আঠারো_বছর_বয়স,পর্ব-৫,৬
লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
পর্ব-৫
বিভোরের এইসব কথাবার্তা শুনে রুহি শুধু অবাকই হলো। হ্যাঁ না কিছু বললো না। যেন একটা কাঠের পুতুল। যে যেভাবে চাচ্ছে সেভাবে ওকে ব্যবহার করে যাচ্ছে। রুহিকে নিয়ে বিভোর চলে আসতে চাইলে মাহিম অনেক ঝামেলা করে। বিভোর বুঝানোর চেষ্টা করে বলল,
‘ দেখুন আপনি নিজের বোনের সাথে এমন করতে পারেন না।’
‘ ও আমার নিজের বোন না, সৎ বোন।’
বিভোর অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করে না।
‘ যা-ই হোক, আপনি এমন করতে পারেন না। একটা এডাল্ট মেয়েকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনোকিছুতে রাজি করানো অপরাধ।’
‘ আপনাকে শিখানো লাগবো না। নিজের চরকায় তেল দেন আর ভাগেন।’
‘ আমিতো বলেছি ওকে সাথে নিয়ে যাবো।’
‘ কে হন আপনি এর? কিছু লাগেন? তাইলে এতো ফাল পারতাসেন কেন?’
‘ আপনাকে সেটার বিচার করতে হবেনা। নিজেকে শোধরান আগে।’
‘ আপনি এরে নিতে পারবেন না।’
‘ তাহলে আমি পুলিশকে সবটা জানাতে বাধ্য হবো!’
মাহিম ভয় পেয়ে যায়। ফাহিমা ওর কানে কানে বলল,
‘ এবার কি হবে?’
‘ বুঝতেসিনা।’
‘ যদি সত্যিই পুলিশ নিয়া আসে?’
‘ হইলেও হইতে পারে। পোশাক আশাক দেইখা তো বড় কিছুই মনে হয়।’
‘ এর সাথে রুহির দেখা হইলো কেমনে?’
‘ কি জানি।’
‘ এহন করবা কী? এদিকে সজীব তো তাড়া দিতাছে।’
‘ হ, এরে সজীবের ঘাড়ে তুইলা দিয়া আমরা জেল খাটুম তাইনা?’
‘ আমি কি সেইটা কইছি?’
‘ তাইলে চুপ থাকো। মাইয়া মানুষের জন্মই চুপ থাহনের লাগি।’
ফাহিমা রাগে গজগজ করতে থাকে। মাহিম সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সাহস সঞ্চয় করে বিভোরের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ ঠিক আছে। নিয়া যান এরে।’
‘ এবার লাইনে আসছেন।’
‘ তয় আমার বাড়ির ত্রি-সীমানায় যেন এরে না দেহি।’
বিভোর হেসে বললো,
‘ এটা নিশ্চয়ই ওর ও বাড়ি?’
‘ হ। আমাগো বাপে দুই বিয়া করছিল।’
‘ তাহলে ও এই বাড়িতে যখন ইচ্ছা তখনই আসতে পারবে। আপনি বাধা দিতে পারবেন না।’
মাহিম রেগে যায়। কিন্তু কথা বলার সাহস পায়না। বিভোর রুহিকে নিয়ে চলে আসে। নিজের বাড়ি ছেড়ে আসার সময় শুধু একবার পেছনে ফিরে তাকায় ও। এখানেই ওর জন্ম, মা-বাবার শেষ চিহ্নটুকুও এখানেই আছে। তবে কেন আজ ওর এমন হাল! নিজের বাড়িতেই চাকরানী হয়ে থাকতো অথচ আজ ভাগ্য ওকে সেখান থেকেও তাড়িয়ে দিলো।
ছায়াঘেরা মেঠোপথ ধরে গ্রাম ছেড়ে চলে আসার সময় রুহির চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি ঝরে যায়। চেনে না, জানে না কাগজের স্বামীটার সাথে ও অজানা ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াচ্ছে। এমন শুধু সিনেমায় দেখেছে। বাস্তবে ওর সাথে এমন ঘটতে পারে সেটা ভাবনার অন্ত।
রাস্তার দুইপাশে ঘাসফুলের উপর ছোট ছোট ফুল ফুটে আছে৷ একটা হিন্দুবাড়ির প্রবেশপথের মাথায় সাদা আর লাল রঙের জবা ফুলে গাছ বাতাসে দুলছে। বিভোর সেদিকে এগিয়ে গেলে বোবার মতো দাঁড়িয়ে রইলো রুহি। বিভোর হুট করে অনেকগুলো লাল টকটকে ফুল ছিঁড়ে নেয়, সাথে সাদাটিও। কেউ দেখতে পায়নি।
চোরের মতো যে বিভোর ফুল চুরি করতে পারে সেটা দেখেও রুহি বিস্মিত। ডাক্তার দেখি পুরাই অন্যরকম। অথচ রুহি এতোদিন ভাবতো ডাক্তাররা বুঝি খুবই গম্ভীর আর কাজে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু বিভোর ওর সব ধ্যানধারণা বদলে দিচ্ছে। রৌদ্রকরোজ্জ্বল দুপুরের শেষ আলোর ছটা যখন পথে লুকোচুরি খেলছিলো, বাতাস যখন জোরে হাওয়া দিচ্ছিলো, পৃথিবীটা যখন প্রেমময় হয়ে উঠেছিলো তখনই বিভোর রুহির সামনে এসে দাঁড়ায়। হাতে ফুলের গুচ্ছ। আশ্চর্য রঙিন আলোয় বিভোরকে তখন অদ্ভুত সুন্দর পুরুষ দেখাচ্ছিলো। এতো সুন্দর মানুষ হয়? এই মুহূর্ত কি দ্বিতীয়বার ফিরে আসতে পারেনা? অচেনা পুরুষটিকে একবারের জন্য হলেও রুহি হঠাৎ ওর প্রেমিক স্বামী ভেবে ফেলতে বাধ্য হয়। প্রেমে পড়তেও বাধ্য হয়। অথচ দুজনের পরিচয় একদিনের।
ভালোবাসা এমন এক জিনিস যে কখন কার প্রতি, আর কীভাবে হয়ে যায় তা মানুষ বুঝতেই পারেনা। বিপরীত প্রান্তের মানুষটি তাঁর চোখে হয়ে ওঠে স্বর্গের ন্যায়। স্বর্গেও কি এতো সুখ থাকে যেমন থাকে ভালোবাসায়? নিশ্চয়ই থাকে! নইলে কি আর স্বর্গকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়? যেখানে সবসুখ একত্রিত হয় তাকেই তো স্বর্গসুখ বলে। আর ভালোবাসা না থাকলে সুখ আসবে কোথা থেকে! সুখ থেকেই তো স্বর্গসুখ!
‘ তোমার চুলগুলো তো দারুণ। খুলে ফেলো।’
রুহি চমকে উঠলো। ধ্যান কাটতেই বুঝতে পারলো তার পুরুষটি এখন ওর সামনে দাঁড়ানো। থতমত খেয়ে বলল,
‘ কেন খুলবো?’
‘ আমি বলেছি তাই।’
‘ পারবো না। আমার অস্বস্তি হয় খোলা চুলে।’
‘ হবেনা।’
‘ আপনি জানেন? চুল ওড়াওড়ি করে আমাকে বিরক্ত করে!’
বিভোর হেসে বললো,
‘ খোলা চুলেই থাকতে ভালো লাগবে তোমার। এখন বকবক কম করে খুলো। নইলে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো।’
রুহি চুলের খোঁপা খুলে দিলেই পিঠ ভাসিয়ে ছড়িয়ে পড়ে চুলের গোছা। খুব যত্নে একটা রক্তজবা রুহির চুলে গুঁজে দেয় বিভোর। বাহ! বেশ দেখাচ্ছে।
বিভোরের ঠোঁটের মৃদু হাসিটার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে রুহি। লোকটা বেশ চমৎকার। এই অভাবনীয় সুন্দর মুহূর্তের রেশ কাটতেই বিভোর হেসে ফেলে।
‘ তোমার নাম যেন কী?’
‘ রুহানি।’
‘ তোমার ভাইটা তো কি যে ডাকছিলো!’
‘ রুহি!’
‘ বাহ, তোমার নাম তো বেশ সুন্দর!’
‘ আমার বাবা রেখেছিলো তো, তাই সুন্দর।’
এরপর আর কথা হয়না দুজনের। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে টিকিট নিয়ে বিভোর রুহিকে নিয়ে রওয়ানা হয় ঢাকার দিকে। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। ক্লান্ত রুহি বিভোরের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। যখন ওর ঘুম ভাঙে তখন দেখলো বিভোর রেগে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
গোলগোল চোখে বিভোরকে পরখ করে রুহি বোকা হেসে জিজ্ঞেস করে,
‘ কী হয়েছে?’
বিভোর কটমট করে বলে,
‘ তুমি এভাবে বাঁকা হয়ে ঘুমালে কেন? মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে অল্প বয়সেই কুঁজো হয়ে যাবার ইচ্ছে জাগছে নাকি! ড্যাম ইট!’
‘ বুঝতে পারিনি।’
‘ বাচ্চা নাকি তুমি? যখন তখন গায়ে এসে পড়ো। আমাকে চিনোনা, জানোনা তাও এমন ভাব করছো যেন আমি তোমার পূর্ব পরিচিত। শুনো, এরকম মানুষদের কখনোই বিশ্বাস করবেনা।’
‘ আপনাকেও নয়?’
‘ আমাকে তো বিশ্বাস করেই বসে আছো। আমি সেটা বলছিনা। মানুষকে বিশ্বাস করার আগে একশোবার তাকে পরখ করে নিবে, যাতে করে তার উদ্দেশ্যে বুঝতে পারো।’
‘ আপনার উদ্দেশ্য কী?’
বিভোর বিরক্ত হয়ে ধমক দিলো। তারপর বলল,
‘ আমরা এসে গেছি ঢাকা। এখন উঠো, নামতে হবে।’
রুহি অবাক হয়ে যায়। ঢাকা, তার স্বপ্নের শহর। জীবনের প্রথম পদার্পণ করছে ঢাকায়। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। খুশি খুশি গলায় বলল,
‘ আমরা এখন কি আপনার বাসায় যাবো?’
‘ তুমি দেখি আমাকে সত্যিই তোমার বর ভেবে বসে আছো।’
রুহি লজ্জ্বা পেয়ে চুপ করে যায়। বিভোর গম্ভীর গলায় বলল,
‘ তোমাকে আমি এই অধিকার কখনো দিতে পারবোনা।
আর অতি দ্রুত এটা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করবো।’
রুহি নিচু গলায় বলল,
‘ আমি আপনাকে আমার বর ভাবছিও না।’
‘ তোমাকে আমার এক ফ্রেন্ডের বাসায় দিয়ে আসবো, ও তোমার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিবে।’
রুহি অবাক হয়ে বলল,
‘ আপনি কি আমাকে পাচার করে দিবেন?’
বিভোর এ কথা শুনে বাক্যহারা হয়ে যায়। এসব কি বলে মেয়েটা? সাহায্য করতে নিয়ে এসে এখন নিজেই দেখি বিপদে পড়ে গেলো। রুহিকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল,
‘ এসব কথা দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করবেনা কারণ আমি সেরকম মানুষ নই। আর সন্দেহ হলে একলা যাও, যেদিকে চোখ যায়। ওকে?’
‘ আমিতো তেমন কিছু মিন করিনি।’
‘ তোমার মনে ডাউট আছে।’
‘ আমি দুঃখিত।’
বিভোর ওর কান্ড দেখে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে বললো,
‘ ইট’স ওকে। বললাম না, কাউকে এতো সহজে বিশ্বাস করবেনা!’
রুহি বলল,
‘ আমরা কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবো? আমার খুব খিদে পেয়েছে।’
‘ এখান থেকে ওর বাসা খুব দূরে নয়। ওখানে সব রেডি আছে।’
রুহি চুপ হয়ে যায়। তারপর বলে,
‘ আপনি কি আমাকে ওখানে রেখে চলে যাবেন?’
‘ হুম। বাসার সবাই নিশ্চয়ই চিন্তা করছে। ক্লান্ত আছি, বাসায় গিয়ে ফ্রেশ ঘুম দেবো।’
‘ আপনার সাথে আমার কি আর দেখা হবেনা?’
‘ না।’
বেশ কনফিডেন্সের সাথে বললো বিভোর। রুহির বুকটা কেঁপে উঠলো।
‘ আমি আমার ফ্রেন্ডকে সব বলে দেবো। ও সবকিছু করে দেবে। তোমাকে কলেজে এডমিট করিয়ে দেবে। ভালো করে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। সব অন্যায় মাথা পেতে নেবেনা। তুমি একদিন অনেক বড় হবে।’
রুহি শুধু শুনেই যায়। বিভোর গম্ভীর গলায় বলে,
‘ আর আমাদের দেখা হবেনা রক্তজবা। কখনোই না!’
ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।
চলবে… ইনশাআল্লাহ!
#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬
বিভোর নিজের এক ফ্রেন্ডের কাছে রুহির সব দায়িত্ব দিয়ে ওর থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। যাবার আগে কথা দিয়ে যায় রুহির সঙ্গে ডিভোর্সটা ফাইনাল করবে সময় সুযোগ হয়ে উঠলে। অবশ্য বিভোর তাঁর বান্ধবীকে জানায়নি রুহি তাঁর বউ। বিভোর আত্মবিশ্বাসের সাথে ভাবলো রুহানি নামক মেয়েটির সাথে যেন আর কখনো দেখা না হয়। সেদিনের পরে আসলেই ওদের আর দেখা হলো না। বিভোরের বান্ধবী রুহিকে একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয়, কিছু টিউশন জোগাড় করে দেয় যাতে নিজের খরচ নিজে চালাতে পারে। বান্ধবীটি অবশ্য রুহির খুব খেয়ালও রাখতো। এভাবেই রুহির দিনকাল মোটামুটি চলছিলো৷ কিন্তু দিন যতই যাচ্ছিলো, অচেনা শহরে জীবনের মানে বুঝতে সক্ষম হচ্ছিলো রুহি, তখন ওর মনের কোণে অতি সূক্ষ্মভাবে বিভোর নামক মানবটির নাম গেড়ে বসেছিলো। তাঁর স্বামী, যাকে সে ভালোবেসে ফেলেছিলো। রাতেরবেলা নিরবে চোখের জল বিসর্জন দিতো সে। বিরহে দিন কাটাতো, অভিমানের পাহাড় জমেছিলো মনের ভেতর। সে তখনো জানতো না, কখনো ওই লোকটির সাথে ওর দেখা হবে কি-না!
কিন্তু একদিন ঠিক দেখা হয়ে গেলো। রুহির উৎকন্ঠা আর বিভোরের আত্মবিশ্বাসের সাথে বলা ওই কথাটা যেন ধোপেই টিকলো না। আঠারো বছরের সেই রুহি আজ একুশ বছরের যুবতী। কেটে গেছে তিনটি বছর। ওদের দেখা হওয়াটা নিতান্তই কাকতালীয় ভাবে হলো। বিভোরের খালার বাসায়, তাঁর খালাতো বোন ইভার বিয়েতে। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যখন হলদে শাড়ি পড়া মানবীটি বারবার সবার নজর কাড়ছিলো, পেছন থেকে দেখে বিভোরও বেশ কৌতূহল বোধ করছিলো। কিন্তু মানবীটি যখন রাতুলকে হলুদ মাখাতে গেলো, সেই হাসিমুখে থাকা মেয়েটিকে দেখে বিভোর চমকে, বিস্মিত হয়ে কাঠ হয়ে তাকিয়ে রইলো। এটা তো রক্তজবা। ওর সেই কিশোরী বউটি। যাকে আজ থেকে তিন বছর আগে বান্ধবীর হাতে তুলে দিয়ে এসেছিলো। ডাক্তারি পড়ার বদৌলতে ওকে একটা কোর্সের জন্য দেশ ছেড়ে যেতে হয়েছিলো বিধায় বিভোর ওর কিশোরী বউটিকে ডিভোর্স দিতে পারেনি। একপ্রকার ভুলেই বসেছিলো বিভোর। এবার ও সচকিত হলো। কোন মুখে দাঁড়াবে রুহির সামনে? কথা দিয়ে কথা রাখেনি বিভোর, ছাড়তে পারেনি ওকে। আচ্ছা রুহিও কী বিভোরকে ভুলে গিয়েছে? ভাবনার মাঝেই ওর মা নাসিমা চৌধুরী এসে বিভোরের পাশে দাঁড়ালেন। হাত ঘড়িটাতে চোখ বুলাতে বুলাতে বললেন,
‘ বারোটা বেজে গিয়েছে। তোমার বাবার ঔষধ খাওয়ার সময় হয়েছে।’
‘ ওহহ, আমি যাচ্ছি।’
‘ প্রয়োজন নেই। আমি দিয়ে এসেছি। জাস্ট তোমাকে জানিয়ে রাখলাম।’
‘ ওহহ, ধন্যবাদ!’
‘ আমাকে কেমন দেখাচ্ছে আম্মু?’
‘ হঠাৎ এই প্রশ্ন?’
‘ না মানে, অনেকদিন এসব পরিনি তো তাই অস্বস্তি হচ্ছে।’
নাসিমা চৌধুরী হেসে বললেন,
‘ রাজপুত্রকে সবসময় সুন্দরই লাগে। পাশে রাজকন্যা দরকার।’
বিভোর মায়ের পাশে বসে থাকে। অনুষ্ঠান মাত্র শুরু হয়েছে বিশ মিনিট। আরো রিচুয়ালস এবং ফটোশুট বাকি। বিভোর ওর মায়ের বলা কথাটা ভাবছে। পিছুটান! যেই টান কাটানোর শক্তি সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারোর নেই। ওর একটা বউ আছে, এটা মনে হতেই শরীরে বিদ্যুৎ বয়ে গেলো। কাঁটা দিয়ে উঠলো শরীর। সেই ছোট্ট রুহি আজ পরিপূর্ণ যুবতী। বাতাসে কেমন বউ বউ গন্ধ পাচ্ছে বিভোর। কিন্তু রক্তজবাকে তো সে ভালোবাসে না। এমন কিছু মাথায়ও আসেনি, তাহলে? নাসিমা বেগম ছেলের পাশ থেকে উঠে গেলেন। সম্প্রতি দেশে ফিরা বিভোরকে নিয়ে সবার কৌতূহলের শেষ নেই। আত্মীয়রা এরই মধ্যে নিজেদের মেয়েদের একপ্রকার সাজিয়ে গুছিয়ে প্রস্তাব পাঠাতে শুরু করে দিয়েছে। এমন রাজপুত্র কেউ হাতছাড়া করতে চায়না। বিভোর এসব কথা ভেবে মুচকি হাসে। তার এখন প্রাক্তন আছে, ফ্রিতে বউও আছে। একটা গার্লফ্রেন্ড জোগাড় করার খুব ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও ওই দুটি মানবীর জন্য বোধহয় তৃতীয় কোনো নারী ওর জীবনে পদার্পণ করবেনা। আবার করতেও পারে। ভালোবাসা ছাড়া কি কাউকে আটকে রাখা যায়? যায়না!
_________
গরমে, ঘেমে শেষ রুহি। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যে এতো লোক হয় তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতো না। ইভার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
‘ আপু, তোমাদের এতো স্বজন কেন? আমিতো অতি কষ্টে আর গরমে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছি।’
ইভা হেসে বললো,
‘ বোনের বিয়ে দিতে চাস, একটু খেসারত তো দিতেই হবে। তোকে কিন্তু আজকে অপ্সরা লাগছে।’
‘ ধুর, তোমার সাথে কথা বলাই বৃথা।’
‘ আম্মু কই? বল না আমাকে এক গ্লাস পানি দিতে।’
‘ বড়মা কে ডাকার দরকার কী? আমিই এনে দেবো।’
‘ এতো ভারী সাজগোজ করেছিস আবার বুয়াগিরিও করবি? পার্লারের টাকাটার কোনো দামই দিচ্ছিস না দেখি।’
‘ দেখো, আমি একদম ন্যাচারাল সুন্দরী।’
‘ হুম জানি। তুমি কেমন ন্যাচারাল বান্দরি।’
ইভার সাথে খুনসুটি করে রুহি পা বাড়ায় নিচে। সিঁড়ি দিয়ে অতি সাবধানে নামছে, কারণ শাড়ি সামলানোর অভিজ্ঞতা ওর প্রায় নেই বললেই চলে। নিচতলায় কেউ নেই, অনুষ্ঠান হচ্ছে ছাদে। রুহি ডাইনিং থেকে পানি নিয়ে ছাদের সিঁড়িতে পা দিতেই পেছন থেকে ভেসে এলো অতি পরিচিত, কিন্তু নিতান্তই অপরিচিত একটি পুরুষালী কন্ঠ!
‘ কেমন আছো?’
বুক কেঁপে উঠলো রুহির। পেছনে ফিরে তাকানোর সাহস বা ইচ্ছা কোনোটাই ওর নেই। হ্যালুসিলেশন ওর মাথাটা খারাপ করে দিচ্ছে। আজকাল একটু বেশিই হচ্ছে। কাগজের স্বামীটা প্রায়ই ওর মস্তিষ্ক দখল করে নিজের আয়ত্বে নিয়ে নেয়। তখন রুহি ঠিকঠাক কিছু ভাবতে পারেনা। অভিমান জমা হতে হতে পাহাড়ের আকার ধারণ করেছে। প্রতিবার পেছন ফিরে কাউকেই দেখতে পায়না রুহি৷ তাই আজও এড়িয়ে যেতে চাইলো। পা বাড়ালো সামনে।
‘ স্টপ ইট! মেয়ে, কি বলছি শুনতে পাচ্ছোনা?’
রুহি এবার সত্যিই ফিরে তাকায়। তাকিয়েই বড়সড় ধাক্কা খায়। গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে কাঁপা কাঁপা কিছু শব্দ।
‘ আ..আপ..আপনি?’
‘ চমকে গেলে?’
‘ হুম৷ কিন্তু এটা সত্যিই আপনি ডাক্তারবাবু?’
বিভোর হেসে বললো,
‘ ডাক্তারবাবু? লাইক সিরিয়াসলি? হুম, আমিই!’
‘ আপনি এখানে কেন?’
‘ তুমি এখানে কেন?’
‘ আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।’
‘ ওকে। এটা আমার খালার বাড়ি।’
‘ মানে, ইভা আপুর কাজিন?’
‘ হুম। কিন্তু ওর সাথে তোমার পরিচয় হলো কি করে? তোমরা কি কোনোভাবে রিলেটিভ?’
‘ না না। আমি এখন এখানেই থাকি।’
বিভোর অবাক হয়ে বলল,
‘ কি রিজনে?’
‘ আছে কিছু কারণ। এখন বলা বারণ।’
বিভোর হেসে বললো,
‘ ওকে।’
‘ কেমন আছেন?’
‘ ভালো। তোমাকে দেখে আরও ভালো হয়ে গিয়েছি।’
রুহির মনে একদলা সুখপাখি ডানা ঝাপটে উড়ে যায়। এবার বুঝি সত্যিই ডাক্তারবাবু ওকে দেখে খুশি হয়েছে।
‘ আচ্ছা, আমি যাই।’
‘ কোথায়?’
‘ ইভা আপুকে পানি দিতে হবে।’
‘ শুনো! তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।’
‘ পরে শুনবো।’
‘ জাস্ট টেন সেকেন্ড!’
‘ ওকে বলুন।’
‘ আসলে তোমাকে আমি ডিভোর্স দিতে পারিনি কারণ ওইসময় কিছু সম্ভব ছিলো না। আমি চাচ্ছি এবার যেহেতু দেশে ফিরেছি তাই বিষয়টা শেষ করে দিতে। আই সোয়্যার রক্তজবা, আমি ইচ্ছে করে এমন করিনি। কিন্তু এবার সত্যিই মুক্ত করে দেবো তোমাকে। কাগজের সম্পর্কে আর বেঁধে রাখতে চাইনা তোমায়।’
রুহির হাত থেকে পানির গ্লাসটা ফ্লোরে পড়ে ভেঙে যায়। গ্লাসের পানিটা ছলকে পড়ে শাড়িতে। বিভোর এগিয়ে এসে সাহায্য করতে চাইলে রুহি কান্না চেপে শক্ত গলায় বলল,
‘ আমি একাই পারবো। থ্যাংকস!’
রুহি এলোমেলো পায়ে ফ্লোর থেকে কাচগুলো তুলে নেয়। অসাবধানতাবশত আঙুলের বেশ খানিকটা কেটে যায়। বিভোর দেখতে পেয়ে ওর হাতটা টেনে নিয়ে বলল,
‘ দেখি দেখি, কিভাবে কাটলে?’
রুহি ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে নেয়। কথা না বলে বাকি কাচগুলো তুলতে থাকে। আবারও খোঁচা লাগে আঙুলে। এবার রক্ত টপটপ করে ফ্লোরে পড়তে থাকে। কিন্তু রুহি থামছেনা, বিভোর চটে গেলো।
‘ আর ইউ মেইড? এমন করছো কেন? আমাকে দেখতে দাও!’
‘ আমি ঠিক আছি, আর পাগল? হ্যাঁ, আমি পাগলই। ওকে?’
মেয়েটার ব্যবহারে অবাকের চরম পর্যায়ে চলে যায় বিভোর। এতোক্ষণ তো ভালো ভাবেই কথা বলছিলো, এখন আবার কি হলো!
‘ আমাকে দেখাও কোথায় কেটেছে। নাহলে ব্যথা করবে।’
রুহি ঠান্ডা গলায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো,
‘ কোথায় কেটেছে আমি দেখাতে পারবোনা। আর ব্যথা এমনিতেও কমবেনা। ডাক্তাররা সব রোগ সারাতে পারেনা, আপনিও পারবেন না।’
বলেই রান্নাঘরে চলে যায় রুহি। কাচগুলো ঝুড়িতে ফেলে এন্টিসেপটিক দিয়ে ক্ষতটা পরিষ্কার করে গ্লাসে পানি ঢেলে ছাদের দিকে রওয়ানা হয়। বিভোর সিঁড়িঘরে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটার ব্যবহার অদ্ভুত ঠেকে ওর কাছে। কিন্তু রক্তজবা এখানে কেন? কিছুই বুঝতে পারছেনা ও।
রুহি ছাদে পানি নিয়ে ইভাকে দিলো। তারপর বলল,
‘ আপু আমার খুব ক্লান্ত লাগছে। হইচই ভালো লাগছেনা, আমি ঘরে যাই!’
‘ সেকী কেন?’
‘ ভালো লাগছেনা, ঘুম প্রয়োজন!’
‘ তুই না থাকলে আমার ভালো লাগবেনা।’
‘ কাল থেকে তো বরের সাথেই থাকবে, তখন তো আর আমাকে পাবেনা। তাই আমাকে ছাড়া থাকতে শিখে যাও। হা হা।’
ইভাও হেসে ফেললো। বলল,
‘ ঠিক আছে। নিচতলায় কেউ নেই, দরজা লাগিয়ে দিস।’
‘ ওকে!’
এতোক্ষণ ধরে রুহিকে ফলো করছিলো ইশতিয়াক। টকটকে লাল চোখগুলোতে কেমন অস্বস্তিকর চাহনি। ইভার বন্ধু সে। নিমন্ত্রণ পেয়েই এসেছে। কিন্তু এর পেছনের একটা বড় কারণ রুহি। ওকে ইশতিয়াক পছন্দ করে। একথা সে বলেছেও রুহিকে। কিন্তু রুহি ওকে রিফিউজ করেছে, বাড়াবাড়ি করায় একদিন থাপ্পড়ও দিয়েছিলো। এটার প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ অনেকদিন ধরেই খোঁজছিলো ইশতিয়াক। মনে হচ্ছে সেই সুযোগটা আজ পাওয়া গিয়েছে। রুহিকে আজ খুবই সুন্দর দেখাচ্ছে। একটা নিষিদ্ধ চাওয়া ইশতিয়াকের মনে ঢোল পেটাচ্ছে। ইভার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নামতেই রুহি টের পেলো কেউ একজন পেছন থেকে ওর আঁচল ধরে আছে।
পেছনে ফেরার সুযোগও পেলো না। এর মধ্যেই ইশতিয়াকের হাত চলে গেলো রুহির উন্মুক্ত পেটে। অবাধ্য বিচরণ করতে লাগলো। রুহি পেছনে ফিরে অভদ্রকে দেখার চেষ্টা করতেই ওর মুখ চেপে ধরলো ইশতিয়াক। কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
‘ তোমাকে আমার চাই।’
ইশতিয়াকের নেশাক্ত কন্ঠ শুনে গলা শুকিয়ে এলো রুহির। চিৎকার করার সুযোগ পাচ্ছেনা। আর চিৎকার করেও লাভ নেই। সারাবাড়িতে গান বাজছে। এমন যে সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করলেও কারো কান অব্ধি পৌঁছাবেনা। ইভাদের বাড়ির গেস্টরুমের পাশে ছোট্ট একটা রুম। সেখানে কেউ থাকেওনা। বদ্ধ ঘরটাতে কেমন গুমোট গন্ধ। ইশতিয়াক রুহিকে টেনে এই ঘরে নিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো।
রুহি কাকুতিমিনতি করার চেষ্টা করে বলল,
‘ ইশতিয়াক ভাই আমাকে যেতে দিন।’
‘ অন্যদিন হলে দিতাম। কিন্তু তোমাকে আজ যা মোহনীয় লাগছে, ছাড়া সম্ভব নয়।’
‘ আমি কিন্তু চিৎকার করবো।’
‘ কেউ শুনতে পাবেনা।’
‘ আপনি কিন্তু এখান থেকে পালাতে পারবেন না। আমি সবাইকে সব বলে দেবো।’
‘ নো প্রবলেম। সবাই আসুক, দেখুক। তবুও আজ তোমায় ছাড়ছিনা সুন্দরী!’
বলেই রুহির হাতের পিঠে তপ্ত চুমু খেলো ইশতিয়াক। রুহি কেঁদে দিলো। লোকটাকে সরানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছেনা। রুহির গলায় ঠোঁট বসালো ইশতিয়াক। সব বুঝি শেষ হয়ে গেলো। অপমানের হাত থেকে কেউ আর বাঁচাতে পারলোনা রুহি নামক অভাগী মেয়েটাকে।
এই গল্পটা অনেক অগোছালো হচ্ছে বুঝতে পারছিনা। কেমন একটা খাপছাড়া লাগছে। আপনারা গঠনমূলক মন্তব্য করবেন দয়া করে। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।
চলবে…ইনশাআল্লাহ!