বলুন।’
‘ভালোবাসি।’
‘এটা বলতেই ফোন করেছেন?’
‘হুঁ।’
‘ভালোবাসি টু। রাখেন এবার।’
‘ওয়েট ওয়েট। আর কিছু বলবেনা?’
‘আর কী বলব?’
‘এই যে, হলুদ কেমন কাটলো? ভালো আছি কিনা, কি করছি এসব?’
রুহি হেসে উঠলো। বলল,
‘ঠিক আছে। ভদ্রতার খাতিরে জিজ্ঞেস করেই ফেলি! তা ডাক্তার সাহেব, আপনার হলুদ কেমন কাটলো?’
বিভোর ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
‘মোটামুটি। আমাকে সবাই হলুদ ভূত বানিয়ে দিয়েছে। আর জানো, আমার চশমা ভেঙ্গে দিয়েছে। কিছুই তো এখন দেখতে পাচ্ছিনা…’
রুহি ঠোঁট টিপে হাসলো। বলল,
‘শেষমেশ বিয়ে করবো কানা ডাক্তার? নো ওয়ে।’
বিভোর হুমকি দেওয়া গলায় বলল,
‘কানা হই ল্যাংড়া হই, বিয়ে আমি তোমাকেই করবো। করবো কেন বলছি, করেই তো বসে আছি! চাইলেও দূরে যেতে পারবেনা।’
‘এ্যাহহ। শখ কত রে..’
‘ইশ। কী চমৎকার কন্ঠ আমার বউটার। তা বউ আপনার শরীর কেমন এখন?’
‘ভালোই।’
‘খেয়েছেন তো?’
সেরেছে। এবার কী উত্তর দিবে? হলুদের নিয়মনীতি পালন আর ফ্রুট, কেকটেক খেয়ে তো ওর পেট ভরে গিয়েছে। নাদিরা, ইভার অনেক জোড়াজুড়ি স্বত্তেও এক লোকমা ভাত সে মুখে দেয়নি। এটা জানতে পারলে বিভোর এখন রেগে আগুন হয়ে যাবে। নাহ, জানতে দেওয়া চলবেনা। আবার মিথ্যা বলতেও খারাপ লাগছে। রুহি অনেক কষ্টে মিনমিন করে বলল,
‘হুঁ।’
বিভোর গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,
‘কী খেয়েছেন? আর আন্সার দিতে এতো লেইট হচ্ছে কেন?’
‘খেয়েছি। ভাত-মাছ।’
‘তাই? সত্যি তো?’
‘হ্যাঁ। মিথ্যা বলবো কেন?’
বিভোর এক ধমক দিয়ে ওকে চুপ করিয়ে দিলো। রুহি কেঁপে উঠলো। বিভোরের রাগী কন্ঠ, যেন সামনে পেলে এক্ষুনি কাঁচা চিবিয়ে খাবে। বলছে,
‘আমাকে বোকা ভাবো তুমি? ইভা আমাকে সব বলেছে। আর তুমি আমার সাথে মিথ্যা বলো..আমার সাথে? পিচ্চিকালে তোমাকে বিয়ে করেছি, তোমার হাবভাব-কথার ধরণ আর গলার স্বর শুনেই আমি এখন সব বুঝতে পারি। নিজেকে খুব চালাক ভাবো তাইনা? আমি একজন ডাক্তার। আর তোমাকে আমার হাড়ে হাড়ে চেনা আছে। এই দশদিনে যে দু’কেজি ওয়েট কমিয়েছেন সেটাও জানি। গলার হাড় ভেসে উঠেছে, হাতের রগ দেখা যায়, সেদিনের দুর্ঘটনার পরেও আপনি সচেতন হননি। শিক্ষা হয়নি এখনো? নাকি কানের নিচে কয়েকটা দিলে শিক্ষা হবে?’
রুহি চুপ। চোখে পানি। বিভোর ফোনের ওপাশ থেকেই বুঝতে পারছে। কিন্তু ওর প্রচুর রাগ হচ্ছে। রক্তজবা সবসময় এরকম করে। ও কি জানেনা ওর কিছু হলে বিভোর বাঁচতে পারবেনা, মরে যাবে। জানেনা মেয়েটা? এতো বয়স হলে কি হবে বাচ্চামো যায়নি এখনো। এই বয়সে কি ওকে মেরে মেরে খাওয়াতে হবে নাকি! চেহারার কি হাল হয়েছে এই ক’দিনে৷ বিভোরের কথা না ভাবুক অন্তত নিজের কথাটা তো ভাববে! খাওয়াদাওয়া যদি ঠিকসময় না করে তাহলে চলবে কীভাবে! কোনো উত্তর না পেয়ে বিভোর ধমকের সুরে বলল,
‘মুখে কথার বুলি ফুটছে না এখন? বোবার মতো চুপ করে আছেন কেন? নাকি আমি এসে খাইয়ে দিব? তখন কিন্তু এমন টাইট দিব সারাজীবনেও ভুলবেনা না খেয়ে থাকার কথা। বুঝলে?’
এবারও উত্তর না পেয়ে বিভোর ক্ষ্যাপাটে গলায় বলে উঠলো,
‘ওকে। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি মিসেস চৌধুরী। চাপকিয়ে দাঁত ফালিয়ে যদি না খাওয়াতে পারি তবে আমিও বিভোর না। আসছি আমি।’
রুহি অবাক হয়ে বলল,
‘আসছি মানে? কোথায়?’
‘আপনার কাছে। ঘাড় ধরে খাওয়াবো, মজা বুঝবেন তখন!’
রুহি চমকে ওঠলো। বিয়ের আগেরদিন এরকম কান্ড করলে আত্মীয়স্বজনরা সবাই হাসাহাসি করবে। কি বিশ্রি কান্ড! রুহি বলল,
‘আসবেন কীভাবে? আপনার তো চশমা ভেঙে গেছে।’
‘প্রবলেম হবেনা। আমি পারবো।’
রুহি তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলো,
‘বলছিলাম কি আপনার আসার দরকার নেই।’
‘কেন?’
‘আমিই খেয়ে নিচ্ছি।’
‘তাই? তা কি খাবেন? একটা কলা আর রুটি?’
আবারও ধরা পড়ে গেলো রুহি। মিনমিন করে বলল,
‘না না। ভাত খাবো।’
বিভোর নিজেকে সামলিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
‘আমি প্রুফ পাবো কীভাবে?’
রুহি হতাশ কন্ঠে বলল,
‘ভিডিও কল দিন। দেখাচ্ছি।’
একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো বিভোর। মেয়েটার এসব খামখেয়ালিপনা ওর একদম ভালো লাগেনা। ফোন কেটে হোয়াটস অ্যাপে কল দিলো।
বিভোরের রাগের কথা মাথায় রেখে রুহির মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। পেট ভর্তি হাবিজাবি খাবারে। এখন আবার ভাত! ওফ,, কি যন্ত্রণা। ডাক্তার বরের খাদ্য নিয়ে এই অত্যাচার সইবার চেয়ে দিনমজুরের বউ হওয়া অনেক ভালো ছিলো। ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে রাত বারোটা। রুহি পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরুলো। ইভার ঘরের আলাও জ্বালানো। অন্যসব ঘরে আলো নেই, সবাই ঘুমাচ্ছে। রান্নাঘরে পা বাড়ালো। ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে চুলায় গরম বসালো। গরম তরকারি আর ভাত প্লেটে নিয়ে সব গুছিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। ফোনটা বিছানার উপর রাখা। ভাইব্রেট করছে। রুহি খাবারগুলো নিয়ে বসলো। কল রিসিভ করতেই বিভোরের চেহারা দৃশ্যমান হলো। ওর চোখমুখ ফোলাফোলা। ফর্সা গালে লালচে আভা। সদ্য ঘুম থেকে জাগা আদুরে বেড়ালের মতো লাগছে ওকে। রুহিকে বলল,
‘খাবার রেডি? আমি দেখবো।’
‘হুম।’
বলেই খাবারের আইটেম সব দেখালো। অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও সব খেতে হলো। বিভোর বালিশে হেলান দিয়ে বুকের ওপর ল্যাপটপটা রেখে মেয়েটার খাওয়া দেখছে। বাচ্চাদের মতো ছোট লোকমা দিতে দেখে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো। রুহি খাওয়া থামিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কী হয়েছে?’
‘কিছুনা। খাও।’
‘আমার খাওয়া দেখে হাসছেন, তাইনা?’
বিভোর মুচকি হেসে বলে,
‘হুম৷ বাচ্চা একটা। আমার বউ যে বোঝাই যায়না। আচ্ছা, আমাদের বেবিরাও কী তোমার মতোই হবে? আই মিন এমন বাচ্চাবাচ্চা টাইপ স্বভাব আজীবন থাকবে৷ এরকম কোনো বেবি হওয়ার চান্স আছে কী?’
রুহির চোখদুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে বিষম খেলো। কাশি থামাতে পানির গ্লাস তুলে ঢকঢক করে খেলো। বিভোর আহত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। বলল,
‘দুঃখিত বউ।’
রুহি রাগ এবং লজ্জ্বামিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো,
‘শুভ রাত। ঘুমান।’
ফোন রেখে খাবারদাবার গুছিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। বেশ রাত তখন। নিশুতি প্রাণীদের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আজ রাতটাই নিজের এই ঘরটাতে ঘুমাবে, এরপর হয়ে যাবে অন্য বাড়ির বউ। পার্মানেন্ট থাকার ব্যবস্থা হবে বিভোরের বাড়িতে। প্রিয় এই বিছানার কথা ভেবেই ওর চোখে জল এলো। যদিও মাঝেমধ্যে আসা হবে। নাদিরা একা হয়ে যাওয়ায় ইভা নিজের কাছে নিয়ে যাবে, ইচ্ছে হলে বিভোরের বাসায়ও যাবে। ওর তো নিজের খালাই হয়। এদিক দিয়ে স্বস্তি পেলো রুহি। কাল অনেক ধকল যাবে, তাই দ্রুত ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
_____
সারা বাড়িতে সাজ সাজ রব। বিভিন্ন অর্কিড আর গোলাপ দিয়ে সাজানো বিভোরদের বাড়ি। সব ফুল বাবর চৌধুরীর বাগানের আর অর্কিডগুলো অর্ডারের। মালি রতনের মন খারাপ। সে গেইটের কাছে ফুলগুলো ককশীটের ভেতর গেঁথে দিচ্ছে। বাবর চৌধুরী ওর মুখ ফোলানো দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী রে? মন খারাপ?’
রতন মাথা দুলিয়ে বলল,
‘জে স্যার। আম্মারে কইয়া আসলাম, আমারও বিয়া ঠিক করতে।’
‘বাহ। ভালো তো। যত তাড়াতাড়ি বিয়ে করবি ততই ভালো।’
রতন হতাশ হয়ে বলল,
‘হুঁ।’
‘তুই কিন্তু রেডি থাকিস সময়মত। বরযাত্রী যেতে হবে।’
‘আমি যামুনা।’
ধমকে উঠলেন বাবর চৌধুরী।
‘আমার বাড়ির একটা লোকও বাদ যাবেনা, সবাইকে যেতে হবে। নইলে খুব খারাপ হবে। আর কোনো কথা শুনতে চাইনা। বিভোরের চশমা এনেছিলি?’
রতন মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানায়। তারপর পকেট থেকে বিভোরের চশমাটা হাতে দিয়ে বলে,
‘বিয়ার দিনও কী চশমা পড়বো? মাইনসে কানা জামাই বলব!’
বাবর চৌধুরী বিরক্ত গলায় বললেন,
‘বললে বলুক। ছেলে তো এটা ছাড়া ক্লিয়ার করে কিছু দেখতে পারেনা, বউ দেখবে কীভাবে? ওর তো অধিকার আছে ওর বউ দেখার। আচ্ছা, তুই কাজ সেরে রেডি হ। আমি ওকে এটা দিয়ে আসি।’
বলতে বলতে ওনি রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। নাসিমা আর কয়েকজন মহিলা রান্নাঘরে সব গুছিয়ে রাখছেন। বাবুর্চিদের সব বুঝিয়ে দিচ্ছেন৷ বাবর চৌধুরী নাসিমাকে ডেকে কিছু জরুরি কথা শেষ করে বিভোরের ঘরের দিকে গেলেন। ও তখন সদ্য গোসল সেরে টাওয়াল পরে বসে আছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকাচ্ছে। বাবর চৌধুরী ঘরে ঢুকে ধমকে উঠলেন। বিভোর চমকে জিজ্ঞেস করলো,
‘কী হয়েছে?’
‘তোর মাথা। তুই কী খালি গায়ে টাওয়াল পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসবি?’
‘আমি কি তা বলেছি?’
ওর হাতে চশমাটা দিয়ে ওনি ঠোঁটে হাসি এঁকে বললেন,
‘তুই বরং এভাবেই যা। টাওয়াল পরে বিয়েতে বসবি আমি তোর ফটো তুলে পোস্ট করবো। সবাই দেখবে তোর সিক্স প্যাকওয়ালা বডি। মুহূর্তেই ভাইরাল বনে যাবি। বল, আইডিয়াটা কেমন?’
বিভোর চশমাটা পরে নিলো। বাবার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘আইডিয়া মন্দ নয়৷ তবে তুমি যদি এভাবে পুত্রের বিয়ে খেতে যাও, তাহলে আমিও যেতে রাজি। বাপ-ছেলে মিলে ইতিহাস সৃষ্টি করবো। অবশ্য আমার বউ লজ্জ্বায় তখন নীল হয়ে যাবে। আর তোমার এই উটকো আইডিয়া ইউজ করে হাজব্যান্ড হয়ে আমি ওকে নীল রঙা বউ বানাতে পারিনা। তাইনা?’
ছেলের বেয়াদবিতে কিছুক্ষণের জন্য বাক্যহারা হলেন বাবর চৌধুরী । তারপর মুখ কালো করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন,
‘অতি দ্রুতই নাতিনাতনির মুখ দেখতে চাই। নইলে চাপকিয়ে তোর দাঁত ফালিয়ে বাড়ি থেকে বের দিবো। অবশ্য এসবে আমার মেয়ের দোষ থাকবেনা আমি জানি, তাই কখনো ওর উপর কোনো দোষ কখনো চাপানোর চেষ্টা করবিনা। যা গরু, এবার রেডি হয়ে নে।’
বিভোর ঘোলাটে দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ওর বুকের ভেতর কেমন চিনচিনে ব্যথা আরম্ভ হয়েছে।
চলবে…ইনশাআল্লাহ!